সংসদীয় কমিটি সাজিয়ে রাখার জিনিস নয় -জবাবদিহি by মলয় ভৌমিক
ইতিবাচক পরিবর্তনের পথে কোনো পদক্ষেপই শেষ পর্যন্ত কার্যকর হচ্ছে না। পদে পদে কেবল পেছনমুখী যাত্রা! সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ডাকে সাড়া না দেওয়াটাও মনে হচ্ছে রেওয়াজে পরিণত হতে যাচ্ছে। তাহলে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার উপায়টা কী? এখন দেখা যাচ্ছে সংসদীয় কমিটিগুলো কেবল ডেকে ডেকে নিরাশ হচ্ছে তা-ই নয়, তারা নানা বাগিবতণ্ডাতেও জড়িয়ে পড়ছে। সর্বশেষ উদাহরণ হলো, দুই বিচারককে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া এবং পরবর্তী সময়ে সেই অবসর দেওয়ার আদেশ প্রত্যাহারকে কেন্দ্র করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের বাকযুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ঘটনা।
সংসদীয় কমিটিগুলোর উত্থাপিত অভিযোগ দেশের সব বাঘা বাঘা লোকের বিরুদ্ধে। লোকগুলো কেবল বাঘাই নন, তাঁরা দেশের দায়িত্বশীল নাগরিকও বটে। তো এসব মানুষকে যখনই সংসদীয় কমিটি তলব করছে, তখনই সংসদীয় কমিটির তলবের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা। আবার তলব করার এখতিয়ার থাকলেও তাঁদের ডাকে সাড়া দিতে কেউ বাধ্য নন—এমন যুক্তিও উত্থাপন করছেন কেউ কেউ। এসব প্রশ্ন বা যুক্তি আইনের দৃষ্টিতে হয়তো গুরুত্বহীন নয়। কিন্তু এমন যুক্তি বা প্রশ্ন তুলে গোঁ ধরে বসে থাকায় আইন রক্ষা হলেও সংসদীয় রীতিনীতি অনুশীলনের যে দরজা এবার খুলে দেওয়া হয়েছে তা তো শুরুতেই বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো।
সংসদের প্রথম অধিবেশনেই সবগুলো সংসদীয় কমিটি গঠনের নজির এর আগে দেখা যায়নি। এটা আওয়ামী লীগ সরকারের কেবল একটা ইতিবাচক পদক্ষেপই নয়; এর মাধ্যমে দলটি আমাদের সংসদ-সংস্কৃতির একটা পরিবর্তনের ইঙ্গিতও দিয়েছিল। কিন্তু পরিবর্তন দূরে থাক, ভবিষ্যতে এই কমিটিগুলো আরও অকার্যকর হয়ে পড়বে—এমন শঙ্কা এখনই তৈরি হয়েছে।
পরিবর্তন প্রত্যাশী বর্তমান সংসদের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি প্রথমেই ধাক্কা খেল দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান লে. জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধূরী এবং অন্য দুই কমিশনারকে তলব করতে গিয়ে। সংসদীয় কমিটির হাত দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত লম্বা কি না— এ প্রশ্ন বেশ জোরেশোরে তোলা হলো। বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্য, নানা আইনি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উঠে এল মিডিয়ায়। আর এই শোরগোলের মধ্যে চাপা পড়ে গেল অতি গুরুতর দুটি বিষয়। এর একটি হলো, রাষ্ট্রের সব বিভাগের ওপর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি তথা জনগণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিষয় এবং অন্যটি হলো, খোদ দুর্নীতি দমন কমিশনের কারো কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ। এখানে দুর্নীতি দমন কমিশনের কারো বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগই কিন্তু মুখ্য, আইনি ফ্যাকড়া গৌণ। কেননা দুর্নীতি দমন কমিশন যদি গ্রহণযোগ্যতা হারায় তাহলে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দুর্নীতি দমন, আইনের শাসন ইত্যাদি কোনোটাই প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। না, এ কথা কেউ বলছেন না যে কমিশন সত্যি সত্যি দুর্নীতি করেছে। কিন্তু সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মতো একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এবং গুরুত্বপূর্ণ কমিটি যখন এ ধরনের অভিযোগ তোলে তখন সাধারণের মধ্যে কমিশন সম্পর্কে প্রশ্নের উদ্রেক করে বইকি। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানসহ কমিশনাররা যা করতে পারতেন তা হলো, সংসদীয় কমিটির কাছে উপস্থিত হয়ে আগে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করে তারপর তাদের তলবের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলা। তাঁরা বলতে পারতেন, ‘ওঁদের এখতিয়ার না থাকা সত্ত্বেও আমরা জনমনে সন্দেহ দূর করার জন্যই ওঁদের ডাকে সাড়া দিয়েছি।’ কিন্তু না, এই সংস্কৃতি আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। আসলে আমাদের প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিরাই এ ব্যাপারে পেছনতাড়িত।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটির হাত দুর্নীতি দমন কমিশন পর্যন্ত লম্বা না হতে পারে, কিন্তু এই হাত নিজের ঘরের সীমানা অর্থাত্ সংসদ-সীমানা পর্যন্ত লম্বা হবে না—এমনটা কি বিশ্বাসযোগ্য? কিন্তু এবার সেটাও বিশ্বাস করতে হলো। সাবেক স্পিকার জমির উদ্দিন সরকার, সাবেক ডেপুটি স্পিকার আখতার হামিদ সিদ্দিকী ও সাবেক চিফ হুইপ খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন তো কেবল ঘরের লোকই নন, সংসদে এক সময়ের অভিভাবকও। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে যখন দুর্নীতির অভিযোগ উঠল তখন তাঁরাও সর্বদলীয় সংসদীয় তদন্ত কমিটির ডাকে সাড়া দিলেন না। বিভিন্ন অজুহাতে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। চাপা পড়ে গেল দুর্নীতি আর জনপ্রতিনিধিদের কাছে জবাবদিহিতার সংসদীয় গণতান্ত্রিক রীতিনীতি। ঘরের লোক যদি ঘরের নিয়ম না মানেন, তাহলে সে নিয়ম মানার দায় বাইরের লোকের ওপর বর্তাবে কীভাবে?
সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ডাকে সাড়া দেওয়া না দেওয়ার বিতর্কটি সব থেকে বেশি ঘোলাটে হয়ে গেল ক্ষমতাসীন দলের মধ্যেই, এ ব্যাপারে তীব্র বাগিবতণ্ডা শুরু হওয়ায়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তলব প্রসঙ্গে প্রশ্ন উত্থাপন করায় সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো গঠনের যৌক্তিকতাই প্রশ্নের মুখে পড়ল। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক করেছেন এবং সংসদীয় কমিটিগুলোর ডাকে সাড়া দেওয়ার ব্যাপারটিকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পরামর্শ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই পদক্ষেপ ইতিবাচক হলেও এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভেতরের মানসিকতা কতটা পরিবর্তিত হবে—তা বলা শক্ত।
এর আগে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের জবাব দেওয়ার জন্য সংসদীয় কমিটির কাছে হাজির হননি। ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র সাদেক হোসেন খোকাও সংসদীয় কমিটির তলবের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। দেখা যাচ্ছে, সংসদীয় কমিটিগুলো যখন যাকে ডাকছেন, তাঁর তরফ থেকেই নানা রকম আপত্তি উঠছে। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো গঠন করে কী লাভ হলো? সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কি সংসদের আলনায় সাজিয়ে রাখার মতো কোনো পোশাকি জিনিস? সংসদীয় কমিটিগুলো যাঁদের তলব করেছে তাঁরা কেউ সরকারি দলের, কেউ বিরোধী দলের, আবার কেউ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের লোক। এবং তাঁরা কোনো সাধারণ লোক নন। তাঁদের কেউ গণতন্ত্র আদায়ের জন্য এবং কেউ গণতন্ত্র দেওয়ার জন্য অতি উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। সমাজের উচ্চকণ্ঠ এই ব্যক্তিবর্গ তাঁদের আচরণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে গণতন্ত্র সম্পর্কে কী শিক্ষা দিলেন? ‘গণতন্ত্র মানে কেবল নির্বাচন’— সাধারণের মধ্যে বদ্ধমূল এই ধারণাকে তাঁরা আরও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেন না কি? নির্বাচন গণতন্ত্রের অতি ক্ষুদ্র একটি অনুষঙ্গ মাত্র। গণতন্ত্রের অর্থ রাষ্ট্রের সব স্তরে জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মূলত গণতান্ত্রিক আচরণ তথা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অনুশীলন করা। অথচ গভীর এই সত্যের পথে মানুষকে পরিচালিত করার দায়িত্ব যাঁদের তাঁরাই আজ অগণতান্ত্রিক ও অসহিষ্ণু আচরণের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে দুর্বল করার প্রক্রিয়ায় শামিল হচ্ছেন।
এ কথা ঠিক যে সংসদীয় কমিটিগুলোও কাউকে তলবের ব্যাপারে অসতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করে ফেলতে পারে, হয়ে যেতে পারে কোনো ক্ষেত্রে বাড়াবাড়িও। এ ছাড়া কমিটিগুলোর নির্বাহী ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া, এমন কি কমিটির তলবে সাড়া দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নিয়ে আইনি প্রশ্ন তোলাও হয়তো অযৌক্তিক কিছু নয়। কিন্তু তাই বলে কমিটি তলব করলেই ঢালাওভাবে কেবল ‘না’ জবাব আসবে—এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সংশ্লিষ্ট সবাইকে মনে রাখতে হবে সব ক্ষমতার উত্স জনগণ, সুতরাং জনগণের ভোটে নির্বাচিত সাংসদদের কাছে জবাবদিহি করায় অমর্যাদা বা অগৌরবের কিছু নেই; বরং ‘জবাবদিহি না’ করার মধ্যেই অগৌরব নিহিত আছে।
দেশে প্রতিনিয়ত হাজারো দুর্নীতি-অনিয়মের ঘটনা ঘটছে। অথচ আদালতে এসব ঘটনার ছিটেফোঁটাও নিষ্পত্তি হচ্ছে না। আইনি এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপারে সাধারণ মানুষ আজ হতাশ। এই হতাশার মধ্যেও দুর্নীতি দমন ব্যুরো ভেঙে তাকে অধিকতর ক্ষমতা দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করায় মানুষ অনেকটাই উত্সাহিত হয়েছিল। কিন্তু কমিশনের কর্মকাণ্ড নিয়ে শুরুতেই বিতর্ক দেখা দেওয়ায় মানুষের সে উত্সাহ এখন ফিকে হয়ে আসছে। এ অবস্থায় সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো মন্দের ভালো হিসেবেও মানুষের মনে আশা জাগাতে পারে। কেউই কামনা করে না, দেশের দায়িত্বশীল নাগরিকদের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে এই কমিটিগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ুক। তাই গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া এবং জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে তোলার স্বার্থেই সংসদীয় কমিটিগুলোকে আরও কার্যকর করা প্রয়োজন। তবে কমিটিগুলো কার্যকর করা যাবে তখনই যখন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এ ব্যাপারে অগণতান্ত্রিক আচরণ পরিহার করে দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন।
মলয় ভৌমিক: শিক্ষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার।
সংসদের প্রথম অধিবেশনেই সবগুলো সংসদীয় কমিটি গঠনের নজির এর আগে দেখা যায়নি। এটা আওয়ামী লীগ সরকারের কেবল একটা ইতিবাচক পদক্ষেপই নয়; এর মাধ্যমে দলটি আমাদের সংসদ-সংস্কৃতির একটা পরিবর্তনের ইঙ্গিতও দিয়েছিল। কিন্তু পরিবর্তন দূরে থাক, ভবিষ্যতে এই কমিটিগুলো আরও অকার্যকর হয়ে পড়বে—এমন শঙ্কা এখনই তৈরি হয়েছে।
পরিবর্তন প্রত্যাশী বর্তমান সংসদের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি প্রথমেই ধাক্কা খেল দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান লে. জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধূরী এবং অন্য দুই কমিশনারকে তলব করতে গিয়ে। সংসদীয় কমিটির হাত দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত লম্বা কি না— এ প্রশ্ন বেশ জোরেশোরে তোলা হলো। বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্য, নানা আইনি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উঠে এল মিডিয়ায়। আর এই শোরগোলের মধ্যে চাপা পড়ে গেল অতি গুরুতর দুটি বিষয়। এর একটি হলো, রাষ্ট্রের সব বিভাগের ওপর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি তথা জনগণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিষয় এবং অন্যটি হলো, খোদ দুর্নীতি দমন কমিশনের কারো কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ। এখানে দুর্নীতি দমন কমিশনের কারো বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগই কিন্তু মুখ্য, আইনি ফ্যাকড়া গৌণ। কেননা দুর্নীতি দমন কমিশন যদি গ্রহণযোগ্যতা হারায় তাহলে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দুর্নীতি দমন, আইনের শাসন ইত্যাদি কোনোটাই প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। না, এ কথা কেউ বলছেন না যে কমিশন সত্যি সত্যি দুর্নীতি করেছে। কিন্তু সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মতো একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এবং গুরুত্বপূর্ণ কমিটি যখন এ ধরনের অভিযোগ তোলে তখন সাধারণের মধ্যে কমিশন সম্পর্কে প্রশ্নের উদ্রেক করে বইকি। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানসহ কমিশনাররা যা করতে পারতেন তা হলো, সংসদীয় কমিটির কাছে উপস্থিত হয়ে আগে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করে তারপর তাদের তলবের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলা। তাঁরা বলতে পারতেন, ‘ওঁদের এখতিয়ার না থাকা সত্ত্বেও আমরা জনমনে সন্দেহ দূর করার জন্যই ওঁদের ডাকে সাড়া দিয়েছি।’ কিন্তু না, এই সংস্কৃতি আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। আসলে আমাদের প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিরাই এ ব্যাপারে পেছনতাড়িত।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটির হাত দুর্নীতি দমন কমিশন পর্যন্ত লম্বা না হতে পারে, কিন্তু এই হাত নিজের ঘরের সীমানা অর্থাত্ সংসদ-সীমানা পর্যন্ত লম্বা হবে না—এমনটা কি বিশ্বাসযোগ্য? কিন্তু এবার সেটাও বিশ্বাস করতে হলো। সাবেক স্পিকার জমির উদ্দিন সরকার, সাবেক ডেপুটি স্পিকার আখতার হামিদ সিদ্দিকী ও সাবেক চিফ হুইপ খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন তো কেবল ঘরের লোকই নন, সংসদে এক সময়ের অভিভাবকও। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে যখন দুর্নীতির অভিযোগ উঠল তখন তাঁরাও সর্বদলীয় সংসদীয় তদন্ত কমিটির ডাকে সাড়া দিলেন না। বিভিন্ন অজুহাতে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। চাপা পড়ে গেল দুর্নীতি আর জনপ্রতিনিধিদের কাছে জবাবদিহিতার সংসদীয় গণতান্ত্রিক রীতিনীতি। ঘরের লোক যদি ঘরের নিয়ম না মানেন, তাহলে সে নিয়ম মানার দায় বাইরের লোকের ওপর বর্তাবে কীভাবে?
সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ডাকে সাড়া দেওয়া না দেওয়ার বিতর্কটি সব থেকে বেশি ঘোলাটে হয়ে গেল ক্ষমতাসীন দলের মধ্যেই, এ ব্যাপারে তীব্র বাগিবতণ্ডা শুরু হওয়ায়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তলব প্রসঙ্গে প্রশ্ন উত্থাপন করায় সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো গঠনের যৌক্তিকতাই প্রশ্নের মুখে পড়ল। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক করেছেন এবং সংসদীয় কমিটিগুলোর ডাকে সাড়া দেওয়ার ব্যাপারটিকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পরামর্শ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই পদক্ষেপ ইতিবাচক হলেও এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভেতরের মানসিকতা কতটা পরিবর্তিত হবে—তা বলা শক্ত।
এর আগে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের জবাব দেওয়ার জন্য সংসদীয় কমিটির কাছে হাজির হননি। ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র সাদেক হোসেন খোকাও সংসদীয় কমিটির তলবের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। দেখা যাচ্ছে, সংসদীয় কমিটিগুলো যখন যাকে ডাকছেন, তাঁর তরফ থেকেই নানা রকম আপত্তি উঠছে। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো গঠন করে কী লাভ হলো? সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কি সংসদের আলনায় সাজিয়ে রাখার মতো কোনো পোশাকি জিনিস? সংসদীয় কমিটিগুলো যাঁদের তলব করেছে তাঁরা কেউ সরকারি দলের, কেউ বিরোধী দলের, আবার কেউ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের লোক। এবং তাঁরা কোনো সাধারণ লোক নন। তাঁদের কেউ গণতন্ত্র আদায়ের জন্য এবং কেউ গণতন্ত্র দেওয়ার জন্য অতি উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। সমাজের উচ্চকণ্ঠ এই ব্যক্তিবর্গ তাঁদের আচরণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে গণতন্ত্র সম্পর্কে কী শিক্ষা দিলেন? ‘গণতন্ত্র মানে কেবল নির্বাচন’— সাধারণের মধ্যে বদ্ধমূল এই ধারণাকে তাঁরা আরও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেন না কি? নির্বাচন গণতন্ত্রের অতি ক্ষুদ্র একটি অনুষঙ্গ মাত্র। গণতন্ত্রের অর্থ রাষ্ট্রের সব স্তরে জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মূলত গণতান্ত্রিক আচরণ তথা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অনুশীলন করা। অথচ গভীর এই সত্যের পথে মানুষকে পরিচালিত করার দায়িত্ব যাঁদের তাঁরাই আজ অগণতান্ত্রিক ও অসহিষ্ণু আচরণের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে দুর্বল করার প্রক্রিয়ায় শামিল হচ্ছেন।
এ কথা ঠিক যে সংসদীয় কমিটিগুলোও কাউকে তলবের ব্যাপারে অসতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করে ফেলতে পারে, হয়ে যেতে পারে কোনো ক্ষেত্রে বাড়াবাড়িও। এ ছাড়া কমিটিগুলোর নির্বাহী ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া, এমন কি কমিটির তলবে সাড়া দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নিয়ে আইনি প্রশ্ন তোলাও হয়তো অযৌক্তিক কিছু নয়। কিন্তু তাই বলে কমিটি তলব করলেই ঢালাওভাবে কেবল ‘না’ জবাব আসবে—এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সংশ্লিষ্ট সবাইকে মনে রাখতে হবে সব ক্ষমতার উত্স জনগণ, সুতরাং জনগণের ভোটে নির্বাচিত সাংসদদের কাছে জবাবদিহি করায় অমর্যাদা বা অগৌরবের কিছু নেই; বরং ‘জবাবদিহি না’ করার মধ্যেই অগৌরব নিহিত আছে।
দেশে প্রতিনিয়ত হাজারো দুর্নীতি-অনিয়মের ঘটনা ঘটছে। অথচ আদালতে এসব ঘটনার ছিটেফোঁটাও নিষ্পত্তি হচ্ছে না। আইনি এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপারে সাধারণ মানুষ আজ হতাশ। এই হতাশার মধ্যেও দুর্নীতি দমন ব্যুরো ভেঙে তাকে অধিকতর ক্ষমতা দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করায় মানুষ অনেকটাই উত্সাহিত হয়েছিল। কিন্তু কমিশনের কর্মকাণ্ড নিয়ে শুরুতেই বিতর্ক দেখা দেওয়ায় মানুষের সে উত্সাহ এখন ফিকে হয়ে আসছে। এ অবস্থায় সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো মন্দের ভালো হিসেবেও মানুষের মনে আশা জাগাতে পারে। কেউই কামনা করে না, দেশের দায়িত্বশীল নাগরিকদের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে এই কমিটিগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ুক। তাই গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া এবং জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে তোলার স্বার্থেই সংসদীয় কমিটিগুলোকে আরও কার্যকর করা প্রয়োজন। তবে কমিটিগুলো কার্যকর করা যাবে তখনই যখন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এ ব্যাপারে অগণতান্ত্রিক আচরণ পরিহার করে দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন।
মলয় ভৌমিক: শিক্ষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার।
No comments