আসুন, সবুজ হই by আনিসুল হক
আমার মুঠোফোনটা চার্জারের তার থেকে বিচ্ছিন্ন করার সঙ্গে সঙ্গে একটা লেখা ভেসে ওঠে পর্দায়, আপনার চার্জারটা খুলে রাখুন, এতে কিছু বিদ্যুত্ অপচয় রোধ হবে। একটা চার্জার যদি মুঠোফোনের সঙ্গে যুক্ত না থাকে, কতটুকুন আর বিদ্যুত্ খরচ হবে। কিন্তু ওই অতটুকুন বিদ্যুত্ও বেশি খরচ করতে নেই। সবাই যদি একটু একটু করে বিদ্যুত্ সাশ্রয় করে, তাহলে তা একত্র হয়ে সাশ্রয়ের পরিমাণটাকে করে তুলবে বিশাল। আর বিদ্যুত্ যদি কম ব্যয় হয়, তাহলে তা জলবায়ুর ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে দেবে অনেকখানি। কারণ, বিদ্যুত্ উত্পাদন করতে গিয়ে তেল, কয়লা যাই পোড়ানো হোক না কেন, তা বাতাসে কার্বনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, আর তাতে পৃথিবীর তাপমাত্রা একটু বাড়ানোর ঝুঁকি তৈরি হয়। পৃথিবীব্যাপী এখন এই এক আওয়াজ—গো গ্রিন। আরেকটু সবুজ হোন। মানে জলবায়ু ও পরিবেশের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকুন। প্রচারণা চলছে, গাড়ি কম চড়ুন, হাঁটুন অথবা সাইকেলে চড়ুন, সবগুলো বৈদ্যুতিক বাতি বদলে বিদ্যুত্-সাশ্রয়ী বাতি লাগান। প্রশ্ন উঠেছে, আপনি পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করবেন, নাকি কাগজের ব্যাগ। উত্তর হলো, একটাও না। এমন একটা ব্যাগ ব্যবহার করুন, যেটা বারবার ব্যবহার করা যায়, যেমন চটের ব্যাগ। কারণ, পলিথিন ব্যাগ পচে না, পরিবেশ নষ্ট করে, কিন্তু কাগজের ব্যাগও ক্ষতিকর, এটা বানানোর জন্য যেমন গাছ কাটতে হয়, জ্বালানি খরচ করতে হয়, তেমনি এটা পচনের সময় গ্রিনহাউস গ্যাস উত্পাদন করে। ঘর থেকে যখনই বের হবেন, বিদ্যুতের সু্ইচ বন্ধ করে দিন। কাগজের চিঠির বদলে ই-মেইল ব্যবহার করুন, প্রিন্ট নিতে হলে কাগজের দুই পিঠেই নিন। ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ে এমন কল মেরামত করুন। বোতলের পানি না খেয়ে ফিল্টার করে পানি খান, তাতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর থেকে চাপ কমবে। এই ধরনের নানা ধরনের প্রচারণা চলছে বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোয়, তারা জলবায়ু-পাপী, উন্নতিই তাদের আজন্ম পাপ, তারা তাদের পাপের ভার আর বাড়াতে চায় না।
পৃথিবীটা যে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে উষ্ণতর হয়ে উঠেছে, আর তার জন্য দায়ী বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং এ জন্য মানুষই দায়ী, এটা এখন বৈজ্ঞানিক সত্য। পৃথিবীর সব মানুষ চেষ্টা করলে এই গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ কমিয়েও দিতে পারে, তার মাধ্যমে পৃথিবীকে আবার ধীরে ধীরে শীতলও করে ফেলতে পারে। আপাতত সে সম্ভাবনা নেই। প্রথমত, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এই বিষয়ে একমত হতে পারেনি। চীন এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জলবায়ু দূষণকারী দেশ। দ্বিতীয় স্থানে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। চীন কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমানোর ব্যাপারে আইনগত বাধ্যবাধকতা মানতে চায় না, কারণ তাতে তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতির রাশ টেনে ধরতে হয়। চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা আর ব্রাজিল—এরা বলে, আমরা উন্নয়নশীল দেশ, কার্বন নিঃসরণ কমানোর আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে আমরা কেন যাব? আর আমেরিকা বলে, ওদের যদি বাধ্য না করা হয়, তাহলে আর আমরা কেন সেই লাগাম পরতে যাব। ফলে গত বছর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত কোপেনহেগেন বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন মোটের ওপর বড় কোনো অর্জন ছাড়াই সমাপ্ত হয়েছে।
পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে জলবায়ুর যে পরিবর্তন হচ্ছে, তার বড় শিকারে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে অনাবৃষ্টি হবে, আবার অতিবৃষ্টি হবে, হঠাত্ অসময়ে বন্যা হবে, ঘন ঘন সাইক্লোন হবে, সমুদ্রতলের উচ্চতা বেড়ে যাবে, বাংলাদেশের অনেকাংশ ডুবে যাবে—সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা এটা স্বীকার করে নিয়েছেন।
তবে জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রস্তুতি ও ভূমিকা ভালো ছিল। চীন ও ভারত যখন একটা বিষয়ে একমত হয়, তখন বাংলাদেশের জন্য কথা বলা ছিল মুশকিল। কারণ, কথা বলতে হয় গ্রুপে গ্রুপে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সদস্য হিসেবে, আবার জি-৭৭ ও চীনের গ্রুপের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ যথোচিত ভূমিকাই পালন করেছে। বাংলাদেশ ৩৫০ পিপিএমের বেশি কার্বন ঘনত্ব নয় এবং দেড় ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা বৃদ্ধি নয়—এই দাবিতে সোচ্চার ছিল। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজনের তহবিল গঠন করা, তাকে সহজপ্রাপ্য করা—এই দাবিতেও কথা বলেছে। বাংলাদেশ নিজেকে উপস্থাপন করেছে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে। অভিযোজনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষের এই দক্ষতা এখন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। বাংলাদেশ কিয়োটো প্রটোকলের ধারাবাহিকতার দাবি তুলেছে। শেষ পর্যন্ত ২৬টা দেশ মিলে যে কোপেনহেগেন অ্যাকর্ড দাঁড় করিয়েছে, তাতে বাংলাদেশও ছিল। সব মিলিয়ে কোপেনহেগেনে বাংলাদেশের ভূমিকা ছিল ইতিবাচক।
কিন্তু সাধারণভাবে আমাদের দেশে জলবায়ুর ব্যাপারে জনসচেতনতার এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সতর্কতার অভাব রয়ে গেছে। এই অসচেতনতা যেমন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রকাশিত হয়, তেমনি আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যেও দেখা যায়। যেমন, আমরা একটা দেশলাইয়ের কাঠি বাঁচানোর জন্য গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখি। আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাস বায়ুমণ্ডলে ছড়ালে সেটা গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করবে। আমরা অপ্রয়োজনে বাতি জ্বালিয়ে রাখি। আমরা প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের ব্যবহার করার চিন্তা বিসর্জন দিয়ে ফেলেছি। অথচ কোপেনহেগেনে দেখে এলাম, ওরা ওদের বাড়ি এমনভাবে নকশা করছে, যাতে বাতি জ্বালাতে না হয়, দিনের আলো ঘরের ভেতরে ব্যবহার করা যায়।
পৃথিবীতে এত দিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল এক নম্বর জলবায়ু দূষক দেশ। তারা একটা মারাত্মক নীতি অবলম্বন করেছিল, রেলের বদলে বা রেলের সমান্তরালে সড়কপথে ও আকাশপথে যোগাযোগব্যবস্থাকে উন্নত করেছিল। এর ফলে গাড়ির সংখ্যা বেড়ে গেছে। তেল পুড়ছে, কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে। এখন পৃথিবীতে আবার গাড়ির ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমানোর আওয়াজ উঠেছে। কোপেনহেগেন শহরে রাস্তায় সাইকেলের লেন করে দেওয়া হয়েছে, প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও নারীপুরুষ সবাই সাইকেল চালাচ্ছে। আর আমরা ঢাকা শহর থেকে সাইকেল তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করছি। আমাদের কোনো গণপরিবহনব্যবস্থা নেই। সম্প্রতি দিল্লি-আগ্রা-জয়পুর সড়কপথে ভ্রমণের সময় একটা দারুণ ব্যাপার লক্ষ করলাম। এই সড়কপথে কোনো দূরপাল্লার বাস নেই। তার মানে ভারতে ট্রেন যোগাযোগটা ভালো, ওরা রেলের ওপরেই দূরভ্রমণের জন্য বেশি নির্ভরশীল। আর আমরা সারা দেশ থেকে রেল তুলে দিয়ে বাস-ট্রাকের ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। এটা খুবই আত্মঘাতী হচ্ছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন, ঢাকার চারপাশে চারটা উপশহর গড়ে তোলা হবে। সেই উপশহরের সঙ্গে যোগাযোগটা হবে কীভাবে? বাসে আর গাড়িতে? তাহলে ঢাকার ওপর চাপ মোটেও কমবে না। আমাদের অবশ্যই রেলযোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে।
আর আমরা বন ধ্বংস করছি। আমাদের সমুদ্র উপকূলে গাছ নিধনের ছবি কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে ছাপা হয়েছে। আমরা দেশের সব কটা বন সাফ করে ফেলছি। অথচ আমাদের বনায়ন বাড়াতে হবে। বাতাস থেকে কার্বন ঘনত্ব কমানোর একটা উপায় হলো বনায়ন বৃদ্ধি।
আর আমাদের বায়োগ্যাস ও সৌরবিদ্যুতের কথাও ভাবতে হবে। ন্যানো গাড়ি দেশে আসছে, এটা কোনো সুখবর নয়, দুঃসংবাদ। আমাদের আকাশ-বাতাস আরও দূষিত করবে এই যান। আমরা যখন নৌকায় পাল তুলে চলতাম, তখন আমরা ছিলাম পরিবেশ ও জলবায়ুবান্ধব। এখন আমরা ইঞ্জিন নৌকায় চড়ি, বাতাস ও জল দুই-ই দূষিত করি।
আমরা ঢাকা শহরে গাড়ির সংখ্যা বাড়িয়েই চলেছি। একটা শহরে রাস্তা থাকা উচিত শতকরা ২৫ ভাগ, আমাদের আছে সাত ভাগ। আর যেসব শহরের কথা বলছি, সেসব শহরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ঢাকার মতো বিশাল নয়। তাহলে ঢাকায় কত ভাগ রাস্তা থাকা উচিত? ঢাকার যানজট সমস্যার সমাধানের জন্য বহুমুখী পরিকল্পনা নিতে হবে। এর মধ্যে পাতালরেল, মনোরেল, ফ্লাইওভার, সার্কুলার রোড, জলপথ ব্যবহার—সবই করতে হবে। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি ভিত্তিতে দরকার প্রচুর ফুটওভারব্রিজ ও হাঁটার ফুটপাত। আমাদের হাঁটার অভ্যাস বাড়াতে হবে। আমাদের যোগাযোগব্যবস্থা সড়কনির্ভর না করে রেলনির্ভর করতে হবে। এবং রেলকে বৈদ্যুতিক করতে হবে।
আসলে বলতে চাচ্ছি, আমাদের দৈনন্দিন জীবনচর্চায় পরিবেশ ও জলবায়ুর কথা সার্বক্ষণিকভাবে বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে। আমাদের শহরের রাস্তায় কখনোই যেন সকাল হয়ে যাওয়ার পর বাতি না জ্বলে। আমরা যেন টেলিভিশন বন্ধ করার জন্য রিমোটের পাশাপাশি সুইচটাও বন্ধ করি। আমরা যেন অকারণ আলোকসজ্জা না করি।
সত্য বটে, জলবায়ু কূটনীতির সঙ্গে বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রতিযোগিতাও জড়িত। চীনের অর্থনৈতিক উন্নতির রকেটটাকে থামিয়ে দেওয়ার এ হচ্ছে পশ্চিমা কৌশল, এ অভিযোগ কেউ করতেই পারেন। ভারত বলে, আমি তো মাথাপিছু কার্বন দূষণ কম ঘটাই। জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমে গেলে ওপেক দেশগুলোর কী হবে, এটা তাদের মাথাব্যথা। এই ধরনের নানা কূটকচালের ভেতরে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার—তোমাদের জন্য যা কূটনীতি-রাজনীতি, আমাদের জন্য তা জীবনমরণ সমস্যা।
জলবায়ু পরিবর্তনে কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশের কোনো দায় নেই, বাংলাদেশকে কেউ কোনো বাধ্যবাধকতায় আসতে বলবেও না। তবু আমরা হতে পারি ক্লাইমেট চ্যাম্পিয়ন দেশ। আমরা নিজেদের একটা পরিবেশবান্ধব দেশ হিসেবে গড়ে তুলে হয়ে উঠতে পারি পৃথিবীর জন্য মডেল। আমরা বলতে পারি, দেখ আমাদের সামর্থ্য সীমিত, তবু আমরা সবুজ নীতি অবলম্বন করছি।
রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকেরা যখন বড় বড় নীতি প্রণয়ন করবেন, তখন প্রতিটা নাগরিককেও সচেতনতার প্রমাণ রাখতে হবে। ব্যবহারের পর কম্পিউটার বন্ধ করে দেওয়া বা গ্যাসের চুলা বন্ধ করা তার খুবই সাধারণ কিন্তু বড় উদাহরণ। আসলে প্রথম আলো ঠিকই বলেছে, অন্যকে বদলাতে বলার আগে দরকার আমাদের নিজেদেরই বদলানো।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক, সাংবাদিক।
পৃথিবীটা যে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে উষ্ণতর হয়ে উঠেছে, আর তার জন্য দায়ী বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং এ জন্য মানুষই দায়ী, এটা এখন বৈজ্ঞানিক সত্য। পৃথিবীর সব মানুষ চেষ্টা করলে এই গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ কমিয়েও দিতে পারে, তার মাধ্যমে পৃথিবীকে আবার ধীরে ধীরে শীতলও করে ফেলতে পারে। আপাতত সে সম্ভাবনা নেই। প্রথমত, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এই বিষয়ে একমত হতে পারেনি। চীন এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জলবায়ু দূষণকারী দেশ। দ্বিতীয় স্থানে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। চীন কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমানোর ব্যাপারে আইনগত বাধ্যবাধকতা মানতে চায় না, কারণ তাতে তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতির রাশ টেনে ধরতে হয়। চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা আর ব্রাজিল—এরা বলে, আমরা উন্নয়নশীল দেশ, কার্বন নিঃসরণ কমানোর আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে আমরা কেন যাব? আর আমেরিকা বলে, ওদের যদি বাধ্য না করা হয়, তাহলে আর আমরা কেন সেই লাগাম পরতে যাব। ফলে গত বছর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত কোপেনহেগেন বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন মোটের ওপর বড় কোনো অর্জন ছাড়াই সমাপ্ত হয়েছে।
পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে জলবায়ুর যে পরিবর্তন হচ্ছে, তার বড় শিকারে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে অনাবৃষ্টি হবে, আবার অতিবৃষ্টি হবে, হঠাত্ অসময়ে বন্যা হবে, ঘন ঘন সাইক্লোন হবে, সমুদ্রতলের উচ্চতা বেড়ে যাবে, বাংলাদেশের অনেকাংশ ডুবে যাবে—সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা এটা স্বীকার করে নিয়েছেন।
তবে জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রস্তুতি ও ভূমিকা ভালো ছিল। চীন ও ভারত যখন একটা বিষয়ে একমত হয়, তখন বাংলাদেশের জন্য কথা বলা ছিল মুশকিল। কারণ, কথা বলতে হয় গ্রুপে গ্রুপে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সদস্য হিসেবে, আবার জি-৭৭ ও চীনের গ্রুপের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ যথোচিত ভূমিকাই পালন করেছে। বাংলাদেশ ৩৫০ পিপিএমের বেশি কার্বন ঘনত্ব নয় এবং দেড় ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা বৃদ্ধি নয়—এই দাবিতে সোচ্চার ছিল। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজনের তহবিল গঠন করা, তাকে সহজপ্রাপ্য করা—এই দাবিতেও কথা বলেছে। বাংলাদেশ নিজেকে উপস্থাপন করেছে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে। অভিযোজনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষের এই দক্ষতা এখন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। বাংলাদেশ কিয়োটো প্রটোকলের ধারাবাহিকতার দাবি তুলেছে। শেষ পর্যন্ত ২৬টা দেশ মিলে যে কোপেনহেগেন অ্যাকর্ড দাঁড় করিয়েছে, তাতে বাংলাদেশও ছিল। সব মিলিয়ে কোপেনহেগেনে বাংলাদেশের ভূমিকা ছিল ইতিবাচক।
কিন্তু সাধারণভাবে আমাদের দেশে জলবায়ুর ব্যাপারে জনসচেতনতার এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সতর্কতার অভাব রয়ে গেছে। এই অসচেতনতা যেমন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রকাশিত হয়, তেমনি আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যেও দেখা যায়। যেমন, আমরা একটা দেশলাইয়ের কাঠি বাঁচানোর জন্য গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখি। আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাস বায়ুমণ্ডলে ছড়ালে সেটা গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করবে। আমরা অপ্রয়োজনে বাতি জ্বালিয়ে রাখি। আমরা প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের ব্যবহার করার চিন্তা বিসর্জন দিয়ে ফেলেছি। অথচ কোপেনহেগেনে দেখে এলাম, ওরা ওদের বাড়ি এমনভাবে নকশা করছে, যাতে বাতি জ্বালাতে না হয়, দিনের আলো ঘরের ভেতরে ব্যবহার করা যায়।
পৃথিবীতে এত দিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল এক নম্বর জলবায়ু দূষক দেশ। তারা একটা মারাত্মক নীতি অবলম্বন করেছিল, রেলের বদলে বা রেলের সমান্তরালে সড়কপথে ও আকাশপথে যোগাযোগব্যবস্থাকে উন্নত করেছিল। এর ফলে গাড়ির সংখ্যা বেড়ে গেছে। তেল পুড়ছে, কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে। এখন পৃথিবীতে আবার গাড়ির ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমানোর আওয়াজ উঠেছে। কোপেনহেগেন শহরে রাস্তায় সাইকেলের লেন করে দেওয়া হয়েছে, প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও নারীপুরুষ সবাই সাইকেল চালাচ্ছে। আর আমরা ঢাকা শহর থেকে সাইকেল তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করছি। আমাদের কোনো গণপরিবহনব্যবস্থা নেই। সম্প্রতি দিল্লি-আগ্রা-জয়পুর সড়কপথে ভ্রমণের সময় একটা দারুণ ব্যাপার লক্ষ করলাম। এই সড়কপথে কোনো দূরপাল্লার বাস নেই। তার মানে ভারতে ট্রেন যোগাযোগটা ভালো, ওরা রেলের ওপরেই দূরভ্রমণের জন্য বেশি নির্ভরশীল। আর আমরা সারা দেশ থেকে রেল তুলে দিয়ে বাস-ট্রাকের ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। এটা খুবই আত্মঘাতী হচ্ছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন, ঢাকার চারপাশে চারটা উপশহর গড়ে তোলা হবে। সেই উপশহরের সঙ্গে যোগাযোগটা হবে কীভাবে? বাসে আর গাড়িতে? তাহলে ঢাকার ওপর চাপ মোটেও কমবে না। আমাদের অবশ্যই রেলযোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে।
আর আমরা বন ধ্বংস করছি। আমাদের সমুদ্র উপকূলে গাছ নিধনের ছবি কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে ছাপা হয়েছে। আমরা দেশের সব কটা বন সাফ করে ফেলছি। অথচ আমাদের বনায়ন বাড়াতে হবে। বাতাস থেকে কার্বন ঘনত্ব কমানোর একটা উপায় হলো বনায়ন বৃদ্ধি।
আর আমাদের বায়োগ্যাস ও সৌরবিদ্যুতের কথাও ভাবতে হবে। ন্যানো গাড়ি দেশে আসছে, এটা কোনো সুখবর নয়, দুঃসংবাদ। আমাদের আকাশ-বাতাস আরও দূষিত করবে এই যান। আমরা যখন নৌকায় পাল তুলে চলতাম, তখন আমরা ছিলাম পরিবেশ ও জলবায়ুবান্ধব। এখন আমরা ইঞ্জিন নৌকায় চড়ি, বাতাস ও জল দুই-ই দূষিত করি।
আমরা ঢাকা শহরে গাড়ির সংখ্যা বাড়িয়েই চলেছি। একটা শহরে রাস্তা থাকা উচিত শতকরা ২৫ ভাগ, আমাদের আছে সাত ভাগ। আর যেসব শহরের কথা বলছি, সেসব শহরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ঢাকার মতো বিশাল নয়। তাহলে ঢাকায় কত ভাগ রাস্তা থাকা উচিত? ঢাকার যানজট সমস্যার সমাধানের জন্য বহুমুখী পরিকল্পনা নিতে হবে। এর মধ্যে পাতালরেল, মনোরেল, ফ্লাইওভার, সার্কুলার রোড, জলপথ ব্যবহার—সবই করতে হবে। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি ভিত্তিতে দরকার প্রচুর ফুটওভারব্রিজ ও হাঁটার ফুটপাত। আমাদের হাঁটার অভ্যাস বাড়াতে হবে। আমাদের যোগাযোগব্যবস্থা সড়কনির্ভর না করে রেলনির্ভর করতে হবে। এবং রেলকে বৈদ্যুতিক করতে হবে।
আসলে বলতে চাচ্ছি, আমাদের দৈনন্দিন জীবনচর্চায় পরিবেশ ও জলবায়ুর কথা সার্বক্ষণিকভাবে বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে। আমাদের শহরের রাস্তায় কখনোই যেন সকাল হয়ে যাওয়ার পর বাতি না জ্বলে। আমরা যেন টেলিভিশন বন্ধ করার জন্য রিমোটের পাশাপাশি সুইচটাও বন্ধ করি। আমরা যেন অকারণ আলোকসজ্জা না করি।
সত্য বটে, জলবায়ু কূটনীতির সঙ্গে বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রতিযোগিতাও জড়িত। চীনের অর্থনৈতিক উন্নতির রকেটটাকে থামিয়ে দেওয়ার এ হচ্ছে পশ্চিমা কৌশল, এ অভিযোগ কেউ করতেই পারেন। ভারত বলে, আমি তো মাথাপিছু কার্বন দূষণ কম ঘটাই। জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমে গেলে ওপেক দেশগুলোর কী হবে, এটা তাদের মাথাব্যথা। এই ধরনের নানা কূটকচালের ভেতরে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার—তোমাদের জন্য যা কূটনীতি-রাজনীতি, আমাদের জন্য তা জীবনমরণ সমস্যা।
জলবায়ু পরিবর্তনে কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশের কোনো দায় নেই, বাংলাদেশকে কেউ কোনো বাধ্যবাধকতায় আসতে বলবেও না। তবু আমরা হতে পারি ক্লাইমেট চ্যাম্পিয়ন দেশ। আমরা নিজেদের একটা পরিবেশবান্ধব দেশ হিসেবে গড়ে তুলে হয়ে উঠতে পারি পৃথিবীর জন্য মডেল। আমরা বলতে পারি, দেখ আমাদের সামর্থ্য সীমিত, তবু আমরা সবুজ নীতি অবলম্বন করছি।
রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকেরা যখন বড় বড় নীতি প্রণয়ন করবেন, তখন প্রতিটা নাগরিককেও সচেতনতার প্রমাণ রাখতে হবে। ব্যবহারের পর কম্পিউটার বন্ধ করে দেওয়া বা গ্যাসের চুলা বন্ধ করা তার খুবই সাধারণ কিন্তু বড় উদাহরণ। আসলে প্রথম আলো ঠিকই বলেছে, অন্যকে বদলাতে বলার আগে দরকার আমাদের নিজেদেরই বদলানো।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক, সাংবাদিক।
No comments