আমরাই পারি পৃথিবী বদলে দিতে -নেলসন ম্যান্ডেলা বক্তৃতা by মুহাম্মদ ইউনূস
পৃথিবীর সবচেয়ে দারুণ মানুষটির সামনে দাঁড়াতে পেরে আজ আমি রোমাঞ্চিত। আজ এত একান্তভাবে তাঁকে শুভ জন্মদিন বলতে পেরে আমি গর্বিত। আপনি আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন; আপনি জানেন না আমরা কে, আমরা কোথায় বেড়ে উঠেছি, কিন্তু আপনি ছুঁয়ে গেছেন আমাদের জীবন।
আমরা, তরুণেরা দেখেছি আপনি শিরদাঁড়া খাড়া করে দাঁড়িয়েছেন, আমাদেরও শিখিয়েছেন মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়াতে। আপনি সংস্কারহীন হয়েছেন, আমাদেরও তা করতে প্রাণিত করেছেন। আপনি আমাদের মানুষকে ভালোবাসার প্রেরণা যুগিয়েছেন, প্রেরণা দিয়েছেন শান্তিকে আলিঙ্গন করতে ও সাহসী হতে। আপনি আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন উদ্ধত হতে। অনুপ্রাণিত করেছেন শত্রুর মোকাবিলা করতে, তারপর তাদের দিকে নিঃশর্ত বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে, তাদের ভালোবেসে শান্তিময় জীবন কাটাতে। আপনি আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন আপসহীন হতে, সেই সঙ্গে অপেক্ষা করতে বলেছেন সন্ধির মুহূর্তের, পরস্পরকে জড়িয়ে ধরার অপূর্বমুহূর্তের। আপনি মানবিকতার সর্বোত্তম প্রকাশ। আপনি অনুপ্রাণিত করেছেন সমগ্র পৃথিবীকে।
আজ আপনার ৯১তম জন্মদিনে আপনার সঙ্গে এক মঞ্চে থাকাটা আমার জন্য দারুণ এক অভিজ্ঞতা। একই পৃথিবীর অংশীদার আমরা। আমি ধন্য। সারা জীবন এই মুহূর্তটি আমাকে আলোড়িত করবে।
আপনি মানুষকে মুক্তি দিয়েছেন তার ক্ষুদ্রতা থেকে। জাতি-ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে মানুষকে করেছেন সম্মানিত, দিয়েছেন আত্মমর্যাদা। মানুষের উদ্যমের প্রতীক আপনি। আপনি চিরদিনের জন্য মানুষের নৈতিক শক্তির এক অনন্য উচ্চতা স্থাপন করেছেন, দেখিয়েছেন কতটা নৈতিক উচ্চতায় উঠতে পারে মানুষ। চিরকাল আপনি থাকবেন অনুপ্রেরণার উত্স হয়ে। নিজস্ব সংগ্রামের ভেতর দিয়ে গিয়েছেন আপনি; পৃথিবী দেখেছে আপনার সংগ্রাম, দূর থেকে দেখেছি আমরাও। আমাদেরও ছিল নিজস্ব লড়াই—ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধ, ছিল নিজেদের নায়ক; তবুও আপনিও ছিলেন প্রেরণা হয়ে।
স্বাধীনতার লগ্নে বাংলাদেশ ব্যাপক দারিদ্র্যে নিপতিত ছিল। বিধ্বস্ত ছিল যুদ্ধ ও রক্তপাতে। দারিদ্র্যই ছাপিয়ে উঠেছিল সব কিছু—তার পরই এলো চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ।
অর্থনীতির তরুণ শিক্ষক হিসেবে আমি ছাত্রদের বোঝাচ্ছিলাম অর্থনীতি কত চমত্কার বিষয়, কী দারুণ এর তত্ত্বগুলো। আর শ্রেণীকক্ষের বাইরে দুর্ভিক্ষ প্রচণ্ড হয়ে উঠছে। তখনই এল হতাশা, ‘কী হবে এসব তত্ত্ব দিয়ে, যদি তা মানুষের কাজেই না লাগে?’
তখন প্রয়োজন ছিল একটি সাহসী পদক্ষেপের, পাঠ্যবইয়ের বাইরে এসে মানবীয় উদ্যম ও স্বাভাবিক যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে দেখা যে, পাঠ্যবইয়ের সাহায্য ছাড়াই কিছু করা যায় কি না?
ঋণদাতাদের থাবা থেকে আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের মুক্ত করার চেষ্টা করছিলাম—এটাই ছিল আমাদের শুরুর ইতিহাস।
গ্রামের কয়েকজন মানুষ মিলে ২৭ মার্কিন ডলার ঋণ নেয়। কারও পরামর্শ ছাড়াই আমি তাদের এই ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই, যাতে তারা মহাজনদের ঋণ শোধ করে তাদের থাবা থেকে মুক্ত হতে পারে। মানুষের উদ্দীপনা আমাকে দারুণ আকৃষ্ট করল। মনে হলো যদি মাত্র ২৭ ডলারেই মানুষকে এত সুখী করা যায়, তাহলে আরও এগোই না কেন?
এ ধারণা নিয়ে আমার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ব্যাংকটির কাছে গেলাম। মহাজনদের বদলে ব্যাংক কি এই ঋণ দিতে পারে না? কিন্তু তারা এটাকে আমলে নিল না। তারা বলল, এটা হয় না, এটা অসম্ভব।
মাদিবা, আপনি শিখিয়েছেন কিছুই অসম্ভব নয়। তাই আমরা যাত্রা শুরু করলাম এবং অসম্ভবকে সম্ভব করলাম।
আমি হলাম জামানতদার, ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠল গ্রামীণ ব্যাংক, যা কখনোই ধসে পড়েনি। এখন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে শুরু করে সারা পৃথিবীতে আমাদের শাখা আছে। যারা বলেছিল আমাদের মডেল ধসে পড়বে, তারাই ধসে পড়েছে।
ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা পুরুষের চেয়ে নারীদের বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। কারণ, আমরা দেখেছি সংসারে নারীদের মাধ্যমে টাকা এলে সেটা বেশি কার্যকর হয়। আমরা যত বেশি ঋণ দিতে থাকলাম তত বেশি রোষের সম্মুখীন হলাম, বিরোধের মুখোমুখি হলাম। শুরুতে আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল পুরুষ, শিগগিরই তারা পরিণত হলো ধর্মীয় প্রতিপক্ষে।
লোকজন বলত, আমরা তাদের সংস্কৃতি ধ্বংস করছি। নারীদের থাকা উচিত ঘরের ভেতর, সংসার চালানো তাদের কাজ নয়। তারা বলত, ‘মেয়েদের হাতে টাকা দিয়ে তোমরা আমাদের সংস্কৃতি নষ্ট করছ, তাদের হাতে টাকা থাকা উচিত নয়।’
আমি বলতাম, ‘তোমরা তোমাদের সংস্কৃতি নিয়ে থাক, আমি বিকল্প সংস্কৃতি তৈরি করছি।’
তখন আমার খুব মনে হতো, যেকোনো সংস্কৃতিই অর্থহীন, যদি তা প্রতিনিয়ত কোনো প্রতিসংস্কৃতির মুখোমুখি না হয়। মানুষ সংস্কৃতি তৈরি করে, সংস্কৃতি মানুষ তৈরি করে। এটি দ্বিমুখী চলাচল। যখন মানুষ সংস্কৃতির পেছনে লুকায়, তখন তা মৃত সংস্কৃতি।
এখন প্রায় আশি লক্ষ মানুষ গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা, এদের ৯৭ শতাংশই নারী। তারা তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠায়। আমরা কেবল আশা করেছিলাম, তারা অন্তত প্রাথমিক শিক্ষাটা শেষ করবে। কিন্তু অসম্ভবও সম্ভব হয়ে উঠল। তারা শুধু প্রাথমিক শিক্ষাই শেষ করল না, উচ্চবিদ্যালয়েও গেল। গ্রামীণ ব্যাংক তাদের সাহস জোগাল, বৃত্তির ব্যবস্থা করল যাতে তারা স্নাতক হতে পারে।
যাতে তাদের এখানেই থামতে না হয় তার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক শিক্ষাঋণের ব্যবস্থা করল। গ্রামীণ ব্যাংকের শিক্ষাঋণ নিয়ে ৩৮ হাজার ছাত্র এখন বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিত্সা, প্রকৌশলবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে পড়াশোনা করছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পিএইচডিও অর্জন করেছে।
এদের মধ্যে কেউ কেউ আমার কাছে চাকরি চান। কারণ, বাংলাদেশে চাকরি পাওয়া কঠিন। আমি তাদের বলি, তোমরা হলে গ্রামীণ ব্যাংকের সন্তান, তোমাদের অন্যদের মতো করে ভাবা উচিত নয়। আমি তাদের একটি শপথ করতে বলি এবং প্রতিদিন সকালে সেই শপথ আওড়াতে বলি, ‘আমি জীবনে কখনো চাকরি খুঁজব না, আমার জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে অন্যের জন্য চাকরি সৃষ্টি করা। আমি চাকরি সন্ধানী নই, চাকরিদাতা।’
আমি বলি, তোমরা বিশেষ কেউ। কারণ, তোমাদের মায়েরা একটি ব্যাংকের মালিক, সেটা হচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংক। টাকা তোমাদের জন্য সমস্যা নয়। আমি তাদের বলি, ‘তোমাদের মায়েদের ব্যাংক তোমাদের জন্য প্রচুর টাকা গচ্ছিত রেখেছে, পড়াশোনার সময় তোমরা শুধু পরিকল্পনা করবে—কী করে এ টাকার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারবে, যাতে অন্যদের জন্য তোমরা চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে পার।’
সহকর্মীদের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে নারীরাই আমাদের পরিচালনা পর্ষদে বসেন, সিদ্ধান্ত নেন। নিজেদের সম্পদ থেকেই অর্থায়ন হয়। আমরা ভেবে দেখেছি, অর্থায়নের জন্য দাতাদের ওপর নির্ভর করতে হলে আমরা স্থবির হয়ে পড়ব। তাই আমরা মানুষের কাছ থেকে টাকা জমা নিলাম, সেখান থেকেই গরিব মহিলাদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করলাম।
এখন আমাদের রয়েছে সম্পূর্ণ নতুন ও তরুণ একটি প্রজন্ম, যারা বেড়ে উঠেছে গ্রামীণ পরিবারে।
একদিন আমি এক গ্রামে গিয়ে এক মহিলাকে পেলাম, যিনি ১৫ বছর ধরে গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর সঙ্গে চটপটে একটি মেয়ে। মেয়েটির সঙ্গে তিনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাঁরই মেয়ে। সে এখন ডাক্তার। ব্যাপারটি আমাকে নাড়া দিল। মহিলাটি তাঁর মেয়েকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মেডিকেল কলেজে পড়তে পাঠিয়েছিলেন, পাশ করে মেয়েটি কাছের শহরে রোগী দেখে। মা-মেয়ে দুজনকে একসঙ্গে দেখে আমার শুধু একটি কথাই মনে এল—মেয়েটির মা-ও একজন চিকিত্সক হতে পারতেন। তাঁর কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু কেউ তাঁকে সে সুযোগটি দেয়নি। তিনি কখনো স্কুলে যাননি। তিনি শুধু একটি সুযোগই পেয়েছেন—গ্রামীণ ব্যাংকে যোগদানের সুযোগ। তারপর তিনি মেয়েটিকে স্কুলে পাঠিয়েছেন, শিক্ষাঋণ নিয়ে ডাক্তারি পড়িয়েছেন। এটাই ছিল দুজনের মধ্যে তফাত্। কিন্তু এটাই জীবনে কত বিশাল ফারাক তৈরি করেছে।
তাদের দিকে তাকালে সহজেই বোঝা যায়, দারিদ্র্য ব্যক্তিগত নয়। সমস্যা গরিবদের নয়—তারা অন্য যে কারও মতো যেকোনো কিছু করতে সক্ষম। কিন্তু সমাজ তাদের কখনো সে সুযোগটি দেয়নি। সমাজব্যবস্থাই দারিদ্র্য সৃষ্টি করে। ব্যাংক গরিবদের ঋণ দিতে চায় না। তারা মনে করে গরিবদের ঋণ দিলে তা কখনো উশুল হবে না। কিন্তু আজ সারা বিশ্বে গ্রামীণ ব্যাংক ও অন্যান্য ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রকল্প প্রমাণ করেছে, গরিবরাও ঋণের টাকা ফেরত দেয়।
‘অন্যান্য ব্যাংক কেন এটা করে না?’—এ বিষয়ে তাদের কোনো সদুত্তর নেই। দারিদ্র্যের শিকড় এখানেই প্রোথিত। কিছু প্রতিষ্ঠান মনে করে, গরিবরা চিরদিন গরিবই থাকবে, আর একদল উন্নতি করবে। আমরা যদি এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঠিক করতে পারি, তবেই মানুষ তাদের সৃজনশীলতা দেখাতে পারবে, সন্তানেরা হবে তাদের পিতাদের চেয়ে বেশি সক্ষম।
সমস্যা আছে নীতিনির্ধারণেও। সরকার ও দাতারা গরিবদের যা দেয়, দান হিসেবে দেয়। কিন্তু এটা কোনো সমাধান নয়। দান দারিদ্র্যকে জমাট করে তোলে, মানুষকে আটকে ফেলে। মানুষের ভেতর থেকে দায়িত্ববোধ মুছে দেয়, উদ্যোগকে নিরুত্সাহিত করে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে গরিব মানুষের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা, তাদের সহযোগিতা করা, যাতে তারা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করাই হচ্ছে মানুষের জীবন। এটা মানুষকে চ্যালেঞ্জ নিতে উদ্বুদ্ধ করে।
প্রতিষ্ঠিত কিছু ধারণাও এর পেছনে দায়ী। যেমন ধরুন ব্যবসার যে ধারণা। ব্যবসার উদ্দেশ্য দাঁড়িয়েছে টাকা তৈরি করা, সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা। অস্বীকার করা যাবে না যে, যারা এ ধরনের ব্যবসায়িক কাঠামো তৈরি করেছে, তারা মানুষকে শুধু টাকা তৈরির একমাত্রিক হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করেছে। কিন্তু মানুষমাত্রই বহুমাত্রিক, তাদের অনেক কিছু প্রয়োজন। তাহলে অর্থনৈতিক তত্ত্বেই বা কেন তাদের অন্য দিকগুলোকে অগ্রাহ্য করে তাদের একমাত্রিক বলে বিবেচনা করা হবে। এখানেই ছিল ভুল।
আমাদের ভেতরে স্বার্থপরতা আছে। এর ওপরই টাকা তৈরির ব্যবসাগুলো দাঁড়িয়ে আছে। এর দ্বারা চালিত হই বলেই আমরা সবকিছু নিজেদের জন্য চাই। আমি অন্য একধরনের ব্যবসার কথা প্রস্তাব করছি, যার ভিত্তি হবে ‘নিঃস্বার্থপরতা’, আমাদের সবার ভেতরেই যা আছে। এর নাম দিতে চাই সামাজিক ব্যবসা। আমি জানি, কিছু লোক এতে বিনিয়োগে আগ্রহী। কেউ ভাবতে পারে, আমি নির্বোধের মতো কথা বলছি। কিন্তু অনেক মানুষ এখানে হাজার হাজার ডলার বিনিয়োগ করছে। কেউ তাদের নির্বোধ ভাবে না। তাহলে আমাকে কেন এ রকম ভাবা হবে?
আমার মনে হয়, সামাজিক ব্যবসা খুবই যুক্তিযুক্ত। আমরা যদি এটা করতে পারতাম, তবে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। দারিদ্র্য বিমোচনে, পুষ্টি উন্নয়নে, খাবার পানির ব্যবস্থা করতে এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে আমরা সামাজিক ব্যবসা শুরু করতে পারি।
বাংলাদেশে আমরা কিছু কাজ করেছি। যখনই আমি কোথাও কোনো সমস্যা দেখি, সেখানে একটি প্রতিষ্ঠান খুলি। সারা জীবন আমি তা-ই করেছি। গরিবদের ঋণ পাওয়ার সমস্যা দূর করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছি গ্রামীণ ব্যাংক। আমার জন্য নয়, মানুষের জন্য। আমি এর মালিক নই, মালিক হচ্ছে ঋণগ্রহীতারা। এটা তাদের প্রচুর সাহায্য করে।
শিশুদের পুষ্টিহীনতা দূর করার জন্য আমরা বাংলাদেশে গ্রামীণ ডানোন নামে একটি সামাজিক ব্যবসা শুরু করেছি। এখান থেকে আমরা কোনো লভ্যাংশ নিই না। অপুষ্ট শিশুদের জন্য পুষ্টির ব্যবস্থা করতে এটা করা হয়েছে। আয়রন, ভিটামিন, জিঙ্ক, আয়োডিন পুষ্টির সব উপাদান এতে [এ দই-এ] আছে। এটি সুস্বাদুও। শিশুরা এটি পছন্দ করে, আমি করি, আপনারাও পছন্দ করবেন। কোনো শিশু যদি টানা আট-নয় মাস প্রতি সপ্তাহে দুই কাপ করে এই দই খায়, তাহলে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার মতো সব প্রয়োজনীয় পুষ্টি সে পাবে।
মাননীয় শ্রোতাগণ, আমরাও কেন এটা করি না। এখানে উপস্থিত যে কেউ এটা করতে পারেন। যে কেউ একটি সামাজিক ব্যবসা শুরু করে বেকারদের জন্য কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেন। উপস্থিত শ্রোতামণ্ডলীর কেউ একজন যদি একটি সামাজিক ব্যবসা শুরু করেন, তবে পাঁচজন লোকের চাকরির ব্যবস্থা হবে। এভাবেই বেকারত্ব কমবে।
আমি আপনি মিলে যদি এ রকম একটি করে সামাজিক ব্যবসা খুলি, তবে অনেকের চাকরির সুযোগ তৈরি হবে। আমরা যদি নিজেরাই আমাদের সমস্যার সমাধান করতে পারি, তবে আমাদের সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না। যদি পাঁচজন লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়, তাহলে একটি বীজ তৈরি হয়। যেখানেই প্রয়োজন সেখানেই আমরা এই বীজ রোপণ করব, যতক্ষণ না বেকার সমস্যার সমাধান হয়, এই বীজ ছড়িয়ে যাব।
সামাজিক ব্যবসায় আমি টাকা বানাতে চাই না, আমি শুধু মানুষের স্বাস্থ্যসুবিধা ও শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে চাই। এটা মানসিকতার পরিবর্তন ঘটায়। আমরা যদি এই বদলে যাওয়া মানসিকতা ছড়িয়ে দিতে পারি, তবে দারুণ একটি সমাজ পাব। প্রত্যেক কোম্পানিই একটি করে সামাজিক ব্যবসা খুলতে পারে। অনেক জায়গায় কোম্পানি তাদের কার্যক্রম চালাতে চায় না। কারণ, সেখানে ব্যবসা চালানো অতটা লাভজনক নয়। যদি সেই কোম্পানি সেখানে একটি সামাজিক ব্যবসা চালু করে, তবে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে এবং সেখানকার লোকজন এমন অনেক সেবা পাবে, যেগুলো আগে সেখানে ছিল না। এটা টাকা বানানোর জন্য হবে না, হবে সামাজিক ব্যবসার জন্য। আমরা যদি প্রতিষ্ঠান ও প্রচলিত ধারণাগুলোকে বদলাতে পারি, তবে একটা বদলে যাওয়া পৃথিবী পাব।
বর্তমান অর্থনৈতিক দুর্দশা এটাই প্রমাণ করে যে প্রচলিত কাঠামো ভালোভাবে কাজ করছে না। পরিবর্তনের জন্য আদর্শ সময় এটাই, এটাই জেগে ওঠার সময় এবং কোন বিষয়গুলোতে পরিবর্তন জরুরি, সেটা উপলব্ধি করার সময়। আমরা গুরুতর কিছু সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি—অর্থনৈতিক সমস্যা, খাদ্য সমস্যা, জ্বালানি সমস্যা, পরিবেশসংক্রান্ত সমস্যা, সামাজিক সমস্যা ইত্যাদি। এটাই কি জেগে ওঠার সেরা সময় নয়?
আমরা জানি কোন বিষয়গুলো বদলাতে হবে। এই নভেম্বরে আমরা বার্লিন দেয়াল পতনের ২০ বছর পালন করব। সেই দেয়াল কোনো উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মারণাস্ত্র বা অপ্রতিরোধ্য কোনো সেনাবাহিনী দ্বারা ধ্বংস হয়নি। সেই দেয়াল চূর্ণ করেছে কিছু একতাবদ্ধ মানুষ, যাদের অনেকের কোলে ছিল তাদের সন্তানেরা। এটাকেই আমরা মানুষের শক্তি বলে থাকি।
যদি কিছু মানুষ এ রকম পরাক্রমশালী একটি দেয়াল ধূলিস্মাত্ করে দিতে পারে, তবে দারিদ্র্য কেন পৃথিবী থেকে দূর করা যাবে না? দারিদ্র্যের দেয়ালও ভেঙে দিতে পারে মানুষের মিলিত শক্তি। এটা খুবই সম্ভব।
এ বছর মানুষের চাঁদে যাওয়ার ৪০তম বার্ষিকী। মানুষ কখনো ভাবেনি এরকমটি হবে। তারা এটাকে এক ধরনের পাগলামো মনে করত। কিন্তু ৪০ বছর আগে সব মানুষের চোখের সামনে এটা ঘটেছে। আমরা যদি চাঁদে যেতে পারি, তবে আমাদের দরিদ্র প্রতিবেশীর কাছে কেন যেতে পারব না তার দারিদ্র্য নিরসনের জন্য? এটাই যুগে যুগে মানুষ করেছে।
সব সময় মানুষ তা করত। কারণ, তারা এটা করার প্রয়োজনীয়তাটুকু বুঝতে পারত। কারণ, এটাকে অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হতো। আপনি যদি মনে করেন, দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী গড়া অসম্ভব, তাহলে সে চেষ্টাই করা উচিত। কারণ, করার জন্য উপযুক্ত কাজ এটাই।
মাদিবার ৯১তম জন্মদিনে এখানে আমরা একত্র হয়েছি, যিনি ইতি টেনেছেন বর্ণবৈষম্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার—সবাই মনে করত, এটা কখনোই হতে পারে না। তিনি এটাকে সম্ভব করে তুলে অসম্ভবকে সাধন করেছেন। আমরা সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্তি পেয়েছি, মুক্তি পেয়েছি দাসত্ব ও বর্ণবৈষম্য থেকেও, যেগুলোর প্রত্যেকটিই অসম্ভব মনে হতো। আসুন, আমরা আরেকটি অসম্ভবের দিকে হাত বাড়াই, উত্সাহ-আনন্দ নিয়ে কাজটি শেষ করি, দারিদ্র্যমুক্ত একটি পৃথিবী গড়ে তুলি। চলুন, আমরা আমাদের মনের মতো একটি পৃথিবী গড়ে তুলি।
মানুষের যাত্রা শুরু হয়েছিল এই আফ্রিকাতেই। আসুন, আফ্রিকা থেকে আমরা দক্ষিণ আফ্রিকাকেই প্রথম দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তুলি, যেখানে কোনো দরিদ্র লোক থাকবে না। আসুন দ্রুত এটা করি, ২০ বছরের মধ্যেই। আপনারা হাসছেন। কারণ, এটাকে অসম্ভব মনে হচ্ছে। যদিও অসম্ভব মনে হচ্ছে, কিন্তু এটাকে সম্ভব করার মতো সব উপাদানই এখানে আছে। আমরা শপথ নিই, আমরা এটা করবই। আসুন আমরা পরিকল্পনা করি, ২০ বছর পর দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার পর আমরা কী করব? যেমন ধরেন, আমরা বিজ্ঞাপন দিতে পারি, যদি কেউ দক্ষিণ আফ্রিকায় একজন দরিদ্র লোক খুঁজে পায়, তবে তাকে এক মিলিয়ন ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে। আমরা আত্মবিশ্বাসী থাকব, কেউ এই পুরস্কার দাবি করতে পারবে না। কারণ কেউ কোনো দরিদ্র লোক দক্ষিণ আফ্রিকায় খুঁজে পাবে না।
আমরা দক্ষিণ আফ্রিকাতেই প্রথম দারিদ্র্য জাদুঘর চালু করব। আমাদের শিশুরা সেখানে দেখতে যাবে—কেমন ছিল দরিদ্র মানুষের জীবন। আসুন, আমরা এটাকে সম্ভব করে তুলি। ধন্যবাদ।
সপ্তম নেলসন ম্যান্ডেলা বার্ষিক বক্তৃতা, জোহানেসবার্গ, দক্ষিণ আফ্রিকা। ১১ জুলাই ২০০৯
ইংরেজি থেকে অনুবাদ তামিম ইয়ামীন
মুহাম্মদ ইউনূস: নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা।
আমরা, তরুণেরা দেখেছি আপনি শিরদাঁড়া খাড়া করে দাঁড়িয়েছেন, আমাদেরও শিখিয়েছেন মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়াতে। আপনি সংস্কারহীন হয়েছেন, আমাদেরও তা করতে প্রাণিত করেছেন। আপনি আমাদের মানুষকে ভালোবাসার প্রেরণা যুগিয়েছেন, প্রেরণা দিয়েছেন শান্তিকে আলিঙ্গন করতে ও সাহসী হতে। আপনি আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন উদ্ধত হতে। অনুপ্রাণিত করেছেন শত্রুর মোকাবিলা করতে, তারপর তাদের দিকে নিঃশর্ত বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে, তাদের ভালোবেসে শান্তিময় জীবন কাটাতে। আপনি আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন আপসহীন হতে, সেই সঙ্গে অপেক্ষা করতে বলেছেন সন্ধির মুহূর্তের, পরস্পরকে জড়িয়ে ধরার অপূর্বমুহূর্তের। আপনি মানবিকতার সর্বোত্তম প্রকাশ। আপনি অনুপ্রাণিত করেছেন সমগ্র পৃথিবীকে।
আজ আপনার ৯১তম জন্মদিনে আপনার সঙ্গে এক মঞ্চে থাকাটা আমার জন্য দারুণ এক অভিজ্ঞতা। একই পৃথিবীর অংশীদার আমরা। আমি ধন্য। সারা জীবন এই মুহূর্তটি আমাকে আলোড়িত করবে।
আপনি মানুষকে মুক্তি দিয়েছেন তার ক্ষুদ্রতা থেকে। জাতি-ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে মানুষকে করেছেন সম্মানিত, দিয়েছেন আত্মমর্যাদা। মানুষের উদ্যমের প্রতীক আপনি। আপনি চিরদিনের জন্য মানুষের নৈতিক শক্তির এক অনন্য উচ্চতা স্থাপন করেছেন, দেখিয়েছেন কতটা নৈতিক উচ্চতায় উঠতে পারে মানুষ। চিরকাল আপনি থাকবেন অনুপ্রেরণার উত্স হয়ে। নিজস্ব সংগ্রামের ভেতর দিয়ে গিয়েছেন আপনি; পৃথিবী দেখেছে আপনার সংগ্রাম, দূর থেকে দেখেছি আমরাও। আমাদেরও ছিল নিজস্ব লড়াই—ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধ, ছিল নিজেদের নায়ক; তবুও আপনিও ছিলেন প্রেরণা হয়ে।
স্বাধীনতার লগ্নে বাংলাদেশ ব্যাপক দারিদ্র্যে নিপতিত ছিল। বিধ্বস্ত ছিল যুদ্ধ ও রক্তপাতে। দারিদ্র্যই ছাপিয়ে উঠেছিল সব কিছু—তার পরই এলো চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ।
অর্থনীতির তরুণ শিক্ষক হিসেবে আমি ছাত্রদের বোঝাচ্ছিলাম অর্থনীতি কত চমত্কার বিষয়, কী দারুণ এর তত্ত্বগুলো। আর শ্রেণীকক্ষের বাইরে দুর্ভিক্ষ প্রচণ্ড হয়ে উঠছে। তখনই এল হতাশা, ‘কী হবে এসব তত্ত্ব দিয়ে, যদি তা মানুষের কাজেই না লাগে?’
তখন প্রয়োজন ছিল একটি সাহসী পদক্ষেপের, পাঠ্যবইয়ের বাইরে এসে মানবীয় উদ্যম ও স্বাভাবিক যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে দেখা যে, পাঠ্যবইয়ের সাহায্য ছাড়াই কিছু করা যায় কি না?
ঋণদাতাদের থাবা থেকে আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের মুক্ত করার চেষ্টা করছিলাম—এটাই ছিল আমাদের শুরুর ইতিহাস।
গ্রামের কয়েকজন মানুষ মিলে ২৭ মার্কিন ডলার ঋণ নেয়। কারও পরামর্শ ছাড়াই আমি তাদের এই ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই, যাতে তারা মহাজনদের ঋণ শোধ করে তাদের থাবা থেকে মুক্ত হতে পারে। মানুষের উদ্দীপনা আমাকে দারুণ আকৃষ্ট করল। মনে হলো যদি মাত্র ২৭ ডলারেই মানুষকে এত সুখী করা যায়, তাহলে আরও এগোই না কেন?
এ ধারণা নিয়ে আমার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ব্যাংকটির কাছে গেলাম। মহাজনদের বদলে ব্যাংক কি এই ঋণ দিতে পারে না? কিন্তু তারা এটাকে আমলে নিল না। তারা বলল, এটা হয় না, এটা অসম্ভব।
মাদিবা, আপনি শিখিয়েছেন কিছুই অসম্ভব নয়। তাই আমরা যাত্রা শুরু করলাম এবং অসম্ভবকে সম্ভব করলাম।
আমি হলাম জামানতদার, ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠল গ্রামীণ ব্যাংক, যা কখনোই ধসে পড়েনি। এখন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে শুরু করে সারা পৃথিবীতে আমাদের শাখা আছে। যারা বলেছিল আমাদের মডেল ধসে পড়বে, তারাই ধসে পড়েছে।
ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা পুরুষের চেয়ে নারীদের বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। কারণ, আমরা দেখেছি সংসারে নারীদের মাধ্যমে টাকা এলে সেটা বেশি কার্যকর হয়। আমরা যত বেশি ঋণ দিতে থাকলাম তত বেশি রোষের সম্মুখীন হলাম, বিরোধের মুখোমুখি হলাম। শুরুতে আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল পুরুষ, শিগগিরই তারা পরিণত হলো ধর্মীয় প্রতিপক্ষে।
লোকজন বলত, আমরা তাদের সংস্কৃতি ধ্বংস করছি। নারীদের থাকা উচিত ঘরের ভেতর, সংসার চালানো তাদের কাজ নয়। তারা বলত, ‘মেয়েদের হাতে টাকা দিয়ে তোমরা আমাদের সংস্কৃতি নষ্ট করছ, তাদের হাতে টাকা থাকা উচিত নয়।’
আমি বলতাম, ‘তোমরা তোমাদের সংস্কৃতি নিয়ে থাক, আমি বিকল্প সংস্কৃতি তৈরি করছি।’
তখন আমার খুব মনে হতো, যেকোনো সংস্কৃতিই অর্থহীন, যদি তা প্রতিনিয়ত কোনো প্রতিসংস্কৃতির মুখোমুখি না হয়। মানুষ সংস্কৃতি তৈরি করে, সংস্কৃতি মানুষ তৈরি করে। এটি দ্বিমুখী চলাচল। যখন মানুষ সংস্কৃতির পেছনে লুকায়, তখন তা মৃত সংস্কৃতি।
এখন প্রায় আশি লক্ষ মানুষ গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা, এদের ৯৭ শতাংশই নারী। তারা তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠায়। আমরা কেবল আশা করেছিলাম, তারা অন্তত প্রাথমিক শিক্ষাটা শেষ করবে। কিন্তু অসম্ভবও সম্ভব হয়ে উঠল। তারা শুধু প্রাথমিক শিক্ষাই শেষ করল না, উচ্চবিদ্যালয়েও গেল। গ্রামীণ ব্যাংক তাদের সাহস জোগাল, বৃত্তির ব্যবস্থা করল যাতে তারা স্নাতক হতে পারে।
যাতে তাদের এখানেই থামতে না হয় তার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক শিক্ষাঋণের ব্যবস্থা করল। গ্রামীণ ব্যাংকের শিক্ষাঋণ নিয়ে ৩৮ হাজার ছাত্র এখন বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিত্সা, প্রকৌশলবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে পড়াশোনা করছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পিএইচডিও অর্জন করেছে।
এদের মধ্যে কেউ কেউ আমার কাছে চাকরি চান। কারণ, বাংলাদেশে চাকরি পাওয়া কঠিন। আমি তাদের বলি, তোমরা হলে গ্রামীণ ব্যাংকের সন্তান, তোমাদের অন্যদের মতো করে ভাবা উচিত নয়। আমি তাদের একটি শপথ করতে বলি এবং প্রতিদিন সকালে সেই শপথ আওড়াতে বলি, ‘আমি জীবনে কখনো চাকরি খুঁজব না, আমার জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে অন্যের জন্য চাকরি সৃষ্টি করা। আমি চাকরি সন্ধানী নই, চাকরিদাতা।’
আমি বলি, তোমরা বিশেষ কেউ। কারণ, তোমাদের মায়েরা একটি ব্যাংকের মালিক, সেটা হচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংক। টাকা তোমাদের জন্য সমস্যা নয়। আমি তাদের বলি, ‘তোমাদের মায়েদের ব্যাংক তোমাদের জন্য প্রচুর টাকা গচ্ছিত রেখেছে, পড়াশোনার সময় তোমরা শুধু পরিকল্পনা করবে—কী করে এ টাকার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারবে, যাতে অন্যদের জন্য তোমরা চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে পার।’
সহকর্মীদের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে নারীরাই আমাদের পরিচালনা পর্ষদে বসেন, সিদ্ধান্ত নেন। নিজেদের সম্পদ থেকেই অর্থায়ন হয়। আমরা ভেবে দেখেছি, অর্থায়নের জন্য দাতাদের ওপর নির্ভর করতে হলে আমরা স্থবির হয়ে পড়ব। তাই আমরা মানুষের কাছ থেকে টাকা জমা নিলাম, সেখান থেকেই গরিব মহিলাদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করলাম।
এখন আমাদের রয়েছে সম্পূর্ণ নতুন ও তরুণ একটি প্রজন্ম, যারা বেড়ে উঠেছে গ্রামীণ পরিবারে।
একদিন আমি এক গ্রামে গিয়ে এক মহিলাকে পেলাম, যিনি ১৫ বছর ধরে গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর সঙ্গে চটপটে একটি মেয়ে। মেয়েটির সঙ্গে তিনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাঁরই মেয়ে। সে এখন ডাক্তার। ব্যাপারটি আমাকে নাড়া দিল। মহিলাটি তাঁর মেয়েকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মেডিকেল কলেজে পড়তে পাঠিয়েছিলেন, পাশ করে মেয়েটি কাছের শহরে রোগী দেখে। মা-মেয়ে দুজনকে একসঙ্গে দেখে আমার শুধু একটি কথাই মনে এল—মেয়েটির মা-ও একজন চিকিত্সক হতে পারতেন। তাঁর কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু কেউ তাঁকে সে সুযোগটি দেয়নি। তিনি কখনো স্কুলে যাননি। তিনি শুধু একটি সুযোগই পেয়েছেন—গ্রামীণ ব্যাংকে যোগদানের সুযোগ। তারপর তিনি মেয়েটিকে স্কুলে পাঠিয়েছেন, শিক্ষাঋণ নিয়ে ডাক্তারি পড়িয়েছেন। এটাই ছিল দুজনের মধ্যে তফাত্। কিন্তু এটাই জীবনে কত বিশাল ফারাক তৈরি করেছে।
তাদের দিকে তাকালে সহজেই বোঝা যায়, দারিদ্র্য ব্যক্তিগত নয়। সমস্যা গরিবদের নয়—তারা অন্য যে কারও মতো যেকোনো কিছু করতে সক্ষম। কিন্তু সমাজ তাদের কখনো সে সুযোগটি দেয়নি। সমাজব্যবস্থাই দারিদ্র্য সৃষ্টি করে। ব্যাংক গরিবদের ঋণ দিতে চায় না। তারা মনে করে গরিবদের ঋণ দিলে তা কখনো উশুল হবে না। কিন্তু আজ সারা বিশ্বে গ্রামীণ ব্যাংক ও অন্যান্য ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রকল্প প্রমাণ করেছে, গরিবরাও ঋণের টাকা ফেরত দেয়।
‘অন্যান্য ব্যাংক কেন এটা করে না?’—এ বিষয়ে তাদের কোনো সদুত্তর নেই। দারিদ্র্যের শিকড় এখানেই প্রোথিত। কিছু প্রতিষ্ঠান মনে করে, গরিবরা চিরদিন গরিবই থাকবে, আর একদল উন্নতি করবে। আমরা যদি এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঠিক করতে পারি, তবেই মানুষ তাদের সৃজনশীলতা দেখাতে পারবে, সন্তানেরা হবে তাদের পিতাদের চেয়ে বেশি সক্ষম।
সমস্যা আছে নীতিনির্ধারণেও। সরকার ও দাতারা গরিবদের যা দেয়, দান হিসেবে দেয়। কিন্তু এটা কোনো সমাধান নয়। দান দারিদ্র্যকে জমাট করে তোলে, মানুষকে আটকে ফেলে। মানুষের ভেতর থেকে দায়িত্ববোধ মুছে দেয়, উদ্যোগকে নিরুত্সাহিত করে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে গরিব মানুষের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা, তাদের সহযোগিতা করা, যাতে তারা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করাই হচ্ছে মানুষের জীবন। এটা মানুষকে চ্যালেঞ্জ নিতে উদ্বুদ্ধ করে।
প্রতিষ্ঠিত কিছু ধারণাও এর পেছনে দায়ী। যেমন ধরুন ব্যবসার যে ধারণা। ব্যবসার উদ্দেশ্য দাঁড়িয়েছে টাকা তৈরি করা, সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা। অস্বীকার করা যাবে না যে, যারা এ ধরনের ব্যবসায়িক কাঠামো তৈরি করেছে, তারা মানুষকে শুধু টাকা তৈরির একমাত্রিক হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করেছে। কিন্তু মানুষমাত্রই বহুমাত্রিক, তাদের অনেক কিছু প্রয়োজন। তাহলে অর্থনৈতিক তত্ত্বেই বা কেন তাদের অন্য দিকগুলোকে অগ্রাহ্য করে তাদের একমাত্রিক বলে বিবেচনা করা হবে। এখানেই ছিল ভুল।
আমাদের ভেতরে স্বার্থপরতা আছে। এর ওপরই টাকা তৈরির ব্যবসাগুলো দাঁড়িয়ে আছে। এর দ্বারা চালিত হই বলেই আমরা সবকিছু নিজেদের জন্য চাই। আমি অন্য একধরনের ব্যবসার কথা প্রস্তাব করছি, যার ভিত্তি হবে ‘নিঃস্বার্থপরতা’, আমাদের সবার ভেতরেই যা আছে। এর নাম দিতে চাই সামাজিক ব্যবসা। আমি জানি, কিছু লোক এতে বিনিয়োগে আগ্রহী। কেউ ভাবতে পারে, আমি নির্বোধের মতো কথা বলছি। কিন্তু অনেক মানুষ এখানে হাজার হাজার ডলার বিনিয়োগ করছে। কেউ তাদের নির্বোধ ভাবে না। তাহলে আমাকে কেন এ রকম ভাবা হবে?
আমার মনে হয়, সামাজিক ব্যবসা খুবই যুক্তিযুক্ত। আমরা যদি এটা করতে পারতাম, তবে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। দারিদ্র্য বিমোচনে, পুষ্টি উন্নয়নে, খাবার পানির ব্যবস্থা করতে এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে আমরা সামাজিক ব্যবসা শুরু করতে পারি।
বাংলাদেশে আমরা কিছু কাজ করেছি। যখনই আমি কোথাও কোনো সমস্যা দেখি, সেখানে একটি প্রতিষ্ঠান খুলি। সারা জীবন আমি তা-ই করেছি। গরিবদের ঋণ পাওয়ার সমস্যা দূর করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছি গ্রামীণ ব্যাংক। আমার জন্য নয়, মানুষের জন্য। আমি এর মালিক নই, মালিক হচ্ছে ঋণগ্রহীতারা। এটা তাদের প্রচুর সাহায্য করে।
শিশুদের পুষ্টিহীনতা দূর করার জন্য আমরা বাংলাদেশে গ্রামীণ ডানোন নামে একটি সামাজিক ব্যবসা শুরু করেছি। এখান থেকে আমরা কোনো লভ্যাংশ নিই না। অপুষ্ট শিশুদের জন্য পুষ্টির ব্যবস্থা করতে এটা করা হয়েছে। আয়রন, ভিটামিন, জিঙ্ক, আয়োডিন পুষ্টির সব উপাদান এতে [এ দই-এ] আছে। এটি সুস্বাদুও। শিশুরা এটি পছন্দ করে, আমি করি, আপনারাও পছন্দ করবেন। কোনো শিশু যদি টানা আট-নয় মাস প্রতি সপ্তাহে দুই কাপ করে এই দই খায়, তাহলে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার মতো সব প্রয়োজনীয় পুষ্টি সে পাবে।
মাননীয় শ্রোতাগণ, আমরাও কেন এটা করি না। এখানে উপস্থিত যে কেউ এটা করতে পারেন। যে কেউ একটি সামাজিক ব্যবসা শুরু করে বেকারদের জন্য কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেন। উপস্থিত শ্রোতামণ্ডলীর কেউ একজন যদি একটি সামাজিক ব্যবসা শুরু করেন, তবে পাঁচজন লোকের চাকরির ব্যবস্থা হবে। এভাবেই বেকারত্ব কমবে।
আমি আপনি মিলে যদি এ রকম একটি করে সামাজিক ব্যবসা খুলি, তবে অনেকের চাকরির সুযোগ তৈরি হবে। আমরা যদি নিজেরাই আমাদের সমস্যার সমাধান করতে পারি, তবে আমাদের সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না। যদি পাঁচজন লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়, তাহলে একটি বীজ তৈরি হয়। যেখানেই প্রয়োজন সেখানেই আমরা এই বীজ রোপণ করব, যতক্ষণ না বেকার সমস্যার সমাধান হয়, এই বীজ ছড়িয়ে যাব।
সামাজিক ব্যবসায় আমি টাকা বানাতে চাই না, আমি শুধু মানুষের স্বাস্থ্যসুবিধা ও শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে চাই। এটা মানসিকতার পরিবর্তন ঘটায়। আমরা যদি এই বদলে যাওয়া মানসিকতা ছড়িয়ে দিতে পারি, তবে দারুণ একটি সমাজ পাব। প্রত্যেক কোম্পানিই একটি করে সামাজিক ব্যবসা খুলতে পারে। অনেক জায়গায় কোম্পানি তাদের কার্যক্রম চালাতে চায় না। কারণ, সেখানে ব্যবসা চালানো অতটা লাভজনক নয়। যদি সেই কোম্পানি সেখানে একটি সামাজিক ব্যবসা চালু করে, তবে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে এবং সেখানকার লোকজন এমন অনেক সেবা পাবে, যেগুলো আগে সেখানে ছিল না। এটা টাকা বানানোর জন্য হবে না, হবে সামাজিক ব্যবসার জন্য। আমরা যদি প্রতিষ্ঠান ও প্রচলিত ধারণাগুলোকে বদলাতে পারি, তবে একটা বদলে যাওয়া পৃথিবী পাব।
বর্তমান অর্থনৈতিক দুর্দশা এটাই প্রমাণ করে যে প্রচলিত কাঠামো ভালোভাবে কাজ করছে না। পরিবর্তনের জন্য আদর্শ সময় এটাই, এটাই জেগে ওঠার সময় এবং কোন বিষয়গুলোতে পরিবর্তন জরুরি, সেটা উপলব্ধি করার সময়। আমরা গুরুতর কিছু সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি—অর্থনৈতিক সমস্যা, খাদ্য সমস্যা, জ্বালানি সমস্যা, পরিবেশসংক্রান্ত সমস্যা, সামাজিক সমস্যা ইত্যাদি। এটাই কি জেগে ওঠার সেরা সময় নয়?
আমরা জানি কোন বিষয়গুলো বদলাতে হবে। এই নভেম্বরে আমরা বার্লিন দেয়াল পতনের ২০ বছর পালন করব। সেই দেয়াল কোনো উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মারণাস্ত্র বা অপ্রতিরোধ্য কোনো সেনাবাহিনী দ্বারা ধ্বংস হয়নি। সেই দেয়াল চূর্ণ করেছে কিছু একতাবদ্ধ মানুষ, যাদের অনেকের কোলে ছিল তাদের সন্তানেরা। এটাকেই আমরা মানুষের শক্তি বলে থাকি।
যদি কিছু মানুষ এ রকম পরাক্রমশালী একটি দেয়াল ধূলিস্মাত্ করে দিতে পারে, তবে দারিদ্র্য কেন পৃথিবী থেকে দূর করা যাবে না? দারিদ্র্যের দেয়ালও ভেঙে দিতে পারে মানুষের মিলিত শক্তি। এটা খুবই সম্ভব।
এ বছর মানুষের চাঁদে যাওয়ার ৪০তম বার্ষিকী। মানুষ কখনো ভাবেনি এরকমটি হবে। তারা এটাকে এক ধরনের পাগলামো মনে করত। কিন্তু ৪০ বছর আগে সব মানুষের চোখের সামনে এটা ঘটেছে। আমরা যদি চাঁদে যেতে পারি, তবে আমাদের দরিদ্র প্রতিবেশীর কাছে কেন যেতে পারব না তার দারিদ্র্য নিরসনের জন্য? এটাই যুগে যুগে মানুষ করেছে।
সব সময় মানুষ তা করত। কারণ, তারা এটা করার প্রয়োজনীয়তাটুকু বুঝতে পারত। কারণ, এটাকে অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হতো। আপনি যদি মনে করেন, দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী গড়া অসম্ভব, তাহলে সে চেষ্টাই করা উচিত। কারণ, করার জন্য উপযুক্ত কাজ এটাই।
মাদিবার ৯১তম জন্মদিনে এখানে আমরা একত্র হয়েছি, যিনি ইতি টেনেছেন বর্ণবৈষম্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার—সবাই মনে করত, এটা কখনোই হতে পারে না। তিনি এটাকে সম্ভব করে তুলে অসম্ভবকে সাধন করেছেন। আমরা সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্তি পেয়েছি, মুক্তি পেয়েছি দাসত্ব ও বর্ণবৈষম্য থেকেও, যেগুলোর প্রত্যেকটিই অসম্ভব মনে হতো। আসুন, আমরা আরেকটি অসম্ভবের দিকে হাত বাড়াই, উত্সাহ-আনন্দ নিয়ে কাজটি শেষ করি, দারিদ্র্যমুক্ত একটি পৃথিবী গড়ে তুলি। চলুন, আমরা আমাদের মনের মতো একটি পৃথিবী গড়ে তুলি।
মানুষের যাত্রা শুরু হয়েছিল এই আফ্রিকাতেই। আসুন, আফ্রিকা থেকে আমরা দক্ষিণ আফ্রিকাকেই প্রথম দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তুলি, যেখানে কোনো দরিদ্র লোক থাকবে না। আসুন দ্রুত এটা করি, ২০ বছরের মধ্যেই। আপনারা হাসছেন। কারণ, এটাকে অসম্ভব মনে হচ্ছে। যদিও অসম্ভব মনে হচ্ছে, কিন্তু এটাকে সম্ভব করার মতো সব উপাদানই এখানে আছে। আমরা শপথ নিই, আমরা এটা করবই। আসুন আমরা পরিকল্পনা করি, ২০ বছর পর দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার পর আমরা কী করব? যেমন ধরেন, আমরা বিজ্ঞাপন দিতে পারি, যদি কেউ দক্ষিণ আফ্রিকায় একজন দরিদ্র লোক খুঁজে পায়, তবে তাকে এক মিলিয়ন ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে। আমরা আত্মবিশ্বাসী থাকব, কেউ এই পুরস্কার দাবি করতে পারবে না। কারণ কেউ কোনো দরিদ্র লোক দক্ষিণ আফ্রিকায় খুঁজে পাবে না।
আমরা দক্ষিণ আফ্রিকাতেই প্রথম দারিদ্র্য জাদুঘর চালু করব। আমাদের শিশুরা সেখানে দেখতে যাবে—কেমন ছিল দরিদ্র মানুষের জীবন। আসুন, আমরা এটাকে সম্ভব করে তুলি। ধন্যবাদ।
সপ্তম নেলসন ম্যান্ডেলা বার্ষিক বক্তৃতা, জোহানেসবার্গ, দক্ষিণ আফ্রিকা। ১১ জুলাই ২০০৯
ইংরেজি থেকে অনুবাদ তামিম ইয়ামীন
মুহাম্মদ ইউনূস: নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা।
No comments