নির্বাচন- এ গ্যাঁড়াকল থেকে উত্তরণ কোন পথে? by বদিউল আলম মজুমদার
জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে জাতি হিসেবে
আমরা যেন মস্ত বড় গ্যাঁড়াকলের মধ্যে আটকে গেছি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও
মহাজোটের অধিকাংশ শরিক দল বলছে,
সংবিধানের আলোকে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই
নির্বাচন হতে হবে। পক্ষান্তরে বিএনপির নেতৃত্বে ১৮-দলীয় জোটের পক্ষ থেকে
সেই নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। প্রধান দুটি
রাজনৈতিক দল, তথা জোটের এ বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক অবস্থানের পরিণতি কী? এ
অবস্থা থেকে উত্তরণই বা কোন পথে?
বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা তিনটি দৃশ্যপটের সম্ভাবনা দেখতে পাই। প্রথমটি হলো, সবার অংশগ্রহণে যথাসময়ে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান। এ জন্য এখন প্রয়োজন হবে সংশ্লিষ্ট সবার সদিচ্ছা প্রদর্শন করা এবং সংলাপে বসে নির্বাচনের ব্যাপারে একটি ঐকমত্যে পৌঁছা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, যেন এই মুহূর্তে এ ধরনের ঐকমত্যে পৌঁছার জন্য অলৌকিক কিছু ঘটতে হবে। কিন্তু সবাইকে নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও কি গ্যাঁড়াকল থেকে মুক্ত হওয়া যাবে?
আমাদের আশঙ্কা যে এর মাধ্যমে গ্যাঁড়াকল থেকে হয়তো সাময়িকভাবে মুক্ত হওয়া যাবে, কিন্তু এর স্থায়ী সমাধান হবে না। কারণ, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় যেকোনো মূল্যে সংসদ নির্বাচনে জেতার এবং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার একধরনের সর্বাত্মক প্রতিযোগিতা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরাজমান। বস্তুত, দেশে নির্বাচনে হারার জন্য কেউ প্রস্তুত নন। নির্বাচনে হারা মানে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য নিপীড়ন-নিগ্রহ ও মামলা-হামলার শিকার হওয়া। পক্ষান্তরে, নির্বাচনে জেতার পুরস্কার হলো পাঁচ বছরের জন্য সরকারি কোষাগার ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিজ ও কোটারি স্বার্থে ফায়দা হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ লাভ করা। তাই আসন্ন নির্বাচনে পরাজিত দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যানের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ক্রমবর্ধমান বৈরী সম্পর্কের কারণে নির্বাচনের পরদিন থেকেই হরতাল ও সহিংসতার ঘটনাও ঘটতে পারে।
দ্বিতীয় দৃশ্যপট হতে পারে জোর করে মহাজোটের শরিক ও কিছু নামসর্বস্ব দল নিয়ে একটি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠান। প্রশাসন, সেনাবাহিনীসহ সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বাত্মকভাবে সহায়তা করলে এ ক্ষেত্রে সফলতার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টদের সহায়তা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সব নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব নাও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ব্যাপক সহিংসতা ঘটতে পারে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, সেই নির্বাচনী ফলাফল দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করবে না। এর কারণ হলো, একতরফা নির্বাচনে জাতিসংঘ ও অন্যান্য বিদেশি সংস্থা পর্যবেক্ষক নাও পাঠাতে পারে। দেশের অভ্যন্তরে ও দলান্ধ ব্যক্তিদের বাইরে অন্য নাগরিকদের কাছে এমন নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এ কারণে নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
আরেকটি কারণেও এ ধরনের নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করবে না; প্রধান বিরোধী দল বিএনপি গত সংসদ নির্বাচনে প্রায় ৩৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। কিন্তু গত কয়েক মাসে অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি-মনোনীত বিজয়ী মেয়ররা পেয়েছেন প্রদত্ত ভোটের ৫৭ শতাংশ এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পেয়েছেন প্রায় ৪০ শতাংশ। তাই অনেকের ধারণা, দেশের অধিকাংশ ভোটার এখন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পক্ষে। ফলে, বিএনপি ছাড়া সংসদ নির্বাচন হলে সেই নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হবে না, এমনকি অন্য সব দল অংশ নিলেও। কারণ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রধান মানদণ্ড হলো প্রতিযোগিতা।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আরেকটি মানদণ্ড হলো শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। কিন্তু একতরফা নির্বাচন কোনোভাবেই শান্তিপূর্ণ হবে না।
বিএনপি ছাড়া অনুষ্ঠিত নির্বাচন আরেকটি কারণে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এতে ভোটার উপস্থিতির সংখ্যা নগণ্য হওয়ার আশঙ্কাই বেশি, বিশেষত বিএনপি ও তার সহযোগীদের নির্বাচন প্রতিহত করার প্রচেষ্টার মুখে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ‘ব্যালট বক্স স্টাফিং’-এর মতো ভোট কারচুপিতে সহায়তা না করলে ক্ষমতাসীনেরা বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে।
প্রসঙ্গত, একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ী দলটির ক্ষমতায় টিকে থাকার পরিণতি হতে পারে চরম কর্তৃত্ববাদিতা। যেহেতু, সরকারের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ, তাই নির্বাচনের পরপরই বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে সরকার পতনের আন্দোলন শুরুর চেষ্টা করাই স্বাভাবিক, যে আন্দোলনে অনেক নাগরিকের সমর্থনও থাকতে পারে। এমনই পরিস্থিতিতে সরকার দমন-পীড়নের আশ্রয় নিতে পারে। এমনকি সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টায়ও লিপ্ত হতে পারে। ইতিহাসের শিক্ষা হলো, কর্তৃত্ববাদ দীর্ঘমেয়াদিভাবে টিকে থাকে না এবং এর ফলও ইতিবাচক হয় না।
বস্তুত, জবরদস্তিমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিণতি অমঙ্গলকর হতে বাধ্য। কারণ, একতরফা নির্বাচন-পরবর্তী অবস্থা হবে অস্থিতিশীল। অর্থাৎ, এমন অবস্থার পরিবর্তন হবেই, যদিও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না যে কত দ্রুত, কীভাবে ও কাদের মাধ্যমে তা ঘটবে। তবে এ ধরনের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সাধারণত ক্ষমতাসীনেরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হলে তারা প্রতিহিংসার শিকারও হতে পারে।
ক্ষমতাসীনদের জন্য একটি সম্ভাব্য ক্ষতির উৎস হবে তাদের সম্পর্কে অনেক নাগরিকের মনে চরম বিরূপ মনোভাব। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে জবরদস্তিমূলক নির্বাচন করলে তারা ইমেজ-সংকটে ভুগতে পারে, যা কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে না।
তৃতীয় দৃশ্যপটের ক্ষেত্রে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বাত্মক সহযোগিতা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হতে পারে। ব্যাপক ও ভয়াবহ সহিংসতা এবং তা সামাল দিতে সরকারের অপারগতার কারণেই তা হতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি নতুন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে আমরা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হবো।
ব্যাপক সহিংসতার মুখে নির্বাচন করতে না পারার একটি সম্ভাব্য পরিণতি হতে পারে ক্ষমতাসীনদের উদ্যোগে জরুরি অবস্থা জারি। তবে জরুরি অবস্থা জারির মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ সংরক্ষিত নাও হতে পারে। কারণ, তখন সংশ্লিষ্ট সবার লক্ষ্য থাকবে একটি শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফিরিয়ে আনা। এমতাবস্থায় ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় থাকা বা সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে।
জোর করে নির্বাচন করতে না পারার আরেকটি পরিণতি হতে পারে সামরিক হস্তক্ষেপ। ২০০৭ সালে, সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী থাকাকালে, সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটেছিল একটি সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের মাধ্যমে। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের পর সেই সুযোগ থাকছে না। তাই দেশব্যাপী ব্যাপক সহিংসতার মুখে সেনা হস্তক্ষেপ ঘটলে তা কোন দিকে মোড় নেয়, এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে এতে জটিলতা যে বাড়বে এবং তা যে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থের অনুকূলে যাবে না, এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলকেও মাশুল দিতে হতে পারে।
এটি স্পষ্ট যে বর্তমান পরিস্থিতিতে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে হাঁটা হবে ক্ষমতাসীনদের জন্য চরম আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এটি আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আবার খাদে ফেলে দিতে পারে। আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারে, এমনকি অনির্বাচিত ও অগণতান্ত্রিক শক্তির উত্থানও ঘটাতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলকেও মূল্য দিতে হতে পারে। তাই সংশ্লিষ্ট সবারই আজ শুভবুদ্ধির উদয় হওয়া আবশ্যক, যাতে সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা-সম্পর্কিত সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান এবং যথাসময়ে সবার অংশগ্রহণে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।
তবে সবার অংশগ্রহণে ও শান্তিপূর্ণভাবে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও আমরা রাহুমুক্ত হব না। এ জন্য প্রয়োজন হবে আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরেও আরও বৃহত্তর পরিসরে সংলাপ অনুষ্ঠান করা, কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা এবং নব্বইয়ের তিন জোটের রূপরেখার আদলে একটি ‘জাতীয় সনদ’ তৈরি ও স্বাক্ষর করা। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা-সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান, নির্বাচনকে নিরপেক্ষ ও অর্থবহ করার লক্ষ্যে একটি আচরণবিধি প্রণয়ন এবং নির্বাচন-পরবর্তী নতুন সরকারের করণীয় নির্ধারণই হতে পারে জাতীয় সনদের বিষয়বস্তু (প্রথম আলো, ২১ মে ২০১৩)। আশা করি, আমাদের রাজনীতিবিদেরা প্রজ্ঞার পরিচয় দেবেন এবং বিরাজমান স্থায়ী ও টেকসই সমাধানের কথা ভাববেন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা তিনটি দৃশ্যপটের সম্ভাবনা দেখতে পাই। প্রথমটি হলো, সবার অংশগ্রহণে যথাসময়ে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান। এ জন্য এখন প্রয়োজন হবে সংশ্লিষ্ট সবার সদিচ্ছা প্রদর্শন করা এবং সংলাপে বসে নির্বাচনের ব্যাপারে একটি ঐকমত্যে পৌঁছা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, যেন এই মুহূর্তে এ ধরনের ঐকমত্যে পৌঁছার জন্য অলৌকিক কিছু ঘটতে হবে। কিন্তু সবাইকে নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও কি গ্যাঁড়াকল থেকে মুক্ত হওয়া যাবে?
আমাদের আশঙ্কা যে এর মাধ্যমে গ্যাঁড়াকল থেকে হয়তো সাময়িকভাবে মুক্ত হওয়া যাবে, কিন্তু এর স্থায়ী সমাধান হবে না। কারণ, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় যেকোনো মূল্যে সংসদ নির্বাচনে জেতার এবং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার একধরনের সর্বাত্মক প্রতিযোগিতা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরাজমান। বস্তুত, দেশে নির্বাচনে হারার জন্য কেউ প্রস্তুত নন। নির্বাচনে হারা মানে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য নিপীড়ন-নিগ্রহ ও মামলা-হামলার শিকার হওয়া। পক্ষান্তরে, নির্বাচনে জেতার পুরস্কার হলো পাঁচ বছরের জন্য সরকারি কোষাগার ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিজ ও কোটারি স্বার্থে ফায়দা হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ লাভ করা। তাই আসন্ন নির্বাচনে পরাজিত দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যানের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ক্রমবর্ধমান বৈরী সম্পর্কের কারণে নির্বাচনের পরদিন থেকেই হরতাল ও সহিংসতার ঘটনাও ঘটতে পারে।
দ্বিতীয় দৃশ্যপট হতে পারে জোর করে মহাজোটের শরিক ও কিছু নামসর্বস্ব দল নিয়ে একটি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠান। প্রশাসন, সেনাবাহিনীসহ সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বাত্মকভাবে সহায়তা করলে এ ক্ষেত্রে সফলতার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টদের সহায়তা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সব নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব নাও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ব্যাপক সহিংসতা ঘটতে পারে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, সেই নির্বাচনী ফলাফল দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করবে না। এর কারণ হলো, একতরফা নির্বাচনে জাতিসংঘ ও অন্যান্য বিদেশি সংস্থা পর্যবেক্ষক নাও পাঠাতে পারে। দেশের অভ্যন্তরে ও দলান্ধ ব্যক্তিদের বাইরে অন্য নাগরিকদের কাছে এমন নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এ কারণে নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
আরেকটি কারণেও এ ধরনের নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করবে না; প্রধান বিরোধী দল বিএনপি গত সংসদ নির্বাচনে প্রায় ৩৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। কিন্তু গত কয়েক মাসে অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি-মনোনীত বিজয়ী মেয়ররা পেয়েছেন প্রদত্ত ভোটের ৫৭ শতাংশ এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পেয়েছেন প্রায় ৪০ শতাংশ। তাই অনেকের ধারণা, দেশের অধিকাংশ ভোটার এখন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পক্ষে। ফলে, বিএনপি ছাড়া সংসদ নির্বাচন হলে সেই নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হবে না, এমনকি অন্য সব দল অংশ নিলেও। কারণ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রধান মানদণ্ড হলো প্রতিযোগিতা।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আরেকটি মানদণ্ড হলো শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। কিন্তু একতরফা নির্বাচন কোনোভাবেই শান্তিপূর্ণ হবে না।
বিএনপি ছাড়া অনুষ্ঠিত নির্বাচন আরেকটি কারণে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এতে ভোটার উপস্থিতির সংখ্যা নগণ্য হওয়ার আশঙ্কাই বেশি, বিশেষত বিএনপি ও তার সহযোগীদের নির্বাচন প্রতিহত করার প্রচেষ্টার মুখে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ‘ব্যালট বক্স স্টাফিং’-এর মতো ভোট কারচুপিতে সহায়তা না করলে ক্ষমতাসীনেরা বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে।
প্রসঙ্গত, একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ী দলটির ক্ষমতায় টিকে থাকার পরিণতি হতে পারে চরম কর্তৃত্ববাদিতা। যেহেতু, সরকারের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ, তাই নির্বাচনের পরপরই বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে সরকার পতনের আন্দোলন শুরুর চেষ্টা করাই স্বাভাবিক, যে আন্দোলনে অনেক নাগরিকের সমর্থনও থাকতে পারে। এমনই পরিস্থিতিতে সরকার দমন-পীড়নের আশ্রয় নিতে পারে। এমনকি সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টায়ও লিপ্ত হতে পারে। ইতিহাসের শিক্ষা হলো, কর্তৃত্ববাদ দীর্ঘমেয়াদিভাবে টিকে থাকে না এবং এর ফলও ইতিবাচক হয় না।
বস্তুত, জবরদস্তিমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিণতি অমঙ্গলকর হতে বাধ্য। কারণ, একতরফা নির্বাচন-পরবর্তী অবস্থা হবে অস্থিতিশীল। অর্থাৎ, এমন অবস্থার পরিবর্তন হবেই, যদিও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না যে কত দ্রুত, কীভাবে ও কাদের মাধ্যমে তা ঘটবে। তবে এ ধরনের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সাধারণত ক্ষমতাসীনেরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হলে তারা প্রতিহিংসার শিকারও হতে পারে।
ক্ষমতাসীনদের জন্য একটি সম্ভাব্য ক্ষতির উৎস হবে তাদের সম্পর্কে অনেক নাগরিকের মনে চরম বিরূপ মনোভাব। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে জবরদস্তিমূলক নির্বাচন করলে তারা ইমেজ-সংকটে ভুগতে পারে, যা কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে না।
তৃতীয় দৃশ্যপটের ক্ষেত্রে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বাত্মক সহযোগিতা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হতে পারে। ব্যাপক ও ভয়াবহ সহিংসতা এবং তা সামাল দিতে সরকারের অপারগতার কারণেই তা হতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি নতুন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে আমরা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হবো।
ব্যাপক সহিংসতার মুখে নির্বাচন করতে না পারার একটি সম্ভাব্য পরিণতি হতে পারে ক্ষমতাসীনদের উদ্যোগে জরুরি অবস্থা জারি। তবে জরুরি অবস্থা জারির মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ সংরক্ষিত নাও হতে পারে। কারণ, তখন সংশ্লিষ্ট সবার লক্ষ্য থাকবে একটি শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফিরিয়ে আনা। এমতাবস্থায় ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় থাকা বা সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে।
জোর করে নির্বাচন করতে না পারার আরেকটি পরিণতি হতে পারে সামরিক হস্তক্ষেপ। ২০০৭ সালে, সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী থাকাকালে, সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটেছিল একটি সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের মাধ্যমে। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের পর সেই সুযোগ থাকছে না। তাই দেশব্যাপী ব্যাপক সহিংসতার মুখে সেনা হস্তক্ষেপ ঘটলে তা কোন দিকে মোড় নেয়, এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে এতে জটিলতা যে বাড়বে এবং তা যে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থের অনুকূলে যাবে না, এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলকেও মাশুল দিতে হতে পারে।
এটি স্পষ্ট যে বর্তমান পরিস্থিতিতে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে হাঁটা হবে ক্ষমতাসীনদের জন্য চরম আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এটি আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আবার খাদে ফেলে দিতে পারে। আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারে, এমনকি অনির্বাচিত ও অগণতান্ত্রিক শক্তির উত্থানও ঘটাতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলকেও মূল্য দিতে হতে পারে। তাই সংশ্লিষ্ট সবারই আজ শুভবুদ্ধির উদয় হওয়া আবশ্যক, যাতে সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা-সম্পর্কিত সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান এবং যথাসময়ে সবার অংশগ্রহণে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।
তবে সবার অংশগ্রহণে ও শান্তিপূর্ণভাবে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও আমরা রাহুমুক্ত হব না। এ জন্য প্রয়োজন হবে আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরেও আরও বৃহত্তর পরিসরে সংলাপ অনুষ্ঠান করা, কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা এবং নব্বইয়ের তিন জোটের রূপরেখার আদলে একটি ‘জাতীয় সনদ’ তৈরি ও স্বাক্ষর করা। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা-সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান, নির্বাচনকে নিরপেক্ষ ও অর্থবহ করার লক্ষ্যে একটি আচরণবিধি প্রণয়ন এবং নির্বাচন-পরবর্তী নতুন সরকারের করণীয় নির্ধারণই হতে পারে জাতীয় সনদের বিষয়বস্তু (প্রথম আলো, ২১ মে ২০১৩)। আশা করি, আমাদের রাজনীতিবিদেরা প্রজ্ঞার পরিচয় দেবেন এবং বিরাজমান স্থায়ী ও টেকসই সমাধানের কথা ভাববেন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments