দুই দল কী শিক্ষা নিল?

থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘিরে বিক্ষোভকারীদের
প্রাচীর তৈরির চেষ্টার ছবি ছেপেছে দি ইকোনমিস্ট
নির্বাচনের পর দুই মাস চলে গেছে। অনেকের আশঙ্কা ছিল হরতাল ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশ অচল হয়ে পড়বে। ভাগ্য ভালো যে ভয়ংকর কিছু ঘটেনি। হরতাল নেই, ভাঙচুর নেই, অনিশ্চয়তা অনেক কম। কিন্তু এটা কত দিন থাকবে? মানুষ শান্তিতে থাকতে চাইলেই তো হয় না। দেশের দুই প্রধান দল ও জোট যদি কোনো সমঝোতায় না আসে, তাহলে আবার রাজনৈতিক হানাহানি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। ইতিমধ্যেই তার লক্ষণগুলো দেখা দিতে শুরু করেছে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অতি দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি আবার আন্দোলন শুরু করতে যাচ্ছে। সরকার ‘স্বেচ্ছায় বিদায়’ না নিলে আন্দোলন শুরুর কথা তারা বলছে। তাদের আন্দোলন এবার সফল হবে বলে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আশা করছেন। ১ মার্চ রাজবাড়ীর জনসভায় তাঁর ভাষণের মর্মার্থ এটাই। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বিএনপির মনমেজাজে পরিবর্তন নেই। গত নির্বাচনের আগে যে রকম ছিল এখনো তা-ই। বিএনপির শর্তে নির্বাচন দিতে হবে, না হলে ‘হঠাও’ আন্দোলন চলবে।
এই হলো তাদের কথা। তাহলে কি আবার সেই আগের মতোই পুলিশ খুন, ককটেল, পেট্রলবোমা, গাড়ির চালক-যাত্রী হত্যা, আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারার মতো নৃশংস ঘটনাগুলো ঘটতে থাকবে? বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের কথা শুনলে সবচেয়ে প্রথম এই শঙ্কাই মনে জাগে। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগের রাজনীতিও চলছে সেই পুরোনো চালেই। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৯-দলীয় জোটকে বাইরে রেখে একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করে অনেক প্রশ্নের মুখে পড়লেও এবং নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও আওয়ামী লীগ নির্বিকার। তাদের মধ্যে ভাবান্তর নেই। তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের ঢাক পিটিয়ে চলেছে। দলীয় নেতাদের বক্তৃতা শুনলে মনে হয় না তাঁরা বাস্তবতার ধারেকাছে আছে। অথচ নির্বাচনে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল না। মানুষ রাস্তায় নামেনি ঠিকই, কিন্তু রাজনৈতিক অচলাবস্থা চলতে থাকলে হয়তো মানুষের ধৈর্য ধরে রাখা কঠিন হবে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ কতটা সচেতন? একতরফা নির্বাচন যে মানুষ গ্রহণ করছে না, এটা তারা মানতে নারাজ। স্রোতের বিপরীতে নৌকা বেয়ে তারা কত দূর যেতে পারবে? পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক মোড় নিতে চলেছে। বিএনপির আন্দোলনের কথা শুনে আওয়ামী লীগের নেতারা অরাজনৈতিক ভাষায় বক্তৃতা দিতে শুরু করেছেন। তাঁরা বলছেন, বিএনপির আন্দোলনে যারা নাশকতা করবে,
তাদের ‘হাত-পা কেটে দেওয়া হবে’! ২ মার্চ তেজগাঁও ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের এই ভাষণ শুনলে যেকোনো শান্তিপ্রিয় নাগরিক শিউরে উঠবেন। কোনো দায়িত্বশীল নেতা এ রকম উসকানিমূলক বক্তব্য দিতে পারেন, ভাবতে অবাক লাগে। মূল কথা হলো, বিএনপি বা আওয়ামী লীগের কেউ তাদের নিজেদের অনমনীয় অবস্থান থেকে সরে আসতে রাজি না। অথচ বিগত নির্বাচন থেকে দুই দলেরই অভিজ্ঞতা গ্রহণের অনেক কিছু আছে। যদি তারা প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে দলীয়ভাবে তাদের অনেক বড় সংকটে পড়তে হতে পারে। দেশের জন্যও সেটা কল্যাণকর হবে না। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলগুলো শুধু অন্ধভাবে একই কৌশল নিয়ে চলে না। আন্দোলন-নির্বাচনের বিভিন্ন পর্যায়ে কৌশল পরিবর্তন করে। উদাহরণ হিসেবে আমরা নিকটবর্তী দেশ থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণে রাখতে পারি। সেখানেও সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রার পদত্যাগ ও একটি অনির্বাচিত কাউন্সিলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে জানুয়ারি মাস থেকে বিক্ষোভ-আন্দোলন করে আসছিল। কিন্তু ২ ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচন তারা ঠেকাতে পারেনি, যদিও দেশের বেশ কিছু এলাকায় ভোট গ্রহণ বন্ধ রাখতে হয়েছিল। সেখানে পরে নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনের পরেও তারা কিছুদিন ব্যাংককের কয়েকটি সড়ক সংযোগ অবরোধ করে রাখে।
প্রধানমন্ত্রী ইংলাকের কার্যালয়ের গেটের বাইরে ইট-পাথর-সিমেন্ট দিয়ে প্রাচীর তোলার চেষ্টা করে। দেশ-বিদেশের পত্রিকায় এসব ছবি ছাপাও হয়েছে (দেখুন, দি ইকোনমিস্ট, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪)। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিরোধী আন্দোলনকারীরা রণে ভঙ্গ দিয়েছে। তাদের আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়ছিল। এ অবস্থায় গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে আন্দোলনকারীদের প্রধান নেতা ব্যাংককের সড়ক অবরোধ তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন। তাঁদের দীর্ঘ অবরোধে জনসাধারণের অসুবিধা সৃষ্টির জন্য তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আন্দোলনকারীরা নতুন কর্মকৌশল গ্রহণের মাধ্যমে সরকার অকার্যকর করার কথা বলেন। এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে কাজ করেছে একটি ঘটনা। ২৪ ফেব্রুয়ারি থাইল্যান্ডের সেনাপ্রধান এক বিরল ভাষণে জানিয়ে দেন যে এই প্রতিবাদ আন্দোলনের প্রতি তাঁর কোনো সমর্থন নেই। শুধু তা-ই নয়, দেশের সংবিধানের প্রতি অনুগত থাকার ওপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব দেন (দেখুন, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, ১ মার্চ, ২০১৪)। অবশ্য ব্যাংককের বিশ্লেষকেরা মনে করেন, অবরোধ প্রত্যাহার করলেও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শেষ হবে না। থেমে থেমে আন্দোলন চলতেই থাকবে। ব্যাংকক ও বাংলাদেশের রাজনীতিতে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তার পরও কিছু বিষয়ে আমাদের মনোযোগ দিতে পারি। প্রথমত, এত দিন ধরে অবরোধ চলেছে, কিন্তু সে তুলনায় বোমা-গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনা খুবই কম। হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছেন।
এর মূল কারণ হলো, প্রধানমন্ত্রীর অভাবনীয় নির্দেশ। তিনি প্রথম থেকেই বলে আসছেন, পুলিশ বা নিরাপত্তারক্ষীরা বিরোধী আন্দোলন দমনে বল প্রয়োগ করবে না। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ অন্য কিছু সরকারি দপ্তর অবরুদ্ধ হয়ে পড়লে তাঁর নিজের এবং সরকারি অন্য দপ্তরগুলো সরিয়ে নেন। দূর থেকে সরকারের জরুরি কাজগুলো সেরে নেন। এমনকি প্রতিবাদকারীদের ছত্রভঙ্গ না করার জন্য আদালত রায় দেন। আমাদের দেশে এসব চিন্তাও করা যায় না। অন্যদিকে বিরোধী আন্দোলনের নেতারাও বেশ পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁরা ব্যাংককের প্রধান সড়ক সংযোগস্থলগুলোতে অবরোধ আরোপ করলেও সারা দেশ অচল করার কোনো পদক্ষেপ নেননি। এমনকি ব্যাংককের কেন্দ্রস্থলে অবরোধ থাকলেও বিকল্প সড়কগুলো খোলা রাখার ব্যবস্থা করেছেন। সেখানে হরতাল-অবরোধ ডাকার পরপরই, কর্মসূচি শুরুর আগেই, বোমাবাজি করে আতঙ্ক সৃষ্টির কোনো অপচেষ্টা ছিল না। ব্যাংককের আন্দোলন থেকে এসব অভিজ্ঞতা আমরা গ্রহণ করতে পারি। আসল কথা হলো, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে না পারলে অচলাবস্থা দূর হবে না। বিএনপি যদি মনে করে তাদের পুরোনো দাবি, অর্থাৎ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে যাবে এবং এর মাধ্যমেই সরকার অপসারণ করে তারা ক্ষমতায় বসতে পারবে, তাহলে হয়তো দেশে এক দীর্ঘস্থায়ী অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে। আর তা ছাড়া, এই দাবি যদি আদায়যোগ্যই হবে, তাহলে কেন তারা কয়েক মাস ধরে হরতাল-অবরোধ দিয়েও পারল না?
এ দিকটি তাদের বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগকেও কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। একতরফা নির্বাচনে অর্জিত ক্ষমতা কত দিন ধরে রাখা যায়, সেটি অনুমান করা কি কঠিন? দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগও যদি ভাবে, তারা নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রশ্নে কোনো সমঝোতায় যাবে না, তাহলে তাদের পক্ষে দেশ চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। পদে পদে বিরোধিতা নিয়ে দেশ চলে না। বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। এত কিছুর পরও অর্থনীতি ভেঙে পড়েনি। যদিও সংকট আছে এবং বেশ কিছুদিন এর রেশ চলবে। তার পরও বাস্তবতা হলো, উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিএনপি ও তাদের জোটের সমর্থনপুষ্ট প্রার্থীরা জিতছেন। সরকারকে অবৈধ মনে করলেও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা এই সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন করছেন। এখান থেকেই আমাদের রাজনীতির হারানো সূত্র খুঁজে নিতে হবে। উপজেলা নির্বাচনের পর সরকার পতনের আন্দোলন না, বরং কীভাবে সমঝোতায় পৌঁছানো যায়, সেটাই হতে হবে বিএনপির মূল উদ্যোগ। আর সরকারকে দেখতে হবে, দলীয় নেতাদের হঠকারী বক্তৃতায় যেন সমঝোতার পথ বন্ধ হয়ে না যায়। দেশবাসী যে হরতাল-অবরোধ-প্রাণহানি আর চায় না, এই বাস্তবতা অস্বীকার করে চলার চেষ্টা করলে সরকার ও বিরোধী দল উভয় পক্ষকেই মাশুল গুনতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.