সুঁই-সিরিঞ্জের বদলে কলম -চারদিক by আবদুল কুদ্দুস
‘সুঁই-সিরিঞ্জ নিয়ে একসময় যে হাতে মাদক গ্রহণ করতাম, নানা অপকর্ম চালাতাম; এখন সেই হাতে তুলে নিয়েছি কলম। এই কলম দিয়ে ছবি আঁকছি, ছড়া-গল্প-কৌতুক লেখার চেষ্টা করছি। সময়টা বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছে, স্যার।’
৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে কক্সবাজার শহর থেকে ৮৫ কিলোমিটার দূরে টেকনাফ পৌরসভার কায়ূকখালী গ্রামে স্বেচ্ছাসেবী মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র ‘মধুমিতা নোঙর’ কেন্দ্রের বারান্দায় বসে সাদা কাগজে প্রজাপতির ছবি আঁকতে আঁকতে কথাগুলো বললেন স্থানীয় মাদকাসক্ত যুবক নবী আলম।
নবী আলমের পাশে দুই লাইনে সারিবদ্ধভাবে বসে ছবি আঁকছেন জহির উদ্দিন, বাবুল, সফিক, কবিরসহ আরও অন্তত ৪৫ তরুণ যুবক। এরাও সবাই মাদকাসক্ত। সুস্থ করার জন্য পরিবারের সদস্যরা এদের ধরে এনে এই কেন্দ্রে ভর্তি করিয়ে দেয়। তিন মাস পর সুস্থ হলে এদের নিজ নিজ বাড়িতে ফেরত পাঠানো হবে।
এদের প্রত্যেকের হাতে কাগজ-কলম। কেউ সাদা কাগজের ওপর হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলের ছবি আঁকছে। কেউ আবার অঙ্কে ১, ২, ৩ এভাবে ১০ পর্যন্ত লিখছে। শিক্ষিত যারা, তারা গল্প-কৌতুক লেখার চেষ্টা করছে। মাঝেমধ্যে একজনের ছবি দেখে অন্যজন হাসি-ঠাট্টা-মশকরা করছে। কেউ আবার অন্যের ওপর শিক্ষকতা চালাচ্ছে। দেখিয়ে দিচ্ছে, ‘ণ’ এভাবে লিখতে হয়। ‘৯’ এদিক থেকে লিখতে হবে।
নবী আলম জানান, ‘এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে জীবনটা শেষ করে দিলাম। ব্যবসার লাখ টাকার মূলধন, ঘরের ধনসম্পদ, দামি কাপড়চোপড়, স্ত্রীর মূল্যবান গয়না এই মাদকের পেছনে খরচ করে এখন পথের ফকির। অনেক চেষ্টার পরও স্ত্রী আমাকে ভালো পথে আনতে না পেরে দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে দেড় বছর আগে বাপের বাড়ি চলে যান।’
নবী আলমের বাড়ি কক্সবাজার পৌরসভার ঘোনারপাড়ায়। শহরের প্রধান পাইকারি মাছের বাজার ফিশারিঘাটে আড়তদাড়ি (মাছের ব্যবসা) করেই চলত তাঁর সুখের সংসার। সাত বছর আগে বন্ধুর পাল্লায় পড়ে নবী গাঁজা সেবন করেন। এরপর চোলাই মদ, হেরোইন। তারপর নেশার বড়ি ‘ইয়াবা’। তিন বছর আগে ইয়াবার দাম বেড়ে গেলে নবী শরীরে সুঁই-সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে মাদক গ্রহণ করতেন। সুঁই-সিরিঞ্জের আঘাতে একসময় তাঁর দুই হাত ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। দুই মাস আগে স্থানীয় কয়েকজন লোক নবী আলমকে রাস্তা থেকে অচেতন অবস্থায় তুলে এই কেন্দ্রে ভর্তি করায়। এখানে বিনামূল্যে নবী আলমের চিকিত্সা চলছে। পাশাপাশি চলে খেলাধুলা, ছবি আঁকাআঁকির কাজ। সচেতন করা হচ্ছে মাদক ও এইডস সম্পর্কে।
চিকিত্সা নিতে আসা যুবক জহির ও কবির জানান, এখানে আমরা সেবার পাশাপাশি অনেক কিছু শিখতে পারছি। যে হাত দিয়ে আমরা মাদক গ্রহণ করতাম, কিংবা সুঁই ফোটাতাম নিজের শরীরে, সেই হাত দিয়ে এখন পরিবেশ রক্ষা, আয়-উপার্জনের পথ তৈরির জন্য বৃক্ষরোপই, শাক-সবজির বাগান তৈরি, মত্স্য চাষ ও শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণের কাজের প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। সুঁই-সিরিঞ্জের বদলে কলম তুলে নিয়ে শিখছি লেখাপড়া। শরীর সুস্থ রাখার জন্য নিয়মিত অনুশীলন করি। খেলি ভলিবল, ফুটবলসহ না খেলাধুলা।
টেকনাফের নিলা গ্রামের জহির উদ্দিন (২৮) বলেন, “দুই মাস ধরে এই কেন্দ্রে সেবা নিচ্ছি। মোটামুটি সুস্থ হয়ে এখন বুঝতে পারছি, জীবনে কী ভুল করেছিলাম। এখন আমরা সবাই শপথ নিয়েছি, সুস্থ হয়ে গ্রামে ফিরে গিয়ে আর খারাপ বন্ধুর সঙ্গে মিশব না। খারাপ কাজে জড়িত হব না। মাদককে সব সময় ‘না’ বলব। যে বন্ধু নেশা করতে বলবে, তাকে এড়িয়ে চলব।”
মধুমিতা নোঙর কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক হুমায়ূন কবীর জানান, বর্তমানে এই কেন্দ্রে টেকনাফ, কক্সবাজার শহর, ঈদগাহ, চকরিয়া, লামা ও০ সাতকানিয়ার গরিব ৬১ জনের বিনামূল্যে সেবা চলছে। এদের বয়স ১৪ থেকে ৩৫ বছর। তিন মাস পর সুস্থ করে এদের পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক দিদারুল আলম রাশেদ জানান, এ পর্যন্ত ৫৫৭ জন মাদকাসক্তকে বিনামূল্যে এই কেন্দ্রে সেবা দিয়ে সুস্থ করা হয়েছে। এরা সবাই এখন সুস্থ জীবন ফিরে পেয়েছে। আরও ৪৭৯ জন মাদকাসক্তকে দীর্ঘমেয়াদি সেবা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ৮৫৫ জনকে এসটিআই, ৩১১ জনের এইচআইভি পরীক্ষা এবং ৮৫ জনকে কর্মমুখী শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জামাল আহমদ চৌধুরী জানান, টেকনাফ সীমান্ত দিয়েই মিয়ানমার থেকে পাচার হয়ে আসা নেশার বড়ি ইয়াবা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু টেকনাফে ইয়াবা পাচারকারী রয়েছে তিন শতাধিক। অবশ্যই এর মধ্য থেকে ৮০ জনের মতো পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় উদ্ধার করা হয়েছে ১০ হাজারের বেশি ইয়াবা বড়ি। পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা গত কয়েক মাসে অভিযান চালিয়ে তিন কোটি টাকা দামের তিন কেজি হেরোইনসহ তিন পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করেছেন। তার পরও মাদক পাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না। ফলে মাদকাসক্তের সংখ্যাও বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে মধুমিতা নোঙর কেন্দ্র বিনামূল্যে মাদকাসক্তদের সুস্থ করার যে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে, নিঃসন্দেহে তা প্রশংসার দাবি রাখে।
সুঁই-সিরিঞ্জের বদলে হাতে কমল তুলে নিয়ে ছবি আঁকছে ওরা।
৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে কক্সবাজার শহর থেকে ৮৫ কিলোমিটার দূরে টেকনাফ পৌরসভার কায়ূকখালী গ্রামে স্বেচ্ছাসেবী মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র ‘মধুমিতা নোঙর’ কেন্দ্রের বারান্দায় বসে সাদা কাগজে প্রজাপতির ছবি আঁকতে আঁকতে কথাগুলো বললেন স্থানীয় মাদকাসক্ত যুবক নবী আলম।
নবী আলমের পাশে দুই লাইনে সারিবদ্ধভাবে বসে ছবি আঁকছেন জহির উদ্দিন, বাবুল, সফিক, কবিরসহ আরও অন্তত ৪৫ তরুণ যুবক। এরাও সবাই মাদকাসক্ত। সুস্থ করার জন্য পরিবারের সদস্যরা এদের ধরে এনে এই কেন্দ্রে ভর্তি করিয়ে দেয়। তিন মাস পর সুস্থ হলে এদের নিজ নিজ বাড়িতে ফেরত পাঠানো হবে।
এদের প্রত্যেকের হাতে কাগজ-কলম। কেউ সাদা কাগজের ওপর হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলের ছবি আঁকছে। কেউ আবার অঙ্কে ১, ২, ৩ এভাবে ১০ পর্যন্ত লিখছে। শিক্ষিত যারা, তারা গল্প-কৌতুক লেখার চেষ্টা করছে। মাঝেমধ্যে একজনের ছবি দেখে অন্যজন হাসি-ঠাট্টা-মশকরা করছে। কেউ আবার অন্যের ওপর শিক্ষকতা চালাচ্ছে। দেখিয়ে দিচ্ছে, ‘ণ’ এভাবে লিখতে হয়। ‘৯’ এদিক থেকে লিখতে হবে।
নবী আলম জানান, ‘এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে জীবনটা শেষ করে দিলাম। ব্যবসার লাখ টাকার মূলধন, ঘরের ধনসম্পদ, দামি কাপড়চোপড়, স্ত্রীর মূল্যবান গয়না এই মাদকের পেছনে খরচ করে এখন পথের ফকির। অনেক চেষ্টার পরও স্ত্রী আমাকে ভালো পথে আনতে না পেরে দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে দেড় বছর আগে বাপের বাড়ি চলে যান।’
নবী আলমের বাড়ি কক্সবাজার পৌরসভার ঘোনারপাড়ায়। শহরের প্রধান পাইকারি মাছের বাজার ফিশারিঘাটে আড়তদাড়ি (মাছের ব্যবসা) করেই চলত তাঁর সুখের সংসার। সাত বছর আগে বন্ধুর পাল্লায় পড়ে নবী গাঁজা সেবন করেন। এরপর চোলাই মদ, হেরোইন। তারপর নেশার বড়ি ‘ইয়াবা’। তিন বছর আগে ইয়াবার দাম বেড়ে গেলে নবী শরীরে সুঁই-সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে মাদক গ্রহণ করতেন। সুঁই-সিরিঞ্জের আঘাতে একসময় তাঁর দুই হাত ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। দুই মাস আগে স্থানীয় কয়েকজন লোক নবী আলমকে রাস্তা থেকে অচেতন অবস্থায় তুলে এই কেন্দ্রে ভর্তি করায়। এখানে বিনামূল্যে নবী আলমের চিকিত্সা চলছে। পাশাপাশি চলে খেলাধুলা, ছবি আঁকাআঁকির কাজ। সচেতন করা হচ্ছে মাদক ও এইডস সম্পর্কে।
চিকিত্সা নিতে আসা যুবক জহির ও কবির জানান, এখানে আমরা সেবার পাশাপাশি অনেক কিছু শিখতে পারছি। যে হাত দিয়ে আমরা মাদক গ্রহণ করতাম, কিংবা সুঁই ফোটাতাম নিজের শরীরে, সেই হাত দিয়ে এখন পরিবেশ রক্ষা, আয়-উপার্জনের পথ তৈরির জন্য বৃক্ষরোপই, শাক-সবজির বাগান তৈরি, মত্স্য চাষ ও শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণের কাজের প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। সুঁই-সিরিঞ্জের বদলে কলম তুলে নিয়ে শিখছি লেখাপড়া। শরীর সুস্থ রাখার জন্য নিয়মিত অনুশীলন করি। খেলি ভলিবল, ফুটবলসহ না খেলাধুলা।
টেকনাফের নিলা গ্রামের জহির উদ্দিন (২৮) বলেন, “দুই মাস ধরে এই কেন্দ্রে সেবা নিচ্ছি। মোটামুটি সুস্থ হয়ে এখন বুঝতে পারছি, জীবনে কী ভুল করেছিলাম। এখন আমরা সবাই শপথ নিয়েছি, সুস্থ হয়ে গ্রামে ফিরে গিয়ে আর খারাপ বন্ধুর সঙ্গে মিশব না। খারাপ কাজে জড়িত হব না। মাদককে সব সময় ‘না’ বলব। যে বন্ধু নেশা করতে বলবে, তাকে এড়িয়ে চলব।”
মধুমিতা নোঙর কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক হুমায়ূন কবীর জানান, বর্তমানে এই কেন্দ্রে টেকনাফ, কক্সবাজার শহর, ঈদগাহ, চকরিয়া, লামা ও০ সাতকানিয়ার গরিব ৬১ জনের বিনামূল্যে সেবা চলছে। এদের বয়স ১৪ থেকে ৩৫ বছর। তিন মাস পর সুস্থ করে এদের পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক দিদারুল আলম রাশেদ জানান, এ পর্যন্ত ৫৫৭ জন মাদকাসক্তকে বিনামূল্যে এই কেন্দ্রে সেবা দিয়ে সুস্থ করা হয়েছে। এরা সবাই এখন সুস্থ জীবন ফিরে পেয়েছে। আরও ৪৭৯ জন মাদকাসক্তকে দীর্ঘমেয়াদি সেবা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ৮৫৫ জনকে এসটিআই, ৩১১ জনের এইচআইভি পরীক্ষা এবং ৮৫ জনকে কর্মমুখী শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জামাল আহমদ চৌধুরী জানান, টেকনাফ সীমান্ত দিয়েই মিয়ানমার থেকে পাচার হয়ে আসা নেশার বড়ি ইয়াবা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু টেকনাফে ইয়াবা পাচারকারী রয়েছে তিন শতাধিক। অবশ্যই এর মধ্য থেকে ৮০ জনের মতো পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় উদ্ধার করা হয়েছে ১০ হাজারের বেশি ইয়াবা বড়ি। পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা গত কয়েক মাসে অভিযান চালিয়ে তিন কোটি টাকা দামের তিন কেজি হেরোইনসহ তিন পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করেছেন। তার পরও মাদক পাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না। ফলে মাদকাসক্তের সংখ্যাও বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে মধুমিতা নোঙর কেন্দ্র বিনামূল্যে মাদকাসক্তদের সুস্থ করার যে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে, নিঃসন্দেহে তা প্রশংসার দাবি রাখে।
সুঁই-সিরিঞ্জের বদলে হাতে কমল তুলে নিয়ে ছবি আঁকছে ওরা।
No comments