সময়চিত্র আসিফ নজরুল বিচার বিভাগ: অসামান্য মানুষের গল্প

মসিউর আমার অফিসে প্রথম আসে বছর দুয়েক আগে। হঠাত্ এক দুপুরে ‘আছ্ছালামোলায়কুম স্যার’ শুনে চোখ তুলে দেখি তাকে। তার উচ্চারণে সামান্য সমস্যা আছে। এমনিতেও খুব সাদামাটা সে। মলিন বেশবাস, সাধারণ চেহারা, সারা মুখে চিকচিক করছে ঘাম। অনেকক্ষণ হেঁটে আসা মানুষের ঘাম।
মসিউর দিনাজপুরের প্রত্যন্ত এক অঞ্চলের দরিদ্র কৃষকের সন্তান। অনেক কষ্টে ভালো রেজাল্ট করে গ্র্যাজুয়েশন করেছে, তবু কোনো চাকরি হয় না তার। এই দুঃখে কিছু একটা করার জেদ নিয়ে চলে এসেছে শহরে। খুব সাধারণ ঘটনা এটি। ঢাকাতে এমন মানুষ প্রতিদিনই আসছে; কিন্তু মসিউর আসলে সবার মতো না। সে সামান্য মানুষও নয়। তার জীবনে আছে অসামান্য গল্প।
ঢাকায় প্রথম কয়েক মাস অর্থাভাবে খুবই করুণ জীবন কাটে তার। মসিউরের ফোন এলে তাই মন খারাপ হয়ে যেত আমার। সেই মসিউর নিজের চেষ্টায় একদিন চাকরি পায় মফস্বলের এক স্কুলে। সেখানে যোগদানের আগে গ্রামের বাড়ি গেলে তার জীবনের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় নেমে আসে। গাছ থেকে পড়ে মেরুদণ্ডের হাড় নড়ে যায় তার। মফস্বলের ডাক্তার জানিয়ে দেয়, ভালো হওয়ার কোনো আশা নেই। মসিউর কান্নায় ভেঙে পড়ে ফোনে, ‘স্যার, আমি তো পঙ্গু হয়ে গেলাম!’
মসিউর পঙ্গু থাকেনি শেষ পর্যন্ত। মাসের পর মাস বিছানায় থেকে একটু সুস্থ হয়ে একদিন উঠে দাঁড়ায় সে। ঢাকায় এসে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করে। মাত্র তিন দিন আগে—আমাকে চমকে দিয়ে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ে সে—ফোনে। স্যার, আমি জজ হয়ে গেছি স্যার! জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের সব পরীক্ষায় পাস করে একজন সম্মানিত বিচারক হয়ে গেছে আমাদের মসিউর! তার কান্না থামে না আনন্দে। সে জানে না তার সঙ্গে সঙ্গে আমারও চোখ ভিজে যায়। সারা দিন টিউশনি করার পর অমানুষিক পরিশ্রম করে এসব পরীক্ষার দিয়েছে সে। কত দিন তাকে বলতাম: পরীক্ষায় টিকতে না পারলে মন খারাপ কোরো না। সারা দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা এখন এই পরীক্ষায় অংশ নেয়। মসিউর কি এসব শুনে মন খারাপ করত তখন!
আমার অভিভূত অবস্থা কাটতে না কাটতেই ফোন আসে শিউলির বাবার। শিউলি আমার সরাসরি ছাত্রী ছিল। প্রাণঘাতী ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার কারণে মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করতে পারেনি সে। তার চিকিত্সার জন্য সহযেগিতা চেয়ে প্রথম আলোয় লিখেছিলাম আমি। সারা দেশ থেকে বহু মানুষ সাহায্য করেছে তার চিকিত্সায়। আমার সঙ্গে কিছুদিন আগে মাত্র পরিচয় হয়েছিল ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের, শিউলির কথা শুনেই তিনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন পঞ্চাশ হাজার টাকা! এমন সহূদয় মানুষদের সহযোগিতায় ও তাই সুস্থ হয়ে ফিরে আসতে পেরেছিল দেশে। শিউলির বাবা আমাকে জানালেন, শিউলিও এবার জজ হয়েছে। মৃত্যুর থাবা থেকে ফিরে এসে আমাদের মেয়েটি তার জীবনের প্রথম বড় যুদ্ধে জিতে গেছে। এই আনন্দ একা চেপে রাখি কীভাবে!
শিউলি আর মসিউরদের এই অসামান্য সাফল্য কিছুটা হলেও জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের কারণে। পিএসসি এবং সরকারি নিয়োগদাতা আরও বহু প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির কলঙ্ক স্পর্শ করেনি এই কমিশনকে। মসিউরের মতো ছেলেরা তাই সেখানে সুস্থ প্রতিযোগিতা করে নিম্ন আদালতে বিচারক হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। শিউলির মতো মেয়ে তাই সেখানেই যোগ্যতার পরীক্ষা দেওয়ার আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছে। এই কমিশনকে আমরা পেয়েছি বিচার বিভাগ পৃথক হয়েছিল বলে। কমিশনের নিয়োগ রাজনীতিমুক্ত হতে পেরেছে বলে।
কমিশনের এই সাফল্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় উচ্চ আদালতে নিয়োগের করুণ অবস্থা; সেখানকার নিয়োগে ক্ষমতাসীন দলগুলোর হস্তক্ষেপের করুণ পরিণতির কথা; এবং উচ্চ আদালতের স্বাধীনতা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের ব্যর্থতার কথা।

২.
২০০৬ সালে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয় মাসদার হোসেন মামলার আলোকে। মামলার রায়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিম্ন আদালতে নিয়োগের জন্য পৃথক কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল। এই কমিশনের সব কার্যক্রম পরিচালিত হয় সুপ্রিম কোর্টের নেতৃত্বে। এর সাচিবিক এবং পরীক্ষা কার্যক্রমের দায়িত্বও পালন করেন সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক বাছাই করা জেলা জজ পর্যায়ের বিচারকেরা। কমিশনের প্রতিষ্ঠা এবং নিম্ন আদালতের বিচারকদের ক্ষমতা, স্বাধীনতা ও বেতন-ভাতা বৃদ্ধির পদক্ষেপের অত্যন্ত ইতিবাচক প্রভাব পড়ে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। নিম্ন আদালতে নিয়োগের প্রতি নজিরবিহীন আগ্রহের সৃষ্টি হয়। এর প্রথম প্রমাণ পাওয়া পায় কমিশন কর্তৃক পরিচালিত নিম্ন আদালতে বিচারক নিয়োগদানের প্রথম পরীক্ষাতেই।
বর্তমান প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে কমিশন এই কাজটি সম্পন্ন করে ২০০৭ সালে। সে বছর যে ৩৯৪ জন নিম্ন আদালতে নিয়োগ পান, তাঁদের সবাই এসএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পাওয়া। এঁদের মধ্যে এসএসসিতে মেধা তালিকায় অবস্থান ছিল ২১ জনের এবং এইচএসসিতে ২৭ জনের। আইন বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন পর্যায়ে (এলএলবি) প্রথম শ্রেণী পাওয়া পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৫৩ এবং মাস্টার্স (এলএলএম) পরীক্ষায় ৪১। তুলনা হিসেবে বলে রাখি, আমি ১৯৯১ সালে যে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিই, সেখানে নিম্ন আদালতে বিচারক হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একজনও এলএলবি বা এলএলএম পর্যায়ে প্রথম শ্রেণীপ্রাপ্ত ছিলেন না।
আরেকটি চমকপ্রদ তুলনা দিই। নিম্ন আদালতের বিচারকদের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি বেতন-ভাতা আর মর্যাদা উপভোগ করেন হাইকোর্ট অর্থাত্ উচ্চ আদালতের বিচারকেরা। ২০০৭ সালের পর হাইকোর্টে যে ১৫ জন (তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ৬, বর্তমান সরকারের আমলে ৯) বিচারক নিয়োগ পেয়েছেন তাঁদের অধিকাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা ২০০৭ সালে নিয়োগ পাওয়া নিম্ন আদালতের বিচারকদের তুলনায় অনুজ্জ্বল। এই ১৫ জনের মধ্যে একাধিক বিচারক শিক্ষাজীবনের কোনো না কোনো স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছেন তৃতীয় বিভাগ পেয়ে। বিএনপির শাসনামলে নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারকদের অন্তত ছয়জনের শিক্ষাজীবনে ছিল একাধিক তৃতীয় বিভাগ পাওয়ার গ্লানি।

৩.
এই ‘কদর্য’ তুলনা এমনি এমনি দিইনি। নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা বিচারক নিয়োগে কী ভূমিকা রাখতে পারে তার একটি বড় প্রমাণ এই তুলনা। নিম্ন আদালতে বিচারক নিয়োগ দেয় স্বাধীন প্রতিষ্ঠান জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন; উচ্চ আদালতে নিয়োগ দেয় সরকার নিজে। একাধিক মামলায় (যেমন: সামসুল হুদা বনাম বাংলাদেশ, ১৫ বিএলটি ৬২; রাষ্ট্র বনাম মানবজমিন, ৫৭ ডিএলআর ৩৫৯) উচ্চ আদালতে নিয়োগদানের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করার প্রথাগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে বলা আছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই পরামর্শ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত তালিকার মধ্যেই। এই তালিকা তৈরিতে দলের প্রতি অনুগতদের প্রধান্য দেওয়া প্রায় রেওয়াজে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশে। একজন প্রধান বিচারপতি তাই আক্ষেপ করে বলেছিলেন: উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে ভুলের কারণে মহাপ্রলয় ঘটে গেছে!
উচ্চ আদালতে নিয়োগে রাজনৈতিক পছন্দের সুযোগ আরও অবারিত হয়েছে সংবিধান পালনে আমাদের সরকারগুলোর অনীহার কারণে। সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে, হাইকোর্টে কমপক্ষে ১০ বছর অ্যাডভোকেট হিসেবে না থাকলে বা নিম্ন আদালতে ১০ বছর বিচারক হিসেবে না থাকলে কেউ হাইকোর্টের বিচারক হতে পারবেন না। হাইকোর্টে নিয়োগের জন্য এই যোগ্যতাই যথেষ্ট হতে পারে না। সংবিধান তাই বিচারক পদে নিয়োগের জন্য অন্যান্য যোগ্যতা নির্ধারণের দায়িত্বও সংসদকে দিয়ে দিয়েছে। গত ৩২ বছরে (১৯৭৭—২০০৯) এই দায়িত্ব কোনো সংসদ পালন করেননি, সংসদে এ নিয়ে এমনকি কোনো আলোচনাও সম্ভবত কখনো হয়নি।
আমাদের সরকারগুলো এই সুযোগ গ্রহণ করেছে অকাতরে। সফল বা এমনকি সক্রিয়ও নয়, এমন আইনজীবীদের হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগ করা হয়েছে ১০ বছরের সনদ দেখে। জেলা জজদের তুলনায় রাজনীতিতে অনেক বেশি সক্রিয় বলে হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে আইনজীবীদের।
আইনজীবীদের মধ্য থেকে ভালো নিয়োগও যে কম হয়েছে, তা নয়। কিন্তু তা করা হয়েছে মন্দ নিয়োগের কলঙ্ককে আড়াল করার জন্য। যোগ্যতাগুণে নিয়োগপ্রাপ্তরা তাতে হতদ্যম হয়েছেন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ভালো আর মেধাবী আইনজীবীদের বেশির ভাগ এখন আর হাইকোর্টের বিচারক হওয়ার আগ্রহই অনুভব করেন না।

৪.
উচ্চ আদালতের এই দুরবস্থা বদলাতে হবে। উচ্চ আদালতে রাজনৈতিকভাবে অনুগত নিম্ন মেধার লোকের নিয়োগের কারণে কী পরিণতি হয় তা সাবেক বিচারপতি ফয়েজীর ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি। উচ্চ আদালতে নিয়োগের জন্য তাই প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে স্বাধীন কমিশন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নামেমাত্র এমন একটি কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বটে। কিন্তু তা না ছিল স্বাধীন, না ছিল ক্ষমতাসম্পন্ন। আইন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতকৃত তালিকা থেকে এই কমিশন প্রতিটি পদে নিয়োগের জন্য দুজন ব্যক্তিকে বাছাই করার ক্ষমতা পেয়েছিল মাত্র।
প্রকৃত অর্থে একটি স্বাধীন ও ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করা হলে, বিচারক নিয়োগের জন্য যোগ্যতা নির্ধারণী আইন প্রণীত হলে এবং বিচারকদের বেতন ভাতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করা হলে নিম্ন আদালতের মতো উচ্চ আদালতেও আমরা মেধাবী ও যোগ্য বিচারকদের আরও অনেক বেশি সংখ্যায় দেখতে পাব।
এসব ব্যবস্থা না করা হলে একদিন নিম্ন আদালতের নিয়োগও প্রশ্নবিদ্ধ হযে যেতে পারে। রাজনৈতিকভাবে অনুগত ও অযোগ্য কোনো উচ্চ আদালতের বিচারককে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের প্রধান বানিয়ে দিয়েই এই সর্বনাশ করা সম্ভব। এ ধরনের ব্যক্তিরা যাতে আর কখনো উচ্চ আদালতে নিয়োগ না পেতে পারেন, সে জন্য এখন থেকে সতর্ক হতে হবে।
মসিউর মতো আরও অনেক অনাগত তরুণের ভবিষ্যত্ আমরা এভাবেই নিশ্চিত করতে পারি।

[পুনশ্চ: নিবন্ধের শুরুতে যার কথা বললাম তার প্রকৃত নাম মসিউর নয়। অনুমতি ছাড়াই তার জীবনের সত্যি ঘটনাগুলো লিখে ফেলেছি বলে নাম সামান্য পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে।]

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.