বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও রাজনীতি by বদিউল আলম মজুমদার
সাভারে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি যখন ঘটে, আমি তখন মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটোরে। সেখানে ১৫০ দেশের সমন্বয়ে গঠিত ‘কমিউনিটি অব ডেমোক্রেসি’ আয়োজিত সপ্তম মিনিস্টারিয়াল কনফারেন্সে আমি অংশ নিচ্ছিলাম। কনফারেন্সে সারা পৃথিবী থেকে কয়েক শ ব্যক্তি অংশ নেন, যার মধ্যে ছিলেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি ও তাওয়াক্কল কারমান এবং একাধিক দেশের প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, জাতিসংঘের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রদূত। এ ছাড়া এতে অংশ নেন পার্লামেন্টারিয়ান, সিভিল সোসাইটি, ব্যবসায়ী, নারী ও তরুণদের প্রতিনিধিরা।
বাংলাদেশ থেকে আমিই একমাত্র এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলাম, যদিও চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এতে আমাদের সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ব্যাপকতা সম্পর্কে জানাজানি হতে থাকলে কনফারেন্সে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের অনেকেই আমাকে সমবেদনা জানাতে এগিয়ে আসেন। অনেকেই বলেন, হোটেল রুমে থেকে সিএনএন ও বিবিসি চ্যানেলে দুর্ঘটনার উদ্ধার কার্যক্রম দেখে তাঁরা চরমভাবে ব্যথিত। সমবেদনা জ্ঞাপনকারী ব্যক্তিদের প্রায় সবাই বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ভোক্তা এবং যে অমানবিক পরিবেশে এগুলো তৈরি হয় জেনে তাঁরা মর্মাহত। একজন তো হতাশার সুরে বলেই ফেললেন, তাঁর গায়ের জামাটি যে মেয়েগুলো বানিয়েছে, তারাও হয়তো মৃত বা নিখোঁজ! কয়েকজন আমার কাছে জানতে চান দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ এবং এ ধরনের বিপর্যয় রোধে সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে। তাঁরা প্রশ্ন তোলেন: কেন সরকার উদ্ধারকাজে ব্রিটিশ সহায়তা নিল না? দায়ী ব্যক্তিরা কি চিহ্নিত হবেন? শাস্তি পাবেন? মৃত ব্যক্তিদের পরিবার-পরিজন ও আহত ব্যক্তিদের দায়ভার কে নেবে? ইত্যাদি।
সম্মেলনে একজন আমেরিকানের সঙ্গে আমার কথা হয়, যিনি বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের সমস্যা সম্পর্কে আমাদের অনেকের চেয়ে অনেক বেশি খোঁজখবর রাখেন, তিনি আমাকে বলেন, গত নভেম্বরের তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডের পর তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে এ পর্যন্ত ছোট-বড় ৪৭টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, যাতে বেশ কয়েকজন হতাহতও হয়েছে। পোশাকশিল্পে দুর্ঘটনাজনিত হতাহতের মূল কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তালা দেওয়া কলাপসিবল গেট এবং হুড়োহুড়িতে শ্রমিকদের পায়ের তলায় পিষ্ট হওয়া। তাঁর আফসোস, বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ হাজার তৈরি পোশাকশিল্পে ৪৫ লাখ শ্রমিক কাজ করলেও, যা মঙ্গোলিয়ার মোট জনসংখ্যার দেড় গুণ, সরকার শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে অনাগ্রহী। বরং কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই দেশি-বিদেশি চক্রান্তের অভিযোগ তোলা হয়। তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের সময় অনেকে চক্রান্তের অভিযোগ তুলেছিলেন। তবে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন, এবার কেউ বিদেশি ষড়যন্ত্রের ধুয়া তোলেনি।
তিনি অভিযোগ করেন, বাংলাদেশ সরকার অর্থ ব্যয় করে শিল্প পুলিশ নিয়োগ দিয়েছে শ্রমিকদের পেটানোর জন্য। কিন্তু সারা দেশের শিল্পকারখানাগুলো নজরদারির জন্য মাত্র যে ১৫০টি ইন্সপেক্টরের পদ রয়েছে, তার প্রায় অর্ধেকই শূন্য। এ ব্যাপারে সরকার অর্থ ব্যয় করছে না। তাঁর কাছে অবিশ্বাস্য যে ১০০ কোটি ডলার ব্যয় করে বাংলাদেশ অস্ত্র কিনতে পারে, কিন্তু দুর্যোগকালীন উদ্ধারকাজে ব্যবহারের জন্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রস্তাবিত ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার টাকা সরকারের নেই! তাঁর আরও অভিযোগ, স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তৈরি পোশাকশিল্পে শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে তুলতে দিচ্ছেন না এবং এ প্রচেষ্টায় রত শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না, যদিও সরকার জানে কারা খুনি।
ভদ্রলোকের দাবি, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের আমেরিকান ভোক্তারা শ্রমিকদের বারবার প্রাণহানিতে দারুণভাবে ক্ষুব্ধ। কিন্তু ক্রেতা কোম্পানিগুলো এর দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। কোম্পানিগুলোর বক্তব্য, তাঁরা কারখানাগুলোর মালিক নন এবং বাংলাদেশি মালিকদের ওপর কারখানার পরিবেশ উন্নয়নের জন্য চাপ দিলেও মালিকেরা কিছু না করলে এবং সরকার এ ব্যাপারে উদাসীনতা প্রদর্শন করলে তাঁদের তেমন কিছু করার থাকে না। আর কোম্পানিগুলো তৈরি পোশাকের জন্য বেশি দাম দিতে চাইলেও তাতে শ্রমিকেরা লাভবান হবে বলে তাঁরা আশাবাদী নন। কারণ, মালিকদের স্বার্থপরতা এবং শ্রমিকদের বঞ্চনার কথা তাঁদের জানা। মালিকেরা শুধু পণ্য বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন তা-ই নয়, তাঁরা বিভিন্নভাবে আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিং করেও ঐশ্বর্যশালী হচ্ছেন, কিন্তু শ্রমিকেরা বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন। মালিকেরা একটার পর একটা কারখানা গড়ে তুলছেন
এবং সম্পদের অশ্লীল প্রদর্শনী দেখাচ্ছেন, কিন্তু যাদের রক্তের বিনিময়ে তাঁরা তা করছেন, সেই শ্রমিকেরা খেতে পায় না।
ভদ্রলোক বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁর চরম শঙ্কার কথা আমাকে জানান। বিদেশি ক্রেতাদের বাংলাদেশি কারখানায় কোনো মালিকানা নেই বলে তাঁরা যেকোনো সময় পণ্য কেনার জন্য অন্য দেশে পাড়ি জমাতে পারেন, যার উদ্যোগ ইতিমধ্যে অনেকেই নিচ্ছেন। ক্রমাগত রাজনৈতিক হানাহানি ও সহিংসতা তা আরও ত্বরান্বিত করবে। এ ছাড়া শ্রমিকদের যে অবিশ্বাস্য পরিমাণের কম মজুরি দেওয়া হয়, তাতে তাদের জীবন নির্বাহ হয় না, ফলে পুরো শিল্পে এক ভয়াবহ ধরনের অসন্তোষ ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। বস্তুত, তাঁর মতে, বাংলাদেশের পোশাকশিল্প অনেকটা বারুদের স্তূপের ওপরে দাঁড়িয়ে, যেকোনো সময় এর বিস্ফোরণ ঘটতে বাধ্য।
কনফারেন্সে অংশহণকারীদের প্রশ্নবাণের যখন মুখোমুখি হই এবং আমেরিকান ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলি, তখন বিজিএমইএর সভাপতির সাম্প্রতিক বক্তব্য আমার সামনে ভেসে ওঠে। দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার খাতিরে তিনি রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির প্রচারণা বন্ধের আহ্বান জানান। উলানবাটোরে একদল বিদেশি ‘অপিনিয়নমেকারের’ সঙ্গে আলাপের অভিজ্ঞতা থেকে আমার কাছে এটি সুস্পষ্ট, বিজিএমইএর সভাপতি চাইলেও এবং আমাদের সরকার তার সর্বশক্তি নিয়োগ করলেও এ ধরনের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া যাবে না। আন্তর্জাতিক মিডিয়া এগুলো প্রচার করবেই। তৈরি পোশাকের ভোক্তারা এবং ক্রেতারা এ নিয়ে প্রশ্ন তুলবেনই। মানুষ হিসেবে ভোক্তারা এ ব্যাপারে একধরনের ব্যক্তিগত দায়দায়িত্ব অনুভব করেন। সভাপতি ও সরকারের এ ক্ষেত্রে করণীয় হলো, এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করা। ভবিষ্যতে এ ধরনের মানবসৃষ্ট ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি না ঘটলেই বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে, যা হওয়াও অত্যন্ত জরুরি।
ইতিহাস থেকে দেখা যায়, অনেক দেশেই প্রথমদিকে শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে শ্রমিকদের ত্যাগের বিনিময়ে। কিন্তু একপর্যায়ে এসে উৎপাদকেরা নিজেদের স্বার্থেই শ্রমিকদের স্বার্থের প্রতি মনোযোগী হয়েছেন। ব্যবসার স্বার্থেই তাঁরা কিছু নিয়মকানুন গড়ে তুলেছেন এবং মেনেছেন। সরকারও তাদের করণীয় করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে সে লক্ষণ এখনো দেখা যায় না, কারণ আমাদের দেশে ব্যবসায়ের ‘রাজনীতিকীকরণ’ হয়েছে—আমাদের ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন, রাজনীতিবিদেরা হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ী, ফলে রাজনীতি আজ লাভজনক ‘ব্যবসায়ে’ পরিণত হয়েছে। আমাদের সংসদের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য ব্যবসায়ী, তাই রাজনীতি এখন পরিচালিত হয় বহুলাংশে ব্যবসায়ীদের স্বার্থে। এসব কারণে স্বল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের অধিকাংশ ব্যবসা ভালো চলছে না, রাজনীতিও হয়ে পড়েছে রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ী-আমলাদের যোগসাজশে নষ্ট ও দুর্বৃত্তায়িত।
আমাদের নষ্ট রাজনীতির মূলে রয়েছে ক্ষমতাধরদের ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতিতে যুক্ত হওয়া এবং এর আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া। বস্তুত, বাংলাদেশের দুর্নীতির একটি অন্যতম বাহন হলো ফায়দাবাজি ও দলবাজি। সোহেল রানার কথাই ধরা যাক। মিডিয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী, জনৈক রবীন্দ্র সাহার জমি ও খাল দখল করে রানা প্লাজা গড়ে তোলা হয়। রবীন্দ্র সাহা মামলা করেও গত সরকারের আমলে প্রতিকার পাননি, কারণ রানার পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা হিসেবে বর্তমান সরকারের ফায়দা পেয়ে রানা অন্যায়ভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন এবং এমপি ও প্রশাসনের সহায়তায় তা রক্ষা করেছেন। অর্থাৎ গত এবং বর্তমান সরকারের নগ্ন ফায়দা ও দলতন্ত্রচর্চার কারণে রানা অন্যায় সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন এবং আইন ও নিয়মনীতি অমান্য এবং অপরাধ করে পার পেয়ে গেছেন। বলাবাহুল্য, আমাদের নষ্ট রাজনীতির দুষ্ট ছোবলের ফলে গত দুই দশকে এ ধরনের অসংখ্য রানা আমাদের দেশে সৃষ্টি হয়েছেন, যাঁরা এবং যাঁদের ক্ষমতাধর গডফাদাররা সারা দেশে আজ একধরনের অরাজক পরিস্থিতি গড়ে তুলছেন। প্রসঙ্গত, গত সরকারের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে জনগণ দুর্নীতি পরিহার এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারের ভিত্তিতে বর্তমান মহাজোট সরকারকে গত নির্বাচনে মহাবিজয় উপহার দিয়েছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অরাজক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন তো ঘটেনিই, বরং অনেক ক্ষেত্রে অবনতি ঘটেছে।
পরিশেষে, মানব উন্নয়নের সূচকে বাংলাদেশের সফলতা অনেককে তাক লাগিয়েছে। পোশাকশিল্পে আমাদের সমৃদ্ধি ও বিস্তৃতি অনেকের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে এখন মনে করেন যে অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের সামনে একটি অভাবনীয় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। কিন্তু আমাদের আশঙ্কা, দ্রুত ফায়দাতন্ত্র-দলতন্ত্র তথা দুর্নীতির অবসান ঘটাতে এবং ন্যায়পরায়ণতা ও আইনের শাসন তথা সুশাসন কায়েম করতে না পারলে, মানব উন্নয়নে আমাদের সফলতা অব্যাহত থাকবে না। আমরা তৈরি পোশাকশিল্পকে বাঁচাতে পারব না এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বাস্তবে রূপায়িতও হবে না। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত অঘটন এড়াতে হলে জরুরি ভিত্তিতে আজ প্রয়োজন আমাদের বিরাজমান অপরাজনীতির অবসান এবং এর গুণগত মানে ব্যাপক পরিবর্তন।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
বাংলাদেশ থেকে আমিই একমাত্র এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলাম, যদিও চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এতে আমাদের সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ব্যাপকতা সম্পর্কে জানাজানি হতে থাকলে কনফারেন্সে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের অনেকেই আমাকে সমবেদনা জানাতে এগিয়ে আসেন। অনেকেই বলেন, হোটেল রুমে থেকে সিএনএন ও বিবিসি চ্যানেলে দুর্ঘটনার উদ্ধার কার্যক্রম দেখে তাঁরা চরমভাবে ব্যথিত। সমবেদনা জ্ঞাপনকারী ব্যক্তিদের প্রায় সবাই বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ভোক্তা এবং যে অমানবিক পরিবেশে এগুলো তৈরি হয় জেনে তাঁরা মর্মাহত। একজন তো হতাশার সুরে বলেই ফেললেন, তাঁর গায়ের জামাটি যে মেয়েগুলো বানিয়েছে, তারাও হয়তো মৃত বা নিখোঁজ! কয়েকজন আমার কাছে জানতে চান দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ এবং এ ধরনের বিপর্যয় রোধে সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে। তাঁরা প্রশ্ন তোলেন: কেন সরকার উদ্ধারকাজে ব্রিটিশ সহায়তা নিল না? দায়ী ব্যক্তিরা কি চিহ্নিত হবেন? শাস্তি পাবেন? মৃত ব্যক্তিদের পরিবার-পরিজন ও আহত ব্যক্তিদের দায়ভার কে নেবে? ইত্যাদি।
সম্মেলনে একজন আমেরিকানের সঙ্গে আমার কথা হয়, যিনি বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের সমস্যা সম্পর্কে আমাদের অনেকের চেয়ে অনেক বেশি খোঁজখবর রাখেন, তিনি আমাকে বলেন, গত নভেম্বরের তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডের পর তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে এ পর্যন্ত ছোট-বড় ৪৭টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, যাতে বেশ কয়েকজন হতাহতও হয়েছে। পোশাকশিল্পে দুর্ঘটনাজনিত হতাহতের মূল কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তালা দেওয়া কলাপসিবল গেট এবং হুড়োহুড়িতে শ্রমিকদের পায়ের তলায় পিষ্ট হওয়া। তাঁর আফসোস, বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ হাজার তৈরি পোশাকশিল্পে ৪৫ লাখ শ্রমিক কাজ করলেও, যা মঙ্গোলিয়ার মোট জনসংখ্যার দেড় গুণ, সরকার শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে অনাগ্রহী। বরং কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই দেশি-বিদেশি চক্রান্তের অভিযোগ তোলা হয়। তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের সময় অনেকে চক্রান্তের অভিযোগ তুলেছিলেন। তবে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন, এবার কেউ বিদেশি ষড়যন্ত্রের ধুয়া তোলেনি।
তিনি অভিযোগ করেন, বাংলাদেশ সরকার অর্থ ব্যয় করে শিল্প পুলিশ নিয়োগ দিয়েছে শ্রমিকদের পেটানোর জন্য। কিন্তু সারা দেশের শিল্পকারখানাগুলো নজরদারির জন্য মাত্র যে ১৫০টি ইন্সপেক্টরের পদ রয়েছে, তার প্রায় অর্ধেকই শূন্য। এ ব্যাপারে সরকার অর্থ ব্যয় করছে না। তাঁর কাছে অবিশ্বাস্য যে ১০০ কোটি ডলার ব্যয় করে বাংলাদেশ অস্ত্র কিনতে পারে, কিন্তু দুর্যোগকালীন উদ্ধারকাজে ব্যবহারের জন্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রস্তাবিত ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার টাকা সরকারের নেই! তাঁর আরও অভিযোগ, স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তৈরি পোশাকশিল্পে শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে তুলতে দিচ্ছেন না এবং এ প্রচেষ্টায় রত শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না, যদিও সরকার জানে কারা খুনি।
ভদ্রলোকের দাবি, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের আমেরিকান ভোক্তারা শ্রমিকদের বারবার প্রাণহানিতে দারুণভাবে ক্ষুব্ধ। কিন্তু ক্রেতা কোম্পানিগুলো এর দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। কোম্পানিগুলোর বক্তব্য, তাঁরা কারখানাগুলোর মালিক নন এবং বাংলাদেশি মালিকদের ওপর কারখানার পরিবেশ উন্নয়নের জন্য চাপ দিলেও মালিকেরা কিছু না করলে এবং সরকার এ ব্যাপারে উদাসীনতা প্রদর্শন করলে তাঁদের তেমন কিছু করার থাকে না। আর কোম্পানিগুলো তৈরি পোশাকের জন্য বেশি দাম দিতে চাইলেও তাতে শ্রমিকেরা লাভবান হবে বলে তাঁরা আশাবাদী নন। কারণ, মালিকদের স্বার্থপরতা এবং শ্রমিকদের বঞ্চনার কথা তাঁদের জানা। মালিকেরা শুধু পণ্য বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন তা-ই নয়, তাঁরা বিভিন্নভাবে আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিং করেও ঐশ্বর্যশালী হচ্ছেন, কিন্তু শ্রমিকেরা বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন। মালিকেরা একটার পর একটা কারখানা গড়ে তুলছেন
এবং সম্পদের অশ্লীল প্রদর্শনী দেখাচ্ছেন, কিন্তু যাদের রক্তের বিনিময়ে তাঁরা তা করছেন, সেই শ্রমিকেরা খেতে পায় না।
ভদ্রলোক বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁর চরম শঙ্কার কথা আমাকে জানান। বিদেশি ক্রেতাদের বাংলাদেশি কারখানায় কোনো মালিকানা নেই বলে তাঁরা যেকোনো সময় পণ্য কেনার জন্য অন্য দেশে পাড়ি জমাতে পারেন, যার উদ্যোগ ইতিমধ্যে অনেকেই নিচ্ছেন। ক্রমাগত রাজনৈতিক হানাহানি ও সহিংসতা তা আরও ত্বরান্বিত করবে। এ ছাড়া শ্রমিকদের যে অবিশ্বাস্য পরিমাণের কম মজুরি দেওয়া হয়, তাতে তাদের জীবন নির্বাহ হয় না, ফলে পুরো শিল্পে এক ভয়াবহ ধরনের অসন্তোষ ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। বস্তুত, তাঁর মতে, বাংলাদেশের পোশাকশিল্প অনেকটা বারুদের স্তূপের ওপরে দাঁড়িয়ে, যেকোনো সময় এর বিস্ফোরণ ঘটতে বাধ্য।
কনফারেন্সে অংশহণকারীদের প্রশ্নবাণের যখন মুখোমুখি হই এবং আমেরিকান ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলি, তখন বিজিএমইএর সভাপতির সাম্প্রতিক বক্তব্য আমার সামনে ভেসে ওঠে। দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার খাতিরে তিনি রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির প্রচারণা বন্ধের আহ্বান জানান। উলানবাটোরে একদল বিদেশি ‘অপিনিয়নমেকারের’ সঙ্গে আলাপের অভিজ্ঞতা থেকে আমার কাছে এটি সুস্পষ্ট, বিজিএমইএর সভাপতি চাইলেও এবং আমাদের সরকার তার সর্বশক্তি নিয়োগ করলেও এ ধরনের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া যাবে না। আন্তর্জাতিক মিডিয়া এগুলো প্রচার করবেই। তৈরি পোশাকের ভোক্তারা এবং ক্রেতারা এ নিয়ে প্রশ্ন তুলবেনই। মানুষ হিসেবে ভোক্তারা এ ব্যাপারে একধরনের ব্যক্তিগত দায়দায়িত্ব অনুভব করেন। সভাপতি ও সরকারের এ ক্ষেত্রে করণীয় হলো, এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করা। ভবিষ্যতে এ ধরনের মানবসৃষ্ট ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি না ঘটলেই বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে, যা হওয়াও অত্যন্ত জরুরি।
ইতিহাস থেকে দেখা যায়, অনেক দেশেই প্রথমদিকে শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে শ্রমিকদের ত্যাগের বিনিময়ে। কিন্তু একপর্যায়ে এসে উৎপাদকেরা নিজেদের স্বার্থেই শ্রমিকদের স্বার্থের প্রতি মনোযোগী হয়েছেন। ব্যবসার স্বার্থেই তাঁরা কিছু নিয়মকানুন গড়ে তুলেছেন এবং মেনেছেন। সরকারও তাদের করণীয় করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে সে লক্ষণ এখনো দেখা যায় না, কারণ আমাদের দেশে ব্যবসায়ের ‘রাজনীতিকীকরণ’ হয়েছে—আমাদের ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন, রাজনীতিবিদেরা হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ী, ফলে রাজনীতি আজ লাভজনক ‘ব্যবসায়ে’ পরিণত হয়েছে। আমাদের সংসদের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য ব্যবসায়ী, তাই রাজনীতি এখন পরিচালিত হয় বহুলাংশে ব্যবসায়ীদের স্বার্থে। এসব কারণে স্বল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের অধিকাংশ ব্যবসা ভালো চলছে না, রাজনীতিও হয়ে পড়েছে রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ী-আমলাদের যোগসাজশে নষ্ট ও দুর্বৃত্তায়িত।
আমাদের নষ্ট রাজনীতির মূলে রয়েছে ক্ষমতাধরদের ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতিতে যুক্ত হওয়া এবং এর আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া। বস্তুত, বাংলাদেশের দুর্নীতির একটি অন্যতম বাহন হলো ফায়দাবাজি ও দলবাজি। সোহেল রানার কথাই ধরা যাক। মিডিয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী, জনৈক রবীন্দ্র সাহার জমি ও খাল দখল করে রানা প্লাজা গড়ে তোলা হয়। রবীন্দ্র সাহা মামলা করেও গত সরকারের আমলে প্রতিকার পাননি, কারণ রানার পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা হিসেবে বর্তমান সরকারের ফায়দা পেয়ে রানা অন্যায়ভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন এবং এমপি ও প্রশাসনের সহায়তায় তা রক্ষা করেছেন। অর্থাৎ গত এবং বর্তমান সরকারের নগ্ন ফায়দা ও দলতন্ত্রচর্চার কারণে রানা অন্যায় সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন এবং আইন ও নিয়মনীতি অমান্য এবং অপরাধ করে পার পেয়ে গেছেন। বলাবাহুল্য, আমাদের নষ্ট রাজনীতির দুষ্ট ছোবলের ফলে গত দুই দশকে এ ধরনের অসংখ্য রানা আমাদের দেশে সৃষ্টি হয়েছেন, যাঁরা এবং যাঁদের ক্ষমতাধর গডফাদাররা সারা দেশে আজ একধরনের অরাজক পরিস্থিতি গড়ে তুলছেন। প্রসঙ্গত, গত সরকারের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে জনগণ দুর্নীতি পরিহার এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারের ভিত্তিতে বর্তমান মহাজোট সরকারকে গত নির্বাচনে মহাবিজয় উপহার দিয়েছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অরাজক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন তো ঘটেনিই, বরং অনেক ক্ষেত্রে অবনতি ঘটেছে।
পরিশেষে, মানব উন্নয়নের সূচকে বাংলাদেশের সফলতা অনেককে তাক লাগিয়েছে। পোশাকশিল্পে আমাদের সমৃদ্ধি ও বিস্তৃতি অনেকের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে এখন মনে করেন যে অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের সামনে একটি অভাবনীয় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। কিন্তু আমাদের আশঙ্কা, দ্রুত ফায়দাতন্ত্র-দলতন্ত্র তথা দুর্নীতির অবসান ঘটাতে এবং ন্যায়পরায়ণতা ও আইনের শাসন তথা সুশাসন কায়েম করতে না পারলে, মানব উন্নয়নে আমাদের সফলতা অব্যাহত থাকবে না। আমরা তৈরি পোশাকশিল্পকে বাঁচাতে পারব না এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বাস্তবে রূপায়িতও হবে না। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত অঘটন এড়াতে হলে জরুরি ভিত্তিতে আজ প্রয়োজন আমাদের বিরাজমান অপরাজনীতির অবসান এবং এর গুণগত মানে ব্যাপক পরিবর্তন।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
No comments