জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় সংসদ অধিবেশন চলতে পারে কি? by ইকতেদার আহমেদ
জাতীয়
সংসদ নির্বাচন কখন ও কী পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে
হলে একজন প্রার্থীর কী কী যোগ্যতা থাকতে হবে, নির্বাচন-পরবর্তী সংসদ
অধিবেশন কখন বসবে, সংসদের একটি অধিবেশনের সমাপ্তি এবং পরবর্তী অধিবেশনের
প্রথম বৈঠকের বিরতির সময়সীমা, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব প্রভৃতি বিষয়
সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানের যে কোনো অনুচ্ছেদ বিষয়ে
পরিপূর্ণ ধারণা লাভ করতে হলে একাধিক অনুচ্ছেদ অধ্যয়নের আবশ্যকতা রয়েছে।
একটি অনুচ্ছেদের খণ্ডিত ও বিচ্ছিন্ন অধ্যয়ন অনুচ্ছেদটির বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা
লাভে সহায়ক নয়। একটি অনুচ্ছেদের চেতনা উপলব্ধি করতে হলে এবং অনুচ্ছেদটিতে
ভাবার্থগতভাবে কী বোঝানো হয়েছে তা অনুধাবন করতে হলে অবশ্যই পরিপূর্ণ
অধ্যয়নের পাশাপাশি কখন এবং কী উদ্দেশ্যে সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান পরিবর্তন
করা হয়েছে তা জানা থাকা প্রয়োজন। জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ে পঞ্চদশ
সংশোধনী-পরবর্তী প্রবর্তিত বিধানে বলা হয়েছে, সংসদ সদস্যদের সাধারণ
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে- মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে
ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে এবং মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো
কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন পূর্ববর্তী দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ে যে বিধান প্রবর্তন করা হয়েছিল তাতে বলা ছিল- মেয়াদ অবসানের কারণে অথবা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী পূর্ববর্তী সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন বিষয়ে ’৭২-এর সংবিধান দ্বারা প্রবর্তিত যে বিধান ছিল তা পঞ্চদশ সংশোধনী দ্বারা প্রবর্তিত বিধানের অনুরূপ।
দেশের প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত গণপরিষদ ভেঙে দিয়ে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখা হলেও ২য়, ৩য় ও ৪র্থ সংসদ নির্বাচনের সময় রাষ্ট্রপতি সরকার ব্যবস্থা বহাল ছিল। উপরোক্ত ৪টি সংসদের কোনোটিই মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারায় এবং উপরোক্ত সংসদগুলো ভেঙে যাওয়া পরবর্তী রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা বহাল থাকায় মেয়াদ অবসানের আগে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা নিয়ে কোনো বিতর্ক সৃষ্টির অবকাশ হয়নি। ৫ম সংসদ নির্বাচন তিন দলীয় জোটের রূপরেখায় অস্থায়ী সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়ায় এ বিষয়টি উত্থাপনের অবকাশ সৃষ্টি হয়নি। পরবর্তীকালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলে ৭ম, ৮ম ও ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানকালে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা বিষয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ ছিল না। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল পরবর্তী মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান প্রবর্তিত হওয়ায় প্রথমবারের মতো আমাদের সাংবিধানিক ইতিহাসে প্রধানমন্ত্রী স্বপদে বহাল থাকাকালীন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের অবকাশ সৃষ্টি হয়েছে।
একজন ব্যক্তি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পরবর্তী ৬৬নং অনুচ্ছেদে যে সব যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে তা হল- তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে এবং তার বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হতে হবে। উপরোক্ত দুটি যোগ্যতার পাশাপাশি একজন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার এবং সংসদ সদস্য হিসেবে থাকার যোগ্য হবেন না যদি- কোনো উপযুক্ত আদালত তাকে অপ্রকৃতিস্থ বলে ঘোষণা করেন; তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর দায় হতে অব্যাহতি লাভ না করে থাকেন; তিনি কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন; তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন ২ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তার মুক্তি লাভের পর ৫ বছরকাল অতিবাহিত না হয়ে থাকে; তিনি ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীন যে কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হয়ে থাকেন; আইনের দ্বারা পদধারীকে অযোগ্য ঘোষণা করছে না এমন পদ ব্যতীত তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন অথবা তিনি কোনো আইনের দ্বারা বা অধীন কোনোরূপ নির্বাচনের জন্য অযোগ্য হন।
সংবিধানের বর্তমান বিধান অনুযায়ী একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে সংসদের বৈঠক অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সংসদের একটি অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের বিরতি বিষয়ে পঞ্চদশ সংশোধনী পরবর্তী যে বিধান করা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে- ১২৩ অনুচ্ছেদের (৩) দফার (ক) উপ-দফায় উল্লেখিত ৯০ দিন সময় ব্যতীত অন্য সময়ে সংসদের এক অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের মধ্যে ৬০ দিনের অতিরিক্ত বিরতি থাকবে না। উল্লেখ্য, অনুচ্ছেদ ১২৩(৩)(ক)তে বলা হয়েছে- মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সংসদের এক অধিবেশনের সমাপ্তি এবং পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের বিরতির ক্ষেত্রে অনুচ্ছেদ ৭২(১)-এর ক্রমবিকাশ পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, এ বিষয়ে ’৭২-এর সংবিধানে বলা ছিল- সংসদের এক অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের মধ্যে ৬০ দিনের অতিরিক্ত বিরতি থাকবে না। অতঃপর সংবিধানের ২য় সংশোধনীর মাধ্যমে এ বিরতির সময়সীমা ১২০ দিন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। এরপর সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিরতির বিধানটি রহিত করে বলা হয়, প্রতিবছর সংসদের অন্তত ২টি অধিবেশন হবে। পরবর্তী সময়ে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিরতি সংক্রান্ত বিষয়ে ’৭২-এর সংবিধানের বিধান পুনঃপ্রবর্তন করে বলা হয়, এক অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের মধ্যে ৬০ দিনের অতিরিক্ত বিরতি থাকবে না। সর্বশেষ বিরতি বিষয়ে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে বিধান করা হয়েছে তাতে এক অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠক পর্যন্ত ৬০ দিনের অতিরিক্ত বিরতি না থাকার বিধান অক্ষুণ্ন রাখা হলেও মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিন সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানকালে ৬০ দিনের বিরতি সংক্রান্ত বিধান অকার্যকর করা হয়। সংবিধানের ৭২(১) অনুচ্ছেদে নবসন্নিবেশিত নির্বাচনকালীন ৯০ দিন সময়ের মধ্যে ৬০ দিনের বিরতির সময়সীমা অপ্রযোজ্য হওয়ার বিধান পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, নির্বাচনকালীন এ ৯০ দিন সময়সীমার মধ্যে সংসদ অধিবেশন বসবে না- সে বিষয়টিকে বিবেচনায় রেখেই সংশোধনটি আনা হয়েছিল। সংবিধানের ৭২(১) ও ১২৩(৩)(ক) অনুচ্ছেদের সম্মিলিত অধ্যয়নে প্রতীয়মান হয়, অনুচ্ছেদ দুটিতে ভাবার্থগতভাবে (ওসঢ়ষরবফষু) বোঝানো হয়েছে যে, এ সময় সংসদের অধিবেশন বসবে না। উল্লেখ্য, এ বিষয়টির মর্মার্থ অনুধাবন করে যথার্থভাবেই আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদে সংসদ সদস্যদের এবং সচিবালয়ে সচিবদের উদ্দেশে বক্তব্য প্রদানের সময় দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন- নির্বাচনকালীন ৯০ দিন সময়ের মধ্যে সংসদ বহাল থাকলেও সংসদের অধিবেশন বসবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপরোক্ত বক্তব্য পরবর্তী ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় নেতার নির্বাচনকালীন ৯০ দিন সময়সীমার মধ্যে সংসদের অধিবেশন চালানোর বিষয়ে যে কোনো ধরনের বক্তব্য সংবিধানের এতদসংক্রান্ত বিধানাবলীর চেতনা ও ভাবার্থের পরিপন্থী নয় কি?
সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান অনুচ্ছেদ নং ১১৯-এর বিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। সাংবিধানিকভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনকে ৯০ দিনের একটি সময়সীমা দেয়া হয়েছে। এ ৯০ দিন সময় গণনার দিন থেকে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালন আবশ্যক হয়ে পড়ে এবং এ ৯০ দিন সময়ের মধ্যে দৈব-দুর্বিপাকের কারণ ব্যতীত নির্বাচন কমিশন নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হলে কমিশন কর্তৃক সংবিধান লংঘনের কারণের উদ্ভব ঘটতে পারে। তাই নির্বাচন কমিশনকে সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি, পরিচালনা ও সম্পন্নের জন্য সংবিধানে বিবৃত ৯০ দিন সময় অবশ্যই প্রদান করতে হবে। এ সময় সংসদ অধিবেশন চালানো প্রচ্ছন্নভাবে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ এমন ধারণা পোষণ অমূলক নয়। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন কর্তৃক তফসিল ঘোষণা পর্যন্ত সংসদ অধিবেশন চলতে পারে মর্মে যে যুক্তি ও ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে, তা অনুচ্ছেদ নং ৭২(১), ১১৯ ও ১২৩ (৩)(ক)-এর চেতনা ও ভাবার্থের আলোকে মনগড়া প্রতীয়মান হয়।
সংবিধানের প্রতিটি সংশোধনীরই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। নির্বাচনকালীন ৯০ দিন সময়সীমা উপনীত হওয়ার পর সংসদের এক অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের বিরতির নির্ধারিত সর্বোচ্চ ৬০ দিনের সময়সীমার ব্যাঘাতকে অতিক্রম করার জন্যই স্পষ্টত ৭২(১) অনুচ্ছেদে সংশোধনী এনে বলা হয়েছে ১২৩(৩)(ক)-এ উল্লিখিত ৯০ দিন সময়ে ৬০ দিনের বাধ্যবাধকতার কার্যকারিতা থাকবে না। তাছাড়া যেখানে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, নির্বাচনের সময় সংসদ বহাল থাকলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কোনোভাবেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর জন্য সমসুযোগ সংবলিত মাঠের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়, সেখানে সংসদ অধিবেশন চালানোর ক্ষেত্রে যে কোনো ধরনের যুক্তি উপস্থাপন নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের অন্তরায়। এ ধরনের অন্তরায় নির্বাচনের নিরপেক্ষতাকে যে প্রশ্নবিদ্ধ করবে সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে হলেও এ ৯০ দিন সময়সীমার মধ্যে সংসদ অধিবেশন না চালানোই যৌক্তিক বলে প্রতীয়মান হয়।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন পূর্ববর্তী দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ে যে বিধান প্রবর্তন করা হয়েছিল তাতে বলা ছিল- মেয়াদ অবসানের কারণে অথবা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী পূর্ববর্তী সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন বিষয়ে ’৭২-এর সংবিধান দ্বারা প্রবর্তিত যে বিধান ছিল তা পঞ্চদশ সংশোধনী দ্বারা প্রবর্তিত বিধানের অনুরূপ।
দেশের প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত গণপরিষদ ভেঙে দিয়ে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখা হলেও ২য়, ৩য় ও ৪র্থ সংসদ নির্বাচনের সময় রাষ্ট্রপতি সরকার ব্যবস্থা বহাল ছিল। উপরোক্ত ৪টি সংসদের কোনোটিই মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারায় এবং উপরোক্ত সংসদগুলো ভেঙে যাওয়া পরবর্তী রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা বহাল থাকায় মেয়াদ অবসানের আগে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা নিয়ে কোনো বিতর্ক সৃষ্টির অবকাশ হয়নি। ৫ম সংসদ নির্বাচন তিন দলীয় জোটের রূপরেখায় অস্থায়ী সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়ায় এ বিষয়টি উত্থাপনের অবকাশ সৃষ্টি হয়নি। পরবর্তীকালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলে ৭ম, ৮ম ও ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানকালে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা বিষয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ ছিল না। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল পরবর্তী মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান প্রবর্তিত হওয়ায় প্রথমবারের মতো আমাদের সাংবিধানিক ইতিহাসে প্রধানমন্ত্রী স্বপদে বহাল থাকাকালীন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের অবকাশ সৃষ্টি হয়েছে।
একজন ব্যক্তি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পরবর্তী ৬৬নং অনুচ্ছেদে যে সব যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে তা হল- তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে এবং তার বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হতে হবে। উপরোক্ত দুটি যোগ্যতার পাশাপাশি একজন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার এবং সংসদ সদস্য হিসেবে থাকার যোগ্য হবেন না যদি- কোনো উপযুক্ত আদালত তাকে অপ্রকৃতিস্থ বলে ঘোষণা করেন; তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর দায় হতে অব্যাহতি লাভ না করে থাকেন; তিনি কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন; তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন ২ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তার মুক্তি লাভের পর ৫ বছরকাল অতিবাহিত না হয়ে থাকে; তিনি ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীন যে কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হয়ে থাকেন; আইনের দ্বারা পদধারীকে অযোগ্য ঘোষণা করছে না এমন পদ ব্যতীত তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন অথবা তিনি কোনো আইনের দ্বারা বা অধীন কোনোরূপ নির্বাচনের জন্য অযোগ্য হন।
সংবিধানের বর্তমান বিধান অনুযায়ী একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে সংসদের বৈঠক অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সংসদের একটি অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের বিরতি বিষয়ে পঞ্চদশ সংশোধনী পরবর্তী যে বিধান করা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে- ১২৩ অনুচ্ছেদের (৩) দফার (ক) উপ-দফায় উল্লেখিত ৯০ দিন সময় ব্যতীত অন্য সময়ে সংসদের এক অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের মধ্যে ৬০ দিনের অতিরিক্ত বিরতি থাকবে না। উল্লেখ্য, অনুচ্ছেদ ১২৩(৩)(ক)তে বলা হয়েছে- মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সংসদের এক অধিবেশনের সমাপ্তি এবং পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের বিরতির ক্ষেত্রে অনুচ্ছেদ ৭২(১)-এর ক্রমবিকাশ পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, এ বিষয়ে ’৭২-এর সংবিধানে বলা ছিল- সংসদের এক অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের মধ্যে ৬০ দিনের অতিরিক্ত বিরতি থাকবে না। অতঃপর সংবিধানের ২য় সংশোধনীর মাধ্যমে এ বিরতির সময়সীমা ১২০ দিন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। এরপর সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিরতির বিধানটি রহিত করে বলা হয়, প্রতিবছর সংসদের অন্তত ২টি অধিবেশন হবে। পরবর্তী সময়ে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিরতি সংক্রান্ত বিষয়ে ’৭২-এর সংবিধানের বিধান পুনঃপ্রবর্তন করে বলা হয়, এক অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের মধ্যে ৬০ দিনের অতিরিক্ত বিরতি থাকবে না। সর্বশেষ বিরতি বিষয়ে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে বিধান করা হয়েছে তাতে এক অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠক পর্যন্ত ৬০ দিনের অতিরিক্ত বিরতি না থাকার বিধান অক্ষুণ্ন রাখা হলেও মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিন সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানকালে ৬০ দিনের বিরতি সংক্রান্ত বিধান অকার্যকর করা হয়। সংবিধানের ৭২(১) অনুচ্ছেদে নবসন্নিবেশিত নির্বাচনকালীন ৯০ দিন সময়ের মধ্যে ৬০ দিনের বিরতির সময়সীমা অপ্রযোজ্য হওয়ার বিধান পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, নির্বাচনকালীন এ ৯০ দিন সময়সীমার মধ্যে সংসদ অধিবেশন বসবে না- সে বিষয়টিকে বিবেচনায় রেখেই সংশোধনটি আনা হয়েছিল। সংবিধানের ৭২(১) ও ১২৩(৩)(ক) অনুচ্ছেদের সম্মিলিত অধ্যয়নে প্রতীয়মান হয়, অনুচ্ছেদ দুটিতে ভাবার্থগতভাবে (ওসঢ়ষরবফষু) বোঝানো হয়েছে যে, এ সময় সংসদের অধিবেশন বসবে না। উল্লেখ্য, এ বিষয়টির মর্মার্থ অনুধাবন করে যথার্থভাবেই আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদে সংসদ সদস্যদের এবং সচিবালয়ে সচিবদের উদ্দেশে বক্তব্য প্রদানের সময় দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন- নির্বাচনকালীন ৯০ দিন সময়ের মধ্যে সংসদ বহাল থাকলেও সংসদের অধিবেশন বসবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপরোক্ত বক্তব্য পরবর্তী ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় নেতার নির্বাচনকালীন ৯০ দিন সময়সীমার মধ্যে সংসদের অধিবেশন চালানোর বিষয়ে যে কোনো ধরনের বক্তব্য সংবিধানের এতদসংক্রান্ত বিধানাবলীর চেতনা ও ভাবার্থের পরিপন্থী নয় কি?
সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান অনুচ্ছেদ নং ১১৯-এর বিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। সাংবিধানিকভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনকে ৯০ দিনের একটি সময়সীমা দেয়া হয়েছে। এ ৯০ দিন সময় গণনার দিন থেকে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালন আবশ্যক হয়ে পড়ে এবং এ ৯০ দিন সময়ের মধ্যে দৈব-দুর্বিপাকের কারণ ব্যতীত নির্বাচন কমিশন নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হলে কমিশন কর্তৃক সংবিধান লংঘনের কারণের উদ্ভব ঘটতে পারে। তাই নির্বাচন কমিশনকে সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি, পরিচালনা ও সম্পন্নের জন্য সংবিধানে বিবৃত ৯০ দিন সময় অবশ্যই প্রদান করতে হবে। এ সময় সংসদ অধিবেশন চালানো প্রচ্ছন্নভাবে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ এমন ধারণা পোষণ অমূলক নয়। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন কর্তৃক তফসিল ঘোষণা পর্যন্ত সংসদ অধিবেশন চলতে পারে মর্মে যে যুক্তি ও ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে, তা অনুচ্ছেদ নং ৭২(১), ১১৯ ও ১২৩ (৩)(ক)-এর চেতনা ও ভাবার্থের আলোকে মনগড়া প্রতীয়মান হয়।
সংবিধানের প্রতিটি সংশোধনীরই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। নির্বাচনকালীন ৯০ দিন সময়সীমা উপনীত হওয়ার পর সংসদের এক অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের বিরতির নির্ধারিত সর্বোচ্চ ৬০ দিনের সময়সীমার ব্যাঘাতকে অতিক্রম করার জন্যই স্পষ্টত ৭২(১) অনুচ্ছেদে সংশোধনী এনে বলা হয়েছে ১২৩(৩)(ক)-এ উল্লিখিত ৯০ দিন সময়ে ৬০ দিনের বাধ্যবাধকতার কার্যকারিতা থাকবে না। তাছাড়া যেখানে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, নির্বাচনের সময় সংসদ বহাল থাকলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কোনোভাবেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর জন্য সমসুযোগ সংবলিত মাঠের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়, সেখানে সংসদ অধিবেশন চালানোর ক্ষেত্রে যে কোনো ধরনের যুক্তি উপস্থাপন নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের অন্তরায়। এ ধরনের অন্তরায় নির্বাচনের নিরপেক্ষতাকে যে প্রশ্নবিদ্ধ করবে সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে হলেও এ ৯০ দিন সময়সীমার মধ্যে সংসদ অধিবেশন না চালানোই যৌক্তিক বলে প্রতীয়মান হয়।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
No comments