অরণ্যে রোদন- এই যন্ত্র লইয়া আমরা কী করিব by আনিসুল হক

দ্য গডস মাস্ট বি ক্রেজি নামের একটি চলচ্চিত্রে একটা ঘটনা ঘটেছিল। কালাহারি মরুভূমিতে একটা কোকা-কোলার বোতল এসে পড়েছিল উড়োজাহাজ থেকে। ওই এলাকার লোকেরা, যাদের বলা হয়েছে বুশম্যান, জংলি, তারা এর আগে শান্তিতেই ছিল।


তারা এর আগে কোনো দিন কোনো কোকা-কোলার বোতল দেখেনি, যন্ত্রজাত কোনো কিছুই দেখেনি। আকাশ থেকে পড়া কোকের বোতলটিকে তারা দেবতার পাঠানো কোনো সামগ্রী বলে ভুল করে। ওই কোকের বোতলটা কে নেবে, ওটা দিয়ে কী করা হবে, এই নিয়ে শুরু হয় নানা ঘটনা-অঘটনা। বাংলাদেশে আমরা আসলে জংলি কিংবা অসভ্য মানুষদের মতোই আচার-আচরণ করে থাকি। আমরা যথেষ্ট পরিপক্ব হইনি, আমাদের শিক্ষা নেই, সভ্যতা কিংবা গণতন্ত্র সম্পর্কে ধারণা নেই, এ-সংক্রান্ত কোনো মূল্যবোধকেই আমরা ধারণ করি না, আমাদের সমাজ না সামন্ততান্ত্রিক, না পুঁজিবাদী, না গ্রামীণ, না যান্ত্রিক; আমাদের শিক্ষা আমাদের আলোকিত করে না, আমাদের অসৎ করে, লোভী করে, ভোগী করে, সুবিধাবাদী করে, অত্যাচারী করে। আমাদের গণতন্ত্র পরমতসহিষ্ণুতা শেখায় না, আমাদের ধরাকে সরা জ্ঞান করার ক্ষমতা দেয়, আমরা সবকিছুই নিজের তালুক মনে করে যা খুশি তা-ই করি। নিয়মকানুন, আইনশৃঙ্খলা বলতে জগতে কোনো কিছু আছে বলে আমাদের ধারণাই থাকে না। এই রকম একটা বুশম্যান বা জঙ্গলমানুষদের এলাকায় আকাশের উড়োজাহাজ থেকে কোমল পানীয়র বোতলের মতো করে হঠাৎ এসে যায় মোবাইল ফোন, এসে যায় ইন্টারনেট, ফেসবুক। মোবাইল ফোনে আবার ক্যামেরা আছে, সেটা দিয়ে ছবি তোলা যায়, ভিডিও করা যায়। আমরা, এই জঙ্গলমানুষেরা আকাশ থেকে পড়া এই সব আজগুবি যন্ত্র পেয়ে হতবুদ্ধি হয়ে গেছি, এই যন্ত্র লইয়া আমরা কী করিব?
আমরা মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটের প্রযুক্তি লাভ করলাম। সেই দেশে, যে দেশে রাস্তায় কোনো একটা গাড়ি কোনো পথচারীকে কারণে-অকারণে ধাক্কা দিলে তার পরিণতি হয় হাজার হাজার মানুষের রাস্তায় নেমে আসা, আর নির্বিচারে গাড়ি ভাঙচুর করা। যদি কোনো কারণে কোনো শিক্ষার্থী সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন, তা হলে আশপাশের সব স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দলে দলে শিক্ষার্থীরা নেমে আসবে পথে, ভাঙো গাড়ি। একই ঘটনা ঘটবে যদি কোনো গার্মেন্টস শ্রমিক ঘটনার শিকার হন। একবার, এক পুলিশ সদস্য সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হলে রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে পুলিশের জোয়ানরা পর্যন্ত বেরিয়ে এসে রাস্তায় ভাঙচুর করেছিলেন, বেশ কয়েক বছর আগে। কয়েকজন শিক্ষার্থী রাতের বেলা আড্ডা দিতে গিয়েছিল আমিনবাজারের ওপাশে, ডাকাত সন্দেহে তাদের পিটিয়ে মারা হয়েছে মাত্র সেদিন। টেলিভিশনের খবরে প্রায়ই দেখি, বিশ্ববিদ্যালয়ের দুদল ছাত্র ইয়া বড় বড় চাপাতি, রামদা, তরবারি, লাঠিসোঁটা এমনকি পিস্তল উঁচিয়ে পরস্পরকে ধাওয়া করছে। আপনারা কি কেউ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক কিংবা অ্যানিমেল প্লানেট চ্যানেলে সিংহ বা বাঘের হরিণ শিকারের দৃশ্য দেখেছেন? হরিণের পালের মধ্যে সিংহ চড়াও হয়, একটা-দুটো হরিণকে বাগে পেয়ে যায়। এমনকি দল বেঁধে সিংহ হামলে পড়ে একটা মোষের ওপরেও। ওই যুযুধান ছাত্রের দল বিরোধী পক্ষকে তাড়া করতে থাকলে হঠাৎ করে একজন-দুজনকে পেয়ে যায় বাগে, তখন তার ওপরে লাঠি, চাপাতি ইত্যাদি নিয়ে যেভাবে তারা চড়াও হয়, আর সেটা টেলিভিশনের পর্দায় যেভাবে দেখানো হয়, তার কোনো ব্যাখ্যা হয় না, বুশম্যান বা আদিমেরা এর চেয়ে সভ্য, এমনকি জানোয়াররাও আমাদের চেয়ে ঢের বেশি মানবিক। পশুকুল কখনো স্বজাতির ওপরে হামলা করে না, সিংহ হরিণ খায়, কিন্তু কম ক্ষেত্রেই সিংহে সিংহে মারামারি হয়।
এই রকম একটা অপ্রস্তুত সমাজে যখন মোবাইল ফোন এল, ইন্টারনেট এল, তখন ওটা দিয়ে আমরা কী করব? আমরা মেয়েদের ছবি তুলতে শুরু করলাম, আর সেটা ছড়িয়ে দিতে লাগলাম ইন্টারনেটে। অন্যের বাথরুমে পর্যন্ত গোপন ক্যামেরা লাগিয়ে রাখলাম, আর ছবি তুলে তুলে সেটা পোস্ট করতে লাগলাম অন্তর্জালে। নিজেরা নিজেদের ছবি তুলে রাখলাম মোবাইল ফোনে, সেটা হাতছাড়া হয়ে ঘটে গেল মহা সর্বনাশ। আমরা নিরীহ মেয়েদের হয়রানি করে সেই ছবি তুলে রেখে ব্ল্যাকমেইল করতে লাগলাম। মেয়েরা আত্মহত্যা করতে লাগল। কোনো মেয়েকে হয়রানি করতে হবে, তার নামে একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে আজেবাজে কথা লিখে রাখতে লাগলাম।
আমাদের প্রতিবেশী দেশে সমস্যা হলো আরও প্রকট। সেখানে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো ও সাম্প্রদায়িক হানাহানি উসকে দেওয়ার জন্য মোবাইল ফোন ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে। তাদের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং এটা প্রতিরোধের চেষ্টায় কর্তৃপক্ষ গলদঘর্ম হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে আমরা ঘটালাম এক ভয়াবহ, ন্যক্কারজনক, লজ্জাজনক, ঘৃণ্য ঘটনা। ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার মতো ছবি একটা পাওয়া গেছে। কার অ্যাকাউন্টে? সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অমুকের অ্যাকাউন্টে। ফেসবুক যাঁরা ব্যবহার করেন, তাঁরা জানেন, ফেসবুকের ছবি যেকোনো কারও হোমে আসতে পারে, সেটার সঙ্গে ওই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের কোনো সম্পর্ক লাগে না। তারপর আবার যে কেউ যেকোনো ছবি বা লেখা বা মন্তব্য যেকোনো কারও পাতায় সেঁটে দিতে পারে। এটা অনেকটা এই রকম, আপনি আপনার বাড়িতে নেই, সাত দিন বিদেশে ছিলেন, এসে দেখলেন, আপনার দেয়ালে কেউ একটা মানহানিকর পোস্টার সেঁটে দিয়েছে। আপনি দেখামাত্র সেটা সরিয়ে ফেললেন। ওই পোস্টারের জন্য আপনি দায়ী নন। এটা করেছে কোনো এক গুপ্ত অপরাধী, যে কিনা আপনাকে বিপদে ফেলতে চায়। উন্মাদ, মানসিক রোগী শুধু এই দেশে নেই, সারা পৃথিবীতে আছে। প্রতিটা মানুষের বিশ্বাসই যে শ্রদ্ধার বিষয়, এটা অনেকেই মানে না। তারা চরম আপত্তিকর জিনিসপত্র বানায়, এর নামে ওর বিরুদ্ধে। ইন্টারনেটে নেই, এমন কিছুই নেই। যে কেউ চাইলে ফেসবুকে ইন্টারনেটে যেকোনো কিছু করতে পারেন। আপনি চাইলেই বিশ্বব্যাংক সভাপতির নামে অ্যাকাউন্ট খুলে তাতে ছবি দিতে পারেন যে তিনি পদ্মা সেতুতে টাকা না দেওয়ার জন্য আবুল হোসেনের কাছে মাফ চাইছেন। কিন্তু ওটা বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জানবেনও না, বুঝবেনও না। মরহুম লেখক হুমায়ূন আহমেদ ফেসবুক ব্যবহার করতেন না, কিন্তু তাঁর নামে অ্যাকাউন্ট ছিল একাধিক, এখনো আছে। ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের নামে অন্তত সাত-আটটা অ্যাকাউন্ট আছে, যার একটাও সাকিবের নয়।
রামুর ঘটনায় আলোচিত ওই তরুণের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট কে দেখেছে? ডেইলি স্টার-এর উপসম্পাদক ইনাম আহমেদ গিয়েছিলেন ঘটনাস্থলে, সেখান থেকে পাঠিয়েছেন মর্মস্পর্শী সব প্রতিবেদন। আমাকে তিনি জানিয়েছেন, তিনি অন্তত ২০০ জনকে জিজ্ঞেস করেছেন, তাদের কেউই ফেসবুক খুলে ওই ছবি দেখেনি, যার প্রতিবাদে এত কাণ্ড। তা হলে এত ক্ষোভ, এত আগুন কেন। কারণ, একটা খুবই আপত্তিকর, অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে, এমন ছবি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া হয়েছিল মোবাইল ফোনে। তারপর সেই ছবি ব্লুটুথে গেছে এক মোবাইল ফোন থেকে আরেক মোবাইল ফোনে। সেটা কেউ কেউ দেখেছে, আবার অনেকেই দেখেনি। যারা দেখেছে, তারা ক্ষুব্ধ হয়েছে। জানানো হয়েছে, এটা করেছে অমুক বড়ুয়া। আর যায় কোথায়?
কিন্তু তার পরেও সন্দেহ থেকে যায়। এই ধরনের বিক্ষোভ রাতের বেলায় হয় না। এই ধরনের বিক্ষোভে গাড়ি করে লোক আনা হয় না। সরকার তো ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই বলছে, এটা পূর্বপরিকল্পিত। পূর্বপরিকল্পিতই যদি হবে, তা হলে সরকার করলটা কী? গোয়েন্দারা করলটা কী? ওই এলাকা তো বিশেষ এলাকা। রোহিঙ্গা ইত্যাদি কারণে সেখানে আমাদের বিভিন্ন বাহিনী ও এজেন্সির সদা সক্রিয় থাকার কথা! তদন্ত সম্পন্ন হওয়ার আগেই ‘এ’ দল বলছে, এটা ‘বি’ দল করেছে, ‘বি’ দল বলছে, এটা ‘এ’ দলের কাণ্ড। দায়িত্বশীল মহল থেকে বলা হয়েছে, এটা বিদেশি চক্রান্ত। বিদেশিরা এই দেশে বসে চক্রান্ত করে, আর আমরা ঘোড়ার ঘাস কাটি?
অনুমান করতে পারি, এটা ‘এ’ দল করতে পারে, ‘বি’ দল করতে পারে, ‘জে’ দলও করতে পারে, দেশিরা করতে পারে, বিদেশিরা করতে পারে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যারা চায় না, তারা করতে পারে, রোহিঙ্গারা করতে পারে। কিন্তু ঘটনা হলো, শত শত মানুষ এই অপকর্মে যোগ দিয়েছে। সেখানে এ দল ও দল মিলেমিশে গেছে। এমনকি পুলিশের থানাকর্তাও বক্তৃতা দিয়েছেন। আমাদের সমাজটাই এত অসহিষ্ণু, এত হুজুগে, যেন আমরা একটা বারুদের ঘরে বসবাস করছি। সামান্য ইন্ধনেই এখানে বড় বিস্ফোরণ ঘটানো যায়, ঘটে।
কাকে দোষ দেব। এ আমার পাপ, এ তোমার পাপ। একাত্তর সালেও কি বৌদ্ধদের এতগুলো উপাসনালয় আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল? যে ঘুমন্ত শিশুটির ঘুম ভেঙে গেছে শত শত মানুষের চিৎকারে, উদ্বিগ্ন মা যাকে কোলে করে আঁচলের তলে পুরে নিয়ে ছুটেছেন জঙ্গলের দিকে, সেই জঙ্গলে যাদের কেটেছে ভয়ার্ত প্রহর, যে দূর থেকে শুনেছে চিৎকার আর দেখেছে আকাশ লাল করে লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে, দিনের বেলা ফিরে এসে দেখেছে পুড়ে গেছে তার সব, তার খেলনা পুতুলটা, বইপত্র, তাদের আর কিছু নেই, তার মা তাকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিতে পারেননি, তার বাবা পারেননি, তার মহল্লার গুরুজন দিতে পারেননি, তার ভান্তে পারেননি, ওই শিশুকে আমরা কী সান্ত্বনা দেব?
ইন্টারনেটেই এখন আগুনে পোড়া বৌদ্ধমন্দির আর বৌদ্ধ বসতিগুলোর ছবি দেখতে পাবেন। যদি দেখেন, কান্নায় আপনার চোখ ফেটে আসবে, দুঃখে আপনার বুক ভেঙে আসবে। এই লজ্জা আমরা রাখব কোথায়? এই মুখ আমরা কাকেই বা দেখাব?
আমাদের আশঙ্কা, অন্য অনেক তদন্তের মতো এই তদন্তের কোনো ফল আসবে না। কারণ, তদন্ত হওয়ার আগেই দায়িত্বশীল মুখ থেকে ‘কে দায়ী, কারা দায়ী’ তা বলে ফেলা হয়েছে। আর প্রথম আলোয় মশিউল আলম যেমনটা লিখেছেন, এখানে সব কটি রাজনৈতিক দলই একাকার হয়ে ভূমিকা পালন করেছে। তার ওপর যুক্ত হয়েছে অসহায় বৌদ্ধ পরিবারের ভিটেমাটিটুকুনের ওপরে লোলুপ শ্যেন দৃষ্টি, ‘ওটা দিতে হবে।’ মশিউল আলমের আশঙ্কা, এ ধরনের অপকর্ম আবারও ঘটতে পারে।
আশার কোনো আলোই তো আর দেখতে পাচ্ছি না। যেখানে আমাদের আশা, সেই তরুণেরা কোথায়? এই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক হানাহানির ইতিহাস পুরোনো, খুবই করুণ, খুবই ভয়াবহ, খুবই লজ্জাজনক, কিন্তু সেই সঙ্গে আছে শুভবাদী মানুষের প্রতিরোধের চেষ্টা, আছে শান্তির সপক্ষের মানুষদের সমাবেশ। আশির দশকেও আমরা দেখেছি, বন্যায় কিংবা সাম্প্রদায়িক সমপ্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে তারুণ্যের মহা-উদ্যোগ। আজ সেই শুভবাদী তরুণেরা কোথায়?
মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক একটা যন্ত্র মাত্র, মাধ্যম মাত্র। এটাকে কেউ কেউ খারাপ কাজের জন্য ব্যবহার করছে। আমাদের তরুণেরা কি পারে না এটাকে ভালো কাজের জন্য ব্যবহার করে দেখিয়ে দিতে? সামাজিক নেটওয়ার্ক তারুণ্যের হাতে ব্যবহূত হোক শুভবাদের পক্ষে জনমত সংগঠনের কাজে, শুভবাদী মানুষের প্রতিরোধের শক্তিকে জোরালো করার উপায় হিসেবে, এটা কি খুব বেশি চাওয়া হবে?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.