আরব বসন্ত ও মিসর : গন্তব্য কোথায়? by আকমল হোসেন
মিসরে
মুসলিম ব্রাদারহুড ও সামরিক জান্তা নিয়ন্ত্রিত সরকারের মধ্যে যে মাত্রায়
সহিংসতা চলমান, তা ধীরে ধীরে গৃহযুদ্ধে রূপ নিচ্ছে। এক বছর আগে অবাধ ভোটের
মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত ব্রাদারহুড নেতা মুরসি ক্ষমতা
গ্রহণের পর থেকে প্রতিপক্ষের বিরোধিতা মোকাবেলা করেছেন। আদর্শগতভাবে
প্রেসিডেন্ট মুরসিকে প্রত্যাখ্যান করে তার প্রশাসনের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য
নির্বাচনের পর বিরোধীরা আন্দোলন শুরু করে দেয়। ইসলামী ভাবাদর্শের
ব্রাদারহুড মোবারকবিরোধী গণআন্দোলনে অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে
অংশগ্রহণ করলেও তার ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারেনি। তাহরির
স্কয়ারে যারা সমবেত হয়ে মোবারকের বিরোধিতা শুরু করেছিল, তাদের মধ্যে
রাজনৈতিক আদর্শ, পেশা, বয়স প্রভৃতি নিরিখে অনেক ভাগ ছিল। তরুণরা সূত্রপাত
করলেও সমাজের অন্যান্য অংশ থেকে মানুষ এসে সমাবেশে অংশ নিয়েছিল। উত্তর
আফ্রিকাজুড়ে ‘আরব বসন্ত’ নামে পরিচিত গণআন্দোলনে তরুণরাই
প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সূত্রপাত ঘটায় তাদের তারুণ্যের শক্তিতে নির্যাতনের
বিরুদ্ধে লড়াই করার সর্বজনীন মানসিকতা দিয়ে। তবে আন্দোলনের মুখে মোবারকের
পতনের পর মিসরের রাজনীতিতে এক শক্তিশালী পক্ষ হিসেবে ব্রাদারহুড ও সালাফি
আল নূর পার্টি উঠে আসে। পার্লামেন্ট নির্বাচনে এ দুটি ইসলামী দল মিলে ৬৯
শতাংশ আসন জিতে তাদের শক্তির পরিচয় দিয়েছিল। এর পর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে
ব্রাদারহুড প্রার্থী জয়ী হওয়ায় তাদের শক্তি আরও সংহত হয়।
যেভাবে ‘আরব বসন্ত’ শব্দগুচ্ছ সংবাদপত্রের পাতায় ব্যবহার করা হয়েছিল, তাতে মনে হতে পারে এসব দেশে গণআন্দোলনে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের ফলে গণতন্ত্রের ফুল ফুটতে যাচ্ছে। শীতকালীন নির্জীব অবস্থা কেটে জীবনের সূত্রপাত হতে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং রাজনৈতিক অস্থিরতা যেমন বেড়েছে, তেমনি ভবিষ্যৎও হয়ে পড়ছে অনিশ্চিত।
মোহাম্মদ মুরসি সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। রাজনৈতিক শক্তির দিক থেকে তার বিরোধীরা প্রায় সমান ছিল। মুরসি প্রস্তাবিত সংবিধানের বিরোধিতা করেছে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী অসাম্প্রদায়িক লিবারেল ধারার রাজনৈতিক দলগুলো। কপটিক খ্রিস্টানরা এ সংবিধানের অধীন নিজেদের নিরাপদ মনে করতে পারেনি যেমন, তেমনি নারী অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন গোষ্ঠীও তাতে নারী স্বাধীনতার প্রতি হুমকি দেখতে পেয়েছে। প্রস্তাবিত সংবিধানে শরিয়া আইন প্রচলনের বিষয়ে বিরোধিতার সূত্রপাত। পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্টের হাতে ক্ষমতা কেন্দ ীভূত করার চেষ্টা বিরোধীদের ক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছিল।
বর্তমানে মিসরে যে রাজনৈতিক জটিলতা তৈরি হয়েছে, তা ব্রাদারহুডের একাধিপত্য আরোপের নীতি থেকে তৈরি হয়েছে বললে অতি কথন হবে না। মিসরে দীর্ঘকালের অগণতান্ত্রিক-স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় সমাজের সব মানুষ পীড়িত হয়েছিল। সে ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে তাই সব শ্রেণী-পেশা ও রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল। মিসরের সামরিক বাহিনী থেকে স্বৈরাচারী শাসকরা আসতেন বলে সামরিক বাহিনী সেই শাসন ব্যবস্থার অংশীদার ও সমর্থক ছিল। ইসরাইলের সঙ্গে দ্বন্দ্ব থাকায় দেশ রক্ষার নামে সামরিক বাহিনী সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে জাতীয় ক্ষেত্রে একটি প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে গড়ে উঠেছিল। সামরিক বাহিনী মোবারকের পেছনে দাঁড়াতে চাইলেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি। তবে মোবারকের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের নামে তাদের হাতে ক্ষমতা থেকে যায়। পার্লামেন্ট নির্বাচনে ইসলামপন্থীরা বিজয়ী হলে সামরিক বাহিনীর চাপে তা বাতিল ঘোষণা করা হয়। অন্যদিকে ব্রাহারহুড নির্বাচনে জয়ী হওয়া সত্ত্বেও অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি তাকে মেনে নিতে চায়নি, যেহেতু তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্রাদারহুডের প্রায় সমান ছিল। এবং তারাও মোবারককে বিতাড়ন করার ‘বিপ্লবে’ অংশগ্রহণ করেছে। ব্রাদারহুড গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতায় এলেও মিসরীয় সমাজ যে বিভক্ত তা আমলে না নেয়ায় তাকে ক্ষমতা সংহত করতে শক্তি প্রয়োগ করতে হয়েছে শেষ অবধি। এবং অন্য রাজনৈতিক শক্তিকে আস্থায় নিয়ে ক্ষমতা প্রয়োগের নীতিতে বিশ্বাসী না হওয়ার মনোভাব তার জন্য ইতিবাচক পরিণতি নিয়ে আসেনি।
মুসলিম ব্রাদারহুড (ইখওয়ানুল মুসলিমিন) মিসরের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল, যার জš§ হয়েছিল ১৯২০-এর দশকে মিসর যখন ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। দলটি মধ্যপ্রাচ্যে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের যেমন বিরোধী ছিল, তেমনি পাশ্চাত্য জীবনধারার বিরোধী ছিল। রাজনৈতিক আদর্শ ও সাংগঠনিক ক্ষমতার কারণে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন সরকার এবং নাসেরের জাতীয়তাবাদী সরকারের সময় সংগঠনটি রাষ্ট্রের কোপানলে পড়ে নিষিদ্ধ ছিল। সে সময় উভয় পক্ষ পরস্পরের প্রতি সহিংসতায় লিপ্ত হয়েছিল। নিষিদ্ধ থাকা অবস্থায় সংগঠনটি তার শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছিল এবং ভিন্ন নামে (ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি) রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করেছে। মোবারক-পরবর্তী নির্বাচনে ব্রাহারহুড ভালো ফলাফল করায় দলটির সাংগঠনিক ক্ষমতার প্রকাশ পাওয়া গেছে। অবশ্য কোনো ‘হেজিমনিক’ শক্তি না হওয়ায় এবং অন্যদের সঙ্গে তার রাজনৈতিক প্রভেদ বিশাল হওয়ায় তাদের পক্ষে এককভাবে দেশ শাসন করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। মুরসির বিরোধিতায় অপর ইসলামী দল আল নূর পার্টিরও সক্রিয় ভূমিকা মিসরীয় সমাজে রাজনৈতিক বিভেদকে স্পষ্ট করে তোলে।
মিসরের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রভাব জামাল আবদুল নাসের কর্তৃক রাজা ফারুক বিরোধী অভ্যুত্থানের সময় থেকে। নাসেরসহ পরবর্তী সব প্রেসিডেন্ট সামরিক বাহিনী থেকে এসেছেন। নাসের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও জাতীয়তাবাদী শাসক ছিলেন। কিন্তু তার উত্তরসূরি সাদাত ও মোবারক কেউ সে স্থান ধরে রাখতে চাননি। তারা বরং মার্কিন সমর্থনপুষ্ট থাকতে চেয়েছেন। নাসের অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতি ত্যাগ করে তারা মিসরকে মার্কিন প্রভাব বলয়ে নিয়ে গেছেন। মার্কিন প্রভাবে মিসর ইসরাইলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। এর বদলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার দুয়ার খুলে যায় মিসরের জন্য। অন্যদিকে মিসরের সামরিক বাহিনী সব সময় ধর্মীয় রাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ইসরাইলের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও ধর্মীয় রাজনীতির বিরোধিতা মিসরের সামরিক বাহিনীকে ব্রাদারহুড নিয়ন্ত্রিত সরকারের সঙ্গে সংঘাতে নিয়ে গেছে। ব্রাদারহুডের ক্ষমতারোহণ প্রতিবেশী ইসরাইলের জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল না। এ সরকারের সঙ্গে হামাস গোষ্ঠীর সখ্য তাদের নজরে ছিল। মুরসির অপসারণকে তাই ইসরাইলের শাসকদের জন্য স্বস্তির বিষয় হিসেবে দেখা যেতে পারে।
মিসরের সামরিক বাহিনী সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতা নেয়নি স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সামরিক হস্তক্ষেপের নতুন নিয়ম ও ধারার সঙ্গে মিল রেখে। নব্বইয়ের দশকের পূর্ববর্তী সময়ে এশিয়া-আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় যখন কোনো সামরিক অভ্যুত্থান হতো, তখন তার প্রতি পাশ্চাত্যের বিশেষ করে মার্কিন সমর্থন প্রায় খোলামেলা ছিল। নতুন সামরিক শাসকরা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে রাজনৈতিক প্রশ্রয় পেতেন। তাদের জন্য মার্কিন অর্থনৈতিক-সামরিক সহায়তার নিশ্চয়তা থাকত। তখনকার আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বে এসব সামরিক শাসক মার্কিন সমর্থক বনে যেতেন। কিন্তু বর্তমান যুগে সামরিক শাসনের প্রতি শক্তিশালী বিরোধিতা থাকায় সামরিক বাহিনী সরাসরি শাসনক্ষমতা হাতে নেয় না। রাজনীতিকদের মধ্য থেকে কাউকে বেছে নিয়ে পরোক্ষভাবে সামরিক বাহিনী ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। মিসরের বেলায় এবার তা-ই দেখা যাচ্ছে। লক্ষ্য করার বিষয়, মিসরে ক্ষমতার পরিবর্তন সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি কোনো মন্তব্য করছে না। এ পরিবর্তনকে সামরিক অভ্যুত্থান বলেও কোনো মন্তব্য করেনি। কারণ তার আইন অনুযায়ী যে রাষ্ট্রে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা নেয়, সেখানে সামরিক সহায়তা সে দিতে পারে না। মিসরের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সখ্যের কারণে সে সহায়তা দেয়ার কথা রয়েছে।
মুরসিকে বিরোধিতা করে তার প্রতিপক্ষরা যে সমাবেশ করছিল, তা মোকাবিলার জন্য মুরসি সরকার ও ব্রাদারহুড শক্তি প্রয়োগের যে নীতি গ্রহণ করেছিল, তাতে কোনো সমাধান আসেনি। সরকারকে পরিস্থিতি সামলাতে সামরিক বাহিনী ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে পরে নিজেরা হস্তক্ষেপ করে বসে। এতে রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে অতীতের সামরিক হস্তক্ষেপের ভ্রান্ত উদাহরণের পুনরাবৃত্তি হয়েছে। কিন্তু মিসরে সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত সরকার গঠন করে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে মুরসির পক্ষাবলম্বনকারী দু’শর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে। ব্রাদারহুডের সমর্থকরা রাজপথে থেকে যেভাবে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে, তাতে মনে হয় না তারা সহজে হার মানবে। বরং দেশটি গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। এ রকম কিছু মিসরবাসীর জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলজনক হতে পারে না। এ পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য সামরিক হস্তক্ষেপের অবসান ঘটিয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে আলোচনা শুরু করতে হবে। বৃহত্তর সমঝোতার ভিত্তিতে সরকার গঠনের মাধ্যমে অস্থিতিশীলতার অবসান হতে পারে।
ড. আকমল হোসেন : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
যেভাবে ‘আরব বসন্ত’ শব্দগুচ্ছ সংবাদপত্রের পাতায় ব্যবহার করা হয়েছিল, তাতে মনে হতে পারে এসব দেশে গণআন্দোলনে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের ফলে গণতন্ত্রের ফুল ফুটতে যাচ্ছে। শীতকালীন নির্জীব অবস্থা কেটে জীবনের সূত্রপাত হতে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং রাজনৈতিক অস্থিরতা যেমন বেড়েছে, তেমনি ভবিষ্যৎও হয়ে পড়ছে অনিশ্চিত।
মোহাম্মদ মুরসি সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। রাজনৈতিক শক্তির দিক থেকে তার বিরোধীরা প্রায় সমান ছিল। মুরসি প্রস্তাবিত সংবিধানের বিরোধিতা করেছে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী অসাম্প্রদায়িক লিবারেল ধারার রাজনৈতিক দলগুলো। কপটিক খ্রিস্টানরা এ সংবিধানের অধীন নিজেদের নিরাপদ মনে করতে পারেনি যেমন, তেমনি নারী অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন গোষ্ঠীও তাতে নারী স্বাধীনতার প্রতি হুমকি দেখতে পেয়েছে। প্রস্তাবিত সংবিধানে শরিয়া আইন প্রচলনের বিষয়ে বিরোধিতার সূত্রপাত। পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্টের হাতে ক্ষমতা কেন্দ ীভূত করার চেষ্টা বিরোধীদের ক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছিল।
বর্তমানে মিসরে যে রাজনৈতিক জটিলতা তৈরি হয়েছে, তা ব্রাদারহুডের একাধিপত্য আরোপের নীতি থেকে তৈরি হয়েছে বললে অতি কথন হবে না। মিসরে দীর্ঘকালের অগণতান্ত্রিক-স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় সমাজের সব মানুষ পীড়িত হয়েছিল। সে ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে তাই সব শ্রেণী-পেশা ও রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল। মিসরের সামরিক বাহিনী থেকে স্বৈরাচারী শাসকরা আসতেন বলে সামরিক বাহিনী সেই শাসন ব্যবস্থার অংশীদার ও সমর্থক ছিল। ইসরাইলের সঙ্গে দ্বন্দ্ব থাকায় দেশ রক্ষার নামে সামরিক বাহিনী সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে জাতীয় ক্ষেত্রে একটি প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে গড়ে উঠেছিল। সামরিক বাহিনী মোবারকের পেছনে দাঁড়াতে চাইলেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি। তবে মোবারকের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের নামে তাদের হাতে ক্ষমতা থেকে যায়। পার্লামেন্ট নির্বাচনে ইসলামপন্থীরা বিজয়ী হলে সামরিক বাহিনীর চাপে তা বাতিল ঘোষণা করা হয়। অন্যদিকে ব্রাহারহুড নির্বাচনে জয়ী হওয়া সত্ত্বেও অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি তাকে মেনে নিতে চায়নি, যেহেতু তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্রাদারহুডের প্রায় সমান ছিল। এবং তারাও মোবারককে বিতাড়ন করার ‘বিপ্লবে’ অংশগ্রহণ করেছে। ব্রাদারহুড গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতায় এলেও মিসরীয় সমাজ যে বিভক্ত তা আমলে না নেয়ায় তাকে ক্ষমতা সংহত করতে শক্তি প্রয়োগ করতে হয়েছে শেষ অবধি। এবং অন্য রাজনৈতিক শক্তিকে আস্থায় নিয়ে ক্ষমতা প্রয়োগের নীতিতে বিশ্বাসী না হওয়ার মনোভাব তার জন্য ইতিবাচক পরিণতি নিয়ে আসেনি।
মুসলিম ব্রাদারহুড (ইখওয়ানুল মুসলিমিন) মিসরের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল, যার জš§ হয়েছিল ১৯২০-এর দশকে মিসর যখন ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। দলটি মধ্যপ্রাচ্যে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের যেমন বিরোধী ছিল, তেমনি পাশ্চাত্য জীবনধারার বিরোধী ছিল। রাজনৈতিক আদর্শ ও সাংগঠনিক ক্ষমতার কারণে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন সরকার এবং নাসেরের জাতীয়তাবাদী সরকারের সময় সংগঠনটি রাষ্ট্রের কোপানলে পড়ে নিষিদ্ধ ছিল। সে সময় উভয় পক্ষ পরস্পরের প্রতি সহিংসতায় লিপ্ত হয়েছিল। নিষিদ্ধ থাকা অবস্থায় সংগঠনটি তার শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছিল এবং ভিন্ন নামে (ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি) রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করেছে। মোবারক-পরবর্তী নির্বাচনে ব্রাহারহুড ভালো ফলাফল করায় দলটির সাংগঠনিক ক্ষমতার প্রকাশ পাওয়া গেছে। অবশ্য কোনো ‘হেজিমনিক’ শক্তি না হওয়ায় এবং অন্যদের সঙ্গে তার রাজনৈতিক প্রভেদ বিশাল হওয়ায় তাদের পক্ষে এককভাবে দেশ শাসন করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। মুরসির বিরোধিতায় অপর ইসলামী দল আল নূর পার্টিরও সক্রিয় ভূমিকা মিসরীয় সমাজে রাজনৈতিক বিভেদকে স্পষ্ট করে তোলে।
মিসরের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রভাব জামাল আবদুল নাসের কর্তৃক রাজা ফারুক বিরোধী অভ্যুত্থানের সময় থেকে। নাসেরসহ পরবর্তী সব প্রেসিডেন্ট সামরিক বাহিনী থেকে এসেছেন। নাসের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও জাতীয়তাবাদী শাসক ছিলেন। কিন্তু তার উত্তরসূরি সাদাত ও মোবারক কেউ সে স্থান ধরে রাখতে চাননি। তারা বরং মার্কিন সমর্থনপুষ্ট থাকতে চেয়েছেন। নাসের অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতি ত্যাগ করে তারা মিসরকে মার্কিন প্রভাব বলয়ে নিয়ে গেছেন। মার্কিন প্রভাবে মিসর ইসরাইলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। এর বদলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার দুয়ার খুলে যায় মিসরের জন্য। অন্যদিকে মিসরের সামরিক বাহিনী সব সময় ধর্মীয় রাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ইসরাইলের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও ধর্মীয় রাজনীতির বিরোধিতা মিসরের সামরিক বাহিনীকে ব্রাদারহুড নিয়ন্ত্রিত সরকারের সঙ্গে সংঘাতে নিয়ে গেছে। ব্রাদারহুডের ক্ষমতারোহণ প্রতিবেশী ইসরাইলের জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল না। এ সরকারের সঙ্গে হামাস গোষ্ঠীর সখ্য তাদের নজরে ছিল। মুরসির অপসারণকে তাই ইসরাইলের শাসকদের জন্য স্বস্তির বিষয় হিসেবে দেখা যেতে পারে।
মিসরের সামরিক বাহিনী সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতা নেয়নি স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সামরিক হস্তক্ষেপের নতুন নিয়ম ও ধারার সঙ্গে মিল রেখে। নব্বইয়ের দশকের পূর্ববর্তী সময়ে এশিয়া-আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় যখন কোনো সামরিক অভ্যুত্থান হতো, তখন তার প্রতি পাশ্চাত্যের বিশেষ করে মার্কিন সমর্থন প্রায় খোলামেলা ছিল। নতুন সামরিক শাসকরা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে রাজনৈতিক প্রশ্রয় পেতেন। তাদের জন্য মার্কিন অর্থনৈতিক-সামরিক সহায়তার নিশ্চয়তা থাকত। তখনকার আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বে এসব সামরিক শাসক মার্কিন সমর্থক বনে যেতেন। কিন্তু বর্তমান যুগে সামরিক শাসনের প্রতি শক্তিশালী বিরোধিতা থাকায় সামরিক বাহিনী সরাসরি শাসনক্ষমতা হাতে নেয় না। রাজনীতিকদের মধ্য থেকে কাউকে বেছে নিয়ে পরোক্ষভাবে সামরিক বাহিনী ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। মিসরের বেলায় এবার তা-ই দেখা যাচ্ছে। লক্ষ্য করার বিষয়, মিসরে ক্ষমতার পরিবর্তন সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি কোনো মন্তব্য করছে না। এ পরিবর্তনকে সামরিক অভ্যুত্থান বলেও কোনো মন্তব্য করেনি। কারণ তার আইন অনুযায়ী যে রাষ্ট্রে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা নেয়, সেখানে সামরিক সহায়তা সে দিতে পারে না। মিসরের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সখ্যের কারণে সে সহায়তা দেয়ার কথা রয়েছে।
মুরসিকে বিরোধিতা করে তার প্রতিপক্ষরা যে সমাবেশ করছিল, তা মোকাবিলার জন্য মুরসি সরকার ও ব্রাদারহুড শক্তি প্রয়োগের যে নীতি গ্রহণ করেছিল, তাতে কোনো সমাধান আসেনি। সরকারকে পরিস্থিতি সামলাতে সামরিক বাহিনী ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে পরে নিজেরা হস্তক্ষেপ করে বসে। এতে রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে অতীতের সামরিক হস্তক্ষেপের ভ্রান্ত উদাহরণের পুনরাবৃত্তি হয়েছে। কিন্তু মিসরে সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত সরকার গঠন করে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে মুরসির পক্ষাবলম্বনকারী দু’শর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে। ব্রাদারহুডের সমর্থকরা রাজপথে থেকে যেভাবে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে, তাতে মনে হয় না তারা সহজে হার মানবে। বরং দেশটি গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। এ রকম কিছু মিসরবাসীর জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলজনক হতে পারে না। এ পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য সামরিক হস্তক্ষেপের অবসান ঘটিয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে আলোচনা শুরু করতে হবে। বৃহত্তর সমঝোতার ভিত্তিতে সরকার গঠনের মাধ্যমে অস্থিতিশীলতার অবসান হতে পারে।
ড. আকমল হোসেন : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments