শিল্পকর্মে ইস্ট ও ওয়েস্টের সার্থক ব্লেন্ডার মুর্তজা বশীর
বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর [জন্ম
১৯৩২] পেইন্টিং, ম্যুরাল, ছাপচিত্রসহ চিত্রকলার নানা ফর্মে কাজ করেছেন।
লিখেছেন গল্প, কবিতা, উপন্যাস।
নিজের লেখা কবিতার বই
'টাটকা রক্তের ক্ষীণরেখা' ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ২০১০-এ। ছোটগল্প 'কাঁচের
পাখির গান' [১৯৬৯], উপন্যাস 'আলট্রামেরিন' [১৯৭৯], কবিতা 'ত্রসরেণু'
[১৯৭৬], 'তোমাকেই শুধু' [১৯৭৯], 'এসো ফিরে অনসূয়া' [১৯৮৫], বিবিধ বিষয়
নির্বাচিত লেখা 'মুর্তজা বশীর : মূর্ত ও বিমূর্ত' [২০০১], গবেষণাগ্রন্থ
'মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ' [২০০৪],
উপন্যাস 'মিতার সঙ্গে চার সন্ধ্যে, অমিতাক্ষর' [২০০৮] এবং 'গল্পসমগ্র'
[২০০৮] প্রকাশিত হয়েছে। উর্দু চলচ্চিত্র 'কারোয়ার' চিত্রনাট্য লিখেছেন।
হুমায়ুন কবীরের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সাদেক খান পরিচালিত চলচ্চিত্র
'নদী ও নারী'র চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক ও প্রধান সহকারী পরিচালক
ছিলেন। আলোকচিত্র, ডাকটিকিট, অটোগ্রাফ সংগ্রহ তার নেশা। তার একক
চিত্রপ্রদর্শনীর সংখ্যা ২০টি। তার ম্যুরালচিত্র সাতটি।১৯৭৩-১৯৯৮ সাল
পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে অধ্যাপনা শেষে ২০০৩ সাল
থেকে স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস করছেন। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- শেখ মেহেদী হাসান
ছেলেবেলার কোনো স্মৃতি আজও আপনাকে আলোড়িত করে।
আমি তখন বগুড়া করনেশন ইনস্টিটিউশনে পড়তাম। একদিন সকালে আমার এক সহপাঠীর বাড়ি গেলাম দেখা করতে। দেখি, গামছা কাঁধে বের হচ্ছে। ওকে প্রশ্ন করলাম, কিরে, কোথায় যাস? সে বলল আধা ঘণ্টা অপেক্ষা কর, আমি নদীতে ডুব দিয়ে আসি। আমি আধা ঘণ্টা ঘুরে এসে দেখি, ওদের উঠানে অনেক মানুষ। ভিড় ঠেলে তাকিয়ে দেখি, বন্ধু আমার মাটিতে শুয়ে। কি হলো? শুনলাম, করতোয়া নদীতে ডুবে মারা গেছে। বিরাট একটা ধাক্কা খেলাম। ছোটবেলা থেকে পড়তাম, মানুষ মরণশীল। কিন্তু সেদিন মনে হলো ম্যান ইজ ইমরটাল। মনে পড়ে, সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় বাড়ি থেকে পালিয়ে আমি নারায়ণগঞ্জ চলে গিয়েছিলাম। আবার দশম শ্রেণীতে উঠে লক্ষ্নৌ চলে গেলাম। পরে বাড়ির জন্য মন খারাপ হলো, তাই ফিরে এলাম। আমরা অনেক ভাইবোন। মা সবার জন্য ফিরনি রেঁধে টেবিলে বাটিতে বাটিতে হয়তো রেখেছেন। আমি গুনে দেখি, একটা কম। এটা হয়তো মনস্তাত্তি্বক সমস্যা। কিন্তু আমার মনে হতো কেউ আমাকে চায় না। শৈশব থেকেই আমি একাকিত্ব ভালোবাসি।
ছোটবেলায় আপনি কখনো ভেবেছেন ছবি অাঁকবেন কিংবা চিত্রশিল্পী হবেন?
আমি কখনো ভাবিনি শিল্পী হব। তবে ছবি দেখতে ভালো লাগত। আমার বাবার বিশাল লাইব্রেরিতে 'প্রবাসী', 'বসুমতী', 'বিচিত্রা', 'ভারতবর্ষ', 'মডার্ন রিভিউ', 'এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা'সহ বহু বই ছিল। সেসব পত্রপত্রিকায় ও বইয়ে আমি বিভিন্ন ছবি দেখতাম। আমরা তখন বগুড়ায়, আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। সে সময় পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে আমার একটা যোগসূত্র গড়ে ওঠে। আমি কমিউনিস্ট পার্টির অফিসের জন্য মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্টালিনের পোর্ট্রেট করি ফুলসিট কাগজে। রাস্তায় যারা সাইনবোর্ড করে তাদের কাজ দেখে ওই ছবিগুলো এঁকেছিলাম। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলো, ১ সেপ্টেম্বর কমিউনিস্ট নেতা ভবানী সেন বগুড়ায় এলেন। তিনি পার্টি অফিসের দেয়ালে ওইসব ছবি দেখে কে এঁকেছে জানতে চান। আমাকে পার্টি অফিসে ডেকে আনা হলো, তিনি আমাকে প্রশংসা করলেন। আমার অটোগ্রাফ খাতায় লিখলেন, 'আর্টিস্টের কাজ হলো শোষিত জনগণের ভাব ও দুঃখ-দুর্দশাকে চিত্রের ভেতর দিয়ে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা, যাতে সমাজে সে আর্ট নবজীবন সৃষ্টি করতে পারে।' আমার বয়স তখন ১৫ বছর। সেই কথা আমার মনে এমনভাবে গেঁথে যায় যে, আজও যা সৃষ্টি করেছি তা সেই অঙ্গীকার থেকেই। যার জন্য ছবি অাঁকাটা হয়েছে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই। যেখানে নিজের ভাবাবেগ স্থান পায়নি।
আপনি একসময় বিখ্যাত মানুষের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করতেন।
আমার বাবা ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তখন বগুড়া আযিযুল হক কলেজের অধ্যক্ষ। আমি ভীষণ দুর্বিনীত ছিলাম। বাবার কাছে অভিযোগ আসত। একদিন তিনি আমাকে ডেকে বললেন, 'হয় ফেমাস হও, নয় নটোরিয়াস; মিডিওকার হয়ো না।' আমি যখন ক্লাস টেনের ছাত্র, বাবার রেমিংটন বন্ড কাগজের প্যাডের পাতায় জওহরলাল নেহরুর পোর্ট্রেট এঁকে পাঠিয়েছিলাম। লিখেছিলাম, আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র, আপনার পোর্ট্রেট এঁকে পাঠালাম, বিনিময়ে আপনার স্বাক্ষর চাই। তিনি তার এক ফটোগ্রাফ পাঠালেন, স্বাক্ষরের নিচে তারিখ : সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮। এখনো সেটি আমার সংগ্রহে আছে। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন নিয়ে বই পড়েছি। জেনেছি, সূর্য সেনের সঙ্গী অনন্ত সিংহ ও অম্বিকা চক্রবর্তীর কথা। তাদের স্বাক্ষর, ছবি আমার কাছে আছে। সাইকেলে বিশ্বভ্রমণ করা প্রথম বাঙালি রামনাথ বিশ্বাস কিংবা দার্শনিক সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন, কবি শেখর কালিদাস রায়, শেরে কাশ্মীর শেখ আবদুল্লাহ, এ কে ফজলুল হক অটোগ্রাফ আমাকে বগুড়ায় পাঠিয়েছেন। পরবর্তীকালে ১৯৫৪ সালে মনোজ বসু, কাজী আবদুল ওদুদ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও ইলা মিত্রের অটোগ্রাফ নিয়েছি। যে বয়সে যে মানুষগুলোর কথা আমি পড়েছি, জেনেছি বা সংস্পর্শে এসেছি, সে বয়সে এদের নামও অনেকে জানত না।
আর্ট কলেজে ভর্তি হলেন কেন?
ম্যাট্রিক পাস করে ১৯৪৯ সালে ঢাকায় আসি। পার্টি তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে। পার্টি আমাকে বলল, তোমাকে আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে সাংগঠনিক কাজ করতে হবে। আমার বড় ভাই এ কে এম সফিউল্লাহ কলকাতায় থাকাকালীন জয়নুল আবেদিনের বন্ধু ছিলেন। আমি ভাইয়ের চিঠি নিয়ে আবেদিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি বললেন, ঠিক আছে ভর্তি হবে। অ্যাডমিশন টেস্ট হলো। আমি পাস করলাম। পার্টির নির্দেশে আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হই। তখন আর্ট ইনস্টিটিউটে কিছু সমস্যা ছিল। লাইব্রেরি আছে কিন্তু পর্যাপ্ত বই নেই, আসবাবপত্র নেই, ক্লাসরুমের সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে আমি আন্দোলন শুরু করে দিলাম। একদিন খুব ভোরে ছাত্ররা আসার আগেই দেয়ালে পোস্টার লাগিয়েছি। আবেদিন স্যার আসলেন, তিনি পোস্টার দেখে দারোয়ানকে বললেন, পোস্টার তুলে ফেল। আমি হাত দিয়ে আটকে রাখলাম, বললাম আমি নিজে হাতে ছিঁড়ে ফেলব, আগে ছাত্ররা দেখুক এটা। ছাত্ররা আসল, দেখল, পরে আমি ছিঁড়ে ফেললাম। আবেদিন সাহেব কমিউনিস্ট বিরোধী ছিলেন না, কিন্তু তিনি ভয় পেয়েছিলেন। ছবি অাঁকায় আমার মন নেই। আমার কাজ হলো পার্টির জন্য চাঁদা তোলা, গোপন কর্মীদের জন্য শেল্টার খুঁজে বের করা। তখনো আমি পার্টির সদস্য হইনি। ২০ বছরের আগে কাউকে পার্টির সদস্যপদ দেওয়া হতো না। আমি রাস্তায় মিটিং কিংবা বিভিন্ন স্কুলে ধর্মঘট করছি। এরপর জেলে গেলাম। ১৯৫০ সালে জেল থেকে আসার পর ১৯ বছর বয়সে দলের সদস্য হই।
জেলে গিয়েছিলেন কেন।
১৯৫০ সালের ৭ জুন আমি জেলে যাই। সেদিন কমিউনিস্ট পার্টি 'মুক্ত এলাকা দিবস' ঘোষণা করেছিল। স্থানগুলো হলো ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলের হাজং, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চবি্বশ পরগনার কাকদ্বীপ আর মাদ্রাজের তেলাঙ্গনা। জনযুদ্ধ তখন শুরু হয়েছে। বিটি রনদীভে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক। ওই সময় আমি একটা পোস্টার এঁকেছিলাম। যার বিষয় ছিল ময়মনসিংহের মানচিত্র হাতুড়ি-কাস্তে দিয়ে ঘেরা। পোস্টারের ওপরে লেখা ছিল 'মুক্ত এলাকা দিবস', যা চকবাজার, মৌলবীবাজার এলাকার দেয়ালে লাগাতে গিয়ে আমি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হই। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আমাকে রাখা হয় ১৪ নম্বর সেলে। 'শকুন্তলা ফাটক' বলে যার একটা সুন্দর নাম ছিল। আমার রাজনৈতিক সতীর্থ আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন, শান্তি পরিষদের নেতা আলী আকসাদ, শ্রমিক নেতা আবদুল বারী, ক্ষেতমজুর নেতা মনু মিয়াও এখানে ছিল। সাড়ে পাঁচ মাস পর জেল থেকে জামিনে ছাড়া পাই। এসডিও [দক্ষিণ] এর এজলাসে আমার বাবা ও বড়ভাই উপস্থিত ছিলেন। আমার কোমরে দড়ি, হাতে হ্যান্ডকাফ পরে যখন কাঠগড়ায় দাঁড়ালাম, বাবাকে দেখে মনে খুব কষ্ট হলো। হাকিমকে বললাম, আমার হাতকড়া ও দড়ি খুলে দিতে। হাকিম তা মঞ্জুর করলেন। অক্টোবরের ১৫ তারিখ ছাড়া পাওয়ার পরদিন তিনি বেগমবাজারে আমাদের বাসায় এসেছিলেন। আমার ওপর নজরদারি ছিল তাই তার এজলাস থেকে আমার কেস অন্য হাকিমের কাছে গেল। এভাবে প্রায় দশ-বারোজন হাকিমের এজলাসে আমার কেস যাওয়া হলেও কেউ আমার পিতার জন্য বিচার করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। পরে এ কে বিশ্বাস নামে হাকিমের এজলাসে বিচার শুরু হলো। তিনি ছিলেন ঘোর কমিউনিস্টবিরোধী। কিছুদিন আগে সদরঘাটে করনেশন পার্কে এক সমাবেশ থেকে আটক সাতজন তরুণীকে সাজা দিয়েছিলেন। তার এজলাসে আমার বিচার হবে জেনে ভয় পাচ্ছিলাম কিন্তু তিনি সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে নির্দোষ বলে রায় দেন।
আপনি সিরিয়াসলি ছবি আঁকায় মন দিলেন কবে।
জেল থেকে ফিরে এসে সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাসে গিয়ে দেখি ছাত্ররা যেভাবে কাজ করছে, আমি পারছি না। জলরঙের ওয়াশ টেকনিক শেখানো হতো, সেগুলো আমি পারছিলাম না। আবেদিন সাহেবকে বলি, স্যার আমাকে দিয়ে ছবি আঁকা হবে না। তিনি বললেন, 'হবে।' তিনি পিয়নকে দিয়ে আমিনুল ইসলামকে ডেকে আনালেন। তিনি আমার এক বছরের সিনিয়র ছিলেন। তাকে দেখিয়ে স্যার আমার কাছে জানতে চাইলেন, 'তুমি একে চেন?' আমি বললাম, আমি চিনি না। আমি কিন্তু চিনতাম। পার্টি থেকে বলা হয়েছিল আমাদের একজন গোপন কর্মী আছে আমিনুল, সে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। স্যার আমিনুল ইসলামকে বললেন, তুমি আউটডোরে যাওয়ার সময় বশীরকে সঙ্গে নিও, ওকে গাইড কর। আমিনুল যে শুধু আমাকে ছবি আঁকার বিভিন্ন কৌশল হাতে-কলমে শিখিয়েছেন তা নয়, তার সংগ্রহে ছিল বিখ্যাত শিল্পীদের চিত্রসম্ভার নিয়ে নানা বই। সেই বইয়ের ছবি নিয়ে আমার সঙ্গে আলাপ করতেন। কিন্তু ইনস্টিটিউটে লাইব্রেরির বই দেখার সুযোগ তেমন আমাদের ছিল না। ওই সময় আর একটি ঘটনা মনে পড়ে, একদিন ক্লাসে বসে আমি রঙ গুলেছি, রঙ কাগজে লাগাতে যাব, আমার শিক্ষক আনোয়ারুল হক পেছন থেকে আমার হাত টেনে ধরলেন। তিনি বললেন, 'ওঠ।' আমি বললাম, 'কেন?' তিনি জানালেন, এখানে রাজ্জাক বসবে। রাজ্জাক আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়। আমি খুব কষ্ট পেলাম, আমি ভালো ছাত্র না, তাই বলে কি ভালো হওয়ার অধিকার নেই। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম। তখন সফিউদ্দীন স্যার বারান্দা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি আমার কাছে ঘটনা শুনে তার বাসায় যেতে বললেন। তিনি সচরাচর বাসায় কাউকে যেতে বলেন না। আমি তার স্বামীবাগের বাড়িতে গেলাম। তিনি নিজের অাঁকা অনেকগুলো তৈলচিত্র আমাকে দেখালেন। অথচ তিনি অ্যাচিং করেন, উডকাট করেন। আমি বেশ অবাক হলাম। স্যার বললেন, 'বশীর, তুমি তৈলচিত্র আঁকবে, কীভাবে করব বললেন।' তারপর থেকে তৈলচিত্রের প্রতি ভালোবাসা জন্মে যায়।
বিদেশে পড়তে গেলেন কখন?
১৯৫৪ ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে পাস করি। বাবা আমাকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আশুতোষ মিউজিয়ামে একটি আর্ট এপ্রিসিয়েশন কোর্স করতে পাঠালেন। আমি চিন্তা-ভাবনা করছি কোন আঙ্গিকে কাজ করব। আমি যা চিন্তা করছি তা পরিতোষ সেনের মধ্যে পেলাম। এরপর ১৯৫৬ সালে বাবা আমাকে ইতালির ফ্লোরেন্সে পড়তে পাঠালেন। সেখানে রেনেসাঁশিল্পী দুচচো, সিমাবো, ফ্রাঞ্জিলিকো, জোততো এদের কাজ এবং বাইজাইনটাইনদের কাজ দেখি। তাদের কাজ আমাকে অনুপ্রাণিত করে কিন্তু মাইকেল এঞ্জোলো, রাফায়েল, টিসান এদের কাজ আমার ভালো লাগত না। আমি রেনেসাঁপূর্ব শিল্পীদের ছবি দেখে অনেক কিছু শিখেছি এবং এখনো অনুপ্রাণিত হচ্ছি। আমি যখন মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১-এর শেষে সপরিবারে প্যারিসে গিয়েছিলাম, সেখানে ১৯৭৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ছিলাম। সে সময় একদিন মপনার্স এলাকায় এক ক্যাফেতে দার্শনিক জঁ্য পল সাত্রকে দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়ি। অস্তিত্ববাদ তখন আমার অস্তিত্বজুড়ে। কিন্তু আমার ভিনদেশী সহপাঠী অবাক হয়ে আমাকে বলেছিলেন, সময় এখন সাত্রের চেয়েও এগিয়ে। পিকাসোর ছবির প্রতি আমার খুব দুর্বলতা, এখনো ছবি আঁকার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে তার কাজের কাছে যাই। পিকাসো যেদিন মারা গেলেন, আমি ভাবলাম, আজ বুঝি সব ক্লাস বন্ধ থাকবে। পয়সা নেই, এ সুযোগে আমি উইন্ডোশপিং করব। বাবা চাইলেন, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসুক। আমি সোজা লন্ডনে চলে যাই। ওখানে তখন ফজলে লোহানী থাকেন। তিনি আমার বয়সে বড় হলেও বন্ধু ছিলেন। তার সঙ্গে কিছুদিন থাকার পর রেস্টুরেন্টে ছোটখাটো চাকরি শুরু করি। বিবিসিতে তখনকার সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান 'আঞ্জুমান'-এ খবর পাঠ করে কিছু পয়সা পেতাম। দেশে ফেরার জন্য বাবা খুব কড়া করে একটা চিঠি লিখলেন, তোমাকে টিকিট পাঠিয়ে দিচ্ছি, টিকিটে যে তারিখ আছে সে পর্যন্ত তোমাকে থাকার অধিকার দেওয়া হয়েছে। উনি সাধারণত চিঠির শেষাংশে লিখতেন, 'ইতি দোয়াগো কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষী মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।' এ চিঠিতে তিনি লিখলেন, 'ইতি তোমার পিতা মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।' অর্থাৎ তিনি যে আমার পিতা সেই দাবি নিয়ে আদেশ করলেন। এ চিঠি পেয়ে আমি ১৯৫৮-এর ডিসেম্বরে দেশে চলে আসি। ঢাকায় আর্ট ইনস্টিটিউটে চাকরি হলো না, পিতার গলগ্রহ হয়ে থাকার বাসনা ছিল না। তাই শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য করাচি চলে গেলাম।
আপনার বাবা আপনাকে উৎসাহিত করতেন কি?
ছোটবেলা থেকে দেখতাম, আমার বাবা বই পড়ছেন। ঘরে কোনো চেঁচামেচি হলে মা বলতেন, চুপ, তোমার বাবা পড়ছে। তার সঙ্গে সপ্তাহে দুদিন দেখা হতো। বাবা যেদিন বেতন পেতেন, সেদিন বেতনের টাকা টেবিলে রেখে তার সব ছেলেকে ডেকে বলতেন তোমাদের যার যা দরকার নিয়ে নাও। মা তখন সেখানে থাকতেন না, তিনি থাকতেন দরজার বাইরে। আর বাবার সঙ্গে দেখা হতো রবিবার, ছুটির দিন। দুপুরে খাবার টেবিলে বসে আমরা কাঁটাচামচ, ছুরিসহকারে ইংরেজি খাওয়া খেতাম। তিনি লক্ষ্য রাখতেন যথাযথভাবে আমরা কাঁটাচামচ ও ছুরি ব্যবহার করছি কিনা। ছবি আঁকার ব্যাপারে তার খুব মত ছিল না। তিনি বলেছিলেন, 'আমি প্যারিসে ছিলাম, দেখেছি শিল্পীদের জীবন'। অথচ ১৯৪৯ সালে আমি যখন আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হব, তিনি আমাকে ভর্তির টাকাটা দিলেন। উনি সোরবন থেকে পিএইচডি লাভের পর এক সংবর্ধনায় লুভ্যর মিউজিয়ামের দুই খণ্ডের ক্যাটালগ উপহার পেয়েছিলেন। ওই বই দুটো আমার হাতে দিয়ে বললেন, 'এই দুটো এতদিন আমার কাছে ছিল, এখন তোমার।' ১৯৫৭ সালে ওয়াশিংটনে পূর্ব পাকিস্তানের নয়জন চিত্রকরের এক প্রদর্শনী হয়। তার একটি প্রতিবেদন বেরিয়েছিল 'পাকিস্তান অবজারভারে'। সেখানে আমার নাম 'মুর্তজা রশিদ' ছাপা হয়েছিল। বাবা 'সম্পাদক বরাবর চিঠি'তে লিখে জানান, আমার ছবি প্রশংসিত হয়েছে এ জন্য তিনি অত্যন্ত আনন্দিত। তবে নামটি 'মুর্তজা রশিদ' নয় 'মুর্তজা বশীর' এবং তার আসল নাম একেএম বশীরউল্লাহ। ১৯৫৯ সালে করাচিতে আমেরিকান এক সংস্থার উদ্যোগে আমার প্রদর্শনী হয় এবং সে সময়ের শিক্ষামন্ত্রী জনাব হাবিবুর রহমান উদ্বোধন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিকালীন থেকে তাকে চিনতেন। তাই তিনি তার ভিজিটিং কার্ডের ওপরে লিখলেন-‘To Habibur Rahman, Education Minister, Introducting my son Murtaza Bashir artist.’। সেই কার্ড নিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি সানন্দে রাজি হলেন। প্রদর্শনীতে বাবা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে পানীয়ের ব্যবস্থা ছিল তা দেখে আমি কিছুটা বিব্রত ও শঙ্কিত হচ্ছিলাম কিন্তু তিনি সেই পরিবেশন আমলেই নিলেন না। স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করলেন। মাগরিবের সময় প্রদর্শনী কক্ষের এক কোণে তিনি নামাজ পড়লেন। ১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমির এক প্রদর্শনী এবং ছোট্ট একটা সেমিনার হয়। বাবা সে অনুষ্ঠানে ছিলেন। সেমিনারের বক্তা এ কে ব্রোহী হঠাৎ বাবাকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'ডক্টর সাহেব, আপনার ছেলে তো একজন আধুনিক শিল্পী। আপনি তাকে কীভাবে দেখেন?' বাবা দাঁড়িয়ে বললেন, 'আধুনিক চিত্রের মতো আমার ছেলেও আমার কাছে দুর্বোধ্য, আমি তাকে বুঝতে পারি না।' তার মৃত্যুর ১৫-২০ দিন আগের কথা। হাসপাতালে যাওয়ার আগে তিনি আচকান পরলেন, মাথায় টুপি দিলেন, আমাকে বললেন, 'তুমি আমার একটি পোর্ট্রেট কর।' এই আমার বাবা।
কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ আপনাকে লাহোর নিয়ে গিয়েছিলেন
১৯৪৮ সালে তার সঙ্গে আমার পরিচয় লন্ডনে। তিনি ঢাকায় এসেছিলেন ১৯৫৯ সালে 'জাগো হুয়া সাবেরা' চলচ্চিত্রের পরিচালক এ জে কারদারসহ 'দূর হ্যায় সুখ কা গাঁও' ছবির শুটিং করতে। তখন সেপ্টেম্বর মাস, ঢাকা প্রেসক্লাবে আমার প্রদর্শনী চলছিল। তিনি প্রদর্শনীতে এসে আমাকে বললেন, 'বশীর, আমি লাহোর আর্ট কাউন্সিলের সেক্রেটারি হচ্ছি, তোমাকে আমন্ত্রণ জানাব, তুমি লাহোরে এসো।' ১৯৫৯ সালের শেষের দিকে আমি লাহোরে গেলাম। দুই বছর ছিলাম। ১৯৬১ সালে ফয়েজ ভাইকে বলেছিলাম, ফয়েজ ভাই, আমার নাম হয় না কেন? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, 'বশীর, তুমি নামের পেছনে ছুটো না, নাম তোমার পেছনে ছুটবে।' এটাও আমার একটা শিক্ষা। তিনি আমাকে লাহোর থেকে যেতে বলেছিলেন। আমি থাকিনি। ১৯৫৫ সাল থেকে নিয়মিতভাবে আধুনিকশৈলীতে ছবি অাঁকা শুরু করি। ফলে আমার মধ্যে এক ধরনের অহংবোধ ছিল। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন আমার বাসায় এলেন কাজ দেখতে। যখন রিকশা করে ফিরছি, তখন জেলখানার সামনে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বলেছিলেন, 'তুমি ভালো কাজ কর, কিন্তু তুমি একাই ভালো কাজ কর না। আমরাও অাঁকি।' তারপর বললেন, 'এমনভাবে নিজেকে তৈরি কর, যাতে অন্যের প্রশংসা শুনে হাসবে। অন্যের সমালোচনাতেও শুধু হাসবে।' কথাগুলো হৃদয়ে নিতে আমার ১০ বছর লেগেছিল। এখন আমি প্রশংসাতেও হাসি, সমালোচনা শুনলেও হাসি।
বাংলার মন্দির টেরাকোটা নিয়ে আপনি গবেষণা করেছেন। একজন শিল্পী হিসেবে ইতিহাসের মতো বিষয়ে গবেষণায় আগ্রহী হলেন কীভাবে?
১৯৮০ সালে যখন বাংলাদেশ সরকার ও শিল্পকলা একাডেমি আমাকে জাপানের ফুকোকা সিটিতে একটি সেমিনারে পাঠাল। সেখানে আমার ইন্টারপ্রেটার সুন্দরী তরুণীর দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম, সে কিন্তু হাত বাড়াল না। সে তাদের ঐতিহ্য অনুযায়ী মাথাটা ঝুঁকিয়ে নম্রভাবে আমাকে অভিবাদন জানাল। এটা আমাকে ভীষণভাবে আহত করল। আমার তখন ঈশপের গল্প মনে হলো। একটা কাক ময়ূরের পুচ্ছ পরে ছিল। সে কাকও হতে পারেনি, ময়ূরও হতে পারেনি। তখন আমার জানার ইচ্ছা হলো, আমি কে, আমি কি, কোত্থেকে এসেছি? এটি যখন আমার মাথায় ঢুকলো তখন দেখা গেল আমি আর কোনো ছবি অাঁকতে পারছি না। আমি ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত কোনো ছবি অাঁকিনি। ওই সময় আমি নিজেকে জানার জন্য হিন্দুদের বেদ, উপনিষদ ও বৌদ্ধদের ধর্মপদ প্রমুখ ধর্মীয় গ্রন্থ ছাড়াও ভারতের ইতিহাস, সামাজিক ইতিহাস, অর্থনৈতিক ইতিহাস, রাজনৈতিক ইতিহাস, হিন্দু ও বৌদ্ধশাস্ত্র, মনু, নারদ, বৃহস্পতি, অপস্টম্ভা, গৌতম, বশিষ্ঠ বেঠধায়ন ও বৌদ্ধদের জাতক, সুত্তবিভঙ্গ, মহাবর্গ, কুলবর্গ, ভিক্ষু ও ভিক্ষুনী বিভঙ্গ ও থেরগাথা ও বৌদ্ধমূত্র নিজেকে খোঁজার জন্য পড়া শুরু করলাম। ইচ্ছার বিরুদ্ধে ১৯৮৪ সালে একটি প্রদর্শনী করলাম। এরপর ১৯৮৮ সালে কয়েকটি ছবি অাঁকলাম। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৭ এ সাতটি বছরে আমি গবেষণা করলাম। ওই সময় একটি বই করি, মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশি সুলতান ও তৎকালীন সমাজ নামে একটি বই বের হয়।
আপনি তো জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান কারও শিল্পভাষা অনুসরণ করেননি।
শিল্পী হিসেবে জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসান কত বড় এটা সময় বিচার করবে। তবে শিক্ষক হিসেবে তারা অতুলনীয়। এই দুই শিক্ষকের কেউই চাইতেন না তাদের কেউ অনুকরণ করুক। আর পঞ্চাশের বাস্তবতায় আমার শিল্পভাষা সম্পর্কে বললে বলতে হবে, ফ্লোরেন্সে গিয়ে রেনেসাঁসের যে শিক্ষাটা পেয়েছিলাম সেখান থেকেই ইস্ট ও ওয়েস্টকে ব্লেন্ড করেছি আমি। প্রাচ্য হলো সীমিত রংয়ের ব্যবহার ও সমতল যেখানে অবয়ব রেখা দিয়ে সৃষ্টি। আর পাশ্চাত্যের কাজ হলো আলো-ছায়া সমন্বয়ে বাস্তবধর্মী ছবি, যেখানে সামনে-পেছনে বুঝানোর জন্য পারস্পেটিভ অর্থাৎ পরিপ্রেক্ষিতের প্রয়োগ। প্রাচ্যধারা ও পাশ্চাত্যশিল্পেও শিক্ষা নিয়ে আমি একটা চিত্রভাষা তৈরি করলাম। সুলতান ভাই [এস এম সুলতান] আমাকে বলেছিলেন, 'ইস্ট ও ওয়েস্টকে আপনি সার্থকভাবে ব্লেন্ড করতে পেরেছেন।'
শিক্ষিত লোকজন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে সম্মান করতেন একজন বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত রূপে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাকে জানতেন একজন ধর্মভীরু মুসলমান হিসেবে। এ ব্যাপারে আপনি কি বলেন?
তিনি ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। ঢাকায় যখন আমি নবকুমার ইনস্টিটিউশনে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র তখন স্কুলে দিপালীসহ বন্ধুদের সঙ্গে হোলি খেলতাম, বাড়িতে আতশবাজি পোড়াতাম। এ ব্যাপারে তাকে বিরূপ হতে দেখিনি। এমনকি যখন তিনি বগুড়ায় আযিযুুল হক কলেজের অধ্যক্ষ তখন হিন্দু ছাত্ররা তার হাতে আবির দিয়ে প্রণাম করত কিন্তু তিনি বিরক্ত হতেন না। তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে বাঙালি। তিনি যে বাঙালি তা বহুবার নানা সময়ে নানা ভাষণে লক্ষ করা যায়। ১৯১৮ সালে চট্টগ্রাম মুসলমান ছাত্র সম্মিলনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন, 'তোমরা কেবল ছাত্র নও, তোমরা বাঙালি। তোমরা বাঙালি মুসলমান। বাংলার আবহাওয়ায়, বাংলার মাটিতে বাংলার শস্যে, বাংলার ফলে তোমাদের দেহ গঠিত, পুষ্ট, বর্ধিত।' তিনি স্বপ্ন দেখতেন হিন্দু-মুসলমান মিলে এক বাঙালি জাতি। ১৯১৭ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মিলনীর দ্বিতীয় অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে সেই স্বপ্নের ইঙ্গিত পাই। তিনি বলেছিলেন, 'হিন্দু মুসলমান মিলিয়া বাঙালি জাতি গড়িয়া তুলিতে বহু অন্তরায় আছে। কিন্তু দূর ভবিষ্যতে হউক না কেন তাহা তো করিতেই হইবে। বাঙালি হিন্দু বাঙালি মুসলমান ব্যতীত চলিতে পারবে না। চিরকাল কি একভাবে যাবে? জগতের ইতিহাস পৃষ্ঠে কি হিন্দু-মুসলমান মিলিত বাঙালি জাতি, ফরাসি, ইংরেজ ইতালীয়, জার্মান, জাপানি প্রমুখ জাতির ন্যায় নাম রাখিতে পারিবে না? আশা কানে কানে গুঞ্জন করিয়া বলে, পারিবে।...' তার সেই স্বপ্ন আংশিকভাবে একাত্তরে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠা হলেও এখনো সমাজে সাম্প্রদায়িকতা রয়ে গেছে। এখনো জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মিলনভূমি হয়নি। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যখন ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলো তখন তিনি বগুড়া আযিযুল হক কলেজের অধ্যক্ষ। তার ছাত্র বামপন্থি অনুসারী কবি আতাউর রহমানকে তিনি বলেছিলেন এ যুগে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে না। আতাউর রহমান তার লেখা 'পাশ্চাতের নিত্য সহচর ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ' এই শিরোনামে লেখেন, '... পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম, স্যার আপনি বলেছিলেন এ যুগে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। ধর্মের ভিত্তিতে তো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলো। আমার কথা শোনার পর তিনি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকলেন। বললেন, 'হ্যাঁ পাকিস্তান হলো। কিন্তু একটা কথা জেনে রেখ- এ পাকিস্তান ২০/২৫ বছরের বেশি টিকবে না। দুই অংশের মধ্যকার এই দূরত্বের ব্যবধান, কোনো কিছু দিয়ে টিকিয়ে রাখা যাবে না। আমি এতদিন বেঁচে থাকব না, তোমরা থাকবে। একদিন আমার কথার সত্যতা তোমরা বুঝতে পারবে...।' ১৯২৮ সালের শেষে তিনি প্যারিসের সোরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট করার পর ১৯২৯ সালে তার প্রথমা কন্যা মহযূযা খাতুনের বিয়ের নিমন্ত্রণপত্রের ওপর লিখেছিলেন 'আল্লাহ জয়তু'। তা ছিল ওই সময়ে মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত ব্যতিক্রমধর্মী ব্যাপার। যখন তিনি রীতিমতো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে সক্রিয় ছিলেন তখনো ১৯৬২ সালে আমার বিয়ের কার্ডের ওপর প্রচলিত রীতি ও প্রথা অনুসরণ না করে লিখেছিলেন 'এক'। অর্থাৎ আল্লাহ্ এক, রাসূল এক। তার এই দৃঢ় বিশ্বাসের প্রতিফলন আমরা দেখি ধর্মের ভিত্তিতে সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে ঢাকার কার্জন হলে অনুষ্ঠিত ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের মূল সভাপতির ভাষণে আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয় এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকা জে-টি নেই। সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় তার সম্বন্ধে বলেছিলেন- 'ড. শহীদুল্লাহ এ যুগের একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি-তাহাকে আমরা একজন যুগনায়ক মুসলমান বাঙালি বলিয়া অভিবাদন করি। আন্তর্জাতিক মুসলমানদের খাতিরে তাহার সাধনায় বাঙালিত্বকে বিসর্জন দেন নাই। মুসলমান আদর্শ ও সাধনা এবং বাঙালির জীবন, এই দুইয়ের সমন্বয় তাহার চরিত্রে দেখা যায়।'
ছেলেবেলার কোনো স্মৃতি আজও আপনাকে আলোড়িত করে।
আমি তখন বগুড়া করনেশন ইনস্টিটিউশনে পড়তাম। একদিন সকালে আমার এক সহপাঠীর বাড়ি গেলাম দেখা করতে। দেখি, গামছা কাঁধে বের হচ্ছে। ওকে প্রশ্ন করলাম, কিরে, কোথায় যাস? সে বলল আধা ঘণ্টা অপেক্ষা কর, আমি নদীতে ডুব দিয়ে আসি। আমি আধা ঘণ্টা ঘুরে এসে দেখি, ওদের উঠানে অনেক মানুষ। ভিড় ঠেলে তাকিয়ে দেখি, বন্ধু আমার মাটিতে শুয়ে। কি হলো? শুনলাম, করতোয়া নদীতে ডুবে মারা গেছে। বিরাট একটা ধাক্কা খেলাম। ছোটবেলা থেকে পড়তাম, মানুষ মরণশীল। কিন্তু সেদিন মনে হলো ম্যান ইজ ইমরটাল। মনে পড়ে, সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় বাড়ি থেকে পালিয়ে আমি নারায়ণগঞ্জ চলে গিয়েছিলাম। আবার দশম শ্রেণীতে উঠে লক্ষ্নৌ চলে গেলাম। পরে বাড়ির জন্য মন খারাপ হলো, তাই ফিরে এলাম। আমরা অনেক ভাইবোন। মা সবার জন্য ফিরনি রেঁধে টেবিলে বাটিতে বাটিতে হয়তো রেখেছেন। আমি গুনে দেখি, একটা কম। এটা হয়তো মনস্তাত্তি্বক সমস্যা। কিন্তু আমার মনে হতো কেউ আমাকে চায় না। শৈশব থেকেই আমি একাকিত্ব ভালোবাসি।
ছোটবেলায় আপনি কখনো ভেবেছেন ছবি অাঁকবেন কিংবা চিত্রশিল্পী হবেন?
আমি কখনো ভাবিনি শিল্পী হব। তবে ছবি দেখতে ভালো লাগত। আমার বাবার বিশাল লাইব্রেরিতে 'প্রবাসী', 'বসুমতী', 'বিচিত্রা', 'ভারতবর্ষ', 'মডার্ন রিভিউ', 'এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা'সহ বহু বই ছিল। সেসব পত্রপত্রিকায় ও বইয়ে আমি বিভিন্ন ছবি দেখতাম। আমরা তখন বগুড়ায়, আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। সে সময় পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে আমার একটা যোগসূত্র গড়ে ওঠে। আমি কমিউনিস্ট পার্টির অফিসের জন্য মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্টালিনের পোর্ট্রেট করি ফুলসিট কাগজে। রাস্তায় যারা সাইনবোর্ড করে তাদের কাজ দেখে ওই ছবিগুলো এঁকেছিলাম। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলো, ১ সেপ্টেম্বর কমিউনিস্ট নেতা ভবানী সেন বগুড়ায় এলেন। তিনি পার্টি অফিসের দেয়ালে ওইসব ছবি দেখে কে এঁকেছে জানতে চান। আমাকে পার্টি অফিসে ডেকে আনা হলো, তিনি আমাকে প্রশংসা করলেন। আমার অটোগ্রাফ খাতায় লিখলেন, 'আর্টিস্টের কাজ হলো শোষিত জনগণের ভাব ও দুঃখ-দুর্দশাকে চিত্রের ভেতর দিয়ে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা, যাতে সমাজে সে আর্ট নবজীবন সৃষ্টি করতে পারে।' আমার বয়স তখন ১৫ বছর। সেই কথা আমার মনে এমনভাবে গেঁথে যায় যে, আজও যা সৃষ্টি করেছি তা সেই অঙ্গীকার থেকেই। যার জন্য ছবি অাঁকাটা হয়েছে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই। যেখানে নিজের ভাবাবেগ স্থান পায়নি।
আপনি একসময় বিখ্যাত মানুষের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করতেন।
আমার বাবা ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তখন বগুড়া আযিযুল হক কলেজের অধ্যক্ষ। আমি ভীষণ দুর্বিনীত ছিলাম। বাবার কাছে অভিযোগ আসত। একদিন তিনি আমাকে ডেকে বললেন, 'হয় ফেমাস হও, নয় নটোরিয়াস; মিডিওকার হয়ো না।' আমি যখন ক্লাস টেনের ছাত্র, বাবার রেমিংটন বন্ড কাগজের প্যাডের পাতায় জওহরলাল নেহরুর পোর্ট্রেট এঁকে পাঠিয়েছিলাম। লিখেছিলাম, আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র, আপনার পোর্ট্রেট এঁকে পাঠালাম, বিনিময়ে আপনার স্বাক্ষর চাই। তিনি তার এক ফটোগ্রাফ পাঠালেন, স্বাক্ষরের নিচে তারিখ : সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮। এখনো সেটি আমার সংগ্রহে আছে। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন নিয়ে বই পড়েছি। জেনেছি, সূর্য সেনের সঙ্গী অনন্ত সিংহ ও অম্বিকা চক্রবর্তীর কথা। তাদের স্বাক্ষর, ছবি আমার কাছে আছে। সাইকেলে বিশ্বভ্রমণ করা প্রথম বাঙালি রামনাথ বিশ্বাস কিংবা দার্শনিক সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন, কবি শেখর কালিদাস রায়, শেরে কাশ্মীর শেখ আবদুল্লাহ, এ কে ফজলুল হক অটোগ্রাফ আমাকে বগুড়ায় পাঠিয়েছেন। পরবর্তীকালে ১৯৫৪ সালে মনোজ বসু, কাজী আবদুল ওদুদ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও ইলা মিত্রের অটোগ্রাফ নিয়েছি। যে বয়সে যে মানুষগুলোর কথা আমি পড়েছি, জেনেছি বা সংস্পর্শে এসেছি, সে বয়সে এদের নামও অনেকে জানত না।
আর্ট কলেজে ভর্তি হলেন কেন?
ম্যাট্রিক পাস করে ১৯৪৯ সালে ঢাকায় আসি। পার্টি তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে। পার্টি আমাকে বলল, তোমাকে আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে সাংগঠনিক কাজ করতে হবে। আমার বড় ভাই এ কে এম সফিউল্লাহ কলকাতায় থাকাকালীন জয়নুল আবেদিনের বন্ধু ছিলেন। আমি ভাইয়ের চিঠি নিয়ে আবেদিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি বললেন, ঠিক আছে ভর্তি হবে। অ্যাডমিশন টেস্ট হলো। আমি পাস করলাম। পার্টির নির্দেশে আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হই। তখন আর্ট ইনস্টিটিউটে কিছু সমস্যা ছিল। লাইব্রেরি আছে কিন্তু পর্যাপ্ত বই নেই, আসবাবপত্র নেই, ক্লাসরুমের সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে আমি আন্দোলন শুরু করে দিলাম। একদিন খুব ভোরে ছাত্ররা আসার আগেই দেয়ালে পোস্টার লাগিয়েছি। আবেদিন স্যার আসলেন, তিনি পোস্টার দেখে দারোয়ানকে বললেন, পোস্টার তুলে ফেল। আমি হাত দিয়ে আটকে রাখলাম, বললাম আমি নিজে হাতে ছিঁড়ে ফেলব, আগে ছাত্ররা দেখুক এটা। ছাত্ররা আসল, দেখল, পরে আমি ছিঁড়ে ফেললাম। আবেদিন সাহেব কমিউনিস্ট বিরোধী ছিলেন না, কিন্তু তিনি ভয় পেয়েছিলেন। ছবি অাঁকায় আমার মন নেই। আমার কাজ হলো পার্টির জন্য চাঁদা তোলা, গোপন কর্মীদের জন্য শেল্টার খুঁজে বের করা। তখনো আমি পার্টির সদস্য হইনি। ২০ বছরের আগে কাউকে পার্টির সদস্যপদ দেওয়া হতো না। আমি রাস্তায় মিটিং কিংবা বিভিন্ন স্কুলে ধর্মঘট করছি। এরপর জেলে গেলাম। ১৯৫০ সালে জেল থেকে আসার পর ১৯ বছর বয়সে দলের সদস্য হই।
জেলে গিয়েছিলেন কেন।
১৯৫০ সালের ৭ জুন আমি জেলে যাই। সেদিন কমিউনিস্ট পার্টি 'মুক্ত এলাকা দিবস' ঘোষণা করেছিল। স্থানগুলো হলো ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলের হাজং, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চবি্বশ পরগনার কাকদ্বীপ আর মাদ্রাজের তেলাঙ্গনা। জনযুদ্ধ তখন শুরু হয়েছে। বিটি রনদীভে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক। ওই সময় আমি একটা পোস্টার এঁকেছিলাম। যার বিষয় ছিল ময়মনসিংহের মানচিত্র হাতুড়ি-কাস্তে দিয়ে ঘেরা। পোস্টারের ওপরে লেখা ছিল 'মুক্ত এলাকা দিবস', যা চকবাজার, মৌলবীবাজার এলাকার দেয়ালে লাগাতে গিয়ে আমি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হই। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আমাকে রাখা হয় ১৪ নম্বর সেলে। 'শকুন্তলা ফাটক' বলে যার একটা সুন্দর নাম ছিল। আমার রাজনৈতিক সতীর্থ আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন, শান্তি পরিষদের নেতা আলী আকসাদ, শ্রমিক নেতা আবদুল বারী, ক্ষেতমজুর নেতা মনু মিয়াও এখানে ছিল। সাড়ে পাঁচ মাস পর জেল থেকে জামিনে ছাড়া পাই। এসডিও [দক্ষিণ] এর এজলাসে আমার বাবা ও বড়ভাই উপস্থিত ছিলেন। আমার কোমরে দড়ি, হাতে হ্যান্ডকাফ পরে যখন কাঠগড়ায় দাঁড়ালাম, বাবাকে দেখে মনে খুব কষ্ট হলো। হাকিমকে বললাম, আমার হাতকড়া ও দড়ি খুলে দিতে। হাকিম তা মঞ্জুর করলেন। অক্টোবরের ১৫ তারিখ ছাড়া পাওয়ার পরদিন তিনি বেগমবাজারে আমাদের বাসায় এসেছিলেন। আমার ওপর নজরদারি ছিল তাই তার এজলাস থেকে আমার কেস অন্য হাকিমের কাছে গেল। এভাবে প্রায় দশ-বারোজন হাকিমের এজলাসে আমার কেস যাওয়া হলেও কেউ আমার পিতার জন্য বিচার করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। পরে এ কে বিশ্বাস নামে হাকিমের এজলাসে বিচার শুরু হলো। তিনি ছিলেন ঘোর কমিউনিস্টবিরোধী। কিছুদিন আগে সদরঘাটে করনেশন পার্কে এক সমাবেশ থেকে আটক সাতজন তরুণীকে সাজা দিয়েছিলেন। তার এজলাসে আমার বিচার হবে জেনে ভয় পাচ্ছিলাম কিন্তু তিনি সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে নির্দোষ বলে রায় দেন।
আপনি সিরিয়াসলি ছবি আঁকায় মন দিলেন কবে।
জেল থেকে ফিরে এসে সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাসে গিয়ে দেখি ছাত্ররা যেভাবে কাজ করছে, আমি পারছি না। জলরঙের ওয়াশ টেকনিক শেখানো হতো, সেগুলো আমি পারছিলাম না। আবেদিন সাহেবকে বলি, স্যার আমাকে দিয়ে ছবি আঁকা হবে না। তিনি বললেন, 'হবে।' তিনি পিয়নকে দিয়ে আমিনুল ইসলামকে ডেকে আনালেন। তিনি আমার এক বছরের সিনিয়র ছিলেন। তাকে দেখিয়ে স্যার আমার কাছে জানতে চাইলেন, 'তুমি একে চেন?' আমি বললাম, আমি চিনি না। আমি কিন্তু চিনতাম। পার্টি থেকে বলা হয়েছিল আমাদের একজন গোপন কর্মী আছে আমিনুল, সে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। স্যার আমিনুল ইসলামকে বললেন, তুমি আউটডোরে যাওয়ার সময় বশীরকে সঙ্গে নিও, ওকে গাইড কর। আমিনুল যে শুধু আমাকে ছবি আঁকার বিভিন্ন কৌশল হাতে-কলমে শিখিয়েছেন তা নয়, তার সংগ্রহে ছিল বিখ্যাত শিল্পীদের চিত্রসম্ভার নিয়ে নানা বই। সেই বইয়ের ছবি নিয়ে আমার সঙ্গে আলাপ করতেন। কিন্তু ইনস্টিটিউটে লাইব্রেরির বই দেখার সুযোগ তেমন আমাদের ছিল না। ওই সময় আর একটি ঘটনা মনে পড়ে, একদিন ক্লাসে বসে আমি রঙ গুলেছি, রঙ কাগজে লাগাতে যাব, আমার শিক্ষক আনোয়ারুল হক পেছন থেকে আমার হাত টেনে ধরলেন। তিনি বললেন, 'ওঠ।' আমি বললাম, 'কেন?' তিনি জানালেন, এখানে রাজ্জাক বসবে। রাজ্জাক আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়। আমি খুব কষ্ট পেলাম, আমি ভালো ছাত্র না, তাই বলে কি ভালো হওয়ার অধিকার নেই। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম। তখন সফিউদ্দীন স্যার বারান্দা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি আমার কাছে ঘটনা শুনে তার বাসায় যেতে বললেন। তিনি সচরাচর বাসায় কাউকে যেতে বলেন না। আমি তার স্বামীবাগের বাড়িতে গেলাম। তিনি নিজের অাঁকা অনেকগুলো তৈলচিত্র আমাকে দেখালেন। অথচ তিনি অ্যাচিং করেন, উডকাট করেন। আমি বেশ অবাক হলাম। স্যার বললেন, 'বশীর, তুমি তৈলচিত্র আঁকবে, কীভাবে করব বললেন।' তারপর থেকে তৈলচিত্রের প্রতি ভালোবাসা জন্মে যায়।
বিদেশে পড়তে গেলেন কখন?
১৯৫৪ ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে পাস করি। বাবা আমাকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আশুতোষ মিউজিয়ামে একটি আর্ট এপ্রিসিয়েশন কোর্স করতে পাঠালেন। আমি চিন্তা-ভাবনা করছি কোন আঙ্গিকে কাজ করব। আমি যা চিন্তা করছি তা পরিতোষ সেনের মধ্যে পেলাম। এরপর ১৯৫৬ সালে বাবা আমাকে ইতালির ফ্লোরেন্সে পড়তে পাঠালেন। সেখানে রেনেসাঁশিল্পী দুচচো, সিমাবো, ফ্রাঞ্জিলিকো, জোততো এদের কাজ এবং বাইজাইনটাইনদের কাজ দেখি। তাদের কাজ আমাকে অনুপ্রাণিত করে কিন্তু মাইকেল এঞ্জোলো, রাফায়েল, টিসান এদের কাজ আমার ভালো লাগত না। আমি রেনেসাঁপূর্ব শিল্পীদের ছবি দেখে অনেক কিছু শিখেছি এবং এখনো অনুপ্রাণিত হচ্ছি। আমি যখন মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১-এর শেষে সপরিবারে প্যারিসে গিয়েছিলাম, সেখানে ১৯৭৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ছিলাম। সে সময় একদিন মপনার্স এলাকায় এক ক্যাফেতে দার্শনিক জঁ্য পল সাত্রকে দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়ি। অস্তিত্ববাদ তখন আমার অস্তিত্বজুড়ে। কিন্তু আমার ভিনদেশী সহপাঠী অবাক হয়ে আমাকে বলেছিলেন, সময় এখন সাত্রের চেয়েও এগিয়ে। পিকাসোর ছবির প্রতি আমার খুব দুর্বলতা, এখনো ছবি আঁকার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে তার কাজের কাছে যাই। পিকাসো যেদিন মারা গেলেন, আমি ভাবলাম, আজ বুঝি সব ক্লাস বন্ধ থাকবে। পয়সা নেই, এ সুযোগে আমি উইন্ডোশপিং করব। বাবা চাইলেন, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসুক। আমি সোজা লন্ডনে চলে যাই। ওখানে তখন ফজলে লোহানী থাকেন। তিনি আমার বয়সে বড় হলেও বন্ধু ছিলেন। তার সঙ্গে কিছুদিন থাকার পর রেস্টুরেন্টে ছোটখাটো চাকরি শুরু করি। বিবিসিতে তখনকার সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান 'আঞ্জুমান'-এ খবর পাঠ করে কিছু পয়সা পেতাম। দেশে ফেরার জন্য বাবা খুব কড়া করে একটা চিঠি লিখলেন, তোমাকে টিকিট পাঠিয়ে দিচ্ছি, টিকিটে যে তারিখ আছে সে পর্যন্ত তোমাকে থাকার অধিকার দেওয়া হয়েছে। উনি সাধারণত চিঠির শেষাংশে লিখতেন, 'ইতি দোয়াগো কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষী মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।' এ চিঠিতে তিনি লিখলেন, 'ইতি তোমার পিতা মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।' অর্থাৎ তিনি যে আমার পিতা সেই দাবি নিয়ে আদেশ করলেন। এ চিঠি পেয়ে আমি ১৯৫৮-এর ডিসেম্বরে দেশে চলে আসি। ঢাকায় আর্ট ইনস্টিটিউটে চাকরি হলো না, পিতার গলগ্রহ হয়ে থাকার বাসনা ছিল না। তাই শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য করাচি চলে গেলাম।
আপনার বাবা আপনাকে উৎসাহিত করতেন কি?
ছোটবেলা থেকে দেখতাম, আমার বাবা বই পড়ছেন। ঘরে কোনো চেঁচামেচি হলে মা বলতেন, চুপ, তোমার বাবা পড়ছে। তার সঙ্গে সপ্তাহে দুদিন দেখা হতো। বাবা যেদিন বেতন পেতেন, সেদিন বেতনের টাকা টেবিলে রেখে তার সব ছেলেকে ডেকে বলতেন তোমাদের যার যা দরকার নিয়ে নাও। মা তখন সেখানে থাকতেন না, তিনি থাকতেন দরজার বাইরে। আর বাবার সঙ্গে দেখা হতো রবিবার, ছুটির দিন। দুপুরে খাবার টেবিলে বসে আমরা কাঁটাচামচ, ছুরিসহকারে ইংরেজি খাওয়া খেতাম। তিনি লক্ষ্য রাখতেন যথাযথভাবে আমরা কাঁটাচামচ ও ছুরি ব্যবহার করছি কিনা। ছবি আঁকার ব্যাপারে তার খুব মত ছিল না। তিনি বলেছিলেন, 'আমি প্যারিসে ছিলাম, দেখেছি শিল্পীদের জীবন'। অথচ ১৯৪৯ সালে আমি যখন আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হব, তিনি আমাকে ভর্তির টাকাটা দিলেন। উনি সোরবন থেকে পিএইচডি লাভের পর এক সংবর্ধনায় লুভ্যর মিউজিয়ামের দুই খণ্ডের ক্যাটালগ উপহার পেয়েছিলেন। ওই বই দুটো আমার হাতে দিয়ে বললেন, 'এই দুটো এতদিন আমার কাছে ছিল, এখন তোমার।' ১৯৫৭ সালে ওয়াশিংটনে পূর্ব পাকিস্তানের নয়জন চিত্রকরের এক প্রদর্শনী হয়। তার একটি প্রতিবেদন বেরিয়েছিল 'পাকিস্তান অবজারভারে'। সেখানে আমার নাম 'মুর্তজা রশিদ' ছাপা হয়েছিল। বাবা 'সম্পাদক বরাবর চিঠি'তে লিখে জানান, আমার ছবি প্রশংসিত হয়েছে এ জন্য তিনি অত্যন্ত আনন্দিত। তবে নামটি 'মুর্তজা রশিদ' নয় 'মুর্তজা বশীর' এবং তার আসল নাম একেএম বশীরউল্লাহ। ১৯৫৯ সালে করাচিতে আমেরিকান এক সংস্থার উদ্যোগে আমার প্রদর্শনী হয় এবং সে সময়ের শিক্ষামন্ত্রী জনাব হাবিবুর রহমান উদ্বোধন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিকালীন থেকে তাকে চিনতেন। তাই তিনি তার ভিজিটিং কার্ডের ওপরে লিখলেন-‘To Habibur Rahman, Education Minister, Introducting my son Murtaza Bashir artist.’। সেই কার্ড নিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি সানন্দে রাজি হলেন। প্রদর্শনীতে বাবা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে পানীয়ের ব্যবস্থা ছিল তা দেখে আমি কিছুটা বিব্রত ও শঙ্কিত হচ্ছিলাম কিন্তু তিনি সেই পরিবেশন আমলেই নিলেন না। স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করলেন। মাগরিবের সময় প্রদর্শনী কক্ষের এক কোণে তিনি নামাজ পড়লেন। ১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমির এক প্রদর্শনী এবং ছোট্ট একটা সেমিনার হয়। বাবা সে অনুষ্ঠানে ছিলেন। সেমিনারের বক্তা এ কে ব্রোহী হঠাৎ বাবাকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'ডক্টর সাহেব, আপনার ছেলে তো একজন আধুনিক শিল্পী। আপনি তাকে কীভাবে দেখেন?' বাবা দাঁড়িয়ে বললেন, 'আধুনিক চিত্রের মতো আমার ছেলেও আমার কাছে দুর্বোধ্য, আমি তাকে বুঝতে পারি না।' তার মৃত্যুর ১৫-২০ দিন আগের কথা। হাসপাতালে যাওয়ার আগে তিনি আচকান পরলেন, মাথায় টুপি দিলেন, আমাকে বললেন, 'তুমি আমার একটি পোর্ট্রেট কর।' এই আমার বাবা।
কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ আপনাকে লাহোর নিয়ে গিয়েছিলেন
১৯৪৮ সালে তার সঙ্গে আমার পরিচয় লন্ডনে। তিনি ঢাকায় এসেছিলেন ১৯৫৯ সালে 'জাগো হুয়া সাবেরা' চলচ্চিত্রের পরিচালক এ জে কারদারসহ 'দূর হ্যায় সুখ কা গাঁও' ছবির শুটিং করতে। তখন সেপ্টেম্বর মাস, ঢাকা প্রেসক্লাবে আমার প্রদর্শনী চলছিল। তিনি প্রদর্শনীতে এসে আমাকে বললেন, 'বশীর, আমি লাহোর আর্ট কাউন্সিলের সেক্রেটারি হচ্ছি, তোমাকে আমন্ত্রণ জানাব, তুমি লাহোরে এসো।' ১৯৫৯ সালের শেষের দিকে আমি লাহোরে গেলাম। দুই বছর ছিলাম। ১৯৬১ সালে ফয়েজ ভাইকে বলেছিলাম, ফয়েজ ভাই, আমার নাম হয় না কেন? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, 'বশীর, তুমি নামের পেছনে ছুটো না, নাম তোমার পেছনে ছুটবে।' এটাও আমার একটা শিক্ষা। তিনি আমাকে লাহোর থেকে যেতে বলেছিলেন। আমি থাকিনি। ১৯৫৫ সাল থেকে নিয়মিতভাবে আধুনিকশৈলীতে ছবি অাঁকা শুরু করি। ফলে আমার মধ্যে এক ধরনের অহংবোধ ছিল। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন আমার বাসায় এলেন কাজ দেখতে। যখন রিকশা করে ফিরছি, তখন জেলখানার সামনে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বলেছিলেন, 'তুমি ভালো কাজ কর, কিন্তু তুমি একাই ভালো কাজ কর না। আমরাও অাঁকি।' তারপর বললেন, 'এমনভাবে নিজেকে তৈরি কর, যাতে অন্যের প্রশংসা শুনে হাসবে। অন্যের সমালোচনাতেও শুধু হাসবে।' কথাগুলো হৃদয়ে নিতে আমার ১০ বছর লেগেছিল। এখন আমি প্রশংসাতেও হাসি, সমালোচনা শুনলেও হাসি।
বাংলার মন্দির টেরাকোটা নিয়ে আপনি গবেষণা করেছেন। একজন শিল্পী হিসেবে ইতিহাসের মতো বিষয়ে গবেষণায় আগ্রহী হলেন কীভাবে?
১৯৮০ সালে যখন বাংলাদেশ সরকার ও শিল্পকলা একাডেমি আমাকে জাপানের ফুকোকা সিটিতে একটি সেমিনারে পাঠাল। সেখানে আমার ইন্টারপ্রেটার সুন্দরী তরুণীর দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম, সে কিন্তু হাত বাড়াল না। সে তাদের ঐতিহ্য অনুযায়ী মাথাটা ঝুঁকিয়ে নম্রভাবে আমাকে অভিবাদন জানাল। এটা আমাকে ভীষণভাবে আহত করল। আমার তখন ঈশপের গল্প মনে হলো। একটা কাক ময়ূরের পুচ্ছ পরে ছিল। সে কাকও হতে পারেনি, ময়ূরও হতে পারেনি। তখন আমার জানার ইচ্ছা হলো, আমি কে, আমি কি, কোত্থেকে এসেছি? এটি যখন আমার মাথায় ঢুকলো তখন দেখা গেল আমি আর কোনো ছবি অাঁকতে পারছি না। আমি ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত কোনো ছবি অাঁকিনি। ওই সময় আমি নিজেকে জানার জন্য হিন্দুদের বেদ, উপনিষদ ও বৌদ্ধদের ধর্মপদ প্রমুখ ধর্মীয় গ্রন্থ ছাড়াও ভারতের ইতিহাস, সামাজিক ইতিহাস, অর্থনৈতিক ইতিহাস, রাজনৈতিক ইতিহাস, হিন্দু ও বৌদ্ধশাস্ত্র, মনু, নারদ, বৃহস্পতি, অপস্টম্ভা, গৌতম, বশিষ্ঠ বেঠধায়ন ও বৌদ্ধদের জাতক, সুত্তবিভঙ্গ, মহাবর্গ, কুলবর্গ, ভিক্ষু ও ভিক্ষুনী বিভঙ্গ ও থেরগাথা ও বৌদ্ধমূত্র নিজেকে খোঁজার জন্য পড়া শুরু করলাম। ইচ্ছার বিরুদ্ধে ১৯৮৪ সালে একটি প্রদর্শনী করলাম। এরপর ১৯৮৮ সালে কয়েকটি ছবি অাঁকলাম। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৭ এ সাতটি বছরে আমি গবেষণা করলাম। ওই সময় একটি বই করি, মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশি সুলতান ও তৎকালীন সমাজ নামে একটি বই বের হয়।
আপনি তো জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান কারও শিল্পভাষা অনুসরণ করেননি।
শিল্পী হিসেবে জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসান কত বড় এটা সময় বিচার করবে। তবে শিক্ষক হিসেবে তারা অতুলনীয়। এই দুই শিক্ষকের কেউই চাইতেন না তাদের কেউ অনুকরণ করুক। আর পঞ্চাশের বাস্তবতায় আমার শিল্পভাষা সম্পর্কে বললে বলতে হবে, ফ্লোরেন্সে গিয়ে রেনেসাঁসের যে শিক্ষাটা পেয়েছিলাম সেখান থেকেই ইস্ট ও ওয়েস্টকে ব্লেন্ড করেছি আমি। প্রাচ্য হলো সীমিত রংয়ের ব্যবহার ও সমতল যেখানে অবয়ব রেখা দিয়ে সৃষ্টি। আর পাশ্চাত্যের কাজ হলো আলো-ছায়া সমন্বয়ে বাস্তবধর্মী ছবি, যেখানে সামনে-পেছনে বুঝানোর জন্য পারস্পেটিভ অর্থাৎ পরিপ্রেক্ষিতের প্রয়োগ। প্রাচ্যধারা ও পাশ্চাত্যশিল্পেও শিক্ষা নিয়ে আমি একটা চিত্রভাষা তৈরি করলাম। সুলতান ভাই [এস এম সুলতান] আমাকে বলেছিলেন, 'ইস্ট ও ওয়েস্টকে আপনি সার্থকভাবে ব্লেন্ড করতে পেরেছেন।'
শিক্ষিত লোকজন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে সম্মান করতেন একজন বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত রূপে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাকে জানতেন একজন ধর্মভীরু মুসলমান হিসেবে। এ ব্যাপারে আপনি কি বলেন?
তিনি ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। ঢাকায় যখন আমি নবকুমার ইনস্টিটিউশনে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র তখন স্কুলে দিপালীসহ বন্ধুদের সঙ্গে হোলি খেলতাম, বাড়িতে আতশবাজি পোড়াতাম। এ ব্যাপারে তাকে বিরূপ হতে দেখিনি। এমনকি যখন তিনি বগুড়ায় আযিযুুল হক কলেজের অধ্যক্ষ তখন হিন্দু ছাত্ররা তার হাতে আবির দিয়ে প্রণাম করত কিন্তু তিনি বিরক্ত হতেন না। তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে বাঙালি। তিনি যে বাঙালি তা বহুবার নানা সময়ে নানা ভাষণে লক্ষ করা যায়। ১৯১৮ সালে চট্টগ্রাম মুসলমান ছাত্র সম্মিলনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন, 'তোমরা কেবল ছাত্র নও, তোমরা বাঙালি। তোমরা বাঙালি মুসলমান। বাংলার আবহাওয়ায়, বাংলার মাটিতে বাংলার শস্যে, বাংলার ফলে তোমাদের দেহ গঠিত, পুষ্ট, বর্ধিত।' তিনি স্বপ্ন দেখতেন হিন্দু-মুসলমান মিলে এক বাঙালি জাতি। ১৯১৭ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মিলনীর দ্বিতীয় অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে সেই স্বপ্নের ইঙ্গিত পাই। তিনি বলেছিলেন, 'হিন্দু মুসলমান মিলিয়া বাঙালি জাতি গড়িয়া তুলিতে বহু অন্তরায় আছে। কিন্তু দূর ভবিষ্যতে হউক না কেন তাহা তো করিতেই হইবে। বাঙালি হিন্দু বাঙালি মুসলমান ব্যতীত চলিতে পারবে না। চিরকাল কি একভাবে যাবে? জগতের ইতিহাস পৃষ্ঠে কি হিন্দু-মুসলমান মিলিত বাঙালি জাতি, ফরাসি, ইংরেজ ইতালীয়, জার্মান, জাপানি প্রমুখ জাতির ন্যায় নাম রাখিতে পারিবে না? আশা কানে কানে গুঞ্জন করিয়া বলে, পারিবে।...' তার সেই স্বপ্ন আংশিকভাবে একাত্তরে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠা হলেও এখনো সমাজে সাম্প্রদায়িকতা রয়ে গেছে। এখনো জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মিলনভূমি হয়নি। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যখন ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলো তখন তিনি বগুড়া আযিযুল হক কলেজের অধ্যক্ষ। তার ছাত্র বামপন্থি অনুসারী কবি আতাউর রহমানকে তিনি বলেছিলেন এ যুগে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে না। আতাউর রহমান তার লেখা 'পাশ্চাতের নিত্য সহচর ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ' এই শিরোনামে লেখেন, '... পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম, স্যার আপনি বলেছিলেন এ যুগে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। ধর্মের ভিত্তিতে তো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলো। আমার কথা শোনার পর তিনি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকলেন। বললেন, 'হ্যাঁ পাকিস্তান হলো। কিন্তু একটা কথা জেনে রেখ- এ পাকিস্তান ২০/২৫ বছরের বেশি টিকবে না। দুই অংশের মধ্যকার এই দূরত্বের ব্যবধান, কোনো কিছু দিয়ে টিকিয়ে রাখা যাবে না। আমি এতদিন বেঁচে থাকব না, তোমরা থাকবে। একদিন আমার কথার সত্যতা তোমরা বুঝতে পারবে...।' ১৯২৮ সালের শেষে তিনি প্যারিসের সোরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট করার পর ১৯২৯ সালে তার প্রথমা কন্যা মহযূযা খাতুনের বিয়ের নিমন্ত্রণপত্রের ওপর লিখেছিলেন 'আল্লাহ জয়তু'। তা ছিল ওই সময়ে মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত ব্যতিক্রমধর্মী ব্যাপার। যখন তিনি রীতিমতো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে সক্রিয় ছিলেন তখনো ১৯৬২ সালে আমার বিয়ের কার্ডের ওপর প্রচলিত রীতি ও প্রথা অনুসরণ না করে লিখেছিলেন 'এক'। অর্থাৎ আল্লাহ্ এক, রাসূল এক। তার এই দৃঢ় বিশ্বাসের প্রতিফলন আমরা দেখি ধর্মের ভিত্তিতে সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে ঢাকার কার্জন হলে অনুষ্ঠিত ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের মূল সভাপতির ভাষণে আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয় এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকা জে-টি নেই। সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় তার সম্বন্ধে বলেছিলেন- 'ড. শহীদুল্লাহ এ যুগের একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি-তাহাকে আমরা একজন যুগনায়ক মুসলমান বাঙালি বলিয়া অভিবাদন করি। আন্তর্জাতিক মুসলমানদের খাতিরে তাহার সাধনায় বাঙালিত্বকে বিসর্জন দেন নাই। মুসলমান আদর্শ ও সাধনা এবং বাঙালির জীবন, এই দুইয়ের সমন্বয় তাহার চরিত্রে দেখা যায়।'
No comments