নিজের সুযোগ নিজেই তৈরি করো —নেলসন ম্যান্ডেলা
নেলসন ম্যান্ডেলা |
>>>>নেলসন ম্যান্ডেলা। জন্ম: ১৮ জুলাই ১৯১৮, মৃত্যু: ৫ ডিসেম্বর ২০১৩ (বয়স ৯৫)।
বিশ্বের বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা। বর্ণবাদ-পরবর্তী সময়ে
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম রাষ্ট্রপতি। আফ্রিকানরা তাঁকে ‘মাদিবা’ বলে ডাকে,
যার অর্থ হল "জাতির জনক"। বিভিন্ন সময় মোট ২৭ বছর কেটেছে কারাগারে।
বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথমবারের মতো
গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন ১৯৯৩ সালে।
ম্যান্ডেলা ব্রিটিশ দক্ষিণ আফ্রিকার এমভেজোর এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ
করেন। তিনি ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ও উইটওয়াটারস্র্যান্ড
বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশুনা করেন এবং জোহানেসবার্গে আইনজীবী
হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। সেখানে তিনি উপনিবেশ-বিরোধী কার্যক্রম ও
আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং ১৯৪৩ সালে আফ্রিকান
ন্যাশনাল কংগ্রেসে যোগ দেন ও ১৯৪৪ সালে ইয়ুথ লিগ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয়
ভূমিকা পালন করেন। তিনি সশস্ত্র সংগঠন উমখন্তো উই সিযওয়ের নেতা হিসাবে
বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকার গ্রেপ্তার করে ও অন্তর্ঘাতসহ নানা অপরাধের
দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। ম্যান্ডেলা ২৭ বছর কারাবাস করেন। এর
অধিকাংশ সময়ই তিনি ছিলেন রবেন দ্বীপে। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি
তিনি কারামুক্ত হন। এর পর তিনি তাঁর দলের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ
সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় অংশ নেন। এর ফলশ্রুতিতে দক্ষিণ আফ্রিকায়
বর্ণবাদের অবসান ঘটে এবং সব বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়ের প্রতীক হিসবে গণ্য
ম্যান্ডেলা ২৫০টিরও অধিক পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ভারত
সরকার প্রদত্ত ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে ভারতরত্ন পুরস্কার ও ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে
নোবেল শান্তি পুরস্কার। তাছাড়াও তিনি ১৯৮৮ সালে শাখারভ পুরস্কারের অভিষেক
পুরস্কারটি যৌথভাবে অর্জন করেন। ১৯৯৬ সালের ১৬ জুন দক্ষিণ আফ্রিকার যুব
দিবসে তরুণদের উদ্দেশে উৎসাহব্যঞ্জক এক বক্তব্য দেন নেলসন ম্যান্ডেলা।<<<<
- আজও স্মৃতিগুলো ভেসে ওঠে চোখে। কোমলমতি তরুণদের নিথর দেহ পড়ে আছে পথে পথে। পুলিশের বন্দুকের বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে অসংখ্য তরুণের তাজা তাজা প্রাণ। পুরো দক্ষিণ আফ্রিকা সেদিন কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। এই স্মৃতিগুলো আমাদের তাড়া করে আর মনে করিয়ে দেয়, কেমন এক বিভীষিকাময় অন্ধকার ভয়ংকর অতীতকে আমরা জয় করেছি। এই স্মৃতিগুলো বারবার করে বলে তরুণদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে। কারণ, তরুণদের আত্মত্যাগেই মিলেছে আমাদের মুক্তি, আমাদের স্বাধীনতা। আমরা এখন কত না আনন্দিত। কারণ, আর কোনো বুলেট কোনো তরুণের গায়ে লাগবে না। আমাদের তরুণেরা এখন শিক্ষার ভালো পরিবেশ চায়। তারা চায় ভালোভাবে জীবনটাকে উপভোগ করতে।
- আমরা এই দিনে সমবেত হয়েছি শুধু তরুণদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে। কেননা বর্ণবৈষম্যের বিষদাঁত ভেঙে তরুণেরাই তো আমাদের মুক্তি এনে দিয়েছে। বর্ণবৈষম্যবিরোধী বিপ্লবের সামনে থেকে তারা নেতৃত্ব দিয়েছে। মুক্তি বা স্বাধীনতা যখনই হাতছানি দিয়ে ডেকেছে, তখনই তোমরা তরুণেরা সাড়া দিয়েছ। মৃত্যুকে পরোয়া না করে, বরং তুচ্ছ বলে বুলেটের আঘাতকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছ। বিপ্লবের মাঠ থেকে তোমরা কখনোই পিছপা হওনি। একটি গণতান্ত্রিক ও বিকল্প জাতি গঠনের আহ্বানে তোমরা সাড়া দিয়েছ।
- তোমরা এসব করেছ নিজেদের জন্য, জাতির জন্য। অথচ বিনিময়ে তোমরা বিশেষ কোনো সুবিধা চাওনি। এমনকি আজও চাইছ না। কিন্তু আজ আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বলতে চাই, এই জাতি তরুণদের কাছে ঋণী। তাই জাতি তোমাদের গণতন্ত্রের সব ধরনের সুবিধা দিতে নতুন করে একটি জাতীয় যুব কমিশন গঠন করছে। শুধু তরুণদের জন্য এই কমিশন কাজ করবে। তরুণদের চাহিদার জোগান আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই হবে এ কমিশনের কাজ। তরুণেরা যেমন জাতির জন্য নিবেদিতপ্রাণ, তেমনি জাতিরও কিছু দায়িত্ব থাকে। তরুণেরা যেন জাতি গঠনে ও জাতির উন্নয়নে সক্রিয় অংশ নিতে পারে, সেটা নিশ্চিত করবে জাতি। আশা করি, এই কমিশন সব বাধা পেরিয়ে সফলভাবেই কাজ করতে পারবে। তবে কমিশনের সফলতা নির্ভর করবে তরুণদের ওপরই। তোমাদের সহযোগিতা ছাড়া এই কমিশন সফল হতে পারবে না। তোমাদের সহযোগিতা ছাড়া জাতিও সফল হতে পারবে না। কারণ, তোমরা তরুণেরাই জাতির কর্ণধার।
- আমরা ঋণী তরুণদের কাছে, যারা অকাতরে প্রাণ দিয়েছে জাতির জন্য। যারা আত্মবিসর্জন দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের জন্য, যেন সবাই উন্নত ও সুখী জীবনযাপন করতে পারে। ২০ বছর আগের সেই দিন, ১৬ জুন ১৯৭৬। ঘুমন্ত জাতিকে তোমরা তরুণেরা সেদিন জাগিয়ে তুলেছিলে। তখন বর্ণবৈষম্যের শাসনব্যবস্থায় কালোরা ছিল ক্রীতদাস। তোমরা সেই তরুণ, যারা সেদিন নিজেদের প্রাণ দিয়ে দাসত্ব থেকে জাতিকে এনে দিয়েছিলে মুক্তি। বর্ণবৈষম্যের পতন ঘটিয়ে তোমরা বদলে দিয়েছ ইতিহাসের গতিধারা।
- আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দারিদ্র্যকে জয় করা। গৃহহীনদের আবাসনের ব্যবস্থা করা। আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ এখন অশিক্ষা আর অজ্ঞানতাকে জয় করা। পৃথিবীটা দিন দিন ছোট হয়ে আসছে। আমাদের দক্ষতা আরও বাড়াতে হবে। উদ্ভাবনের দিকে আমাদের উন্নতি করতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক পণ্য উৎপাদন করতে হবে এবং এসব চ্যালেঞ্জ আসলে তরুণদেরই মোকাবিলা করতে হবে। যখন শহর আর গ্রাম থেকে তোমরা প্রকৌশলী, পদার্থবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ ও অন্যান্য বিজ্ঞানী হিসেবে গড়ে উঠবে এবং এই সংখ্যাটা ধীরে ধীরে বাড়বে, তখনই আমরা বলতে পারব, আমরা উন্নতি করছি। এ জন্য যত ধরনের সুযোগ-সুবিধা তোমরা পাবে, তা ঠিকঠাকভাবে কাজে লাগাবে।
- জাতির জন্য চাই কর্মঠ ও পরিশ্রমী তরুণ। দেশের অর্থনীতি নির্ভর করে তরুণদের ওপর, তোমাদের ওপর। তোমরাই পারো, তোমাদের কঠোর পরিশ্রম আর প্রচেষ্টায় নিজ জাতিকে সবচেয়ে সফল, সুখী ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড় করাতে। জাতি গঠনের এ লক্ষ্যটা পূরণ করতে তোমাদের কাজ করতে হবে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহভাগিতার মানসিকতা নিয়ে।
- যেসব তরুণ কাজ জোটাতে পারোনি, তাদের বলি, তোমরা হতাশ হোয়ো না। সুযোগকে কাজে লাগাতে শেখো। বড় হোক ছোট হোক, কাজে যোগ দাও। শুধু শুধু অন্যের ওপর নির্ভর কোরো না। নিজেই নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হবে। নিজের জন্য নিজেই সুযোগ তৈরি করো। সরকারের দেওয়া ছোট কোনো কাজ, হতে পারে সেটা কৃষিকাজ, তুমিও যোগ দাও।
- আমার বিশ্বাস, দেশের সব মানুষই বর্ণ ও লিঙ্গবৈষম্যহীন জাতি গঠনে একযোগে কাজ করবে। আমি জোরালো প্রত্যাশা করি তরুণদের কাছ থেকে। বৈষম্যহীন জাতি গঠনের স্বপ্নটাকে সত্যি করতে তোমরা প্রাণ উজাড় করে কাজ করবে। সব যুবক যদি এক হয়, সব মানুষ যদি এক হয়, তবে দেশে এমন একটা পরিবেশ গড়ে উঠবে, যেখানে সবাই মিলে সুখে-শান্তিতে বাস করা যায়।
- তরুণেরা আমাদের অহংকার, তরুণেরা একটা জাতির অলংকার। তরুণেরা দুঃসাহসের প্রতীক। তাদের বীরত্বকে ভোলা যায় না। সংগ্রামী তরুণদের জন্য আমরা গর্বিত। আজকের দিনে প্রতিটি জাতির জন্য এমন দুঃসাহসিক বীর যুবকের আরও বেশি প্রয়োজন। তোমরা সাহসী হও। শেখায় মনোনিবেশ করো। নিজেদের দক্ষতা বাড়াও। মতৈক্য গড়ে তোলো। জাতির ভবিষ্যৎ তোমাদের হাতেই। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তোমরা তোমাদের জাতির ভবিষ্যৎটাকে উজ্জ্বল করো, আলোকিত করো। তোমাদের সবাইকে ধন্যবাদ।
>>>(নেলসন ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর: জাহাঙ্গীর আলম ।)
No comments