এ কেমন উদারতা? by বিমল সরকার
আমাদের
দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক বিশৃংখলা, দৈন্যদশা এবং সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
বিখ্যাত সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন কার্যক্রম তো অনেক আগে থেকেই
ছাত্র নামধারী সশস্ত্র ক্যাডারদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। সিলেবাস কমানো,
পরীক্ষার তারিখ পেছানো, ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে কিংবা পরীক্ষায় ফেল
করেও ভর্তি করানো, নির্বাচনী পরীক্ষা না দিয়ে বা পরীক্ষায় ফেল করেও
চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগদান, পরীক্ষাকেন্দ্র স্থাপন বা
স্থানান্তরকরণ,বহিষ্কারের আদেশ প্রত্যাহার এবং ফেল করা শিক্ষার্থীকে পাস
করিয়ে দেয়া- কোনো ইস্যুতে নামিদামি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায়
প্রতিনিয়ত তথাকথিত আন্দোলনের নামে তুলকালাম হচ্ছে। আর ভর্তি ফি কমানো, কম
টাকায় ফরমপূরণের সুযোগদান, জরিমানা বা শাস্তি মওকুফ এসব তো তাদের কাছে
একেবারেই মামুলি ইসু। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এসব অবাঞ্ছিত-অনভিপ্রেত
দাবি-দাওয়ার কাছেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনেক সময় নতি স্বীকার করতে হয়।
আর শিক্ষা ক্ষেত্রে একবার একটি অনিয়মকে প্রশ্রয় দিলে ভবিষ্যতে তা কীরূপ
অসুবিধা ও বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে একমাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া আর
কেউ বোধকরি বলতে পারবে না। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান,
শিক্ষক-কর্মকর্তাবৃন্দ, শিক্ষা বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি
কিংবা কর্তৃপক্ষের এই বিষয়টি খুব ভালো করে জানার কথা।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ২০১১ সালের অনার্স প্রথম বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফলকে কেন্দ্র করে যে কাণ্ডটি সম্প্রতি ঘটেছে বা ঘটানো হয়েছে তা শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের দৈন্যদশা কিংবা অন্তঃসারশূন্যতার আরও একটি দলিল হিসেবেই অনেকদিন পর্যন্ত চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ১৭ জুলাই প্রকাশিত ওই ফলাফলে দেখা যায়, অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীদের মধ্যে শতকরা ৫৪ ভাগ উত্তীর্ণ হয়েছে। উত্তীর্ণদের স্বাভাবিকভাবে দ্বিতীয় বর্ষে উন্নীত বলে ঘোষণা করা হয়। আর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অর্থাৎ ৪৬ ভাগ পরীক্ষার্থীই হয় অকৃতকার্য। এই বিপুলসংখ্যক ফেল করা পরীক্ষার্থী তাদের পাস করিয়ে দ্বিতীয় বর্ষে উন্নীত করার দাবিতে প্রথমে নিজ নিজ কলেজে এবং পরে রাজপথে বিক্ষোভ, অবরোধ, সমাবেশ ও মানববন্ধন করে। টায়ার জ্বালিয়ে অগ্নিসংযোগ এবং যানবাহন ভাংচুর করে। এমনকি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাখা শিক্ষক-কর্মকর্তাদের পরিবহনে ব্যবহƒত গাড়ি ভাংচুর করে অন্তত ১০-১২টি। টানা ৪-৫দিন দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং রাজপথে এসব আচার বা অনাচার সংঘটিত হতে থাকলে ২১ জুলাই রাতে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মোট ৬ অথবা ৭টি বিষয়ের মধ্যে ৫টিতে যারা এফ গ্রেড পেয়েছে বা ফেল করেছে তাদের আপাতত পাস দেখিয়ে দ্বিতীয় বর্ষে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিজ্ঞান অনুষদের বিভিন্ন বিভাগে যারা ৭টি কোর্সের মধ্যে ২টি আর কলা, সামাজিক বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদভুক্ত বিভাগগুলোর ৬টি কোর্সের মধ্যে একটিতে পাস করেছে তাদের দ্বিতীয় বর্ষে উন্নীত হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। ওই সিদ্ধান্তের ফলে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষায় পাসের হার ৫৪ থেকে এক লাফে ৯৩.৭৪-এ উন্নীত হয়। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই ‘অতি-উদার’ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরও প্রায় আট হাজার পরীক্ষার্থী অনুত্তীর্ণই থেকে যায়। পরীক্ষায় ফেল করা শিক্ষার্থীদের প্রমোশনের দাবিতে আন্দোলনের নামে তাণ্ডবের মুখে নতি স্বীকারের বিষয়টি সচেতন সব মহলে নানা আলোচনা-সমালোচনার জš§ দিয়েছে।
এখানে আমি পাঠক সাধারণের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করব এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে যে, আমাদের দেশে শিক্ষার, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার মান কী পরিমানে নিচে নেমেছে। ২০১১ সালের অনার্স প্রথম বর্ষের চূড়ান্ত ওই পরীক্ষাটিতে অংশগ্রহণকারী সব শিক্ষার্থী (পাস, বিশেষ বিবেচনায় পাস এবং চূড়ান্ত বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত ফেল আট হাজারসহ) ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত এইচএসসি বা সমমান এবং ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত এসএসসি বা সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। এসএসসিতে ৯ বোর্ডে গড়ে তাদের পাসের হার ছিল ৭২.১৮। সারাদেশ থেকে মোট জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৫২ হাজার ৫০০ জন। আর এইচএসসিতে ১০ বোর্ডে গড় পাসের হার ৭৪.২৮। এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পায় ২৮ হাজার ৬৭১ জন। উচ্চশিক্ষা লাভের আশা নিয়ে যারা ২০১১ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন কলেজে অনার্স কোর্সে ভর্তি হয়, স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে অধিকাংশই বিগত দুটি পাবলিক পরীক্ষায় কমপক্ষে জিপিএ-৩ কিংবা ৪ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। অনেকে আবার জিপিএ-৫ও পেয়েছে। বোর্ড-বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেচনায় নিশ্চয়ই তারা সবাই মেধাবী। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, অনার্স কোর্সের ওইসব শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪০ শতাংশই প্রথম বর্ষের ৬০০ নম্বরের ৬টি বিষয়ের ৫টিতেই ফেল করেছে! এ ছাড়া তাদের মধ্যে প্রায় আট হাজার শিক্ষার্থী এক বছর পড়াশোনা করার পরও একটি বিষয়েও ৪০ শতাংশ নম্বর অর্জন করতে পারেনি! দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ বর্ষে আরও ১৮০০ কিংবা তারও বেশি নম্বরের বিশাল কোর্স তো তাদের সামনে এখনও পড়েই রয়েছে। ফেল করে পরবর্তীতে বিশেষ বিবেচনায় দ্বিতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা নাকি এক লাখের কাছাকাছি। মজার ব্যাপার হচ্ছে- প্রথম বর্ষ থেকে বিশেষ বিবেচনায় প্রমোশন দেয়া শিক্ষার্থীদের শর্তজুড়ে দিয়ে কর্তৃপক্ষ আশা করছে যে, এফ গ্রেড পাওয়া বিষয়গুলোতে পরবর্তীতে পরীক্ষা দিয়ে তাদের অবশ্যই পাস করতে হবে। অর্থাৎ দ্বিতীয় বর্ষে নির্ধারিত ৭০০ নম্বরের সঙ্গে প্রথম বর্ষে ফেল করা আরও ৫০০ নম্বর যোগ হয়ে মোট ১২০০ নম্বরের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে তাদের। আশংকার বিষয় হল, ওইসব শিক্ষার্থী পরে একই দাবিতে আর কোনো ধরনের লংকাকাণ্ড না জানি ঘটায়। কারণ তাদের মনে এতদিনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, এখানে চাইলেই পাওয়া যায়। আগেরবার, ২০১০ সালেও অনার্স প্রথম বর্ষে চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীরা ৫ বিষয়ে ফেল করে দ্বিতীয় বর্ষে প্রমোশন আদায় করে নিয়েছিল। পূর্বসূরিদের অনুসরণ করতে ওদেরই উত্তরসূরিরা এখন থেকেই তৈরি হচ্ছে না, এরই বা নিশ্চয়তা কোথায়?
যে কোনো পরীক্ষায় পাস এবং ফেলের মধ্যে ব্যবধান আকাশ আর পাতাল। পাসের আনন্দ আর ফেলের বেদনা একমাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া সঠিকভাবে আর কারও পক্ষে বোঝার কথা নয়। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এ ক্ষেত্রে করল কী? বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থীর পাস আর ফেলের অনুভূতিটিকে একেবারে একাকার করে ফেলেছে! এ ছাড়া পাস-ফেলের মধ্যকার ব্যবধানকে আকাশ আর পাতালের সঙ্গে তুলনা করা হলেও ৫টি বিষয় আর ৬টি বিষয়ে ফেলের ব্যবধান সামান্যই, বড়জোর উনিশ-বিশ। ৫টি বিষয়ে ফেল করে যদি দ্বিতীয়বর্ষে ৭টিসহ মোট ১২০০ নম্বরের কোর্স সম্পন্ন করা যায়, তাহলে ৬টি বিষয়ে ফেলওয়ালাদেরও দ্বিতীয়বর্ষে ১৩০০ নম্বর সম্পন্ন করা একেবারে অসম্ভব কিছু নয়। অনার্স শিক্ষার্থীদের পাস-ফেলের বাছবিচার না করে আকস্মিক সিদ্ধান্তে ঢালাওভাবে দ্বিতীয়বর্ষে প্রমোশন দেয়ায় পরীক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা বা যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। এমন মন্তব্যও করা হয়েছে যে, সবাইকে যদি প্রমোশন দিতে হয় তাহলে পরীক্ষকদের বলে দিলেই হয় যে, কাউকেই ফেল করানো যাবে না। শতভাগ পাস করাতে হবে।
ওইসব শিক্ষার্থীর অনার্স এবং মাস্টার্স কোর্স সম্পন্ন করতে নিয়ম অনুযায়ী ৫ বছর এবং বাস্তবে কমপক্ষে ৮ বছর সময় লাগার কথা। কিন্তু উচ্চশিক্ষা অর্জনের শুরুতেই তারা শক্ত হোঁচট খেল। আর বিপুলসংখ্যক ফেল করা শিক্ষার্থীকে ঢালাও প্রমোশন দিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় করল গোটা জাতির সঙ্গে একটি তামাশা। এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মোঃ বদরুজ্জামান বলেন, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সার্বিক দিক বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কর্তা ব্যক্তিদের কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা- অযৌক্তিক দাবি নিয়ে ভাংচুরকারী ফেল করা শিক্ষার্থী এবং এ ব্যাপারে ‘সম্পূর্ণ নীরব’ অভিভাবকদের স্বার্থ বড়, নাকি জাতীয় স্বার্থ বড়? বঙ্গবন্ধুর আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ১৯৭৩ সালের বিএ (পাস) পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ১৩.৪ ভাগ। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে ছিল ৬.১ ভাগ আর ১৯৭৫ সালে ৬.৫ ভাগ। তখন শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের স্বার্থ কোথায় ছিল? আমাদের আরও জানতে ইচ্ছে হয়, উচ্চশিক্ষার দ্বার বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর আর কোনো দেশে এত উন্মুক্ত আছে কি?
বিমল সরকার : কলেজ শিক্ষক
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ২০১১ সালের অনার্স প্রথম বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফলকে কেন্দ্র করে যে কাণ্ডটি সম্প্রতি ঘটেছে বা ঘটানো হয়েছে তা শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের দৈন্যদশা কিংবা অন্তঃসারশূন্যতার আরও একটি দলিল হিসেবেই অনেকদিন পর্যন্ত চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ১৭ জুলাই প্রকাশিত ওই ফলাফলে দেখা যায়, অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীদের মধ্যে শতকরা ৫৪ ভাগ উত্তীর্ণ হয়েছে। উত্তীর্ণদের স্বাভাবিকভাবে দ্বিতীয় বর্ষে উন্নীত বলে ঘোষণা করা হয়। আর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অর্থাৎ ৪৬ ভাগ পরীক্ষার্থীই হয় অকৃতকার্য। এই বিপুলসংখ্যক ফেল করা পরীক্ষার্থী তাদের পাস করিয়ে দ্বিতীয় বর্ষে উন্নীত করার দাবিতে প্রথমে নিজ নিজ কলেজে এবং পরে রাজপথে বিক্ষোভ, অবরোধ, সমাবেশ ও মানববন্ধন করে। টায়ার জ্বালিয়ে অগ্নিসংযোগ এবং যানবাহন ভাংচুর করে। এমনকি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাখা শিক্ষক-কর্মকর্তাদের পরিবহনে ব্যবহƒত গাড়ি ভাংচুর করে অন্তত ১০-১২টি। টানা ৪-৫দিন দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং রাজপথে এসব আচার বা অনাচার সংঘটিত হতে থাকলে ২১ জুলাই রাতে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মোট ৬ অথবা ৭টি বিষয়ের মধ্যে ৫টিতে যারা এফ গ্রেড পেয়েছে বা ফেল করেছে তাদের আপাতত পাস দেখিয়ে দ্বিতীয় বর্ষে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিজ্ঞান অনুষদের বিভিন্ন বিভাগে যারা ৭টি কোর্সের মধ্যে ২টি আর কলা, সামাজিক বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদভুক্ত বিভাগগুলোর ৬টি কোর্সের মধ্যে একটিতে পাস করেছে তাদের দ্বিতীয় বর্ষে উন্নীত হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। ওই সিদ্ধান্তের ফলে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষায় পাসের হার ৫৪ থেকে এক লাফে ৯৩.৭৪-এ উন্নীত হয়। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই ‘অতি-উদার’ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরও প্রায় আট হাজার পরীক্ষার্থী অনুত্তীর্ণই থেকে যায়। পরীক্ষায় ফেল করা শিক্ষার্থীদের প্রমোশনের দাবিতে আন্দোলনের নামে তাণ্ডবের মুখে নতি স্বীকারের বিষয়টি সচেতন সব মহলে নানা আলোচনা-সমালোচনার জš§ দিয়েছে।
এখানে আমি পাঠক সাধারণের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করব এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে যে, আমাদের দেশে শিক্ষার, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার মান কী পরিমানে নিচে নেমেছে। ২০১১ সালের অনার্স প্রথম বর্ষের চূড়ান্ত ওই পরীক্ষাটিতে অংশগ্রহণকারী সব শিক্ষার্থী (পাস, বিশেষ বিবেচনায় পাস এবং চূড়ান্ত বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত ফেল আট হাজারসহ) ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত এইচএসসি বা সমমান এবং ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত এসএসসি বা সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। এসএসসিতে ৯ বোর্ডে গড়ে তাদের পাসের হার ছিল ৭২.১৮। সারাদেশ থেকে মোট জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৫২ হাজার ৫০০ জন। আর এইচএসসিতে ১০ বোর্ডে গড় পাসের হার ৭৪.২৮। এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পায় ২৮ হাজার ৬৭১ জন। উচ্চশিক্ষা লাভের আশা নিয়ে যারা ২০১১ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন কলেজে অনার্স কোর্সে ভর্তি হয়, স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে অধিকাংশই বিগত দুটি পাবলিক পরীক্ষায় কমপক্ষে জিপিএ-৩ কিংবা ৪ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। অনেকে আবার জিপিএ-৫ও পেয়েছে। বোর্ড-বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেচনায় নিশ্চয়ই তারা সবাই মেধাবী। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, অনার্স কোর্সের ওইসব শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪০ শতাংশই প্রথম বর্ষের ৬০০ নম্বরের ৬টি বিষয়ের ৫টিতেই ফেল করেছে! এ ছাড়া তাদের মধ্যে প্রায় আট হাজার শিক্ষার্থী এক বছর পড়াশোনা করার পরও একটি বিষয়েও ৪০ শতাংশ নম্বর অর্জন করতে পারেনি! দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ বর্ষে আরও ১৮০০ কিংবা তারও বেশি নম্বরের বিশাল কোর্স তো তাদের সামনে এখনও পড়েই রয়েছে। ফেল করে পরবর্তীতে বিশেষ বিবেচনায় দ্বিতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা নাকি এক লাখের কাছাকাছি। মজার ব্যাপার হচ্ছে- প্রথম বর্ষ থেকে বিশেষ বিবেচনায় প্রমোশন দেয়া শিক্ষার্থীদের শর্তজুড়ে দিয়ে কর্তৃপক্ষ আশা করছে যে, এফ গ্রেড পাওয়া বিষয়গুলোতে পরবর্তীতে পরীক্ষা দিয়ে তাদের অবশ্যই পাস করতে হবে। অর্থাৎ দ্বিতীয় বর্ষে নির্ধারিত ৭০০ নম্বরের সঙ্গে প্রথম বর্ষে ফেল করা আরও ৫০০ নম্বর যোগ হয়ে মোট ১২০০ নম্বরের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে তাদের। আশংকার বিষয় হল, ওইসব শিক্ষার্থী পরে একই দাবিতে আর কোনো ধরনের লংকাকাণ্ড না জানি ঘটায়। কারণ তাদের মনে এতদিনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, এখানে চাইলেই পাওয়া যায়। আগেরবার, ২০১০ সালেও অনার্স প্রথম বর্ষে চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীরা ৫ বিষয়ে ফেল করে দ্বিতীয় বর্ষে প্রমোশন আদায় করে নিয়েছিল। পূর্বসূরিদের অনুসরণ করতে ওদেরই উত্তরসূরিরা এখন থেকেই তৈরি হচ্ছে না, এরই বা নিশ্চয়তা কোথায়?
যে কোনো পরীক্ষায় পাস এবং ফেলের মধ্যে ব্যবধান আকাশ আর পাতাল। পাসের আনন্দ আর ফেলের বেদনা একমাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া সঠিকভাবে আর কারও পক্ষে বোঝার কথা নয়। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এ ক্ষেত্রে করল কী? বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থীর পাস আর ফেলের অনুভূতিটিকে একেবারে একাকার করে ফেলেছে! এ ছাড়া পাস-ফেলের মধ্যকার ব্যবধানকে আকাশ আর পাতালের সঙ্গে তুলনা করা হলেও ৫টি বিষয় আর ৬টি বিষয়ে ফেলের ব্যবধান সামান্যই, বড়জোর উনিশ-বিশ। ৫টি বিষয়ে ফেল করে যদি দ্বিতীয়বর্ষে ৭টিসহ মোট ১২০০ নম্বরের কোর্স সম্পন্ন করা যায়, তাহলে ৬টি বিষয়ে ফেলওয়ালাদেরও দ্বিতীয়বর্ষে ১৩০০ নম্বর সম্পন্ন করা একেবারে অসম্ভব কিছু নয়। অনার্স শিক্ষার্থীদের পাস-ফেলের বাছবিচার না করে আকস্মিক সিদ্ধান্তে ঢালাওভাবে দ্বিতীয়বর্ষে প্রমোশন দেয়ায় পরীক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা বা যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। এমন মন্তব্যও করা হয়েছে যে, সবাইকে যদি প্রমোশন দিতে হয় তাহলে পরীক্ষকদের বলে দিলেই হয় যে, কাউকেই ফেল করানো যাবে না। শতভাগ পাস করাতে হবে।
ওইসব শিক্ষার্থীর অনার্স এবং মাস্টার্স কোর্স সম্পন্ন করতে নিয়ম অনুযায়ী ৫ বছর এবং বাস্তবে কমপক্ষে ৮ বছর সময় লাগার কথা। কিন্তু উচ্চশিক্ষা অর্জনের শুরুতেই তারা শক্ত হোঁচট খেল। আর বিপুলসংখ্যক ফেল করা শিক্ষার্থীকে ঢালাও প্রমোশন দিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় করল গোটা জাতির সঙ্গে একটি তামাশা। এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মোঃ বদরুজ্জামান বলেন, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সার্বিক দিক বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কর্তা ব্যক্তিদের কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা- অযৌক্তিক দাবি নিয়ে ভাংচুরকারী ফেল করা শিক্ষার্থী এবং এ ব্যাপারে ‘সম্পূর্ণ নীরব’ অভিভাবকদের স্বার্থ বড়, নাকি জাতীয় স্বার্থ বড়? বঙ্গবন্ধুর আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ১৯৭৩ সালের বিএ (পাস) পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ১৩.৪ ভাগ। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে ছিল ৬.১ ভাগ আর ১৯৭৫ সালে ৬.৫ ভাগ। তখন শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের স্বার্থ কোথায় ছিল? আমাদের আরও জানতে ইচ্ছে হয়, উচ্চশিক্ষার দ্বার বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর আর কোনো দেশে এত উন্মুক্ত আছে কি?
বিমল সরকার : কলেজ শিক্ষক
No comments