ভাসে পেয়ারা, আমরাও ভাসি বই কী! by কাউসার রুশো
ঝালকাঠি জেলার ভীমরুলি আর পিরোজপুর জেলার আটঘর-কুড়িয়ানা জুড়ে
রয়েছে দেশের বৃহত্তম পেয়ারা বাগান। ঝালকাঠি, বরিশাল ও পিরোজপুরের
সীমান্তবর্তী এলাকার ২৫টিরও বেশি গ্রামের ৩০ হাজার একরের বেশি জমির ওপর গড়ে
ওঠেছে এটি। পেয়ারা চাষের সঙ্গে প্রায় ২০ হাজার পরিবার সম্পৃক্ত। বর্ষায় এই
এলাকা যেন উৎসবের আনন্দে জেগে ওঠে। বাগান থেকে ফল পেড়ে নৌকায় ভাসতে ভাসতে
প্রতিদিন পেয়ারা-আমড়া-লেবু ইত্যাদি দেশীয় ফলের বেচাকেনা চলতে থাকে।
বৃষ্টিবিলাস আর দিনব্যাপী নৌকা ভ্রমণের জন্য ভাসমান এই পেয়ারা বাজার তাই
বেশ জনপ্রিয়। এখানে পাইকারি দামে কেনাবেচা হয় পেয়ারা। সেসব দেখা বেশ
আনন্দের।
আমরা ২০ জনের একটি দল কয়েকদিন আগে অনিন্দ্যসুন্দর ভাসমান পেয়ারা বাজার
ঘুরে এলাম। রাতে যখন লঞ্চে উঠি, বৃষ্টি না হলেও আকাশটাকে ছেয়ে রেখেছিল মেঘ।
অথচ অনেক হিসাব-নিকাশ করে লঞ্চযাত্রায় পূর্ণিমা উপভোগের জন্য ওইদিন
ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছিলাম। আমাদের দুঃখী চেহারা দেখেই কিনা মধ্যরাতের পর
মেঘমঞ্জরির দয়া হলো! চাঁদের আলোয় সবাই মিলে লঞ্চের ডেকে বসে কাটিয়ে দিলাম
বাকিটা রাত। বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে ভোরে যখন বানারীপাড়া ঘাটে নামলাম, ততক্ষণে
আমরা চন্দ্রগ্রস্ত।
ভীমরুলি পেয়ার বাজার |
সবাই সকালের নাশতা সেরে একটা ট্রলার নিয়ে রওনা দিলাম ভীমরুলির উদ্দেশে।
যেতে যেতে ভীমরুলিহাট খালের একটি মোহনা মুগ্ধ করলো আমাদের। তিন দিক থেকে
নাম না জানা তিনটি খাল এসে মিশেছে। ভীমরুলি গ্রামের আঁকাবাঁকা ছোট্ট
খালজুড়ে সপ্তাহের প্রতিদিনই সকাল-সন্ধ্যা চলে বিকিকিনি। এখানকার
গ্রামগুলোতে অজস্র পেয়ারা বাগান। বন বললেও ভুল হবে না! সেইসব বাগান থেকে
পেয়ারা পেড়ে চাষীরা নৌকায় তুলে এই বাজারে নিয়ে আসেন।
নৌকায় খাল পাড়ি দেওয়ার সময় দু’পাশের সবুজের সমারোহ চোখ জুড়িয়ে দেয়। আমরা
খুব সকালে ভীমরুলি পৌঁছে গেলাম। হাট তখনও জমে ওঠেনি। তবে ঘণ্টাখানেকের
মধ্যে সারিবেঁধে পেয়ারা-আমড়া-লেবু বোঝাই নৌকা হাটে জড়ো হতে লাগলো। ভীমরুলি
বাজারের সবচেয়ে ব্যস্ত সময় হলো সকাল ১১টা থেকে বিকাল ৩টা। এ সময় নৌকার
সংখ্যা কয়েকশ’ ছাড়িয়ে যায়!
খুব অল্প দামেই প্রায় একটি নৌকা বোঝাই পেয়ারা-আমড়া-লেবু কিনে ফেললাম
আমরা। তারপর চললো উপর্যুপরি ভক্ষণ। অবশিষ্ট যা রইলো, ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার
সিদ্ধান্ত নিলাম। এরপর আমরা নৌকায় ভেসে ভেসে আটঘর-কুড়িয়ানা নৌকার বাজারে
পৌঁছালাম। এত সুন্দর! পান্থ কানাইয়ের সেই গানটার কথা মনে পড়ে গেলো- ‘শুনেছি
তোমার মনের গহীন গাঙ্গে উপচে পড়ে জল, সেই জলে সাঁতার কাটো তুমি
অনর্গল/আবার ডুবসাঁতারে অনেকে নাকি আনন্দে টলমল, তাই সামনের মাসে তোমায়
একটা নৌকা কিনে দেবো।’ দু’একটা নৌকা কিনে ফিরতে পারলে ভালো লাগতো! বিকাল
পর্যন্ত ঘুরেফিরে এরপর স্বরূপকাঠি গিয়ে দুপুরের খাবারে মেতে গেলাম।
কখন যাবেন
জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পেয়ারার মৌসুম। পেয়ারার মৌসুম শেষ হলে শুরু হয় আমড়ার মৌসুম। এ অঞ্চলে আমড়ার ফলন অনেক বেশি। আর সবশেষে আসে সুপারি। তবে ভাসমান পেয়ারার বাজার জমজমাট রূপ লাভ করে আগস্টের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যভাগ পর্যন্ত।যেভাবে যাবেন
সদরঘাট থেকে প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যা
৬টা-৭টার দিকে ঢাকা থেকে বানারীপাড়া-হুলার হাটের লঞ্চ ছেড়ে যায়। এগুলোর
সিঙ্গেল কেবিন ৯০০ টাকা, ডাবল কেবিন ১৮০০ টাকা ও ডেক জনপ্রতি ২৫০ টাকা।
এছাড়া ফ্যামিলি কেবিনও পাওয়া যায়।
লঞ্চগুলো সকাল ৭টার দিকে বানারীপাড়া নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে সারাদিনের
জন্য ট্রলার ভাড়া করে নিলে আটঘর, কুড়িয়ানা, ভীমরুলি বাজার ও স্বরূপকাঠি
ঘুরে আসা যায়। ভাড়া পড়বে ১৫০০-২০০০ টাকা। এই রুটের সবচেয়ে ভালো লঞ্চ
ফারহান-৯ ও ফারহান-১০। এছাড়া ঢাকা থেকে বরিশাল হয়েও যাওয়া যেতে পারে।
সদরঘাট
থেকে প্রতিদিন রাত সাড়ে ৮টা-৯টার মধ্যে মানামি, সুন্দরবন-১১, সুরভী-৯,
পারাবত-১২সহ বেশকিছু উন্নতমানের লঞ্চ বরিশালের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এসব
লঞ্চের ভাড়া সিঙ্গেল কেবিন ১০০০ টাকা, ডাবল কেবিন ২০০০ টাকা ও ডেক জনপ্রতি
১৫০ টাকা। এছাড়া ভিআইপি কেবিন ভাড়া ৫০০০ থেকে ৭০০০ টাকা, সেমি ভিআইপি কেবিন
৪০০০ থেকে ৪৫০০ টাকা, ফ্যামিলি কেবিন ২৫০০ থেকে ৩৫০০ টাকা। ভোর ৫টা-৬টার
মধ্যে এসব লঞ্চ বরিশাল পৌঁছে যায়। এরপর ঘাট থেকে অটোরিকশায় চড়ে
বাসস্ট্যান্ড সেখান থেকে ২৫০-৩৫০ টাকায় টেম্পো ভাড়া করে বানারীপাড়া যাওয়া
যায়। একেকটি টেম্পোতে ৫-৬ জন বসতে পারে। আর বাস ভাড়া জনপ্রতি ৩০-৪০ টাকা।
বানারীপাড়া পৌঁছে সেখান থেকে সারাদিনের জন্য ট্রলার ভাড়া নেওয়া যাবে। ভাড়া ১৫০০-২০০০ টাকার মতো। আকারভেদে প্রতিটি ট্রলারে ১৫-২৫ জন বসতে পারে।
বানারীপাড়া পৌঁছে সেখান থেকে সারাদিনের জন্য ট্রলার ভাড়া নেওয়া যাবে। ভাড়া ১৫০০-২০০০ টাকার মতো। আকারভেদে প্রতিটি ট্রলারে ১৫-২৫ জন বসতে পারে।
তবে
ভাসমান পায়রা বাগান দেখার জন্য বরিশালের লঞ্চগুলোতে যাওয়াই সবচেয়ে
সুবিধাজনক। কারণ হুলার হাটের লঞ্চগুলো নিরাপদ হলেও অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা অত
ভালো নয়। সেদিক থেকে বরিশালের লঞ্চগুলোতে ভ্রমণ নিরাপদ ও আরামদায়ক।
এছাড়া ঢাকার গাবতলী থেকে সাকুরা পরিবহনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) বাস
বরিশাল যায়। ভাড়া ৮০০ টাকা। হানিফ, ঈগল, সুরভী ও সাকুরা পরিবহনের নন-এসি
বাসের ভাড়া ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা। ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে বরিশাল যাওয়ার জন্য
রয়েছে সুগন্ধা পরিবহন।
কোথায় থাকবেন
ভাসমান পেয়ারা বাজার দেখার ভ্রমণে হোটেলে থাকার প্রয়োজন নেই। ঢাকা থেকে সন্ধ্যার লঞ্চে গিয়ে আবার বরিশাল থেকে সন্ধ্যার লঞ্চেই ঢাকায় ফিরে আসা যাবে। কেউ থাকতে চাইলে বরিশাল শহরের হোটেলে থাকাই শ্রেয়। এখানে রয়েছে বিভিন্ন মানের হোটেল।কোথায় খাবেন
স্বরূপকাঠি-বানারীপাড়া-কুড়িয়ানায়
খাওয়া-দাওয়া সেরে নেওয়া যায়। মোটামুটি মানের রেস্তোরাঁ পাওয়া যাবে এসব
জায়গায়। ভীমরুলি বাজারের পথে আছে কিছু ভাসমান দোকান।
No comments