‘জানালাটা একটু খোলো...’by রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী
এলিয়ট ওয়াইনবার্গার, খালেদ সরকার |
এলিয়ট ওয়াইনবার্গার—কবি, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও অনুবাদক। সাহিত্যিক প্রবন্ধ ছাড়াও রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখেছেন মাঝেমধ্যে। নিজেকে নিউইয়র্কের মানুষ বলে পরিচয় দিতেই ভালোবাসেন। এবারের হে উৎসবে তিনি এসেছিলেন বাংলাদেশে। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী
টরফিক উম মুনীর চৌধুরী: বাংলাদেশে স্বাগত। এবারের ‘হে ফেস্টিভ্যাল’ উপলক্ষে এ দেশে এসে আপনার কেমন লাগল?
এলিয়ট ওয়াইনবার্গার: ভীষণ ভালো। এবারই প্রথম বাংলাদেশে আসা। যদিও খুব একটা কিছু দেখার সুযোগ হলো না এ যাত্রায়। ভেবেছিলাম, দুই সপ্তাহ থাকব, বেড়াব। কিন্তু আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ায় এবং এখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিও অনুকূলে নয় বিধায় আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমি আবার আসব। সেই ১৯৭০ সাল থেকেই তো ভারতে আসছি-যাচ্ছি। হিসাব করলে দেখা যাবে, সব মিলিয়ে প্রায় তিন বছরের মতো সময় পার করেছি ভারতবর্ষে।
রফিক: বিচিত্রমুখী বিষয় নিয়ে লিখেছেন আপনি, বিশেষ করে অন্য পাড়, অন্য দুনিয়াকে নিয়ে (পশ্চিমা জগতের বাইরের) আপনার লেখালেখি চোখে পড়ার মতো। এই অন্য দুনিয়ার প্রতি আপনার আকর্ষণ এত কেন?
এলিয়ট: ব্যক্তিগত প্রেরণা থেকেই এসব লেখালেখি। বলতে পারো, আমার স্বভাবটাই ও রকম, অন্য দুনিয়া আমাকে টানে। আমার ভেতরের কিছু একটা আমাকে ওদিকটায় নিয়ে যায়। সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধগুলো লিখি ঔৎসুক্য থেকে, নিয়মিতভাবে। রাজনৈতিক প্রবন্ধ খুব একটা লেখা হয় না, শুধু রেগে গেলেই সেগুলো লিখি, যেমনটা লিখেছিলাম ইরাকযুদ্ধের সময়।
রফিক: বিশ্বসাহিত্যের পাঠ ও অনুবাদের মধ্য দিয়ে আমাদের বাংলা সাহিত্য সঞ্জীবিত হবে—এমনটা বলা কতটা সঠিক?
এলিয়ট: পুরোপুরি ঠিক। যেকোনো জাতীয় সাহিত্যের প্রসঙ্গেই এটা নির্ভুলভাবে খাটে। আসলে কোনো জাতীয় সাহিত্যই সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়।
রফিক: তবে এ ক্ষেত্রে যোগাযোগের সেতুটা তো অনুবাদকই তৈরি করেন। একটি সাংস্কৃতিক পটভূমিকে ভিন্ন একটি সাংস্কৃতিক পটভূমিতে পৌঁছে দেওয়া সত্যিই কি এক বাস্তব প্রকল্প? এ বিষয়ে কী মনে হয় আপনার?
এলিয়ট: কেন নয়? আজকের বাস্তবতায় অনুবাদ বা তরজমাহীন বিশ্বের কথা ভাবিই বা কী করে। অনেকে বলেন, কবিতার তরজমা সম্ভব নয়। উদ্ভট ধারণা। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এজরা পাউন্ড চীনা কবিতার তরজমা করেছিলেন ইংরেজিতে কিংবা প্রসঙ্গক্রমে নেরুদার কথাও বলা যায়, যিনি রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার অনুকরণে লিখেছিলেন ‘এন মি সিয়েলো এল ক্রেপুসকুলো’ শীর্ষক কবিতাটি (বাংলায় ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’)। নেরুদা কী সুন্দর করে মালা গাঁথলেন রবীন্দ্রনাথের ফুলস্তবক দিয়ে। কী অসম্ভব সহজতায় এস্পানিয়োলে মিশে গেল বাংলা। আমি বলব, সরাসরি এস্পানিয়োল থেকে বাংলায় যেকোনো অনুবাদ অনেক সহজ ও সুন্দর হবে অলংকার ও শৈলীগত কারণে। এস্পানিয়োল থেকে ইংরেজিতে এটা কিছুটা মুশকিল, ওই একই কারণে।
রফিক: অনুবাদ কেন গুরুত্বপূর্ণ?
এলিয়ট: অনুবাদের কল্যাণেই আজ তুমি অন্য দেশ, অন্য ভুবন, অন্য সংস্কৃতির আলো, হাওয়া, জল ও মাটির স্পর্শের ও ঘ্রাণের স্বাদ পেতে পারো। নিজেকে নিজের ঘরে আটকে রাখবে কেন? জানালাটা একটু খোলো, ভিনদেশের হাওয়া আসুক, তোমার জানার, শোনার দিগন্ত বিস্তৃত হোক। আমার মনে হয়, অনুবাদ এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ।
রফিক: বিশ্বস্ত অনুবাদ বলতে কী বোঝায়? ইমেজ, ছন্দ, অনুরণন, উচ্চারণ, ধ্বনি—কবিতার শরীরের এ বিষয়গুলোকে ভাষাগত সীমানা অতিক্রম করে লক্ষ্য-ভাষায় উপস্থিত করা যায় কি?
এলিয়ট: অনুবাদকে ঘিরে অনেক আজেবাজে, ক্লিশে বক্তব্য আমরা হরহামেশাই শুনি। অনুবাদক মানেই বিশ্বাসঘাতক—এ-জাতীয় কথাবার্তায় আমার আগ্রহ নেই। মূল টেক্সটের অর্থটি ঠিকটাক বজায় রেখে লক্ষ্য-ভাষায় টেক্সটিকে পাঠযোগ্য করে তোলাই অনুবাদকের প্রধান কাজ। কবিতার অনুবাদের ক্ষেত্রে দেখতে হবে, এটি কবিতা হয়ে উঠল কি না। এ ক্ষেত্রে অনুবাদকের পাঠের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনে সংযোজন-বিয়োজন হতেই পারে, তাতে কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু মূল কবি যেন উপস্থিত থাকেন, অনুবাদক নিজেই প্রবল হয়ে উঠলে সেটা অনুবাদের জন্য ক্ষতিকর।
রফিক: কবিতার অনুবাদে যা হারিয়ে যায়, তা কবিতাই—এ রকম বলেছিলেন রবার্ট ফ্রস্ট। বিষয়টি নিয়ে আপনার অভিমত...
এলিয়ট: না। কবিতা থেকে যায়, হারায় না; বরং আমরা কিছু পাই। অনুবাদ কোনো ক্লোন নয়। মূল ভাষার কবিতার এক ভিন্ন পাঠ হলো অনুবাদ। কবিতার জন্য প্রয়োজন পাঠকের। এক ভাষার কবিতা অনুবাদের মধ্য দিয়ে পৌঁছায় ভিন্ন ভাষার হাজার হাজার পাঠকের কাছে। সে রকম না হলে তো রবীন্দ্রনাথ থেকে যেতেন শুধু বাঙালি পাঠকের কাছেই আর নেরুদা থেকে যেতেন শুধুই এস্পানিয়োল-ভাষীদের কাছে। অনুবাদ মানেই একটি নতুন টেক্সট, ভিন্ন ভাষায় একটি সৃষ্টিকর্ম।
রফিক: আপনি অনুবাদকর্মে আগ্রহী হলেন কেন?
এলিয়ট: আমি হাইস্কুলের পর আর লেখাপড়া করিনি। কবিতা লিখব বলেই কবিতার অনুবাদে আমার হাতেখড়ি হয়। অনুবাদ আমায় অনেক কিছু শিখিয়েছে, দিয়েছে। আমার জীবন অনুবাদের ফসল। অনুবাদ করতে করতেই আমি লিখতে শিখেছি, লেখক হয়েছি, হয়েছি কবি।
রফিক: একালের অন্যতম প্রধান বাঙালি কবি ও গদ্যকার শঙ্খ ঘোষ কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘পোয়েট্রি ইজ অ্যা স্টেট অব মাইন্ড’—এ কথার সূত্র ধরে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
এলিয়ট: আমি বলব, ‘পোয়েট্রি ইজ অ্যান এক্সপ্রেশন অব অ্যা স্টেট অব মাইন্ড।’
রফিক: আপনি ওক্তাবিয়ো পাসের কাব্যসমগ্র ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। তাঁর কবিতার অনুবাদ কবে, কীভাবে শুরু করলেন? কেনই বা উদ্বুদ্ধ হলেন তাঁর কবিতার অনুবাদে?
এলিয়ট: আমার বয়স তখন ১৩। আমি প্রত্নতত্ত্ববিদ হতে চেয়েছিলাম। মেসো-আমেরিকার মাইয়া, আজতেক সভ্যতার প্রতি দুর্মর আকর্ষণ ছিল আমার। একটি পাঠাগারে কনকোয়েস্ট অব মেহিকো শিরোনামের একটি বই পড়তে গিয়ে একটি প্যামফ্লেটে ওক্তাবিয়োর ‘পিয়েদ্রা দে সোল’ (‘সূর্যশিলা’) কবিতাটি পাই এবং তৎক্ষনাৎ পড়ে ফেলি। আমার জীবনকে আমূল বদলে দেয় এ কবিতা। হাইস্কুলে পড়ার সময়েই ওক্তাবিয়োর কবিতা অনুবাদ করতে শুরু করি। ১৮ বছর বয়সে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়, যিনি ওক্তাবিয়োকে চিনতেন। তাঁর সূত্রে ওক্তাবিয়োর কাছে আমার অনুবাদ করা কয়েকটি কবিতা গিয়ে পৌঁছায়। শুরুটা এ রকম। তাঁর গদ্যকবিতার সংকলন আগিলা ও সোল? (ইগল কিংবা সূর্য?) আমার করা প্রথম অনুবাদগ্রন্থ, যা বেরোয় ১৯৬৭ সালে।
রফিক: বোর্হেসের প্রবন্ধ অনুবাদ করেছেন আপনি। কখনো কি তাঁর গল্প বা কবিতা অনুবাদ করেছেন?
এলিয়ট: না। আমার কাছে তাঁর প্রবন্ধই সবচেয়ে ভালো লাগে। আমি তাঁর কবিতার ভক্ত নই।
রফিক: আপনার প্রিয় কবি কে?
এলিয়ট: এজরা পাউন্ড, যিনি চীনা কবিতার অনুবাদের মাধ্যমে ইংরেজি সাহিত্যকে সঞ্জীবিত করেছেন।
রফিক: বর্তমানে কী কাজ করছেন?
এলিয়ট: সমসময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবি পেই তাওয়ের সঙ্গে কাজ করছি। চীনা একটি দুরূহ ভাষা, যা আমি শিখেছিলাম ৩০ বছর বয়সে। এখন পেই তাওয়ের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে চীনা ভাষার অন্দর-বাহির বোঝার চেষ্টা করছি।
রফিক: বাংলাদেশের কোনো সাহিত্য পড়েছেন কি?
এলিয়ট: না। বেঙ্গল লাইটস থেকে সদ্য প্রকাশিত হাসান আজিজুল হকের থ্রি স্টোরিজ উপহার হিসেবে পেলাম। এবার পড়ার পালা। এ উৎসবে ঢাকা ট্রান্সলেশন সেন্টারের যাত্রা শুরু হলো। ভবিষ্যতে এই প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আরও সাহিত্য পড়তে পারব, সে আশা রাখি।
টরফিক উম মুনীর চৌধুরী: বাংলাদেশে স্বাগত। এবারের ‘হে ফেস্টিভ্যাল’ উপলক্ষে এ দেশে এসে আপনার কেমন লাগল?
এলিয়ট ওয়াইনবার্গার: ভীষণ ভালো। এবারই প্রথম বাংলাদেশে আসা। যদিও খুব একটা কিছু দেখার সুযোগ হলো না এ যাত্রায়। ভেবেছিলাম, দুই সপ্তাহ থাকব, বেড়াব। কিন্তু আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ায় এবং এখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিও অনুকূলে নয় বিধায় আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমি আবার আসব। সেই ১৯৭০ সাল থেকেই তো ভারতে আসছি-যাচ্ছি। হিসাব করলে দেখা যাবে, সব মিলিয়ে প্রায় তিন বছরের মতো সময় পার করেছি ভারতবর্ষে।
রফিক: বিচিত্রমুখী বিষয় নিয়ে লিখেছেন আপনি, বিশেষ করে অন্য পাড়, অন্য দুনিয়াকে নিয়ে (পশ্চিমা জগতের বাইরের) আপনার লেখালেখি চোখে পড়ার মতো। এই অন্য দুনিয়ার প্রতি আপনার আকর্ষণ এত কেন?
এলিয়ট: ব্যক্তিগত প্রেরণা থেকেই এসব লেখালেখি। বলতে পারো, আমার স্বভাবটাই ও রকম, অন্য দুনিয়া আমাকে টানে। আমার ভেতরের কিছু একটা আমাকে ওদিকটায় নিয়ে যায়। সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধগুলো লিখি ঔৎসুক্য থেকে, নিয়মিতভাবে। রাজনৈতিক প্রবন্ধ খুব একটা লেখা হয় না, শুধু রেগে গেলেই সেগুলো লিখি, যেমনটা লিখেছিলাম ইরাকযুদ্ধের সময়।
রফিক: বিশ্বসাহিত্যের পাঠ ও অনুবাদের মধ্য দিয়ে আমাদের বাংলা সাহিত্য সঞ্জীবিত হবে—এমনটা বলা কতটা সঠিক?
এলিয়ট: পুরোপুরি ঠিক। যেকোনো জাতীয় সাহিত্যের প্রসঙ্গেই এটা নির্ভুলভাবে খাটে। আসলে কোনো জাতীয় সাহিত্যই সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়।
রফিক: তবে এ ক্ষেত্রে যোগাযোগের সেতুটা তো অনুবাদকই তৈরি করেন। একটি সাংস্কৃতিক পটভূমিকে ভিন্ন একটি সাংস্কৃতিক পটভূমিতে পৌঁছে দেওয়া সত্যিই কি এক বাস্তব প্রকল্প? এ বিষয়ে কী মনে হয় আপনার?
এলিয়ট: কেন নয়? আজকের বাস্তবতায় অনুবাদ বা তরজমাহীন বিশ্বের কথা ভাবিই বা কী করে। অনেকে বলেন, কবিতার তরজমা সম্ভব নয়। উদ্ভট ধারণা। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এজরা পাউন্ড চীনা কবিতার তরজমা করেছিলেন ইংরেজিতে কিংবা প্রসঙ্গক্রমে নেরুদার কথাও বলা যায়, যিনি রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার অনুকরণে লিখেছিলেন ‘এন মি সিয়েলো এল ক্রেপুসকুলো’ শীর্ষক কবিতাটি (বাংলায় ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’)। নেরুদা কী সুন্দর করে মালা গাঁথলেন রবীন্দ্রনাথের ফুলস্তবক দিয়ে। কী অসম্ভব সহজতায় এস্পানিয়োলে মিশে গেল বাংলা। আমি বলব, সরাসরি এস্পানিয়োল থেকে বাংলায় যেকোনো অনুবাদ অনেক সহজ ও সুন্দর হবে অলংকার ও শৈলীগত কারণে। এস্পানিয়োল থেকে ইংরেজিতে এটা কিছুটা মুশকিল, ওই একই কারণে।
রফিক: অনুবাদ কেন গুরুত্বপূর্ণ?
এলিয়ট: অনুবাদের কল্যাণেই আজ তুমি অন্য দেশ, অন্য ভুবন, অন্য সংস্কৃতির আলো, হাওয়া, জল ও মাটির স্পর্শের ও ঘ্রাণের স্বাদ পেতে পারো। নিজেকে নিজের ঘরে আটকে রাখবে কেন? জানালাটা একটু খোলো, ভিনদেশের হাওয়া আসুক, তোমার জানার, শোনার দিগন্ত বিস্তৃত হোক। আমার মনে হয়, অনুবাদ এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ।
রফিক: বিশ্বস্ত অনুবাদ বলতে কী বোঝায়? ইমেজ, ছন্দ, অনুরণন, উচ্চারণ, ধ্বনি—কবিতার শরীরের এ বিষয়গুলোকে ভাষাগত সীমানা অতিক্রম করে লক্ষ্য-ভাষায় উপস্থিত করা যায় কি?
এলিয়ট: অনুবাদকে ঘিরে অনেক আজেবাজে, ক্লিশে বক্তব্য আমরা হরহামেশাই শুনি। অনুবাদক মানেই বিশ্বাসঘাতক—এ-জাতীয় কথাবার্তায় আমার আগ্রহ নেই। মূল টেক্সটের অর্থটি ঠিকটাক বজায় রেখে লক্ষ্য-ভাষায় টেক্সটিকে পাঠযোগ্য করে তোলাই অনুবাদকের প্রধান কাজ। কবিতার অনুবাদের ক্ষেত্রে দেখতে হবে, এটি কবিতা হয়ে উঠল কি না। এ ক্ষেত্রে অনুবাদকের পাঠের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনে সংযোজন-বিয়োজন হতেই পারে, তাতে কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু মূল কবি যেন উপস্থিত থাকেন, অনুবাদক নিজেই প্রবল হয়ে উঠলে সেটা অনুবাদের জন্য ক্ষতিকর।
রফিক: কবিতার অনুবাদে যা হারিয়ে যায়, তা কবিতাই—এ রকম বলেছিলেন রবার্ট ফ্রস্ট। বিষয়টি নিয়ে আপনার অভিমত...
এলিয়ট: না। কবিতা থেকে যায়, হারায় না; বরং আমরা কিছু পাই। অনুবাদ কোনো ক্লোন নয়। মূল ভাষার কবিতার এক ভিন্ন পাঠ হলো অনুবাদ। কবিতার জন্য প্রয়োজন পাঠকের। এক ভাষার কবিতা অনুবাদের মধ্য দিয়ে পৌঁছায় ভিন্ন ভাষার হাজার হাজার পাঠকের কাছে। সে রকম না হলে তো রবীন্দ্রনাথ থেকে যেতেন শুধু বাঙালি পাঠকের কাছেই আর নেরুদা থেকে যেতেন শুধুই এস্পানিয়োল-ভাষীদের কাছে। অনুবাদ মানেই একটি নতুন টেক্সট, ভিন্ন ভাষায় একটি সৃষ্টিকর্ম।
রফিক: আপনি অনুবাদকর্মে আগ্রহী হলেন কেন?
এলিয়ট: আমি হাইস্কুলের পর আর লেখাপড়া করিনি। কবিতা লিখব বলেই কবিতার অনুবাদে আমার হাতেখড়ি হয়। অনুবাদ আমায় অনেক কিছু শিখিয়েছে, দিয়েছে। আমার জীবন অনুবাদের ফসল। অনুবাদ করতে করতেই আমি লিখতে শিখেছি, লেখক হয়েছি, হয়েছি কবি।
রফিক: একালের অন্যতম প্রধান বাঙালি কবি ও গদ্যকার শঙ্খ ঘোষ কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘পোয়েট্রি ইজ অ্যা স্টেট অব মাইন্ড’—এ কথার সূত্র ধরে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
এলিয়ট: আমি বলব, ‘পোয়েট্রি ইজ অ্যান এক্সপ্রেশন অব অ্যা স্টেট অব মাইন্ড।’
রফিক: আপনি ওক্তাবিয়ো পাসের কাব্যসমগ্র ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। তাঁর কবিতার অনুবাদ কবে, কীভাবে শুরু করলেন? কেনই বা উদ্বুদ্ধ হলেন তাঁর কবিতার অনুবাদে?
এলিয়ট: আমার বয়স তখন ১৩। আমি প্রত্নতত্ত্ববিদ হতে চেয়েছিলাম। মেসো-আমেরিকার মাইয়া, আজতেক সভ্যতার প্রতি দুর্মর আকর্ষণ ছিল আমার। একটি পাঠাগারে কনকোয়েস্ট অব মেহিকো শিরোনামের একটি বই পড়তে গিয়ে একটি প্যামফ্লেটে ওক্তাবিয়োর ‘পিয়েদ্রা দে সোল’ (‘সূর্যশিলা’) কবিতাটি পাই এবং তৎক্ষনাৎ পড়ে ফেলি। আমার জীবনকে আমূল বদলে দেয় এ কবিতা। হাইস্কুলে পড়ার সময়েই ওক্তাবিয়োর কবিতা অনুবাদ করতে শুরু করি। ১৮ বছর বয়সে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়, যিনি ওক্তাবিয়োকে চিনতেন। তাঁর সূত্রে ওক্তাবিয়োর কাছে আমার অনুবাদ করা কয়েকটি কবিতা গিয়ে পৌঁছায়। শুরুটা এ রকম। তাঁর গদ্যকবিতার সংকলন আগিলা ও সোল? (ইগল কিংবা সূর্য?) আমার করা প্রথম অনুবাদগ্রন্থ, যা বেরোয় ১৯৬৭ সালে।
রফিক: বোর্হেসের প্রবন্ধ অনুবাদ করেছেন আপনি। কখনো কি তাঁর গল্প বা কবিতা অনুবাদ করেছেন?
এলিয়ট: না। আমার কাছে তাঁর প্রবন্ধই সবচেয়ে ভালো লাগে। আমি তাঁর কবিতার ভক্ত নই।
রফিক: আপনার প্রিয় কবি কে?
এলিয়ট: এজরা পাউন্ড, যিনি চীনা কবিতার অনুবাদের মাধ্যমে ইংরেজি সাহিত্যকে সঞ্জীবিত করেছেন।
রফিক: বর্তমানে কী কাজ করছেন?
এলিয়ট: সমসময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবি পেই তাওয়ের সঙ্গে কাজ করছি। চীনা একটি দুরূহ ভাষা, যা আমি শিখেছিলাম ৩০ বছর বয়সে। এখন পেই তাওয়ের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে চীনা ভাষার অন্দর-বাহির বোঝার চেষ্টা করছি।
রফিক: বাংলাদেশের কোনো সাহিত্য পড়েছেন কি?
এলিয়ট: না। বেঙ্গল লাইটস থেকে সদ্য প্রকাশিত হাসান আজিজুল হকের থ্রি স্টোরিজ উপহার হিসেবে পেলাম। এবার পড়ার পালা। এ উৎসবে ঢাকা ট্রান্সলেশন সেন্টারের যাত্রা শুরু হলো। ভবিষ্যতে এই প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আরও সাহিত্য পড়তে পারব, সে আশা রাখি।
No comments