পোস্টারসর্বস্ব নেতা ও আগামীর নেতৃত্ব by অরবিন্দ রায়
‘আমাদের
দেশে হবে সেই ছেলে কবে? কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।’ কবিতার চরণ দুটি
নেয়া হয়েছে কবি কুসুমকুমারী দাসের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতা থেকে। কবির এ
‘কবে’-এর জবাব কবে মিলবে তা বিধাতাই জানেন। তবে এরই মধ্যে তরুণ প্রজন্মর
মধ্যে নতুন এক অনুসর্গ দেখা দিয়েছে। কবি আজ বেঁচে থাকলে অকর্মাদের
বাগাড়ম্বরসর্বস্ব পুরনো অনুসর্গের সঙ্গে নবীন অনুসর্গটিকেও যোগ করতেন।
কেননা চলমান এ উদ্ভট কর্মকাণ্ডের কারণে কেবল মহানগরীর সৌন্দর্যই নষ্ট হচ্ছে
না, সেই সঙ্গে দেশ ও জাতি তার ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি গঠনেও হিমশিম খাচ্ছে। বলার
অপেক্ষা রাখে না, এসব কর্মকাণ্ড যোগ্য নেতা সৃষ্টির পথে বড় অন্তরায়। দেশের
ভাবী কাণ্ডারিদের এসব কার্যকলাপে বীতশ্রদ্ধ হয়ে কবি হয়তো লিখতেন, ‘আমাদের
দেশে হবে সেই নেতা কবে? পোস্টারে না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।’ সেই কাজের নেতা
কবে দেখতে পাব? জবাব, সদিচ্ছা থাকলে অচিরেই দেয়া সম্ভব। এর জন্য চাই সরকারি
ও বিরোধী দলসহ অন্যান্য দলের হাইকমান্ডে থাকা ব্যক্তিদের শুধু একটি
নির্দেশনা। তা হচ্ছে ‘উঠিয়ে ফেলো, আর না’।
দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে যুগে যুগে অনেক নেতার আবির্ভাব ঘটেছে। তাদের মধ্যে চীনের মাও জে দং, ভিয়েতনামের হো চি মিন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, বলিভিয়ার চে গুয়েভারা, ভেনিজুয়েলার হুগো শাভেজ, বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা অন্যতম। তারা দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে নিজ জীবন ও যৌবনকে তুচ্ছ করে সংকটময় পরিস্থিতি থেকে জাতিকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তাদের এ সুকর্মের সৌরভ সময়ের সীমা ছাড়িয়ে, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রশ্ন জাগে, তাদের এ কর্মগুণ দেশ-মহাদেশে ছড়িয়ে দিতে তারাও কি বিলবোর্ড আকারের পোস্টার শহরের মোড়ে মোড়ে টাঙ্গিয়ে রেখেছিলেন? যদি তাই না হয়ে থাকে, তাহলে বর্তমানে আমাদের দেশে যারা ‘গাঁয়ে মানে না, আপনি মোড়ল’ স্টাইলে নিজেদের প্রচার করছেন, তাদের এসব কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য যাই-ই হোক, তার সঙ্গে যে সততার কোনো সম্পর্ক নেই তা হলফ করেই বলা যায়। আর এই মোটা বুদ্ধির কার্যক্রমকে নীতিনির্ধারকরা কিভাবে দুই যুগ ধরে সায় দিচ্ছেন তা বোধগম্য নয়। এসব প্রশ্রয়ধর্মী কর্মকাণ্ডে দেশ ও সমাজ কোন রসাতলের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে, আজ সে কথা ভাবার সময় এসেছে।
বলা যায় টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া হেন জায়গা নেই, যেখানে স্বঘোষিত জনদরদি ও সমাজসেবক নামধারীদের চন্দ্র মুখ প্রদর্শিত হচ্ছে না। এ ধরনের পোস্টার প্রচারে কোনোরকম নীতি-নৈতিকতা ও আইনগত বাধা না থাকায় যে যেভাবে পারছে দলীয় ঊর্ধ্বতন নেতাদের লেজ ধরে নিজেদের জনসমক্ষে উপস্থাপিত করছেন। ঈদ, নববর্ষ বা পদপ্রাপ্তির শুভেচ্ছা জানানোর আড়ালে প্রকারান্তরে তারা নিজেদেরই জাহির করছেন। ফলে দেশ ও সমাজের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়ার মানস নিয়ে মাঠে নামা ত্যাগী নেতার বদলে বর্তমানে যাদের দেখা যাচ্ছে, তাদের কতকটা কাগজের চাইনিজ গোলাপের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কৃত্রিম টবসহ ফুল পাতা কুঁড়ির এমন সব চাইনিজ গোলাপ আজকাল পাওয়া যায়, যা মাটিতে লাগানো গোলাপের চেয়েও প্রাণবন্ত বলে মনে হয়। কিন্তু কোনো ঘ্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না। ইদানীং এ ধরনের প্রচার কার্যক্রমের ইঁদুর দৌড়ে মহল্লার পাতিনেতা থেকে শুরু করে অনেক জাতীয় নেতাকেও শামিল হতে দেখা যাচ্ছে। বুক মাপের ছবি বাঁশের খুঁটিতে জিআই তার দিয়ে বেঁধে গলির মোড়ে, বিপণিবিতানের সামনে, গুরুত্বপূর্ণ চৌপথি ছাড়াও বাসের বডিতে, রিকশার হুডের তলায়, বৈদ্যুতিক খুঁটিতে প্রদর্শিত হতে দেখা যায়। রকমারি ভঙ্গিমায় তোলা ছবিগুলোর দিকে তাকালে বড় করুণা হয়। কথায় বলে মুখচ্ছবি হচ্ছে মনের আয়না। মনের ইচ্ছা-অনিচ্ছাগুলোই মুখচ্ছবিতে ভেসে ওঠে। কাজেই অনেক ছবির দিকে তাকালে তাদের চাহনির সঙ্গে মুরগির দিকে শেয়ালের চাহনির অনেকটাই মিল পাওয়া যায়। এখানে মুরগি হচ্ছে দেশ ও দশের স্বার্থ। অনেকের দৃষ্টির মধ্যে দেশ ও দশের স্বার্থ লুটেপুটে খাওয়ার ইঙ্গিত মেলে।
প্রাসঙ্গিক বিধায় উল্লেখ্য, ইউরোপের বেশ ক’টি দেশ ভ্রমণের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সেসব দেশে বাস ও রেলপথে হাজার হাজার মাইল ভ্রমণ করার পরও কোথাও কোনো নেতা-নেত্রীর ছবিসহ পোস্টার আমার চোখে পড়েনি। তাই বলে কি ধারণা করা যৌক্তিক হবে যে, ইউরোপে কোনো যোগ্য নেতা-নেত্রী নেই? আসলে ইউরোপের ওরা কাজে বিশ্বাসী। আর আমরা বিশ্বাসী ভং-এ। তারা সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী বলেই নিজেদের উপস্থাপন করে কাজ ও সেবার মাধ্যমে। আর আমাদের দেশে উদীয়মান আগামীর নেতারা নিজেদের উপস্থাপন করছেন বড় বড় পোস্টারে। একটি জাতিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য দক্ষ নেতার প্রয়োজন, যিনি নেতৃত্ব দিয়ে শিকড় পর্যায়ের নেতাদের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ের জনহিতৈষী কাজগুলো করিয়ে নেবেন। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতার দৃষ্টি কাড়ার প্রতিযোগিতা হবে ভালো কাজের ও মার্জিত আচার-আচরণের। কিন্তু এখন অধিকাংশ নেতাই ভালো কাজ ও মার্জিত আচার-আচরণের পথ পরিহার করে বিলবোর্ড মাপের পোস্টার দিয়ে কেন্দ্রের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। ফলে দেশ ও সমাজকে ভালোবাসা ও জনসেবার বিষয়টি গৌণই থেকে যায়। কতকটা চতুর্থ বিষয় বা অপশনাল সাবজেক্টের মতো। ফেল করলেও কোনো যায় আসে না তাতে। কিন্তু দেশ ও সমাজের মঙ্গলার্থে কাজ না করলে কি যোগ্য নেতা হওয়া সম্ভব? বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশ ও সমাজসেবার পথ এড়িয়ে আজ যারা পোস্টারীয় প্রচারে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন, এসবের মাধ্যমে তারা যোগ্য নেতা হওয়া দূরে থাক, পুরনো কোনো প্রতিষ্ঠিত নেতার সহকারী হওয়ারও যোগ্যতা অর্জন করতে পারবেন কি-না সন্দেহ। এ সংক্রান্ত আরও একটি কথা না বললেই নয়। যারা পোস্টারে ছবি জাহিরের চেয়ে কাজে বিশ্বাসী, তাদের কথা যদি না বলি তাহলে লেখাটির চৌদ্দ আনাই অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। আজ যারা নীরবে নিভৃতে কাজ করে যাবেন বলে মনস্থির করেছেন, তারা কিন্তু পোস্টারের ভিড়ে অন্তরালেই থেকে যাচ্ছেন। প্রকারান্তরে তারা দলের হাইকমান্ডের চোখে আনুগত্যহীন বা ভিলেন হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন। উপর মহল এলাকায় এসে যখন মুলোর মতো দাঁত কেলানো হাসিমাখা মুখের পোস্টারীয় নেতাকে দেখতে পান, তখন তাকেই এলাকার একনিষ্ঠ কর্মী ভেবে কাছে ডেকে ফিসফাঁস করে চলে যান। ফলে সত্যিকার কর্মীরা কেন্দ্রীয় নেতাদের অবজ্ঞার শিকার হয়ে তুষের আগুনের মতো জ্বলতে থাকেন। এভাবে জ্বলতে জ্বলতে এক সময় তিনি নিজেও সঠিক পথের প্রতি আস্থা হারিয়ে অগত্যা যুগের গড্ডলিকায় গা ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হন। কিন্তু ততক্ষণে সময় অনেক পেরিয়ে গেছে। কেননা সময়ের অনেক আগেই সেই চীনা গোলাপটি কেন্দ্রীয় নেতার মনের বাগানে স্থান করে নিয়েছে। সেই রূপকথার গল্পের মতো। রাজকুমারী ‘কাজল রেখা’ স্নান সেরে এসে বিধিমতো রাজকুমারকে জাগিয়ে তোলার আগেই কুটনি দাসী রাজকুমারকে জাগিয়ে তুলে কাজল রেখার আসন দখলে নিয়েছে। আর এভাবেই ভুল পথে ভুল নেতা সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজে একের পর এক কাহিনীর সৃষ্টি হচ্ছে। সেই সঙ্গে আনুপাতিক হারে বাড়ছে জনদুর্ভোগ। এ দুর্ভোগ কেবল জনগণের একার নয়। এ দুর্ভোগ পথ চলাচলকারী নেতা ও নেত্রীদেরও। কাজেই সরকার ও নেতা-নেত্রীদের প্রতি বিনীত অনুরোধ, তারা যেন অবিলম্বে তাদের অনুসারীদের ভণ্ড পোস্টার নীতির পথ পরিহার করে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনেন। পোস্টার কেবল নির্বাচনকালীন নমিনেশন প্রাপ্তরাই লাগানোর অনুমতি পাবেন। তাও নমিনেশন প্রাপ্তির পরদিন থেকে নির্বাচনের সময় পর্যন্ত। নির্বাচন শেষ হওয়ার তিন দিনের মাথায় তা নিজ নিজ দায়িত্বে সরিয়ে ফেলে নগরীর সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনবেন। এটা করার জন্য সবার সদিচ্ছাই যথেষ্ট বলে মনে হয়। এ ব্যাপারে সব দলের হাইকমান্ড থেকে ও সরকারি নির্দেশসহ ঘোষণা আসা প্রয়োজন। যারা যেখানে যে উদ্দেশ্যেই পোস্টার ঝুলিয়ে রাখেন না কেন, তা যেন স্ব স্ব ব্যক্তি অবিলম্বে খুলে ফেলেন। তা না হলে যার পোস্টার পাওয়া যাবে, তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে সরকার বা দলীয় উচ্চ নির্দেশকরা বাধ্য হবেন। যেহেতু আইন অমান্যকারীর ছবি ও ঠিকানা দেয়াই থাকবে, তাই তাকে ত্বরিত আইনের আওতায় নিয়ে আসা খুব কঠিন হবে বলে মনে হয় না। এটা করা গেলে ‘যত বড় নেতা নয়, তত বড় পোস্টার’- এ রেওয়াজ থেকে উদীয়মান নেতারা রক্ষা পাবেন। সেই সঙ্গে যোগ্য নেতা পরিমাপের জন্য পোস্টারের আকার ও সংখ্যা বিবেচনায় না এনে কর্ম ও গুণকে প্রাধান্য দেয়ার রেওয়াজটি রক্ষা পাবে বলে মনে হয়।
সরকারের তরফ থেকে যদি ঘোষণা নাও আসে, কেউ সত্যিকারের নেতা হতে চাইলে তাকে নিজ দায়িত্বে নিজের ছবিওয়ালা পোস্টারগুলো সরিয়ে নিয়ে জনসেবামূলক কাজে লেগে যেতে হবে। এতেই তিনি হয়ে উঠবেন সত্যিকারের নেতা। জনগণের মানসপটে থাকবে তার নাম। কেননা আমজনতা এতটা বেঈমান নয়। আপনি যদি মানুষের জন্য কাজ করেন, তাহলে দেখবেন মানুষ আপনার ছবি ঘরে ঘরে ঝুলিয়ে রাখবে। আপনাকে টাকা খরচ করে বিলবোর্ড বানাতে হবে না। তখন আপনার সঙ্গে গলির মোড়ের বাঁশের খুঁটিতে লটকানো পোস্টারসর্বস্ব নেতার তুলনা করা হলে আপনি পাবেন নিরানব্বই ভোট। আর তিনি পাবেন মোটে একটি। অর্থাৎ নিজেরটি।
অরবিন্দ রায় : একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কারিগরি পরিচালক
দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে যুগে যুগে অনেক নেতার আবির্ভাব ঘটেছে। তাদের মধ্যে চীনের মাও জে দং, ভিয়েতনামের হো চি মিন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, বলিভিয়ার চে গুয়েভারা, ভেনিজুয়েলার হুগো শাভেজ, বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা অন্যতম। তারা দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে নিজ জীবন ও যৌবনকে তুচ্ছ করে সংকটময় পরিস্থিতি থেকে জাতিকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তাদের এ সুকর্মের সৌরভ সময়ের সীমা ছাড়িয়ে, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রশ্ন জাগে, তাদের এ কর্মগুণ দেশ-মহাদেশে ছড়িয়ে দিতে তারাও কি বিলবোর্ড আকারের পোস্টার শহরের মোড়ে মোড়ে টাঙ্গিয়ে রেখেছিলেন? যদি তাই না হয়ে থাকে, তাহলে বর্তমানে আমাদের দেশে যারা ‘গাঁয়ে মানে না, আপনি মোড়ল’ স্টাইলে নিজেদের প্রচার করছেন, তাদের এসব কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য যাই-ই হোক, তার সঙ্গে যে সততার কোনো সম্পর্ক নেই তা হলফ করেই বলা যায়। আর এই মোটা বুদ্ধির কার্যক্রমকে নীতিনির্ধারকরা কিভাবে দুই যুগ ধরে সায় দিচ্ছেন তা বোধগম্য নয়। এসব প্রশ্রয়ধর্মী কর্মকাণ্ডে দেশ ও সমাজ কোন রসাতলের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে, আজ সে কথা ভাবার সময় এসেছে।
বলা যায় টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া হেন জায়গা নেই, যেখানে স্বঘোষিত জনদরদি ও সমাজসেবক নামধারীদের চন্দ্র মুখ প্রদর্শিত হচ্ছে না। এ ধরনের পোস্টার প্রচারে কোনোরকম নীতি-নৈতিকতা ও আইনগত বাধা না থাকায় যে যেভাবে পারছে দলীয় ঊর্ধ্বতন নেতাদের লেজ ধরে নিজেদের জনসমক্ষে উপস্থাপিত করছেন। ঈদ, নববর্ষ বা পদপ্রাপ্তির শুভেচ্ছা জানানোর আড়ালে প্রকারান্তরে তারা নিজেদেরই জাহির করছেন। ফলে দেশ ও সমাজের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়ার মানস নিয়ে মাঠে নামা ত্যাগী নেতার বদলে বর্তমানে যাদের দেখা যাচ্ছে, তাদের কতকটা কাগজের চাইনিজ গোলাপের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কৃত্রিম টবসহ ফুল পাতা কুঁড়ির এমন সব চাইনিজ গোলাপ আজকাল পাওয়া যায়, যা মাটিতে লাগানো গোলাপের চেয়েও প্রাণবন্ত বলে মনে হয়। কিন্তু কোনো ঘ্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না। ইদানীং এ ধরনের প্রচার কার্যক্রমের ইঁদুর দৌড়ে মহল্লার পাতিনেতা থেকে শুরু করে অনেক জাতীয় নেতাকেও শামিল হতে দেখা যাচ্ছে। বুক মাপের ছবি বাঁশের খুঁটিতে জিআই তার দিয়ে বেঁধে গলির মোড়ে, বিপণিবিতানের সামনে, গুরুত্বপূর্ণ চৌপথি ছাড়াও বাসের বডিতে, রিকশার হুডের তলায়, বৈদ্যুতিক খুঁটিতে প্রদর্শিত হতে দেখা যায়। রকমারি ভঙ্গিমায় তোলা ছবিগুলোর দিকে তাকালে বড় করুণা হয়। কথায় বলে মুখচ্ছবি হচ্ছে মনের আয়না। মনের ইচ্ছা-অনিচ্ছাগুলোই মুখচ্ছবিতে ভেসে ওঠে। কাজেই অনেক ছবির দিকে তাকালে তাদের চাহনির সঙ্গে মুরগির দিকে শেয়ালের চাহনির অনেকটাই মিল পাওয়া যায়। এখানে মুরগি হচ্ছে দেশ ও দশের স্বার্থ। অনেকের দৃষ্টির মধ্যে দেশ ও দশের স্বার্থ লুটেপুটে খাওয়ার ইঙ্গিত মেলে।
প্রাসঙ্গিক বিধায় উল্লেখ্য, ইউরোপের বেশ ক’টি দেশ ভ্রমণের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সেসব দেশে বাস ও রেলপথে হাজার হাজার মাইল ভ্রমণ করার পরও কোথাও কোনো নেতা-নেত্রীর ছবিসহ পোস্টার আমার চোখে পড়েনি। তাই বলে কি ধারণা করা যৌক্তিক হবে যে, ইউরোপে কোনো যোগ্য নেতা-নেত্রী নেই? আসলে ইউরোপের ওরা কাজে বিশ্বাসী। আর আমরা বিশ্বাসী ভং-এ। তারা সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী বলেই নিজেদের উপস্থাপন করে কাজ ও সেবার মাধ্যমে। আর আমাদের দেশে উদীয়মান আগামীর নেতারা নিজেদের উপস্থাপন করছেন বড় বড় পোস্টারে। একটি জাতিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য দক্ষ নেতার প্রয়োজন, যিনি নেতৃত্ব দিয়ে শিকড় পর্যায়ের নেতাদের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ের জনহিতৈষী কাজগুলো করিয়ে নেবেন। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতার দৃষ্টি কাড়ার প্রতিযোগিতা হবে ভালো কাজের ও মার্জিত আচার-আচরণের। কিন্তু এখন অধিকাংশ নেতাই ভালো কাজ ও মার্জিত আচার-আচরণের পথ পরিহার করে বিলবোর্ড মাপের পোস্টার দিয়ে কেন্দ্রের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। ফলে দেশ ও সমাজকে ভালোবাসা ও জনসেবার বিষয়টি গৌণই থেকে যায়। কতকটা চতুর্থ বিষয় বা অপশনাল সাবজেক্টের মতো। ফেল করলেও কোনো যায় আসে না তাতে। কিন্তু দেশ ও সমাজের মঙ্গলার্থে কাজ না করলে কি যোগ্য নেতা হওয়া সম্ভব? বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশ ও সমাজসেবার পথ এড়িয়ে আজ যারা পোস্টারীয় প্রচারে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন, এসবের মাধ্যমে তারা যোগ্য নেতা হওয়া দূরে থাক, পুরনো কোনো প্রতিষ্ঠিত নেতার সহকারী হওয়ারও যোগ্যতা অর্জন করতে পারবেন কি-না সন্দেহ। এ সংক্রান্ত আরও একটি কথা না বললেই নয়। যারা পোস্টারে ছবি জাহিরের চেয়ে কাজে বিশ্বাসী, তাদের কথা যদি না বলি তাহলে লেখাটির চৌদ্দ আনাই অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। আজ যারা নীরবে নিভৃতে কাজ করে যাবেন বলে মনস্থির করেছেন, তারা কিন্তু পোস্টারের ভিড়ে অন্তরালেই থেকে যাচ্ছেন। প্রকারান্তরে তারা দলের হাইকমান্ডের চোখে আনুগত্যহীন বা ভিলেন হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন। উপর মহল এলাকায় এসে যখন মুলোর মতো দাঁত কেলানো হাসিমাখা মুখের পোস্টারীয় নেতাকে দেখতে পান, তখন তাকেই এলাকার একনিষ্ঠ কর্মী ভেবে কাছে ডেকে ফিসফাঁস করে চলে যান। ফলে সত্যিকার কর্মীরা কেন্দ্রীয় নেতাদের অবজ্ঞার শিকার হয়ে তুষের আগুনের মতো জ্বলতে থাকেন। এভাবে জ্বলতে জ্বলতে এক সময় তিনি নিজেও সঠিক পথের প্রতি আস্থা হারিয়ে অগত্যা যুগের গড্ডলিকায় গা ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হন। কিন্তু ততক্ষণে সময় অনেক পেরিয়ে গেছে। কেননা সময়ের অনেক আগেই সেই চীনা গোলাপটি কেন্দ্রীয় নেতার মনের বাগানে স্থান করে নিয়েছে। সেই রূপকথার গল্পের মতো। রাজকুমারী ‘কাজল রেখা’ স্নান সেরে এসে বিধিমতো রাজকুমারকে জাগিয়ে তোলার আগেই কুটনি দাসী রাজকুমারকে জাগিয়ে তুলে কাজল রেখার আসন দখলে নিয়েছে। আর এভাবেই ভুল পথে ভুল নেতা সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজে একের পর এক কাহিনীর সৃষ্টি হচ্ছে। সেই সঙ্গে আনুপাতিক হারে বাড়ছে জনদুর্ভোগ। এ দুর্ভোগ কেবল জনগণের একার নয়। এ দুর্ভোগ পথ চলাচলকারী নেতা ও নেত্রীদেরও। কাজেই সরকার ও নেতা-নেত্রীদের প্রতি বিনীত অনুরোধ, তারা যেন অবিলম্বে তাদের অনুসারীদের ভণ্ড পোস্টার নীতির পথ পরিহার করে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনেন। পোস্টার কেবল নির্বাচনকালীন নমিনেশন প্রাপ্তরাই লাগানোর অনুমতি পাবেন। তাও নমিনেশন প্রাপ্তির পরদিন থেকে নির্বাচনের সময় পর্যন্ত। নির্বাচন শেষ হওয়ার তিন দিনের মাথায় তা নিজ নিজ দায়িত্বে সরিয়ে ফেলে নগরীর সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনবেন। এটা করার জন্য সবার সদিচ্ছাই যথেষ্ট বলে মনে হয়। এ ব্যাপারে সব দলের হাইকমান্ড থেকে ও সরকারি নির্দেশসহ ঘোষণা আসা প্রয়োজন। যারা যেখানে যে উদ্দেশ্যেই পোস্টার ঝুলিয়ে রাখেন না কেন, তা যেন স্ব স্ব ব্যক্তি অবিলম্বে খুলে ফেলেন। তা না হলে যার পোস্টার পাওয়া যাবে, তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে সরকার বা দলীয় উচ্চ নির্দেশকরা বাধ্য হবেন। যেহেতু আইন অমান্যকারীর ছবি ও ঠিকানা দেয়াই থাকবে, তাই তাকে ত্বরিত আইনের আওতায় নিয়ে আসা খুব কঠিন হবে বলে মনে হয় না। এটা করা গেলে ‘যত বড় নেতা নয়, তত বড় পোস্টার’- এ রেওয়াজ থেকে উদীয়মান নেতারা রক্ষা পাবেন। সেই সঙ্গে যোগ্য নেতা পরিমাপের জন্য পোস্টারের আকার ও সংখ্যা বিবেচনায় না এনে কর্ম ও গুণকে প্রাধান্য দেয়ার রেওয়াজটি রক্ষা পাবে বলে মনে হয়।
সরকারের তরফ থেকে যদি ঘোষণা নাও আসে, কেউ সত্যিকারের নেতা হতে চাইলে তাকে নিজ দায়িত্বে নিজের ছবিওয়ালা পোস্টারগুলো সরিয়ে নিয়ে জনসেবামূলক কাজে লেগে যেতে হবে। এতেই তিনি হয়ে উঠবেন সত্যিকারের নেতা। জনগণের মানসপটে থাকবে তার নাম। কেননা আমজনতা এতটা বেঈমান নয়। আপনি যদি মানুষের জন্য কাজ করেন, তাহলে দেখবেন মানুষ আপনার ছবি ঘরে ঘরে ঝুলিয়ে রাখবে। আপনাকে টাকা খরচ করে বিলবোর্ড বানাতে হবে না। তখন আপনার সঙ্গে গলির মোড়ের বাঁশের খুঁটিতে লটকানো পোস্টারসর্বস্ব নেতার তুলনা করা হলে আপনি পাবেন নিরানব্বই ভোট। আর তিনি পাবেন মোটে একটি। অর্থাৎ নিজেরটি।
অরবিন্দ রায় : একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কারিগরি পরিচালক
No comments