কিভাবে গঠিত হবে নির্বাচনকালীন সরকার by মোহাম্মদ কায়কোবাদ
সরকারি
দল ও বিরোধী দল যখন ক্ষমতার রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত, তখন সাধারণ মানুষ শংকিত
দেশের আইন-শৃংখলা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে। এর মধ্যেও মানুষ আশা করছে, শেষ মুহূর্তে
একটি আপসরফা হবে। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী পৃথকভাবে
নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা তুলে ধরেছেন। প্রশ্ন হল, যেখানে সরকারি ও
বিরোধী দলের মধ্যে একবিন্দু আস্থা নেই, সেখানে উভয়ের কাছে গ্রহণযোগ্য
ব্যক্তিদের নিয়ে কিভাবে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে? ইতিপূর্বে
যতগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছে, সেগুলোর উপদেষ্টাদের কীভাবে উভয়ের
সম্মতিতে বাছাই করা হয়েছে, সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কোনো ধারণা নেই। খুব
ভালো হতো যদি গোটা প্রক্রিয়াটি সাধারণ মানুষের সামনে স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন
হতো, তাদের সম্পৃক্ততা থাকত। তাহলে কোনো দলই নির্বাচনকালীন সরকার তথা
নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করতে পারত না। আমার এরকম
একটি প্রস্তাব একাধিকবার গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও তা সুধীজনের দৃষ্টি
আকর্ষণে সক্ষম হয়নি। দেশের এই সন্ধিক্ষণে আবার বিষয়গুলো বলার সাধ জাগল। এ
নিয়ে আলোচনা করলে হয়তো অনেক বেশি সুচিন্তিত ও গ্রহণযোগ্য একটি পদ্ধতি
আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
১.
বিগত চারটি নির্বাচনে সাধারণ মানুষ সব সময় সরকারি দলকে প্রত্যাখ্যান করেছে। নিশ্চয়ই আমাদের দেশের রাজনীতিকরা বিষয়টি লক্ষ্য করেছেন এবং এর থেকে আমাদের দলগুলো এখনও যে শিক্ষা গ্রহণ করেনি তার বড় প্রমাণ এই ধারা বেশ কিছুদিন ধরে অব্যাহত রয়েছে। বিগত নির্বাচনে ৭-৮ বছর ক্ষমতায় না থাকা, কোনরকম উন্নয়নমূলক কাজ করতে না পারা, টেন্ডার দিতে না পারা আওয়ামী লীগকে মানুষ জয়যুক্ত করেছিল। এবার আবার পাঁচ বছর এমনকি সংসদ অধিবেশনে না যাওয়া, ক্ষমতায় না থাকা বিএনপিকে নির্বাচিত করলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। সুতরাং নির্বাচনে জেতার জন্য ভালো মানুষ হওয়ার প্রয়োজন নেই, স্রোতের অনুকূলে থাকতে পারাটাই গুরুত্বপূর্ণ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বড় দুটি দলে গণতন্ত্রের চর্চাও লক্ষণীয় নয়। এর ফলে নতুন নেতৃত্বও তৈরি হচ্ছে না। তাই বড় দুটি দলে গণতন্ত্রের চর্চা আবশ্যক। দেশের সাধারণ মানুষের যারা প্রতিনিধিত্ব করবেন, সেই সংসদ সদস্যরা যদি ভাবেন তারা তো কিছুই নন- দলই সব, তাহলে প্রতিনিধিত্ব যোগ্য হবে না। আবার গত কয়েকটি নির্বাচনে এ-ও দেখা গেছে, এই বড় দল দুটি যত ভোট পেয়েছে, সেই অনুপাতে সংসদে তারা আসন পায়নি। ভোটের ব্যবধান ৫-৬ শতাংশ হলেও আসনের ব্যবধান ৮-৯ গুণ, যা কিনা একটি নির্বাচন ব্যবস্থার অগ্রহণযোগ্য ত্র“টি হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। আজ সংসদে বিরোধী দলের আসন সংখ্যা যদি ১৩০-১৪০ হতো, নিশ্চয়ই তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যেত না। তাই আমার প্রস্তাব হল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ তৈরি করা। একজন ভোটার দুটি ভোট দেবে- একটি দলকে আরেকটি স্থানীয় সংসদ আসনের প্রার্থীকে। সংসদ নির্বাচনে যারা দাঁড়াবে, তারা দলের প্রতীক ব্যবহার করতে পারবে না, তবে আমাদের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মতো নানা দল তাদের পক্ষ নিতে পারবে। দলের প্রতীক না নিয়ে যদি কেউ নির্বাচনে জয়ী হতে পারে, তাহলে তার নিজের প্রতি আস্থা ও আত্মমর্যাদাবোধ বেশি হবে। এই সংসদ সদস্যরা ইচ্ছা করলেই ফ্লোরক্রসও করতে পারবেন। এর ফলে তারা দলের অন্ধ আজ্ঞাবহে পরিণত হবেন না। দলের সিদ্ধান্তে তারা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবেন। এর ফলে দলের সিদ্ধান্তের গুণগত মানও বাড়বে। আর প্রতিটি রাজনৈতিক দল যে ভোট পাবে, সেই অনুপাতে তারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত করতে পারবে। আমরা যদি ধরি, আমাদের ৩০০ জন সংসদ সদস্য ভোটারদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন, আর ৩০০ জন দলীয়ভাবে। তাহলে ৩০০ আসন রাজনৈতিক দলগুলোকে আনুপাতিক হারে বণ্টন করা হবে। আমরা জানি, অনেক ছোট দলের সারা দেশভিত্তিক ভোট থাকা সত্ত্বেও কোনো আসন থেকেই তারা বিজয়ী হতে পারে না, যদিও তাদের মোট প্রাপ্ত ভোট একাধিক সংসদ সদস্যের প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে বেশি হতে পারে। সুতরাং তাদের এই জনপ্রিয়তা দৃশ্যমান হওয়া প্রয়োজন। স্থানীয় সংসদ সদস্যরা এলাকার উন্নয়নমূলক কাজে যৌক্তিক মাত্রায় অংশগ্রহণ করবেন। সংসদ সদস্যরা একাধারে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হওয়ার ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যের দায়িত্ব পালনে স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় বলে সংসদ এ বিষয়ে পরিষ্কার নীতি গ্রহণ করতে পারে। এছাড়াও বিগত কয়েকটি সরকারে বিরোধী দলের সংসদ বর্জন অথচ সংসদ সদস্য হিসেবে সব সুযোগ-সুবিধা কড়ায়গণ্ডায় ভোগ করা থেকে সাধারণ মানুষের ধারণা জšে§ছে যে, আমাদের প্রতিনিধি নেতারা চিন্তা-চেতনা-ত্যাগে আমাদের প্রত্যাশাকে কোনোভাবেই স্পর্শ করতে পারছেন না। সুতরাং তাদের নিজেদের কর্মকাণ্ডের যথাযথ মূল্যায়নের জন্য ‘না ভোট’ দানের সুযোগ থাকা উচিত।
২.
বর্তমানে প্রধান দুটি দলের মধ্যে পরস্পরের প্রতি আস্থাহীনতা দেশের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর ও লজ্জাজনক। এ অবস্থায় সমঝোতার মাধ্যমে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া তত সহজ হওয়ার কথা নয়। নির্বাচনকালীন সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্দলীয় সরকার কিংবা নির্বাচন কমিশন বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে দুটি দল একমত হবে এটা কল্পনা করতেও কষ্ট হয়। এজন্য সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যে বিষয়েই সমঝোতা হওয়া প্রয়োজন, সে বিষয়েই নিচের পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে।
মনে করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ও অন্য সদস্যদের নির্বাচনে উভয় দলকে সমঝোতায় আসতে হবে। নির্বাচন কমিশন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে উভয় দলকে আমন্ত্রণ জানাবে। জনসাধারণও জানবে এ অনুষ্ঠানে অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের জন্য দুই দলের মধ্যে সমঝোতা হবে। সারাদেশের মানুষ ওই অনুষ্ঠান উপভোগ করবে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা পেনড্রাইভে নিয়ে উভয় দলের প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হবেন। এর ফলে তালিকাগুলোর গোপনীয়তা বজায় রাখাও সহজ হবে। এবার প্রতিটি তালিকার প্রথম ১০টি নামের মধ্যে (সংখ্যাটি ১০-এর পরিবর্তে অন্য কিছুও হতে পারে) প্রথম মিল খোঁজা হবে (প্রথম মিলকেও আমরা প্রয়োজন অনুসারে সংজ্ঞায়িত করতে পারি)। না পেলে প্রথম ২০, প্রথম ৪০- এভাবে মিল খোঁজা হবে। তালিকার নামগুলোতে যাতে কোনো অস্পষ্টতা না থাকে সেজন্য তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ব্যবহার করা যেতে পারে। এক বা একাধিক সুযোগ্য উপস্থাপকের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানটি যেমন হতে পারে চিত্তাকর্ষক, তেমনি বিশ্বাসযোগ্য। সাধারণ মানুষের সামনে ঘটে যাওয়া এই সমঝোতা নিয়ে সন্দেহ কিংবা অনাস্থা জ্ঞাপন করা কোনো দলের জন্যই সহজ হবে না। সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা যাতে খুব বড় না হয়, সেজন্য উভয় দলের কাছে গ্রহণযোগ্য শর্ত দিয়ে এর দৈর্ঘ্য সীমিত রাখাও সম্ভব। তাছাড়া যেহেতু উভয় দলই জানছে যে নামটি অন্য তালিকায় থাকতে হবে, সুতরাং তাদের পছন্দের তালিকা যৌক্তিক হবে। যতক্ষণ উভয় তালিকায় একই নাম পাওয়া না যায়, ততক্ষণ টেলিভিশন অনুষ্ঠানটি চলতে থাকবে।
শুধু অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ও অন্যান্য সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে নয়, অন্য যে কোনো বিষয়েই সমঝোতায় পৌঁছতে এ ধরনের নৈর্ব্যক্তিক, স্বচ্ছ পদ্ধতি সাধারণ মানুষের সামনে উপস্থাপন করে তাদেরও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। জাতীয় সংসদের স্পিকার যেমন নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন, এক্ষেত্রেও জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দলগুলো তাদের পছন্দের মানুষ নির্বাচন করবে। তাই অনির্বাচিতদের দিয়ে সরকার চালানোর সমালোচনা এখানে প্রযোজ্য হবে না। উল্লেখ করা যেতে পারে, তত্ত্বাবধায়ক, নির্দলীয়, সর্বদলীয়, নির্বাচনকালীন সরকার কিংবা নির্বাচন কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নির্বাচনসহ যে কোনো বিষয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যদি সমঝোতার প্রয়োজন হয়, তা এ পদ্ধতির মাধ্যমে নিরপেক্ষভাবে ও স্বচ্ছতার সঙ্গে জনগণের সামনে করা যাবে।
৩.
আরেকটি বিষয় নিয়েও গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। একসময় আমরা কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কিংবা থাইল্যান্ডের তুলনায় পিছিয়ে ছিলাম না। উন্নতির মাপকাঠিতে এখন আমরা অনেক পেছনে। এ উদাহরণগুলো বিবেচনায় নিলে মনে হয়, পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতি আমাদের দেশে কোনো সুফল বয়ে আনেনি। প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য অন্যান্য দেশে যে নানারকম শর্ত রয়েছে, তা আমাদের দেশেও আরোপ করা উচিত। এর ফলে যারা প্রধানমন্ত্রী হবেন, তারা যথেষ্ট বিচক্ষণতা ও ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করবেন, যাতে করে সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পরও তারা যথাযথ সম্মানের সঙ্গে দেশেই বসবাস করতে পারেন। শুধু তাই নয়, দেশের জ্যেষ্ঠ, প্রাজ্ঞ, দেশ চালনায় অভিজ্ঞ, সম্মানিত নাগরিক হিসেবে তারা পরবর্তী নেতাদের মূল্যবান উপদেশ দিয়ে দেশ পরিচালনায় সহায়তা করতে পারেন। এই পদে সর্বোচ্চ এক মেয়াদ থাকার নিয়ম করা যায় কিনা, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। কোনো নেতা যদি যোগ্য নেতা তৈরি করতে ব্যর্থ হন, তাকে নেতা হিসেবে সফল ভাবা যায় না। ১৬ কোটি মানুষের দেশে মাত্র দু-একজন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য হলে আমাদের দেশে গণতন্ত্র সফলভাবে বিকশিত হবে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।
আমি আশা করি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান কিংবা সমাজবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা এবং আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে গবেষণা করে আমাদের দেশকে যথাসম্ভব ত্র“টিমুক্ত একটি ব্যবস্থা উপহার দিয়ে দেশবাসীকে অনিশ্চয়তা ও শংকা থেকে রক্ষা করবেন।
ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ : অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
১.
বিগত চারটি নির্বাচনে সাধারণ মানুষ সব সময় সরকারি দলকে প্রত্যাখ্যান করেছে। নিশ্চয়ই আমাদের দেশের রাজনীতিকরা বিষয়টি লক্ষ্য করেছেন এবং এর থেকে আমাদের দলগুলো এখনও যে শিক্ষা গ্রহণ করেনি তার বড় প্রমাণ এই ধারা বেশ কিছুদিন ধরে অব্যাহত রয়েছে। বিগত নির্বাচনে ৭-৮ বছর ক্ষমতায় না থাকা, কোনরকম উন্নয়নমূলক কাজ করতে না পারা, টেন্ডার দিতে না পারা আওয়ামী লীগকে মানুষ জয়যুক্ত করেছিল। এবার আবার পাঁচ বছর এমনকি সংসদ অধিবেশনে না যাওয়া, ক্ষমতায় না থাকা বিএনপিকে নির্বাচিত করলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। সুতরাং নির্বাচনে জেতার জন্য ভালো মানুষ হওয়ার প্রয়োজন নেই, স্রোতের অনুকূলে থাকতে পারাটাই গুরুত্বপূর্ণ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বড় দুটি দলে গণতন্ত্রের চর্চাও লক্ষণীয় নয়। এর ফলে নতুন নেতৃত্বও তৈরি হচ্ছে না। তাই বড় দুটি দলে গণতন্ত্রের চর্চা আবশ্যক। দেশের সাধারণ মানুষের যারা প্রতিনিধিত্ব করবেন, সেই সংসদ সদস্যরা যদি ভাবেন তারা তো কিছুই নন- দলই সব, তাহলে প্রতিনিধিত্ব যোগ্য হবে না। আবার গত কয়েকটি নির্বাচনে এ-ও দেখা গেছে, এই বড় দল দুটি যত ভোট পেয়েছে, সেই অনুপাতে সংসদে তারা আসন পায়নি। ভোটের ব্যবধান ৫-৬ শতাংশ হলেও আসনের ব্যবধান ৮-৯ গুণ, যা কিনা একটি নির্বাচন ব্যবস্থার অগ্রহণযোগ্য ত্র“টি হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। আজ সংসদে বিরোধী দলের আসন সংখ্যা যদি ১৩০-১৪০ হতো, নিশ্চয়ই তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যেত না। তাই আমার প্রস্তাব হল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ তৈরি করা। একজন ভোটার দুটি ভোট দেবে- একটি দলকে আরেকটি স্থানীয় সংসদ আসনের প্রার্থীকে। সংসদ নির্বাচনে যারা দাঁড়াবে, তারা দলের প্রতীক ব্যবহার করতে পারবে না, তবে আমাদের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মতো নানা দল তাদের পক্ষ নিতে পারবে। দলের প্রতীক না নিয়ে যদি কেউ নির্বাচনে জয়ী হতে পারে, তাহলে তার নিজের প্রতি আস্থা ও আত্মমর্যাদাবোধ বেশি হবে। এই সংসদ সদস্যরা ইচ্ছা করলেই ফ্লোরক্রসও করতে পারবেন। এর ফলে তারা দলের অন্ধ আজ্ঞাবহে পরিণত হবেন না। দলের সিদ্ধান্তে তারা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবেন। এর ফলে দলের সিদ্ধান্তের গুণগত মানও বাড়বে। আর প্রতিটি রাজনৈতিক দল যে ভোট পাবে, সেই অনুপাতে তারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত করতে পারবে। আমরা যদি ধরি, আমাদের ৩০০ জন সংসদ সদস্য ভোটারদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন, আর ৩০০ জন দলীয়ভাবে। তাহলে ৩০০ আসন রাজনৈতিক দলগুলোকে আনুপাতিক হারে বণ্টন করা হবে। আমরা জানি, অনেক ছোট দলের সারা দেশভিত্তিক ভোট থাকা সত্ত্বেও কোনো আসন থেকেই তারা বিজয়ী হতে পারে না, যদিও তাদের মোট প্রাপ্ত ভোট একাধিক সংসদ সদস্যের প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে বেশি হতে পারে। সুতরাং তাদের এই জনপ্রিয়তা দৃশ্যমান হওয়া প্রয়োজন। স্থানীয় সংসদ সদস্যরা এলাকার উন্নয়নমূলক কাজে যৌক্তিক মাত্রায় অংশগ্রহণ করবেন। সংসদ সদস্যরা একাধারে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হওয়ার ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যের দায়িত্ব পালনে স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় বলে সংসদ এ বিষয়ে পরিষ্কার নীতি গ্রহণ করতে পারে। এছাড়াও বিগত কয়েকটি সরকারে বিরোধী দলের সংসদ বর্জন অথচ সংসদ সদস্য হিসেবে সব সুযোগ-সুবিধা কড়ায়গণ্ডায় ভোগ করা থেকে সাধারণ মানুষের ধারণা জšে§ছে যে, আমাদের প্রতিনিধি নেতারা চিন্তা-চেতনা-ত্যাগে আমাদের প্রত্যাশাকে কোনোভাবেই স্পর্শ করতে পারছেন না। সুতরাং তাদের নিজেদের কর্মকাণ্ডের যথাযথ মূল্যায়নের জন্য ‘না ভোট’ দানের সুযোগ থাকা উচিত।
২.
বর্তমানে প্রধান দুটি দলের মধ্যে পরস্পরের প্রতি আস্থাহীনতা দেশের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর ও লজ্জাজনক। এ অবস্থায় সমঝোতার মাধ্যমে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া তত সহজ হওয়ার কথা নয়। নির্বাচনকালীন সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্দলীয় সরকার কিংবা নির্বাচন কমিশন বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে দুটি দল একমত হবে এটা কল্পনা করতেও কষ্ট হয়। এজন্য সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যে বিষয়েই সমঝোতা হওয়া প্রয়োজন, সে বিষয়েই নিচের পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে।
মনে করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ও অন্য সদস্যদের নির্বাচনে উভয় দলকে সমঝোতায় আসতে হবে। নির্বাচন কমিশন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে উভয় দলকে আমন্ত্রণ জানাবে। জনসাধারণও জানবে এ অনুষ্ঠানে অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের জন্য দুই দলের মধ্যে সমঝোতা হবে। সারাদেশের মানুষ ওই অনুষ্ঠান উপভোগ করবে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা পেনড্রাইভে নিয়ে উভয় দলের প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হবেন। এর ফলে তালিকাগুলোর গোপনীয়তা বজায় রাখাও সহজ হবে। এবার প্রতিটি তালিকার প্রথম ১০টি নামের মধ্যে (সংখ্যাটি ১০-এর পরিবর্তে অন্য কিছুও হতে পারে) প্রথম মিল খোঁজা হবে (প্রথম মিলকেও আমরা প্রয়োজন অনুসারে সংজ্ঞায়িত করতে পারি)। না পেলে প্রথম ২০, প্রথম ৪০- এভাবে মিল খোঁজা হবে। তালিকার নামগুলোতে যাতে কোনো অস্পষ্টতা না থাকে সেজন্য তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ব্যবহার করা যেতে পারে। এক বা একাধিক সুযোগ্য উপস্থাপকের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানটি যেমন হতে পারে চিত্তাকর্ষক, তেমনি বিশ্বাসযোগ্য। সাধারণ মানুষের সামনে ঘটে যাওয়া এই সমঝোতা নিয়ে সন্দেহ কিংবা অনাস্থা জ্ঞাপন করা কোনো দলের জন্যই সহজ হবে না। সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা যাতে খুব বড় না হয়, সেজন্য উভয় দলের কাছে গ্রহণযোগ্য শর্ত দিয়ে এর দৈর্ঘ্য সীমিত রাখাও সম্ভব। তাছাড়া যেহেতু উভয় দলই জানছে যে নামটি অন্য তালিকায় থাকতে হবে, সুতরাং তাদের পছন্দের তালিকা যৌক্তিক হবে। যতক্ষণ উভয় তালিকায় একই নাম পাওয়া না যায়, ততক্ষণ টেলিভিশন অনুষ্ঠানটি চলতে থাকবে।
শুধু অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ও অন্যান্য সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে নয়, অন্য যে কোনো বিষয়েই সমঝোতায় পৌঁছতে এ ধরনের নৈর্ব্যক্তিক, স্বচ্ছ পদ্ধতি সাধারণ মানুষের সামনে উপস্থাপন করে তাদেরও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। জাতীয় সংসদের স্পিকার যেমন নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন, এক্ষেত্রেও জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দলগুলো তাদের পছন্দের মানুষ নির্বাচন করবে। তাই অনির্বাচিতদের দিয়ে সরকার চালানোর সমালোচনা এখানে প্রযোজ্য হবে না। উল্লেখ করা যেতে পারে, তত্ত্বাবধায়ক, নির্দলীয়, সর্বদলীয়, নির্বাচনকালীন সরকার কিংবা নির্বাচন কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নির্বাচনসহ যে কোনো বিষয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যদি সমঝোতার প্রয়োজন হয়, তা এ পদ্ধতির মাধ্যমে নিরপেক্ষভাবে ও স্বচ্ছতার সঙ্গে জনগণের সামনে করা যাবে।
৩.
আরেকটি বিষয় নিয়েও গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। একসময় আমরা কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কিংবা থাইল্যান্ডের তুলনায় পিছিয়ে ছিলাম না। উন্নতির মাপকাঠিতে এখন আমরা অনেক পেছনে। এ উদাহরণগুলো বিবেচনায় নিলে মনে হয়, পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতি আমাদের দেশে কোনো সুফল বয়ে আনেনি। প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য অন্যান্য দেশে যে নানারকম শর্ত রয়েছে, তা আমাদের দেশেও আরোপ করা উচিত। এর ফলে যারা প্রধানমন্ত্রী হবেন, তারা যথেষ্ট বিচক্ষণতা ও ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করবেন, যাতে করে সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পরও তারা যথাযথ সম্মানের সঙ্গে দেশেই বসবাস করতে পারেন। শুধু তাই নয়, দেশের জ্যেষ্ঠ, প্রাজ্ঞ, দেশ চালনায় অভিজ্ঞ, সম্মানিত নাগরিক হিসেবে তারা পরবর্তী নেতাদের মূল্যবান উপদেশ দিয়ে দেশ পরিচালনায় সহায়তা করতে পারেন। এই পদে সর্বোচ্চ এক মেয়াদ থাকার নিয়ম করা যায় কিনা, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। কোনো নেতা যদি যোগ্য নেতা তৈরি করতে ব্যর্থ হন, তাকে নেতা হিসেবে সফল ভাবা যায় না। ১৬ কোটি মানুষের দেশে মাত্র দু-একজন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য হলে আমাদের দেশে গণতন্ত্র সফলভাবে বিকশিত হবে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।
আমি আশা করি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান কিংবা সমাজবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা এবং আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে গবেষণা করে আমাদের দেশকে যথাসম্ভব ত্র“টিমুক্ত একটি ব্যবস্থা উপহার দিয়ে দেশবাসীকে অনিশ্চয়তা ও শংকা থেকে রক্ষা করবেন।
ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ : অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
No comments