মূল্যায়ন- তারিক আলির সঙ্গে এক বিকেল by আবদুল মান্নান
আমাদের যৌবনকালের একজন নায়ক দীর্ঘ প্রায় ৪৩ বছর পর বাংলাদেশে ঘুরে গেলেন।
এই নায়ক কোনো সিনেমার নায়ক নন, রাজনৈতিক অঙ্গনের নায়ক, পাকিস্তানের
বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক তারিক আলি।
ষাটের দশকে দুই পরাশক্তি সোভিয়েত
ইউনিয়ন আর যুক্তরাষ্ট্র প্রচণ্ড ঠান্ডা লড়াইয়ে ব্যস্ত। একদিন এক দেশ
পারমাণবিক বোমা ফাটায় তো আরেক দিন অন্য দেশ। তখন একটি প্রচলিত বিশ্বাস ছিল
যে যৌবনে সবাইকে মার্ক্সবাদে দীক্ষিত হতে হবে। ঢাকার স্টেডিয়াম মার্কেটের
দ্বিতীয় তলায় স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স চুটিয়ে বাংলায় মার্ক্সবাদী বই
বিক্রি করছে। কলকাতা থেকে এল নীহার কুমার সরকারের ছোটদের রাজনীতি আর ছোটদের
অর্থনীতি। বলা যেতে পারে, মার্ক্সিস্ট হওয়ার সহজ পাঠ।
ষাটের দশকের শেষের দিকে যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ তুঙ্গে, তখন প্রথমে আমাদের সামনে রাজনৈতিক নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হলেন উত্তর ভিয়েতনামের রাজনৈতিক গুরু হো চি মিন। তরুণদের সামনে তখন কিউবা আর দক্ষিণ আমেরিকার মার্ক্সিস্ট বিপ্লবী চে গুয়েভারা এক মহানায়ক। আজকের মতো ঘরে ঘরে তখন টেলিভিশন ছিল না। বিত্তবানদের বাড়িতে ছিল রেডিও। আর ছিল হাতে গোনা কয়েকটি খবরের কাগজ। হঠাৎ একদিন খবর এল, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্ররোচনায় পূর্ব বার্লিনের মাঝ বরাবর কাঁটাতারের বেড়া তুলে পুরো বার্লিন শহরটাকেই পূর্ব জার্মানি দুই ফালি করে দিয়েছে। সে এক লোমহর্ষক খবর বটে। শহর দুই ভাগ মানে পরিবার দুই ভাগ, জায়গা-জমিন-সম্পদ দুই ভাগ। ব্যাপারটা যেহেতু সোভিয়েত-মন্ত্রে দীক্ষিত পূর্ব জার্মানি করেছে, সেহেতু দেশের মার্ক্সবাদে দীক্ষিত ব্যক্তিরাও বেশ শিহরণ অনুভব করল। ঘটনা থেমে থাকল না; বছর না ঘুরতেই কাঁটাতারের বেড়া জায়গা করে দিল আস্ত একটা দেয়ালকে।
ভিয়েতনাম তো বটেই, যেখানেই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন, সেখানেই সোভিয়েত ইউনিয়নের মদদ। অ্যাঙ্গোলা, কিউবা, বলিভিয়া, চিলি—কোনো জায়গাই বাদ যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, সব দেশেই লাল ঝান্ডার জয়জয়কার। যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা আত্মরক্ষার ভূমিকায়। ইউরোপের তরুণেরা শুরু করলেন ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন। সামনে থেকে যাঁরা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন পাকিস্তানের লাহোর থেকে বিলেতে পড়ালেখা করতে আসা দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ, তারিক আলি। পারিবারিকভাবে আলি পরিবার পাঞ্জাবের ক্ষমতাশালী ভূস্বামী হলেও বাবা সাংবাদিক মাজহার আলি খান বাম রাজনীতির সঙ্গে আজীবন জড়িত। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে তিনি আর তাঁর স্ত্রী তাহেরা মাজহার আলি খান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। মওলানা ভাসানীর সঙ্গে পরিবারটির একটি সুসম্পর্ক ছিল। তাহেরার বাবা সরদার সেকান্দার হায়াত খান একসময় (১৯৩৭-৪২) পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনিও বাম রাজনীতির একজন সমর্থক ছিলেন।
ইউরোপে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে সেই আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ল আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে। আন্দোলনের মশাল তখন যুক্তরাষ্ট্রের বাম আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের হাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে ক্যাম্পাসে সেই আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে। ১৯৭০ সালের ৪ মে কেন্ট স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর ন্যাশনাল গার্ড গুলি চালালে চারজন ছাত্র ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। কেন্টের কয়েক হাজার মাইল দূর থেকে আমরা মৃত কমরেডদের লাল সালাম জানালাম। এ সময় পশ্চিমা বিশ্ব দুনিয়ার অন্য প্রান্তে আরেকটি অগ্ন্যুৎপাতের সূত্রপাতের সঙ্গে পরিচিত হলো, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন। সেই বিশ্বের মানুষ জানল, এই আন্দোলনের সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন পূর্ববঙ্গের ছাত্র-জনতা এবং তাঁদের অন্যতম সেনাপতি তোফায়েল আহমেদ। তারিক আলি, জন লেনন (বিটলস খ্যাত) ইকো ওনো, অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের পাশাপাশি লন্ডন-নিউইয়র্কের পত্রপত্রিকায় ছাপা হতে লাগল বাংলা আর বাঙালির খবর। সত্তরের নির্বাচনের পর দৃশ্যে আবির্ভাব ঘটল আরেকজন কালজয়ী মহানায়কের, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সত্তরে তারিক আলি এলেন ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনের সামনে বটতলায় তিনি যখন লাখো ছাত্র-জনতার জনসমুদ্রে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল তিনি তাঁর পরনের লম্বা কুর্তার পকেট থেকে বিপ্লবের আগুন বের করে তা চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। তারিক আলির সেই অপরাহের বক্তৃতা কী যে এক উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল, তা এখন বোঝানো যাবে না। ইউরোপে ফেরার আগে দেখা করতে ভুললেন না বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু বটতলায় তারিক আলির দেওয়া বক্তৃতার প্রশংসা করলেন।
১৯৭০ থেকে ২০১৩—দীর্ঘ ৪৩ বছরের ব্যবধানে বিশ্ব অনেক পাল্টে গেছে। পতন হয়েছে বার্লিন দেয়ালের, সঙ্গে ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে গেছে পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের। বাম রাজনীতি এখন অনেকটা গৃহবন্দী। তারিক আলি এখন আর মার্ক্সবাদ প্রচার করেন না; ইতিহাস আর সাহিত্যচর্চা করেন। সময় পেলে সিনেমা বানান। থাকেন বিলেতে। সময় পেলে পত্রিকায় বিশ্লেষণধর্মী কলাম লেখেন। নিজ দেশে মৌলবাদীদের কাছে অবাঞ্ছিত। কারণ, তাদের মতে তিনি একজন নাস্তিক; যদিও তিনি ইসলাম নিয়ে একাধিক বই লিখেছেন। ঢাকায় হে উৎসব উপলক্ষে সম্প্রতি ঢাকা ঘুরে গেলেন ৭০ বছর বয়সী তারিক আলি। একটি উঁচু মাপের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এক পড়ন্ত বিকেলে তারিক আলির জন্য ‘হিস্টোরি অ্যান্ড ফিকশন’ (ইতিহাস ও কল্পকাহিনি) শিরোনামে একটি সেমিনার আয়োজন করেছিল। বেশ প্রশংসনীয় উদ্যোগ। হলভর্তি শ্রোতাদের উপচে পড়া ভিড়। ৭০ বছর বয়সেও তারিক আলির গলার জোর এবং বলার ভঙ্গি এতটুকু বদলায়নি। প্রায় এক ঘণ্টা দর্শক-শ্রোতাদের ধরে রেখেছিলেন। বললেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে তিনি অবাক হননি। কারণ, এটি অনিবার্য ছিল।
তাঁর মতে, সোভিয়েত রাষ্ট্রকাঠামো অতিমাত্রায় আমলাতান্ত্রিক হয়ে পড়েছিল। সামরিক বাহিনীর পেছনে তাদের বিশাল ব্যয় ছিল সম্পূর্ণভাবে অযৌক্তিক। এর ফলে একসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন আর্থিক সংকটে পড়লে তার পতন ত্বরান্বিত হলো। মানুষ ভুলভাবে মনে করল, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একমাত্র বিকল্প মুক্তবাজার অর্থনীতি। তিনি আরও বললেন তার পরিণতি কী হতে পারে, এর জ্বলন্ত প্রমাণ গ্রিস, পর্তুগাল, স্পেন আর ইতালির চরম অর্থনৈতিক সংকট আর দেউলিয়া হওয়া। তাঁর মতে, ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া, কোস্টারিকা ও ব্রাজিলের একটা অংশ ২০০৭-০৮-এর বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা থেকে মুক্ত থাকতে পেরেছে। কারণ, তারা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটা সংমিশ্রণ ঘটাতে পেরেছে। এক রহস্যজনক কারণে তিনি কিউবা সম্পর্কে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেননি।
একজন শ্রোতা তাঁর কাছে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মতামত জানতে চাইলে তিনি নির্দ্বিধায় বললেন, বঙ্গবন্ধু বাকশাল কায়েম করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত করেছিলেন। সুতরাং, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড অবধারিত ছিল। তাঁর হয়তো এটি জানা নেই, বাকশাল ব্যবস্থাটি কখনো কার্যকর করার সুযোগ বঙ্গবন্ধু পাননি। আর বাকশাল ব্যবস্থাকে সময়ের প্রেক্ষাপটে বিচার করতে হবে। তিনি একবারও বললেন না বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে নিক্সন প্রশাসনের ভূমিকা অথবা সে সময়কার যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশে খাদ্য চালান নিয়ে নোংরা রাজনীতি, যার ফলে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ। তাঁর কথায় মনে হয়েছে, তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনাটি দুঃখজনকভাবে অত্যন্ত ক্ষুদ্র দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। বাকশাল গঠনে বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকাকে তিনি সমালোচনা করে বলেন, এটি ছিল একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তাঁর মতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নেই।
তারিক আলি শ্রোতাদের জানালেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কোনো ভবিষ্যৎ নেই এবং এর বারোটা বাজিয়েছে পিএলও আর হামাস। সময় থাকতে ফিলিস্তিন নেতাদের উচিত এক ইসরায়েল-ফিলিস্তিন রাষ্ট্র মেনে নেওয়া। একপর্যায়ে বললেন, ইউরোপের ইতিহাস বইয়ে ইউরোপীয় সভ্যতায় মুসলমানদের কোনো অবদানের কথা পড়ানো হয় না। সেখানে মুসলমানদের ইতিহাস এক প্যারাগ্রাফে সীমাবদ্ধ। দুঃখজনকভাবে তিনি একবারও বলেননি, পাকিস্তানে ইতিহাসই পড়ানো হয় না। বাংলাদেশ সম্পর্কে সেই দেশের সত্তর-পরবর্তী প্রজন্ম সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তাঁর এসব বক্তব্য শ্রোতাদের হতাশ করেছে।
তারিক আলি সেদিন দু-একটি চরম সত্য কথা বলেছেন। তাঁর মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সংকট, সেটি অনেকটা ১৯৪৭ সালের চেতনা বনাম ১৯৭১ সালের চেতনার লড়াই। ১৯৪৭ সালের চেতনা চরমভাবে ভুল ছিল। কারণ, শুধু ধর্মের ভিত্তিতে কোনো রাষ্ট্রের জন্ম হতে পারে না। বললেন, সৌদি আরব দুটি বস্তু বিশ্বকে উপহার দেয়। প্রথমটি তেল আর দ্বিতীয়টি ওয়াহাবি মতবাদনির্ভর জঙ্গিবাদ। খোদ সৌদি আরবে ওয়াহাবিদের সংখ্যা তেমন উল্লেখযোগ্য না হলেও এই মতবাদ তারা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে, যা বিশ্বকে অস্থিতিশীল করেছে। ইরাক, আফগানিস্তান অথবা ইয়েমেনে গণতন্ত্র রপ্তানি করতে যুক্তরাষ্ট্র বেশ উৎসাহী, কিন্তু সৌদি আরবের ব্যাপারে নিশ্চুপ। এ ক্ষেত্রে তাদের অভিমত, মুসলমানেরা গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত নয়। তবে এই তারিক আলির সঙ্গে আমার দেখা এবং জানা তারিক আলির অনেক তফাত। মনে হলো, তিনি চরমভাবে বিভ্রান্ত। হয়তো বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তা-চেতনাও বদলে যায়। সবশেষে সেদিনের জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ দিতেই হয়।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
ষাটের দশকের শেষের দিকে যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ তুঙ্গে, তখন প্রথমে আমাদের সামনে রাজনৈতিক নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হলেন উত্তর ভিয়েতনামের রাজনৈতিক গুরু হো চি মিন। তরুণদের সামনে তখন কিউবা আর দক্ষিণ আমেরিকার মার্ক্সিস্ট বিপ্লবী চে গুয়েভারা এক মহানায়ক। আজকের মতো ঘরে ঘরে তখন টেলিভিশন ছিল না। বিত্তবানদের বাড়িতে ছিল রেডিও। আর ছিল হাতে গোনা কয়েকটি খবরের কাগজ। হঠাৎ একদিন খবর এল, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্ররোচনায় পূর্ব বার্লিনের মাঝ বরাবর কাঁটাতারের বেড়া তুলে পুরো বার্লিন শহরটাকেই পূর্ব জার্মানি দুই ফালি করে দিয়েছে। সে এক লোমহর্ষক খবর বটে। শহর দুই ভাগ মানে পরিবার দুই ভাগ, জায়গা-জমিন-সম্পদ দুই ভাগ। ব্যাপারটা যেহেতু সোভিয়েত-মন্ত্রে দীক্ষিত পূর্ব জার্মানি করেছে, সেহেতু দেশের মার্ক্সবাদে দীক্ষিত ব্যক্তিরাও বেশ শিহরণ অনুভব করল। ঘটনা থেমে থাকল না; বছর না ঘুরতেই কাঁটাতারের বেড়া জায়গা করে দিল আস্ত একটা দেয়ালকে।
ভিয়েতনাম তো বটেই, যেখানেই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন, সেখানেই সোভিয়েত ইউনিয়নের মদদ। অ্যাঙ্গোলা, কিউবা, বলিভিয়া, চিলি—কোনো জায়গাই বাদ যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, সব দেশেই লাল ঝান্ডার জয়জয়কার। যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা আত্মরক্ষার ভূমিকায়। ইউরোপের তরুণেরা শুরু করলেন ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন। সামনে থেকে যাঁরা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন পাকিস্তানের লাহোর থেকে বিলেতে পড়ালেখা করতে আসা দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ, তারিক আলি। পারিবারিকভাবে আলি পরিবার পাঞ্জাবের ক্ষমতাশালী ভূস্বামী হলেও বাবা সাংবাদিক মাজহার আলি খান বাম রাজনীতির সঙ্গে আজীবন জড়িত। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে তিনি আর তাঁর স্ত্রী তাহেরা মাজহার আলি খান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। মওলানা ভাসানীর সঙ্গে পরিবারটির একটি সুসম্পর্ক ছিল। তাহেরার বাবা সরদার সেকান্দার হায়াত খান একসময় (১৯৩৭-৪২) পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনিও বাম রাজনীতির একজন সমর্থক ছিলেন।
ইউরোপে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে সেই আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ল আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে। আন্দোলনের মশাল তখন যুক্তরাষ্ট্রের বাম আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের হাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে ক্যাম্পাসে সেই আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে। ১৯৭০ সালের ৪ মে কেন্ট স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর ন্যাশনাল গার্ড গুলি চালালে চারজন ছাত্র ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। কেন্টের কয়েক হাজার মাইল দূর থেকে আমরা মৃত কমরেডদের লাল সালাম জানালাম। এ সময় পশ্চিমা বিশ্ব দুনিয়ার অন্য প্রান্তে আরেকটি অগ্ন্যুৎপাতের সূত্রপাতের সঙ্গে পরিচিত হলো, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন। সেই বিশ্বের মানুষ জানল, এই আন্দোলনের সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন পূর্ববঙ্গের ছাত্র-জনতা এবং তাঁদের অন্যতম সেনাপতি তোফায়েল আহমেদ। তারিক আলি, জন লেনন (বিটলস খ্যাত) ইকো ওনো, অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের পাশাপাশি লন্ডন-নিউইয়র্কের পত্রপত্রিকায় ছাপা হতে লাগল বাংলা আর বাঙালির খবর। সত্তরের নির্বাচনের পর দৃশ্যে আবির্ভাব ঘটল আরেকজন কালজয়ী মহানায়কের, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সত্তরে তারিক আলি এলেন ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনের সামনে বটতলায় তিনি যখন লাখো ছাত্র-জনতার জনসমুদ্রে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল তিনি তাঁর পরনের লম্বা কুর্তার পকেট থেকে বিপ্লবের আগুন বের করে তা চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। তারিক আলির সেই অপরাহের বক্তৃতা কী যে এক উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল, তা এখন বোঝানো যাবে না। ইউরোপে ফেরার আগে দেখা করতে ভুললেন না বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু বটতলায় তারিক আলির দেওয়া বক্তৃতার প্রশংসা করলেন।
১৯৭০ থেকে ২০১৩—দীর্ঘ ৪৩ বছরের ব্যবধানে বিশ্ব অনেক পাল্টে গেছে। পতন হয়েছে বার্লিন দেয়ালের, সঙ্গে ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে গেছে পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের। বাম রাজনীতি এখন অনেকটা গৃহবন্দী। তারিক আলি এখন আর মার্ক্সবাদ প্রচার করেন না; ইতিহাস আর সাহিত্যচর্চা করেন। সময় পেলে সিনেমা বানান। থাকেন বিলেতে। সময় পেলে পত্রিকায় বিশ্লেষণধর্মী কলাম লেখেন। নিজ দেশে মৌলবাদীদের কাছে অবাঞ্ছিত। কারণ, তাদের মতে তিনি একজন নাস্তিক; যদিও তিনি ইসলাম নিয়ে একাধিক বই লিখেছেন। ঢাকায় হে উৎসব উপলক্ষে সম্প্রতি ঢাকা ঘুরে গেলেন ৭০ বছর বয়সী তারিক আলি। একটি উঁচু মাপের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এক পড়ন্ত বিকেলে তারিক আলির জন্য ‘হিস্টোরি অ্যান্ড ফিকশন’ (ইতিহাস ও কল্পকাহিনি) শিরোনামে একটি সেমিনার আয়োজন করেছিল। বেশ প্রশংসনীয় উদ্যোগ। হলভর্তি শ্রোতাদের উপচে পড়া ভিড়। ৭০ বছর বয়সেও তারিক আলির গলার জোর এবং বলার ভঙ্গি এতটুকু বদলায়নি। প্রায় এক ঘণ্টা দর্শক-শ্রোতাদের ধরে রেখেছিলেন। বললেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে তিনি অবাক হননি। কারণ, এটি অনিবার্য ছিল।
তাঁর মতে, সোভিয়েত রাষ্ট্রকাঠামো অতিমাত্রায় আমলাতান্ত্রিক হয়ে পড়েছিল। সামরিক বাহিনীর পেছনে তাদের বিশাল ব্যয় ছিল সম্পূর্ণভাবে অযৌক্তিক। এর ফলে একসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন আর্থিক সংকটে পড়লে তার পতন ত্বরান্বিত হলো। মানুষ ভুলভাবে মনে করল, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একমাত্র বিকল্প মুক্তবাজার অর্থনীতি। তিনি আরও বললেন তার পরিণতি কী হতে পারে, এর জ্বলন্ত প্রমাণ গ্রিস, পর্তুগাল, স্পেন আর ইতালির চরম অর্থনৈতিক সংকট আর দেউলিয়া হওয়া। তাঁর মতে, ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া, কোস্টারিকা ও ব্রাজিলের একটা অংশ ২০০৭-০৮-এর বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা থেকে মুক্ত থাকতে পেরেছে। কারণ, তারা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটা সংমিশ্রণ ঘটাতে পেরেছে। এক রহস্যজনক কারণে তিনি কিউবা সম্পর্কে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেননি।
একজন শ্রোতা তাঁর কাছে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মতামত জানতে চাইলে তিনি নির্দ্বিধায় বললেন, বঙ্গবন্ধু বাকশাল কায়েম করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত করেছিলেন। সুতরাং, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড অবধারিত ছিল। তাঁর হয়তো এটি জানা নেই, বাকশাল ব্যবস্থাটি কখনো কার্যকর করার সুযোগ বঙ্গবন্ধু পাননি। আর বাকশাল ব্যবস্থাকে সময়ের প্রেক্ষাপটে বিচার করতে হবে। তিনি একবারও বললেন না বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে নিক্সন প্রশাসনের ভূমিকা অথবা সে সময়কার যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশে খাদ্য চালান নিয়ে নোংরা রাজনীতি, যার ফলে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ। তাঁর কথায় মনে হয়েছে, তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনাটি দুঃখজনকভাবে অত্যন্ত ক্ষুদ্র দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। বাকশাল গঠনে বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকাকে তিনি সমালোচনা করে বলেন, এটি ছিল একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তাঁর মতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নেই।
তারিক আলি শ্রোতাদের জানালেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কোনো ভবিষ্যৎ নেই এবং এর বারোটা বাজিয়েছে পিএলও আর হামাস। সময় থাকতে ফিলিস্তিন নেতাদের উচিত এক ইসরায়েল-ফিলিস্তিন রাষ্ট্র মেনে নেওয়া। একপর্যায়ে বললেন, ইউরোপের ইতিহাস বইয়ে ইউরোপীয় সভ্যতায় মুসলমানদের কোনো অবদানের কথা পড়ানো হয় না। সেখানে মুসলমানদের ইতিহাস এক প্যারাগ্রাফে সীমাবদ্ধ। দুঃখজনকভাবে তিনি একবারও বলেননি, পাকিস্তানে ইতিহাসই পড়ানো হয় না। বাংলাদেশ সম্পর্কে সেই দেশের সত্তর-পরবর্তী প্রজন্ম সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তাঁর এসব বক্তব্য শ্রোতাদের হতাশ করেছে।
তারিক আলি সেদিন দু-একটি চরম সত্য কথা বলেছেন। তাঁর মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সংকট, সেটি অনেকটা ১৯৪৭ সালের চেতনা বনাম ১৯৭১ সালের চেতনার লড়াই। ১৯৪৭ সালের চেতনা চরমভাবে ভুল ছিল। কারণ, শুধু ধর্মের ভিত্তিতে কোনো রাষ্ট্রের জন্ম হতে পারে না। বললেন, সৌদি আরব দুটি বস্তু বিশ্বকে উপহার দেয়। প্রথমটি তেল আর দ্বিতীয়টি ওয়াহাবি মতবাদনির্ভর জঙ্গিবাদ। খোদ সৌদি আরবে ওয়াহাবিদের সংখ্যা তেমন উল্লেখযোগ্য না হলেও এই মতবাদ তারা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে, যা বিশ্বকে অস্থিতিশীল করেছে। ইরাক, আফগানিস্তান অথবা ইয়েমেনে গণতন্ত্র রপ্তানি করতে যুক্তরাষ্ট্র বেশ উৎসাহী, কিন্তু সৌদি আরবের ব্যাপারে নিশ্চুপ। এ ক্ষেত্রে তাদের অভিমত, মুসলমানেরা গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত নয়। তবে এই তারিক আলির সঙ্গে আমার দেখা এবং জানা তারিক আলির অনেক তফাত। মনে হলো, তিনি চরমভাবে বিভ্রান্ত। হয়তো বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তা-চেতনাও বদলে যায়। সবশেষে সেদিনের জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ দিতেই হয়।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments