তালপাতার পাঠশালা by মোজাম্মেল হোসেন মুন্না
কাগজ ও কলম প্রচলনের আগে বর্ণমালা শেখাতে লেখার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার
করা হতো তালপাতা। আধুনিককালে এর ব্যবহার নেই বললেই চলে। তবে গোপালগঞ্জের
টুঙ্গিপাড়া ও কোটালীপাড়ার বেশ কয়েকটি গ্রামে শিশুদের বর্ণমালা শেখানোর জন্য
এখনও তালপাতার পাঠশালা চালু রয়েছে। এসব গ্রামের মানুষের বিশ্বাস, তালপাতায়
হাতে খড়ি হলে হাতের লেখা সুন্দর হয়। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি
সেখানে এই তালপাতায় লেখার ব্যবস্থাও চালু রাখা হয়েছে। সরেজমিনে এসব তথ্য
জানা গেছে।
টুঙ্গিপাড়ার প্রত্যন্ত ডুমুরিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার একটি
দুর্গা মন্দিরে মাদুর বিছিয়ে চলছে পাঠদান। কথা হয় স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে।
তারা জানান, অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের প্রথমে এই পাঠশালায় পাঠান। সেখানে
বর্ণমালার হাতে খড়ি হয় তাদের। বর্ণমালা শেখা হলে শিশুদের পাঠানো হয় পাশের
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মূলত শিশুদেরকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির
উপযুক্ত করে তৈরি করা হয় এসব পাঠশালায়।
জানা
যায়, সরকারি কোনও সাহায্য ছাড়াই স্থানীয়দের সহযোগিতায় এসব পাঠশালা চলছে।
ধানের মৌসুমে গ্রাম থেকে ধান তুলে শিক্ষকের বেতন দেওয়া হয়।এক বছরে প্রতি
শিক্ষার্থীর জন্য দেওয়া হয় এক মণ করে ধান।
অভিভাবকরা জানান, তালপাতায় শিক্ষকের এঁকে দেওয়া বর্ণের ওপর হাত ঘুরিয়ে
বর্ণমালা লেখা শেখে ছেলেমেয়েরা। এতে হাতের লেখা ভালো হয়। তাছাড়া, এসব
পাঠশালায় নৈতিক শিক্ষাও দেওয়া হয়, যা শিশুদের চরিত্র গঠনের প্রাথমিক ধাপ
হিসেবে কাজ করে।
তালপাতার পাঠশালা থেকে হাতে খড়ি হয়েছে এমন অনেকেই এখন
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছেন। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তারা
জানান, এই পাঠশালার শিক্ষা তাদের অনেক কাজে লেগেছে। তালপাতার পাঠাশালা থেকে
শিক্ষা নিয়েছে বলেই তাদের হাতের লেখা সুন্দর হয়েছে।
ডুমুরিয়া
গ্রামের মানুষের শিক্ষার উন্নয়নে স্বাধীনতার পর শিক্ষানুরাগী রথীন্দ্র নাথ
মালো এই তালপাতার পাঠশালা গড়ে তোলেন। প্রথম দিকে বিভিন্ন গাছতলা ও বাড়িতে
ঘুরে ঘুরে তিনি শিশুদের শিক্ষা দিতেন। এখন দুর্গা মন্দিরে পাঠদান করা হয়।
এটাকে দুর্গা মন্দিরের পাঠশালাও বলা হয়। টুঙ্গিপাড়ার ছোট ডুমুরিয়া ও বড়
ডুমুরিয়া গ্রাম এবং কোটালীপাড়ার কাঠি গ্রাম, কানাই নগর, ভৈরব নগরসহ বিভিন্ন
গ্রাম থেকে শিশুরা শিক্ষা নিতে আসে এখানে।
এই পাঠশালার একমাত্র শিক্ষক কাকলি কির্ত্তনীয়া জানান, তিনি তালপাতায়
প্রথমে বর্ণ লিখে দেন। শিক্ষার্থীরা তার ওপর নিজেদের বানানো কালি দিয়ে হাত
ঘুরিয়ে বর্ণমালা শিখে ফেলে। এতে করে হাতের লেখা সুন্দর হয়। শুরুতে কাগজ আর
কলম দিয়ে লিখলে হাতের লেখা এত সুন্দর হয় না।
শিক্ষক
কাকলি কির্ত্তনীয়া বলেন, ‘অভিভাবকরা সন্তানদের প্রথমে এই পাঠশালায় পাঠান।
এখানে শিশুদের ইংরেজি ও বাংলা বর্ণমালা ও নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হয়। তাদের
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির উপযুক্ত করে গড়ে তোলা হয়।’
ডুমুরিয়া গ্রামের আনন্দ কীর্তনিয়া, দীলিপ কীর্তনিয়া, গোবিন্দ বিশ্বাস
গৌর মণ্ডলসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তাদের ভাষ্য— ‘আমরাও এই পাঠশালায়
পড়েছি। এরপর আমাদের ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনিরাও পড়ছে। এ পাঠশালা থেকে হাতে
খড়ি নিয়ে যারা এখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, তারা উপকার পেয়েছেন।’
পাঠশালাটি যাতে টিকে থাকে, এজন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করেছেন এলাকাবাসী।
পাঠশালাটি যাতে টিকে থাকে, এজন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করেছেন এলাকাবাসী।
No comments