বিডিআর বিদ্রোহ- আদালতের রায় ও পর্যবেক্ষণ by এম সাখাওয়াত হোসেন
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রক্তক্ষয়ী
হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে তত্কালীন বিডিআরের (বাংলাদেশ রাইফেলস) বিদ্রোহের অতি
প্রতীক্ষিত বিচারের রায় ঘোষণা করা হয়েছে ৫ নভেম্বর।
ওই
বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত সদস্যদের, যাঁদের পরে চিহ্নিত করা হয়, বিচার করা
হয়েছিল দুই পর্বে। প্রথম পর্বে তত্কালীন সময়ে বিদ্যমান বিডিআর আইনে মূলত
বিদ্রোহের জন্য বিচার করে শাস্তি দেওয়া সম্পন্ন হয়েছিল বেশ আগেই। কিন্তু
বিডিআরের এই বিদ্রোহে যেসব সদস্য হত্যা, লুণ্ঠন এবং অগ্নিসংযোগের বিচার
পূর্বতন আইনে অপ্রতুল শাস্তির বিধানের কারণে বেসামরিক আদালতে করতে হয়েছিল,
যার কারণে লম্বা সময়ের প্রয়োজন হয়। এই বিদ্রোহের পরপরই কারণ চিহ্নিত করে
প্রকৃত ঘটনার প্রেক্ষাপট উদ্ধার করার জন্য একটি বেসামরিক ও সামরিক তদন্ত
করা হলেও ওই দুই তদন্তের বিবরণ বিভিন্ন কারণে জনসমক্ষে আসেনি। যার কারণে
বহু প্রশ্নের উত্তর আজও পাওয়া যায়নি। অবশ্য এ বিষয়টি বাংলাদেশে নতুন নয়।
যা-ই হোক, বেসামরিক বিশেষ আদালতে যে বিচার হয়, তার রায়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিচারের মুখোমুখি করা হয় ৮৪৬ জন বিভিন্ন র্যাঙ্কের সদস্যকে। ওই বিচারের রায়ে মোট ১৫২ জনকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২৫৬ জনকে ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ঘোষণা করা হয়। এবং ২৭৭ জনের কোনো সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়নি বিধায় খালাস দেওয়া হয়েছে; যদিও তথ্যে প্রকাশ যে বিস্ফোরক দ্রব্যাদি লুট এবং ব্যবহার করার দায়ে যে অভিযোগ রয়েছে, তার বিচার এখনো শুরু হয়নি।
এই বিচারকার্যের তদন্ত থেকে রায় ঘোষণা পর্যন্ত সময় লেগেছে প্রায় চার বছর। এত বড় এবং এতজনের বিচার এত অল্প সময়ে বেসামরিক আদালতে শেষ করার মতো ঘটনা বিশ্বে বিরল। এই বিচারে নিহত কর্মকর্তা এবং অন্যদের পরিবারের সিংহভাগ স্বস্তি প্রকাশ করেছেন বলে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। তবে এই রায় এই বিচারের প্রথম ধাপ মাত্র। এর সমাপ্তি হবে উচ্চতর আদালতে আপিল নিষ্পত্তির মাধ্যমে। এরই মধ্যে প্রায় সব অভিযুক্ত ব্যক্তির আইনজ্ঞরা আপিল করবেন বলে মতামত দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে এ রায় কার্যকর করতে বেশ সময় লাগবে বলে মনে হয়।
যদিও বিচারের বিস্তারিত নথি পাওয়া যায়নি, যার পরিধি প্রায় ১৭ হাজার পৃষ্ঠা বলে প্রকাশিত, তথাপি বিচারের রায় ঘোষণার প্রাক্কালে আদালত বেশ কিছু পর্যবেক্ষণের উল্লেখ করেছেন। এসব পর্যবেক্ষণ অতি সাধারণ ঘটে যাওয়া অপরাধ অথবা সন্ত্রাসের বিচারের প্রেক্ষাপটে নয়, বরং এমন একটি ঘটনার বিচারের পরিপ্রেক্ষিতে, যার সঙ্গে দেশের প্রধান আধা সামরিক বাহিনী, সামরিক বাহিনীর তথা রাষ্ট্রের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের ভবিষ্যত্ করণীয়র সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত।
আদালতের পর্যবেক্ষণে অর্থনৈতিক বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে, যার মধ্যে বহু সময় ধরে চলা অপারেশন ‘ডাল-ভাত’ কর্মসূচিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এই কর্মসূচি শুরু হয়েছিল বিগত সরকারের শেষ সময়ে এবং চলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর এবং বর্তমান সরকারের সময়ের এক মাস মেয়াদে। এই কার্যক্রম প্রায় স্থায়ী রূপ নিয়েছিল। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ‘বিডিআর শপ’ স্থাপন করা হয়েছিল। সবচেয়ে দুঃখজনক যে এসব কাজের জন্য চাকরিরত বিডিআর জওয়ানদের নিয়োজিত করা হয়েছিল। প্রায় দুই বছরের ওপরে এসব কাজে নিয়োজিত জওয়ানেরা তাঁদের আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। তদুপরি এসব দোকান চালাতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের মতের, এমনকি রাজনৈতিক মতাদর্শের ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্যদের জন্য ক্ষতিকর বিবেচিত হয় এবং এখন প্রমাণিত যে, তেমনটাই হয়েছিল। এসব সদস্যদের বেশির ভাগই ইউনিফর্মের এবং সৈনিক হওয়ার গর্ব হারিয়ে ফেলেছিলেন। তথ্যে যত দূর প্রকাশিত হয়েছে, তাতে প্রতীয়মান যে এ কাজের জন্য সৈনিকদের যে অতিরিক্ত ভাতা দেওয়ার কথা ছিল, তা নিয়েও অসন্তোষ ছিল বিডিআর জওয়ানদের মধ্যে।
অপারেশন ডাল-ভাত ছাড়াও আরও কয়েকটি অর্থনৈতিক বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে পর্যবেক্ষণে। এর মধ্যে একটি জাতিসংঘ মিশনে আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য পাঠানো। এখানেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ছিল বলে প্রতীয়মান। জাতিসংঘ মিশনে, বিশেষভাবে সামরিক বাহিনী এবং পুলিশের প্রয়োজনই পড়ে। দেশের আধা সামরিক বাহিনী, বিশেষ করে বিডিআর বা বর্তমান বিজিবিকে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ খুব একটা যে নেই, তার ব্যাখ্যা সরকার বা মন্ত্রণালয় আদৌ দিয়েছে কি না, জানা যায়নি। যে কারণে মাত্র একবার অন্য বাহিনীর সঙ্গে, এ ক্ষেত্রে পুলিশের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে কিছু বিডিআর সদস্যকে পাঠানো হয়েছিল এবং সংগত কারণেই অন্তর্ভুক্তি বন্ধ হয়ে যায়। এ বিষয়ে বিডিআরকে স্পষ্টভাবে অবহিত করার দায়িত্ব ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল কি না, জানা যায়নি। এ দাবি ভবিষ্যতেও উত্থাপিত হতে পারে।
আদালতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হলো গোয়েন্দা ব্যর্থতার। আদালতের ভাষায় বিডিআরের এ ধরনের বিদ্রোহ সংঘটন ‘গোয়েন্দা ব্যর্থতার এক বিশেষ নজির’। আদালতের এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত না হওয়ার উপায় নেই। এই বিদ্রোহ এবং হত্যাযজ্ঞ এমন সময় সংঘটিত হয়, যখন পিলখানায় বিডিআর সপ্তাহের উত্সব চলছিল। আগের দিন আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজে প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভা এবং সামরিক ও বেসামরিক বিশেষ ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। পরের দিন মহাপরিচালকের দরবার এবং রাতে বিডিআরের নৈশভোজ ছিল, যেখানে মন্ত্রিসভার সদস্যসহ দেশের সামরিক ও বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কাজেই ওই সময়ে শুধু বিডিআরের গোয়েন্দাদেরও, যাঁদের পরিধি অত্যন্ত সীমিত, মাত্র দায়িত্বে ছিল—এমন ভাবা যায় না। এ ধরনের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে দেশের তাবত্ গোয়েন্দা সদস্যদের উপস্থিতি অবধারিত।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, ওই সব দায়িত্বপূর্ণ সংস্থা আগাম তথ্য দিতে কেন ব্যর্থ হয়েছিল, আদালত উদাহরণ হিসেবে ঘটনার চার দিন আগে যে লিফলেট বিতরণের কথা তুলেছেন, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই লিফলেটের বিষয় দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তিদের কাছে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গোচরীভূত করা হয়েছিল কি না, তা সাধারণ জনগণের জানার উপায় নেই। ওই লিফলেটকে কতখানি গুরুত্ব দিয়ে দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ব্যবস্থা নিয়েছিল, তা নিরূপণ হয়েছে কি না, জানা যায়নি। শুধু নিরূপণই নয়, কর্তব্যে গাফিলতি হয়ে থাকলে তার কোনো প্রতিকার করা হয়েছে কি না, তাও জানা যায়নি। হয়তো আদালতের পূর্ণ বিবরণে এ বিষয়ে আরও বিশদ তথ্য থাকতে পারে।
আমাদের দেশে এর আগে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার আগাম তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। বিডিআর বিদ্রোহ ছিল ব্যর্থতার চরম দৃষ্টান্ত। এমনটা আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণেও বলেছেন। দেশে বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে। রয়েছে প্রতিটি বাহিনীর নিজস্ব গোয়েন্দা বিভাগ, যার তথ্যও জাতীয় পর্যায়ে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। তবে এসব সংস্থার ভেতরে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। প্রয়োজন রয়েছে সমন্বয় করার জন্য একটি শীর্ষ সংগঠনের। আরও প্রয়োজন পেশাদারত্ব বাড়ানোর। জাতীয় নিরাপত্তার অন্যতম অঙ্গ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত না রাখতে পারায় গোয়েন্দা ব্যর্থতার মুখোমুখি অতীতেও হতে হয়েছে, হয়তো ভবিষ্যতেও হতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে অবশ্যই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।
আদালতের পর্যবেক্ষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পৃক্ততার কথা। এর যত্সামান্য ব্যাখ্যা দিয়ে রায়ের আগে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে হেয়প্রতিপন্ন করতে এবং সামরিক বাহিনীতে যোগদান নিরুত্সাহিত করতে এমনটি করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এ ধরনের পর্যবেক্ষণ আদালত নিশ্চয়ই তাঁর সামনে উত্থাপিত সাক্ষীসাবুদ এবং বিভিন্ন নথিপত্র ইত্যাদির আলোকেই করেছেন। বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। এ ধরনের রক্তাক্ত বিদ্রোহের পেছনে আরও কোনো কারণ ছিল কি না, তা জানা যায়নি। এই বিদ্রোহের মূল হোতাদের মধ্যে আরও ২০ জন সদস্য এখনো পলাতক, যাঁদের হদিস আজও পাওয়া যায়নি। এসব পলাতক অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করার তত্পরতা আরও জোরদার করে গ্রেপ্তার করতে পারলে হয়তো তাঁদের অধিক সম্পৃক্ততার কথা বিশদভাবে জানা যেত।
যা-ই হোক, আদালতের পর্যবেক্ষণগুলো অতীব গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপত্তাবিষয়ক বিভিন্ন থিঙ্ক ট্যাংকের গবেষণার বিষয় হতে পারে এসব পর্যবেক্ষণ। কারণ, এই বিদ্রোহ আমাদের সামরিক ও জাতীয় নিরাপত্তাকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে। কাজেই এ ঘটনা থেকে শিক্ষা এবং ভবিষ্যতের করণীয় নির্ণয় করা উচিত হবে।
এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক
hhintlbd@yahoo.com
No comments