অনুত্তীর্ণদের জন্য প্রশংসা-বচন by শাহনেওয়াজ বিপ্লব
মাঝে
মাঝে ভাবি আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশ সত্যিই এক আশ্চর্য দেশ। পৃথিবীর
অন্যান্য দেশের সংস্কৃতি থেকে একেবারেই আলাদা। সম্ভবত এটাই একমাত্র দেশ,
যেখানে পরাজিতের কথা কেউ মনে রাখে না। পাঠান-মুঘল-ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধ
করতে গিয়ে যেসব সৈনিক দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন, তাদের অনেকেরই যথাযথ জায়গা
হয়নি বাংলার ইতিহাসে। ওই সব যুদ্ধে পরাজিত হয়ে যেসব সৈনিক রক্তাক্ত হয়ে
ফিরে এসেছেন, সেসব পরাজিত সৈনিকের জন্য কোনো শোকগাথা নেই আমাদের। পরাজিতদের
ভুলে যাই আমরা খুব দ্রুত। স্মৃতির কোনো কক্ষে আমরা তুলে রাখি না পরাজিতদের
স্মৃতিচিহ্ন। পরাজিতের কবরে আমরা উৎসর্গ করি না কোনো রক্তগোলাপ। আসলে
আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিটাই এমন যে, ব্যর্থ আর সাফল্যহীনদের মনে রাখি না
আমরা। আমরা কেবল মুক্তোর মালা পরিয়ে দিই, যারা সফল তাদের গলায়। কথাটা মনে
হল এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের সৌভাগ্য দেখে। এইচএসসি
পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়ে গেছে এখন থেকে দেড় মাস আগে। আর ফলাফল প্রকাশের পর
থেকেই সমাজ বদলের স্লোগানধারী দেশের অন্যতম একটি দৈনিক, নানা প্রতিষ্ঠান,
সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক আর টেলিভিশন চ্যানেলগুলো জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের
সংবর্ধিত করে চলেছে আজ অবধি। এর বাইরে বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো উল্লাসরত
ছাত্রছাত্রীদের ছবি ছেপেছে। নিয়মিত সংবাদ প্রচার করেছে এসব সফলের স্বপ্ন আর
সম্ভাবনা নিয়ে। সব সংবাদ প্রতিবেদনের গৎবাঁধা সুর ছিল একই : শিক্ষার মান
বাংলাদেশে বেড়েছে, বাংলাদেশে মেধাবী শিক্ষার্থীর হার আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে
গেছে, জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা এগিয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি
নানারকম কেচ্ছা-কাহিনী।
বাংলাদেশে এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল ১০ লাখ ২ হাজার ৪৯৬ জন পরীক্ষার্থী। তার ভেতরে পাস করেছে ৭ লাখ ৪৪ হাজার ৮৯১ জন। সবচেয়ে বেশি ফেল করেছে চট্টগ্রামে। শতকরা ৩৯ জন পাস করতে পারেনি ওই বোর্ডে। পাসের এ রমরমা সময়ে চট্টগ্রামে প্রতি ১০০ জনে ৩৯ জন কেন পাস করতে পারল না, অথবা সারাদেশে সম্মিলিত হিসেবে বাকি ২৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী কেন পাস করতে পারল না? ইউরোপের দেশগুলোতে প্রশ্নটি এভাবেই তোলা হয়। জার্মানি ও অস্ট্রিয়ায় প্রতিবছর পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার পর দৈনিক পত্রিকাগুলো বাংলাদেশের মতোই সংবাদ ও প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তবে বাংলাদেশের মতো করে নয়। পরীক্ষায় যেসব ছাত্রছাত্রী অকৃতকার্য হয়, সাংবাদিকরা জানতে চায় ওই সব অকৃতকার্য ছাত্রছাত্রীর কাছ থেকে, কী দুঃখ ছিল তাদের মনে, কেন তারা পাস করল না? যারা ফেল করেছে তারা কি পাস করা ছাত্রছাত্রীদের চেয়ে স্বভাবে ও চারিত্র্যে ব্যতিক্রম? কী অভাব ছিল ফেল করা ছাত্র বা ছাত্রীটির? তার কি বইয়ের অভাব ছিল অথবা খাবারের? ঘরে কি তার মা নেই অথবা বাবাকে হারিয়েছে ছোটবেলায়?
কিন্তু আমাদের দেশে আজ পর্যন্ত কোনো সাংবাদিক এইচএসসি বা এসএসসিতে যারা ফেল করেছে যারা, তাদের কথা কোনো দিন ভাবেনি। তাদের কোনো সাক্ষাৎকার কোথাও ছাপা হয়নি। পরীক্ষায় ফেল করে যে আত্মহত্যা করেছে, তার কথা হয়তো লিখেছে সংবাদপত্রগুলো। কিন্তু গভীরে গিয়ে জানতে চায়নি কী দুঃখে ওই এইচএসসি ফেল করা ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে? কেন ছাত্রছাত্রীরা বেশি ফেল করে আমাদের দরিদ্র গ্রামীণ পরিবারগুলোতে? সে কথা জানতে চায় না কেউ। না মা-বাবা, না বন্ধু-বান্ধবী, সমাজ-সাংবাদিক- কেউই। যারা ফেল করে, আমাদের সমাজ তাদের জন্য বরাদ্দ রেখেছে শুধু নিন্দা আর মন্দ।
বলা হয়ে থাকে, জন্ম মানুষের ভাগ্যকে অর্ধেক নিয়ন্ত্রণ করে। যে ছাত্র বা ছাত্রীটি আজ চট্টগ্রামে কোনো গরিব মা-বাবার ঘরে জন্ম নিয়ে অভাব-অনটনের সংসারে প্রয়োজনীয় শিক্ষা-সুবিধা না পেয়ে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফেল করেছে, সে যদি আমেরিকায় কোনো ধনী মা-বাবার ঘরে জন্মগ্রহণ করত, তাহলে তার জীবন তো অন্যরকম হতে পারত। এ কথাটি আমরা বুঝতে চাই না। অথচ এমন এক গরিব দেশে জন্ম আমাদের, দারিদ্র্য আর অনটনের শিকার হয়ে বেশির ভাগ গ্রামীণ শিক্ষার্থী এসএসসি বা এইচএসসি পর্যন্ত কোনো রকমে লেখাপড়া চালিয়ে যায়। তাদের অনেকের হয়তো উপার্জনক্ষম কেউ নেই সংসারে। খাবার জোগানোর জন্য হয়তো দিনভর কাজ করতে হয়েছে ওসব ছাত্রছাত্রীকে। তাই যারা এবার এইচএসসিতে ফেল করেছ, তাদের বলছি- তোমরা হতাশ হয়ো না। সামর্থ্যে কুলালে পরের বার আবার চেষ্টা কর তোমরা। পৃথিবীতে বড় মনীষীরাও তো ফেল করেছে। আইনস্টাইন অংকে ফেল করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরীক্ষা-ভীতি ছিল। এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেয়া যায়।
পরিশেষে একটি কথা : যারা জিপিএ-৫ পেয়েছে, তাদের নিয়ে উল্লাস করার সঙ্গে সঙ্গে আমরা যেন আমাদের ফেল করা ছাত্রছাত্রীদের কথা ভুলে না যাই; সেদিকটাও খেয়াল রাখতে হবে। কারণ সমাজ বদলের অধিকার শুধু জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের একচ্ছত্র নয়, বরং যারা ফেল করেছে তাদেরও আছে সমাজ বদলের সমান অধিকার। বিষয়টি সমাজ বদলের স্লোগানদাতারা ভেবে দেখবেন- এই আশা করছি।
বাংলাদেশে এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল ১০ লাখ ২ হাজার ৪৯৬ জন পরীক্ষার্থী। তার ভেতরে পাস করেছে ৭ লাখ ৪৪ হাজার ৮৯১ জন। সবচেয়ে বেশি ফেল করেছে চট্টগ্রামে। শতকরা ৩৯ জন পাস করতে পারেনি ওই বোর্ডে। পাসের এ রমরমা সময়ে চট্টগ্রামে প্রতি ১০০ জনে ৩৯ জন কেন পাস করতে পারল না, অথবা সারাদেশে সম্মিলিত হিসেবে বাকি ২৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী কেন পাস করতে পারল না? ইউরোপের দেশগুলোতে প্রশ্নটি এভাবেই তোলা হয়। জার্মানি ও অস্ট্রিয়ায় প্রতিবছর পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার পর দৈনিক পত্রিকাগুলো বাংলাদেশের মতোই সংবাদ ও প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তবে বাংলাদেশের মতো করে নয়। পরীক্ষায় যেসব ছাত্রছাত্রী অকৃতকার্য হয়, সাংবাদিকরা জানতে চায় ওই সব অকৃতকার্য ছাত্রছাত্রীর কাছ থেকে, কী দুঃখ ছিল তাদের মনে, কেন তারা পাস করল না? যারা ফেল করেছে তারা কি পাস করা ছাত্রছাত্রীদের চেয়ে স্বভাবে ও চারিত্র্যে ব্যতিক্রম? কী অভাব ছিল ফেল করা ছাত্র বা ছাত্রীটির? তার কি বইয়ের অভাব ছিল অথবা খাবারের? ঘরে কি তার মা নেই অথবা বাবাকে হারিয়েছে ছোটবেলায়?
কিন্তু আমাদের দেশে আজ পর্যন্ত কোনো সাংবাদিক এইচএসসি বা এসএসসিতে যারা ফেল করেছে যারা, তাদের কথা কোনো দিন ভাবেনি। তাদের কোনো সাক্ষাৎকার কোথাও ছাপা হয়নি। পরীক্ষায় ফেল করে যে আত্মহত্যা করেছে, তার কথা হয়তো লিখেছে সংবাদপত্রগুলো। কিন্তু গভীরে গিয়ে জানতে চায়নি কী দুঃখে ওই এইচএসসি ফেল করা ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে? কেন ছাত্রছাত্রীরা বেশি ফেল করে আমাদের দরিদ্র গ্রামীণ পরিবারগুলোতে? সে কথা জানতে চায় না কেউ। না মা-বাবা, না বন্ধু-বান্ধবী, সমাজ-সাংবাদিক- কেউই। যারা ফেল করে, আমাদের সমাজ তাদের জন্য বরাদ্দ রেখেছে শুধু নিন্দা আর মন্দ।
বলা হয়ে থাকে, জন্ম মানুষের ভাগ্যকে অর্ধেক নিয়ন্ত্রণ করে। যে ছাত্র বা ছাত্রীটি আজ চট্টগ্রামে কোনো গরিব মা-বাবার ঘরে জন্ম নিয়ে অভাব-অনটনের সংসারে প্রয়োজনীয় শিক্ষা-সুবিধা না পেয়ে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফেল করেছে, সে যদি আমেরিকায় কোনো ধনী মা-বাবার ঘরে জন্মগ্রহণ করত, তাহলে তার জীবন তো অন্যরকম হতে পারত। এ কথাটি আমরা বুঝতে চাই না। অথচ এমন এক গরিব দেশে জন্ম আমাদের, দারিদ্র্য আর অনটনের শিকার হয়ে বেশির ভাগ গ্রামীণ শিক্ষার্থী এসএসসি বা এইচএসসি পর্যন্ত কোনো রকমে লেখাপড়া চালিয়ে যায়। তাদের অনেকের হয়তো উপার্জনক্ষম কেউ নেই সংসারে। খাবার জোগানোর জন্য হয়তো দিনভর কাজ করতে হয়েছে ওসব ছাত্রছাত্রীকে। তাই যারা এবার এইচএসসিতে ফেল করেছ, তাদের বলছি- তোমরা হতাশ হয়ো না। সামর্থ্যে কুলালে পরের বার আবার চেষ্টা কর তোমরা। পৃথিবীতে বড় মনীষীরাও তো ফেল করেছে। আইনস্টাইন অংকে ফেল করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরীক্ষা-ভীতি ছিল। এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেয়া যায়।
পরিশেষে একটি কথা : যারা জিপিএ-৫ পেয়েছে, তাদের নিয়ে উল্লাস করার সঙ্গে সঙ্গে আমরা যেন আমাদের ফেল করা ছাত্রছাত্রীদের কথা ভুলে না যাই; সেদিকটাও খেয়াল রাখতে হবে। কারণ সমাজ বদলের অধিকার শুধু জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের একচ্ছত্র নয়, বরং যারা ফেল করেছে তাদেরও আছে সমাজ বদলের সমান অধিকার। বিষয়টি সমাজ বদলের স্লোগানদাতারা ভেবে দেখবেন- এই আশা করছি।
শাহনেওয়াজ বিপ্লব : কবি, গল্পকার ও অস্ট্রিয়া প্রবাসী গবেষক
No comments