কালের পুরাণ- গণতন্ত্রে স্বৈরাচারের কালো ছায়া by সোহরাব হাসান

কয়েক দিন আগে কানাডা থেকে এক বন্ধু একটি মেইল পাঠিয়েছিলেন, যার সঙ্গে চিলির নির্বাচনসংক্রান্ত একটি ছোট্ট সংবাদ ছিল।
চিলিতে এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে দুজন প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের পরিবার কোনো না-কোনোভাবে স্বৈরশাসক জেনারেল অগাস্তো পিনোশের সঙ্গে জড়িত ছিল। একজনের বাবা ছিলেন ১৯৭৩ সালের অভ্যুত্থানে পিনোশের সহযোগী এবং অন্যজনের বাবা পিনোশের শাসনের সমর্থক। প্রবাসী বন্ধু চিলির অবস্থা দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা দেখলে তিনি চিলির কথা ভেবে স্বস্তিবোধ করতেন যে, চিলিতে পিনোশের সহযোগীর সন্তানেরা ক্ষমতায় আসছেন আর বাংলাদেশের পিনোশে স্বয়ং রাষ্ট্র পরিচালনায় ভাগ বসিয়েছেন। ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হওয়ার ২২ বছর পরও তিনি কিংমেকার।

বিষয়টি বিচলিত হওয়ার মতো। যে স্বৈরশাসক এরশাদকে এ দেশের ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করেছে, যে স্বৈরশাসককে হটাতে নূর হোসেন-মিলন-তাজুলেরা জীবন দিয়েছেন, শিল্পী কামরুল হাসান যাঁকে নিয়ে ‘বিশ্ব বেহায়া’ কার্টুন এঁকেছিলেন, নব্বইয়ের পর যাঁর বিচারের দাবিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সোচ্চার ছিল, সেই স্বৈরশাসক কীভাবে এখনো রাজনীতিতে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন?

এরশাদ একাধিকবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন সত্য; কিন্তু তাই বলে তাঁর গায়ে লেগে থাকা স্বৈরশাসকের কালি এতটুকু মুছে যায়নি। তাঁর বিরুদ্ধে যতগুলো দুর্নীতির মামলা ছিল, সবগুলোর বিচার হলে তাঁর কারাদণ্ডের মেয়াদ গোলাম আযমের চেয়ে কম হতো না। আইন নিজস্ব গতিতে চলেনি বলেই একদা স্বৈরশাসক এখন গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক দল ও নেতা-নেত্রীদের ডিকটেট করতে পারছেন।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা বিচারপতি খায়রুল হকের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে গদগদ। তাঁরা অবৈধ উপায়ে ক্ষমতা দখলের জন্য মৃত জিয়াউর রহমানের ‘বিচার’ চাইলেও জীবিত এরশাদকে জামাই আদরেই রেখেছেন। নব্বইয়ের পর জাসদের নেতা ও বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু তাঁর বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করেছিলেন। সেই মামলার খবর কী? গত দুই দশক দুই নেত্রী পালা করে স্বৈরাচার ও রাজাকারের হাত ধরে ক্ষমতায় টিকে আছেন। তাঁরা জোট ছাড়া ক্ষমতায় আসতে পারেননি। সে কারণেই এরশাদ একবার আওয়ামী লীগ, আরেকবার বিএনপির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধছেন।

২.
বছর খানেক ধরেই এরশাদ মহাজোটের বিরুদ্ধে বুলন্দ আওয়াজ তুলে আসছিলেন যে এ সরকার দুর্নীতিবাজ ও দেশ শাসনে ব্যর্থ। অতএব এ সরকারের সঙ্গে তাঁরা কোনো রকম আপস করবেন না। তিনি বহুবার মহাজোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেভাবে মহাজোট ছেড়েছেন, সেটি নাটক নয়, প্রহসনের অংশ। জাতীয় পার্টিতে দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপি ও আওয়ামী লীগপন্থীদের রশি টানাটানি চলছিল। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগপন্থীরা জয়ী হয়েছেন। বিনিময়ে বাগিয়ে নিয়েছেন তিনটি পূর্ণ, দুটি অর্ধমন্ত্রী এবং একটি উপদেষ্টার পদ। বিএনপি তাঁকে ৩০টি আসন দিতে চেয়েছিল, আওয়ামী লীগ ৬০টি দেবে (বিএনপি নির্বাচনে এলে এরশাদ মহাজোটে থেকেই নির্বাচন করবেন)।

ক্ষমতাত্যাগের আগে এরশাদ ষড়যন্ত্র করেছিলেন। এখনো ষড়যন্ত্রে আছেন। তিনি নিজেকে যতই সাচ্চা বলে দাবি করুন না কেন সেই সময়ের দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকাগুলো তাঁর অপরিমেয় দুর্নীতিরই সাক্ষী হয়ে আছে। একাধিক মামলায় তিনি দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হলেও অনেক মামলায় খালাস পেয়েছেন, অনেক মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। লন্ডনভিত্তিক পাকিস্তানি ব্যাংক বিসিসিআইয়ের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি সালেহ নাকভি আমেরিকার ফেডারেল কারাগারে আইনজ্ঞদের সামনে এক হলফনামায় যে তথ্য প্রকাশ করেছিলেন, তা থেকে আমরা বিদেশে এরশাদের অর্থ পাচারের বড় প্রমাণ পাই। তাঁর ভাষ্যমতে, ‘বিসিসিআিইয়ের লুক্সেমবার্গ শাখায় এরশাদের এক কোটি ১০ লাখ ডলারের অ্যাকাউন্ট আছে।

১৯৮৮ সালে বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট আগা হাসান আলী নাকভিকে নির্দেশ দেন কেইমেন দ্বীপে বিসিসিআইয়ের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আইসিআইসি ওভারসিজে এরশাদের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করতে। ওই অ্যাকাউন্টে রওশন এরশাদের নামও ছিল। স্থানান্তরিত অ্যাকাউন্টে এরশাদের অর্থ তখন সুদসহ বেড়ে প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। এ অ্যাকাউন্ট থেকেই এরশাদের স্ত্রী বলে কথিত মেরি মমতাজকে দুই কিস্তিতে এক কোটি ডলার দেওয়া হয়েছিল। (সূত্র: পৃষ্ঠা ২৮৮, কার রাজনীতি, কীসের রাজনীতি, মতিউর রহমান, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০০৪।)

১৯৮৬ সালে লন্ডন অবজারভার সংবাদ প্রকাশ করে, ‘বিশ্বের দরিদ্রতম দেশে প্রেম ও ছলচাতুরী’ শিরোনামে। আন্তর্জাতিক তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান ফেয়ারফ্যাক্সের প্রেসিডেন্ট হার্শম্যানের দাবি, ‘বৈদেশিক অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার প্রমাণ আমাদের কাছে আছে।’ এ নিয়ে মামলাও হয়েছিল। (সূত্র: স্বৈরাচারের নয় বছর, রফিকুল ইসলাম পিএসসি, ইউনিভার্সিটি প্রেস, ঢাকা)
এরশাদের আমলে যিনি টেন পারসেন্ট নামে পরিচিত ছিলেন, তিনি এখন শেখ হাসিনার সর্বদলীয় মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছেন।
এরশাদ আমলের দুর্নীতি কী পর্যায়ে পৌঁছেছিল তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত মুক্তমনা ওয়েবসাইট থেকে এখানে তুলে ধরছি।

১. ১৯৮৩ সালের ২৪ মে শুল্ক কর্তৃপক্ষ প্রতিরক্ষা বিভাগের আমদানি করা এক কোটি টাকা মূল্যের ১৭ হাজার ছয়টি ঘড়ি আটক করে। সেনা গোয়েন্দারা সংশ্লিষ্ট শুল্ক কর্মকর্তা আবদুর রউফকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যান। এরপর রউফ রহস্যজনকভাবে মারা যান। তাঁকে অবশ্যই নির্যাতন করা হয়েছিল। সরকারের মুখপাত্র সব সংবাদপত্রকে সরকারের দেওয়া প্রেস রিলিজ ছাপার নির্দেশ দেন। রউফের স্ত্রীকে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি।

২. ১৯৮৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সে বছর দেওয়া শিল্পঋণের ৫০ ভাগই ২২ জন ব্যক্তির মধ্যে বণ্টন করা হয়, যাঁরা এরশাদের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এরশাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের মধ্যে এখন অনেকেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রভাবশালী নেতা। তাঁর অনুগ্রহভাজন অনেক আমলাও দুই দলে ভাগ হয়ে আছেন।

৩. ১৯৮৫ সালে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির এক কোটি টন গমের এক-তৃতীয়াংশ এরশাদের রাজনৈতিক দলের সদস্যদের মাধ্যমে তছরুপ করা হয়।

৪. নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে এরশাদ পীরদের ব্যবহার করেছেন। আগের রাতে স্বপ্ন দেখে শুক্রবার বিভিন্ন মসজিদে যেতেন বলে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করেছেন। তিনি ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌল চরিত্রই বদলে দিয়েছেন।


৩. গত ১২ জুলাই ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এর খবরে বলা হয়, গতকাল (১১ জুলাই) তদন্ত কর্মকর্তা মঞ্জুর আহমেদ (দুর্নীতি দমন কমিশনের উপপরিচালক) ঢাকার একটি আদালতকে জানান, তিনি আশির দশকে রাডার কেনায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও অপর তিনজনের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রমাণ পেয়েছেন। ওই কর্মকর্তা তাঁর রিপোর্টে আরও জানান, এরশাদ নিজের স্বার্থে এ অবৈধ কাজ করায় রাষ্ট্রের ৬৬.০৪ কোটি টাকা লোকসান করেছেন। ১৯৯২ সালের ১৭ জুলাই এ মামলার কার্যক্রম শুরু হলেও এখন পর্যন্ত বিচারকাজ শেষ হয়নি।


এরশাদের মন্ত্রীদের মধ্যে মমতা ওহাব (রওশন এরশাদের বড় বোন), রুহুল আমিন হাওলাদার, কোরবান আলী, মাহমুদুল হাসান, কাজী ফিরোজ রশীদ, কাজী জাফর আহমদ, এ কে এম মাইদুল ইসলাম, মেজর জেনারেল আবদুস সালাম, মিজানুর রহমান চৌধুরী, নাজিউর রহমান মঞ্জুর, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন প্রমুখের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও এ পর্যন্ত কেউ দণ্ডিত হননি। এর অর্থ এই নয় যে তাঁরা সবাই নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী।

আমাদের সমাজে যে নীতিনৈতিকতা ও মূল্যবোধ রয়েছে, তার কিছুই এরশাদ ধার ধারতেন না। তিনি অনেক নারীর সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক করেছেন। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী বলে খ্যাত মরিয়ম মমতাজকে নির্বাসিত জীবন কাটাতে বাধ্য করেছেন। জিনাত হোসেনের সঙ্গে তাঁর কেমন সম্পর্ক ছিল, তাঁরা বিদেশে কীভাবে সময় কাটাতেন, তার কিছু বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর সামরিক সচিব মনজুর রশীদ খানের বইয়ে (এরশাদের পতন ও সাহাবুদ্দীন আহমদের অস্থায়ী শাসন: কাছ থেকে দেখা, অঙ্কুর প্রকাশনী, ঢাকা)। তাঁর তৃতীয় স্ত্রী বিদিশা এরশাদের প্রেমকাহিনির যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা আরব্য উপন্যাসকেও হার মানায়।
মহাজোট সরকারে থেকে এরশাদ কিছু পাননি বলে প্রচার করলেও ব্যাংক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক কিছু হাতিয়ে নিয়েছেন।

এরশাদ সম্পর্কে তাঁরই একসময়ের প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান লিখেছিলেন: ‘আমার সরল বিশ্বাসের সুযোগে সামরিক প্রশাসক কীভাবে তাহার প্রদত্ত অঙ্গীকার ভঙ্গ করিয়া স্বৈরতন্ত্র চিরস্থায়ী করিবার সমস্ত কৌশল নিয়োগ করিয়াছে এবং অন্যান্য স্বার্থবাদী মহল ও জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে তাহার অনুকূলে সমর্থন জোগাইয়াছে তাহারই একটি চিত্র এই বইয়ে আঁকিবার চেষ্টা করিয়াছি।’ (পৃষ্ঠা ৮, প্রধানমন্ত্রিত্বের নয় মাস, নওরোজ কিতাবিস্তান।)

এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গভবনে যে স্বৈরশাসকের সঙ্গে সহাস্যবদনে শুভেচ্ছাবিনিময় করেছেন, যাঁকে গণভবনে ডেকে আপ্যায়ন করেছেন, সেই শেখ হাসিনাই ১৯৯১ সালে বিরোধী দলের নেত্রী থাকতে তাঁকে অবিলম্বে জেলখানায় পাঠানোর দাবি জানিয়েছিলেন। ১৯৯১ সালের ৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদে শেখ হাসিনার বক্তব্য ছিল এরূপ:

‘মাননীয় স্পিকার, সংসদ নেত্রী (খালেদা জিয়া) নির্বাচনের পূর্বে সাত দিনের মধ্যে এরশাদের বিচার এবং ফাঁসির দাবি করেছিলেন। গত ২০ মার্চ তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তিনি ২০ তারিখ থেকে আজ পর্যন্ত এ ব্যাপারে কতটুকু এগিয়েছেন সেটাই প্রশ্ন। আজ আইনের কথা আসছে। আজকে আমরাও বলতে চাই তিনি এখনো কেন এরশাদকে কারাগারে প্রেরণ করতে পারেন নাই।’ (জনগণের কথা বলতে এসেছি, জাতীয় সংসদে শেখ হাসিনা ১৯৮৭-১৯৯৪, পান্না কায়সার সম্পাদিত, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা)

শেখ হাসিনা এরশাদের কাছ থেকে কোনো আর্থিক সুবিধা নেননি বলে দাবি করেছেন। কিন্তু বিএনপি আমলে যাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় জেলখানায় পাঠানো এবং বিচারের দাবি জানিয়েছিলেন, তাঁর দুই মেয়াদের পুরো সময়টাই তাঁকে কারাগারের বাইরে রেখেছেন। যদিও খালেদার প্রথম শাসনামলের পুরো সময়টাই তিনি জেলে ছিলেন।

বিগত আওয়ামী লীগ আমলে এরশাদ বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জোট করার পর শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সব চোর এক হয়েছে। এখন সেই ‘সব চোরের’ পালের গোদাকে তিনিই সসম্মানে বরণ করে নিলেন। তাঁর দল থেকে ছয়জন মন্ত্রী এবং একজন উপদেষ্টাকে নিয়োগ দিলেন। নূর হোসেন-তাজুলদের আত্মা আমাদের ক্ষমা করবে কি?

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.