সৈয়দ আশরাফের সাফাই! by সোহরাব হাসান
স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের
সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দলের কাজকর্ম নিয়মিত দেখভাল করেন, এ
দাবি তাঁর অতি সুহূদও করবেন না। বরং দল ও সরকার সম্পর্কে তাঁর একধরনের
উদাসীনতা লক্ষ করা যায়। এ নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের ক্ষোভ আছে। আবার তাঁর
ঘনিষ্ঠজনেরা মনে করেন, তেমন সক্রিয় নন বলেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক
পদে তিনি বহাল আছেন।
সক্রিয় থাকলে এই পদে থাকতে পারতেন না।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দলের নজরদারি না করলেও হঠাৎ হঠাৎ চমকে দেওয়া কথা বলেন।
সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ওপর ক্ষোভ ঝাড়েন। আবার সেসব কথা ফিরিয়ে নিতেও
দেরি লাগে না। এসব কি তিনি মন থেকে বলেন, না কাউকে খুশি করতে?
গত সোমবার দলের মহানগর আওয়ামী লীগের দুটি থানা শাখার সম্মেলনে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে নির্দলীয় বৃত্ত থেকে দলীয় বৃত্তে নিয়ে আসার কথা বললেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এ ব্যাপারে আইন পরিবর্তনেরও ইঙ্গিত দিলেন। কিন্তু পরদিনই সংসদে প্রশ্নোত্তরে তিনি জানালেন, স্থানীয় সরকার আইন পরিবর্তনের কোনো পরিকল্পনা আপাতত সরকারের নেই। জনগণ তাঁর কোন কথাটি বিশ্বাস করবে?
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রশ্ন তুলেছেন যে দেশে সংসদীয় আইন ও স্থানীয় সরকার আইন নামে আলাদা দুটি আইন থাকতে পারে না। একই আইনের কাঠামোয় আনতে হবে। খুবই ন্যায্য কথা। কিন্তু দুই দশকের বেশি সময় ধরে দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা চালু থাকলেও কেন্দ্রীয় শাসনটি কোন আইনে চলছে, সেটা পরিষ্কার নয়। অন্যান্য দেশে সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান সমমর্যাদাধারীদের মধ্যে প্রথম (ফার্স্ট অ্যামং ইকোয়াল) হলেও বাংলাদেশে ব্যতিক্রম। তিনি সবার ওপরে এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। স্থানীয় সরকারেও সেই রীতি চলে আসছে। কেন্দ্রীয় সরকারকাঠামোটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক রেখে স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় গণতন্ত্রায়ণ সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যদি আইনের সংস্কারই করতে চান, তাহলে সেটি শুরু করতে হবে ওপর থেকেই।
দ্বিতীয়ত, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম উপজেলা নির্বাচনের ফলাফলে দলীয় ভিত্তিতে প্রকাশ করার সংবাদপত্রগুলোকে একহাত নিয়েছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘তারা কীভাবে জানল যে উনি আওয়ামী লীগের, না বিএনপির? মনোনয়নপত্রে কারও কি কোনো দলীয় মার্কা লেখা আছে?’ স্বীকার করি, লেখা নেই।
কিন্তু ২০০৯ সালে একই পদ্ধতিতে পত্রিকাগুলো উপজেলা নির্বাচনের ফল প্রকাশ করার পর কিন্তু আওয়ামী লীগের সব নেতা আহ্লাদিত হয়েছিলেন। কেননা তখন ফলাফলটি তাঁদের পক্ষে ছিল। পত্রিকার খবর নিজের পক্ষে গেলে জয়ধ্বনি এবং বিপক্ষে গেলে নিন্দামন্দ। এটা অসহিষ্ণু রাজনীতিরই বহিঃপ্রকাশ।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণকে সন্দেহজনক বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর প্রশ্ন, বিএনপি স্থানীয় নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচনে বিশ্বাস করলে ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এসে উপজেলা আইনটি কেন বাতিল করেছিল? এ কথা ঠিক যে ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার অন্যায়ভাবে আইনটি বাতিল করেছিল। আর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আইন পাস করেও পাঁচ বছর উপজেলা নির্বাচন ঠেকিয়ে রেখেছিল। দুইয়ের ফলাফল একই। এমনকি নির্বাচনের পরও আওয়ামী লীগ আমলে উপজেলা পরিষদগুলো ঠুঁটো জগন্নাথ করে রাখা হয়েছে। এ নিয়ে রাস্তায় উপজেলা চেয়ারম্যানরা আন্দোলন-সংগ্রামও কম করেননি। শেষ পর্যন্ত তাঁদের দামি গাড়ি ও অফিস দিয়েই সন্তুষ্ট রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন না হলেও ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিশেষ লাভবান হয়েছে।
একসময় বিএনপি উপজেলা পরিষদের বিরোধিতা করেছিল বলে এখন নির্বাচনে আসতে পারবে না, এটি যুক্তির কথা নয়। বরং তারা যদি অতীতের ভুল বুঝতে পেরে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে থাকে, আওয়ামী লীগের উচিত ছিল তাকে স্বাগত জানানো। কিন্তু আওয়ামী লীগের উদার সাধারণ সম্পাদক কেন এ ক্ষেত্রে অনুদারতার পরিচয় দিলেন, তা বোধগম্য নয়।
তবে থানা সম্মেলনে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সবচেয়ে উদ্বেগজনক যে কথা বলেছেন তা হলো, নির্বাচন কমিশনে প্রার্থীদের হলফনামা দেওয়ার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলা। তিনি বলেছেন, ‘এই হলফনামা এখন রাজনীতিকদের চরিত্রহনননামায় পরিণত হয়েছে। ইনকাম ট্যাক্সে তো আমাদের সবকিছু আছে, রাজনীতিকেরা যদি দুর্নীতি করেন, তারাই ধরতে পারেন। নির্বাচন কমিশনে হলফনামা দিতে হবে আবার ইনকাম ট্যাক্সে হিসাব দিতে হবে, এক দেশে দুই নীতি থাকতে পারে না।’ (প্রথম আলো, ৪ মার্চ ২০১৪)
যেহেতু সংসদে কার্যত বিরোধী দল নেই এবং আওয়ামী লীগের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে, সেহেতু যেকোনো আইন বাতিল, সংশোধন, পরিমার্জনের এখতিয়ার তাদের আছে। প্রশ্ন হলো, সেই সংশোধন-পরিমার্জন কি জনগণের কল্যাণে হবে, না কতিপয় দুর্নীতিবাজের স্বার্থে? সৈয়দ আশরাফুল ইসলামসহ দলের অনেকে হলফনামায় সম্পদের যে হিসাব দিয়েছেন, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি; পত্রপত্রিকায় সমালোচনাও হয়নি। বরং তাঁর আয় না বাড়া এবং ধার-কর্জ করে চলার বিষয়টি মানুষ প্রশংসার দৃষ্টিতেই দেখেছেন। প্রশ্ন উঠেছে তাঁদের সম্পর্কে যাঁরা গত পাঁচ বছরে মন্ত্রী ও সাংসদ পদটি ব্যবহার করে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন; ব্যাংক-বিমা-বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি জমি হাতিয়ে নিয়েছেন।
এই জনপ্রতিনিধিদের সম্পদ কীভাবে বাড়ল, কীভাবে তাঁরা লাখপতি থেকে কোটিপতি হলেন, সেই প্রশ্ন করার অধিকার নিশ্চয়ই জনগণের আছে। ধার-কর্জে চলা সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম কেন দুর্নীতিবাজদের পক্ষ নিলেন, আমরা বুঝতে অপারগ। তিনি যদি এ ব্যাপারে গণমাধ্যম এবং এই উত্তম আইনের প্রতি উষ্মা প্রকাশ না করে দলের যেসব নেতা অন্যায় ও অবৈধভাবে সহায়-সম্পত্তি অর্জন করেছেন, তাঁদের কাছে কৈফিয়ত চাইতেন, তাহলে দেশবাসী আশ্বস্ত হতে পারতেন। তাঁর ভাষায়, রাজনীতিকদের চরিত্রহননের প্রতিষেধক হলফনামা বন্ধ করা নয়, বরং হলফনামা ধরে ধরে যাঁরা অবৈধ উপায়ে সম্পদ আহরণ করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া। তাঁদের দল থেকে বের করে দেওয়া।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামার এখতিয়ার নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছেন, তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। তিনি দীর্ঘদিন যুক্তরাজ্যে ছিলেন, সেখানে মন্ত্রী-সাংসদেরা স্বেচ্ছায় সম্পদের হিসাব দেন। কারও কাছ থেকে কোনো উপহার, চাঁদা বা বিশেষ সুবিধা নিয়েথাকলে সেটাও প্রকাশ করতে হয়। প্রতিবেশী ভারতেও জনপ্রতিনিধিদের সম্পদ ও আয়-ব্যয়ের হিসাব দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে।
তাঁর মনে থাকার কথা, দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং আইনি লড়াইয়ের পরই বাংলাদেশের জনগণ যাঁদের তাঁর নির্বাচিত করবেন, তাঁদের সম্পদের হিসাবসহ আটটি তথ্য জানার অধিকার ফিরে পেয়েছেন। ঘটনাটি বিএনপি আমলে ঘটেছিল বলে আওয়ামী লীগ সমর্থন জানিয়েছিল। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সেই অধিকার কেড়ে নিতে চায়। বড় বিস্ময়কর ক্ষমতার রাজনীতি।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ২০০৫ সালের ২৪ মে আবদুল মোমেন চৌধুরী ও অন্যান্য বনাম বাংলাদেশ (২০০৫ সালে পিটিশন নম্বর ৫৭) মামলার রায়ে নির্বাচন কমিশনকে জাতীয় সংসদে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব প্রার্থী থেকে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে আট ধরনের তথ্য হলফনামা আকারে সংগ্রহ এবং এগুলো গণমাধ্যমের সহায়তায় জনগণের মধ্যে বিতরণ করার নির্দেশ দেন। এ তথ্যগুলো হলো: ১. সার্টিফিকেটসহ প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, ২. বর্তমানে তাঁদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার তালিকা, ৩. অতীতের ফৌজদারি মামলার তালিকা ও ফলাফল, ৪. প্রার্থীর পেশা, ৫. প্রার্থীর আয়ের উৎস ও উৎসসমূহ, ৬. অতীতে সাংসদ থাকলে জনগণের প্রতি প্রতিশ্রুতি পূরণে তাঁর ভূমিকা, ৭. প্রার্থী ও প্রার্থীর ওপর নির্ভরশীলদের সম্পদ এবং দায়দেনার বর্ণনা এবং ৮. ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তিগতভাবে বা যৌথভাবে এবং কোম্পানি কর্তৃক—যে কোম্পানিতে প্রার্থী চেয়ারম্যান, নির্বাহী পরিচালক কিংবা পরিচালক গৃহীত ঋণের পরিমাণ ও বর্ণনা।
এই রায় ঘোষণার পর আবু সাফা নামের এক ব্যক্তির পক্ষে আপিল আবেদন করার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল, তার দুই দিন আগে তৎকালীন চেম্বার জজ বিচারপতি মোহাম্মদ জয়নুল আবেদিনের শরণাপন্ন হলে তিনি স্থগিতাদেশ দেন। পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয় যে আবু সাফার সেই রিট আবেদনটি ছিল ভুয়া। ফলে হাইকোর্টের রায়ই বহাল থাকে। বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন এবং গণমাধ্যমও এর পক্ষে জনমত গড়ে তোলে।
হাইকোর্টের রায়ের পর ২০০৫ সালের ১৫ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী আইন সংস্কারের যে রূপরেখা পেশ করেছিলেন, তাতে নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ করা, পেশিশক্তির প্রভাব ও দুর্বৃত্তমুক্ত করার পাশাপাশি প্রার্থীদের সম্পদ ও পরিচয় প্রকাশের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছিল।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে, তাতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদ ও আয়-ব্যয়ের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করার কথা বলা হয়েছিল।
এখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেই অঙ্গীকার থেকে কেন সরে আসতে চাইছেন? কেনই বা আন্দোলন সংগ্রাম ও আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে পাওয়া জনগণের অধিকারকে কেড়ে নিতে চাইছেন।
তবে এ প্রসঙ্গে তাঁকে একটি কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে দেশের সর্বোচ্চ আদালত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অধিকতর জবাবদিহিমূলক করতে যে রায় দিয়েছেন, জাতীয় সংসদে তার বিপরীত কোনো আইন পাস করলে সেটি না-ও টিকতে পারে। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী, সপ্তম সংশোধনী, ত্রয়োদশ সংশোধনী এবং ২০১৩ সালে দুদক আইনে সরকারি কর্মকর্তাদের রেয়াত দেওয়ার বিধানটিও জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হয়েছিল। কিন্তু আদালতের রায়ে কোনোটিই টেকেনি। আদালতই ক্ষমতাহীন মানুষের শেষ ভরসা।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
গত সোমবার দলের মহানগর আওয়ামী লীগের দুটি থানা শাখার সম্মেলনে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে নির্দলীয় বৃত্ত থেকে দলীয় বৃত্তে নিয়ে আসার কথা বললেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এ ব্যাপারে আইন পরিবর্তনেরও ইঙ্গিত দিলেন। কিন্তু পরদিনই সংসদে প্রশ্নোত্তরে তিনি জানালেন, স্থানীয় সরকার আইন পরিবর্তনের কোনো পরিকল্পনা আপাতত সরকারের নেই। জনগণ তাঁর কোন কথাটি বিশ্বাস করবে?
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রশ্ন তুলেছেন যে দেশে সংসদীয় আইন ও স্থানীয় সরকার আইন নামে আলাদা দুটি আইন থাকতে পারে না। একই আইনের কাঠামোয় আনতে হবে। খুবই ন্যায্য কথা। কিন্তু দুই দশকের বেশি সময় ধরে দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা চালু থাকলেও কেন্দ্রীয় শাসনটি কোন আইনে চলছে, সেটা পরিষ্কার নয়। অন্যান্য দেশে সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান সমমর্যাদাধারীদের মধ্যে প্রথম (ফার্স্ট অ্যামং ইকোয়াল) হলেও বাংলাদেশে ব্যতিক্রম। তিনি সবার ওপরে এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। স্থানীয় সরকারেও সেই রীতি চলে আসছে। কেন্দ্রীয় সরকারকাঠামোটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক রেখে স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় গণতন্ত্রায়ণ সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যদি আইনের সংস্কারই করতে চান, তাহলে সেটি শুরু করতে হবে ওপর থেকেই।
দ্বিতীয়ত, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম উপজেলা নির্বাচনের ফলাফলে দলীয় ভিত্তিতে প্রকাশ করার সংবাদপত্রগুলোকে একহাত নিয়েছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘তারা কীভাবে জানল যে উনি আওয়ামী লীগের, না বিএনপির? মনোনয়নপত্রে কারও কি কোনো দলীয় মার্কা লেখা আছে?’ স্বীকার করি, লেখা নেই।
কিন্তু ২০০৯ সালে একই পদ্ধতিতে পত্রিকাগুলো উপজেলা নির্বাচনের ফল প্রকাশ করার পর কিন্তু আওয়ামী লীগের সব নেতা আহ্লাদিত হয়েছিলেন। কেননা তখন ফলাফলটি তাঁদের পক্ষে ছিল। পত্রিকার খবর নিজের পক্ষে গেলে জয়ধ্বনি এবং বিপক্ষে গেলে নিন্দামন্দ। এটা অসহিষ্ণু রাজনীতিরই বহিঃপ্রকাশ।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণকে সন্দেহজনক বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর প্রশ্ন, বিএনপি স্থানীয় নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচনে বিশ্বাস করলে ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এসে উপজেলা আইনটি কেন বাতিল করেছিল? এ কথা ঠিক যে ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার অন্যায়ভাবে আইনটি বাতিল করেছিল। আর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আইন পাস করেও পাঁচ বছর উপজেলা নির্বাচন ঠেকিয়ে রেখেছিল। দুইয়ের ফলাফল একই। এমনকি নির্বাচনের পরও আওয়ামী লীগ আমলে উপজেলা পরিষদগুলো ঠুঁটো জগন্নাথ করে রাখা হয়েছে। এ নিয়ে রাস্তায় উপজেলা চেয়ারম্যানরা আন্দোলন-সংগ্রামও কম করেননি। শেষ পর্যন্ত তাঁদের দামি গাড়ি ও অফিস দিয়েই সন্তুষ্ট রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন না হলেও ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিশেষ লাভবান হয়েছে।
একসময় বিএনপি উপজেলা পরিষদের বিরোধিতা করেছিল বলে এখন নির্বাচনে আসতে পারবে না, এটি যুক্তির কথা নয়। বরং তারা যদি অতীতের ভুল বুঝতে পেরে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে থাকে, আওয়ামী লীগের উচিত ছিল তাকে স্বাগত জানানো। কিন্তু আওয়ামী লীগের উদার সাধারণ সম্পাদক কেন এ ক্ষেত্রে অনুদারতার পরিচয় দিলেন, তা বোধগম্য নয়।
তবে থানা সম্মেলনে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সবচেয়ে উদ্বেগজনক যে কথা বলেছেন তা হলো, নির্বাচন কমিশনে প্রার্থীদের হলফনামা দেওয়ার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলা। তিনি বলেছেন, ‘এই হলফনামা এখন রাজনীতিকদের চরিত্রহনননামায় পরিণত হয়েছে। ইনকাম ট্যাক্সে তো আমাদের সবকিছু আছে, রাজনীতিকেরা যদি দুর্নীতি করেন, তারাই ধরতে পারেন। নির্বাচন কমিশনে হলফনামা দিতে হবে আবার ইনকাম ট্যাক্সে হিসাব দিতে হবে, এক দেশে দুই নীতি থাকতে পারে না।’ (প্রথম আলো, ৪ মার্চ ২০১৪)
যেহেতু সংসদে কার্যত বিরোধী দল নেই এবং আওয়ামী লীগের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে, সেহেতু যেকোনো আইন বাতিল, সংশোধন, পরিমার্জনের এখতিয়ার তাদের আছে। প্রশ্ন হলো, সেই সংশোধন-পরিমার্জন কি জনগণের কল্যাণে হবে, না কতিপয় দুর্নীতিবাজের স্বার্থে? সৈয়দ আশরাফুল ইসলামসহ দলের অনেকে হলফনামায় সম্পদের যে হিসাব দিয়েছেন, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি; পত্রপত্রিকায় সমালোচনাও হয়নি। বরং তাঁর আয় না বাড়া এবং ধার-কর্জ করে চলার বিষয়টি মানুষ প্রশংসার দৃষ্টিতেই দেখেছেন। প্রশ্ন উঠেছে তাঁদের সম্পর্কে যাঁরা গত পাঁচ বছরে মন্ত্রী ও সাংসদ পদটি ব্যবহার করে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন; ব্যাংক-বিমা-বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি জমি হাতিয়ে নিয়েছেন।
এই জনপ্রতিনিধিদের সম্পদ কীভাবে বাড়ল, কীভাবে তাঁরা লাখপতি থেকে কোটিপতি হলেন, সেই প্রশ্ন করার অধিকার নিশ্চয়ই জনগণের আছে। ধার-কর্জে চলা সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম কেন দুর্নীতিবাজদের পক্ষ নিলেন, আমরা বুঝতে অপারগ। তিনি যদি এ ব্যাপারে গণমাধ্যম এবং এই উত্তম আইনের প্রতি উষ্মা প্রকাশ না করে দলের যেসব নেতা অন্যায় ও অবৈধভাবে সহায়-সম্পত্তি অর্জন করেছেন, তাঁদের কাছে কৈফিয়ত চাইতেন, তাহলে দেশবাসী আশ্বস্ত হতে পারতেন। তাঁর ভাষায়, রাজনীতিকদের চরিত্রহননের প্রতিষেধক হলফনামা বন্ধ করা নয়, বরং হলফনামা ধরে ধরে যাঁরা অবৈধ উপায়ে সম্পদ আহরণ করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া। তাঁদের দল থেকে বের করে দেওয়া।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামার এখতিয়ার নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছেন, তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। তিনি দীর্ঘদিন যুক্তরাজ্যে ছিলেন, সেখানে মন্ত্রী-সাংসদেরা স্বেচ্ছায় সম্পদের হিসাব দেন। কারও কাছ থেকে কোনো উপহার, চাঁদা বা বিশেষ সুবিধা নিয়েথাকলে সেটাও প্রকাশ করতে হয়। প্রতিবেশী ভারতেও জনপ্রতিনিধিদের সম্পদ ও আয়-ব্যয়ের হিসাব দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে।
তাঁর মনে থাকার কথা, দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং আইনি লড়াইয়ের পরই বাংলাদেশের জনগণ যাঁদের তাঁর নির্বাচিত করবেন, তাঁদের সম্পদের হিসাবসহ আটটি তথ্য জানার অধিকার ফিরে পেয়েছেন। ঘটনাটি বিএনপি আমলে ঘটেছিল বলে আওয়ামী লীগ সমর্থন জানিয়েছিল। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সেই অধিকার কেড়ে নিতে চায়। বড় বিস্ময়কর ক্ষমতার রাজনীতি।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ২০০৫ সালের ২৪ মে আবদুল মোমেন চৌধুরী ও অন্যান্য বনাম বাংলাদেশ (২০০৫ সালে পিটিশন নম্বর ৫৭) মামলার রায়ে নির্বাচন কমিশনকে জাতীয় সংসদে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব প্রার্থী থেকে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে আট ধরনের তথ্য হলফনামা আকারে সংগ্রহ এবং এগুলো গণমাধ্যমের সহায়তায় জনগণের মধ্যে বিতরণ করার নির্দেশ দেন। এ তথ্যগুলো হলো: ১. সার্টিফিকেটসহ প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, ২. বর্তমানে তাঁদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার তালিকা, ৩. অতীতের ফৌজদারি মামলার তালিকা ও ফলাফল, ৪. প্রার্থীর পেশা, ৫. প্রার্থীর আয়ের উৎস ও উৎসসমূহ, ৬. অতীতে সাংসদ থাকলে জনগণের প্রতি প্রতিশ্রুতি পূরণে তাঁর ভূমিকা, ৭. প্রার্থী ও প্রার্থীর ওপর নির্ভরশীলদের সম্পদ এবং দায়দেনার বর্ণনা এবং ৮. ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তিগতভাবে বা যৌথভাবে এবং কোম্পানি কর্তৃক—যে কোম্পানিতে প্রার্থী চেয়ারম্যান, নির্বাহী পরিচালক কিংবা পরিচালক গৃহীত ঋণের পরিমাণ ও বর্ণনা।
এই রায় ঘোষণার পর আবু সাফা নামের এক ব্যক্তির পক্ষে আপিল আবেদন করার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল, তার দুই দিন আগে তৎকালীন চেম্বার জজ বিচারপতি মোহাম্মদ জয়নুল আবেদিনের শরণাপন্ন হলে তিনি স্থগিতাদেশ দেন। পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয় যে আবু সাফার সেই রিট আবেদনটি ছিল ভুয়া। ফলে হাইকোর্টের রায়ই বহাল থাকে। বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন এবং গণমাধ্যমও এর পক্ষে জনমত গড়ে তোলে।
হাইকোর্টের রায়ের পর ২০০৫ সালের ১৫ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী আইন সংস্কারের যে রূপরেখা পেশ করেছিলেন, তাতে নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ করা, পেশিশক্তির প্রভাব ও দুর্বৃত্তমুক্ত করার পাশাপাশি প্রার্থীদের সম্পদ ও পরিচয় প্রকাশের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছিল।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে, তাতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদ ও আয়-ব্যয়ের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করার কথা বলা হয়েছিল।
এখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেই অঙ্গীকার থেকে কেন সরে আসতে চাইছেন? কেনই বা আন্দোলন সংগ্রাম ও আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে পাওয়া জনগণের অধিকারকে কেড়ে নিতে চাইছেন।
তবে এ প্রসঙ্গে তাঁকে একটি কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে দেশের সর্বোচ্চ আদালত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অধিকতর জবাবদিহিমূলক করতে যে রায় দিয়েছেন, জাতীয় সংসদে তার বিপরীত কোনো আইন পাস করলে সেটি না-ও টিকতে পারে। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী, সপ্তম সংশোধনী, ত্রয়োদশ সংশোধনী এবং ২০১৩ সালে দুদক আইনে সরকারি কর্মকর্তাদের রেয়াত দেওয়ার বিধানটিও জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হয়েছিল। কিন্তু আদালতের রায়ে কোনোটিই টেকেনি। আদালতই ক্ষমতাহীন মানুষের শেষ ভরসা।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments