ভারতের কৌশল ধ্বংস করছে সার্ককে by ভিম ভুরতেল
জাতীয়তাবাদী
রাজনীতির ওপর ভর করে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছেন ভারতের
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি পাকিস্তানকে একঘরে
করতে রীতিমতো একরোখা হয়ে উঠছিলেন। আর এই দুই কারণেই সাউথ এশিয়ান
অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশন (সার্ক) এখন মৃতপ্রায়। তবে আলোচনায়
এসেছে বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেকটোরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড
ইকোনমিক কো-অপারেশন (বিমসটেক)। সার্কের সদস্য হলো আফগানিস্তান, বাংলাদেশ,
ভূটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা। এই অঞ্চলে বসবাস করে
প্রায় ১৮০ কোটি মানুষ। এই অঞ্চলের সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ ৫০
হাজার কোটি ডলার। জনতাত্বিক মুনাফার (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) দিক দিয়ে এই
অঞ্চল বিশ্বের সবচেয়ে গতিশীল অঞ্চল।
সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত দিক দিয়ে সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় অঞ্চল। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, সঙ্গীত ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিশ্বের সবচেয়ে অসংহত অঞ্চলগুলোর একটি দক্ষিণ এশিয়া।
২০০৬ সালে ভারতের নেতৃত্বে দক্ষিণ এশিয়া মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (সাফটা) স্বাক্ষরিত হয় এই অঞ্চলে বাণিজ্য উদারীকরণের উদ্দেশ্যে। কিন্তু ২০১৬ সাল নাগাদ এই অঞ্চলে শুল্ক হার শূন্যে নামিয়ে আনা ও সকল নন-ট্যারিফ প্রতিবন্ধকতা প্রত্যাহার করার যেই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছিল, তা অর্জিত হয়নি। সার্ক-কে দক্ষিণ এশিয়ার ইকোনমিক ইউনিয়ন হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য পূরণ হওয়া অনেক বাকি।
বিশ্বব্যাংকের মতে, এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের হার সম্মিলিত জিডিপির মাত্র ৫ শতাংশ। আন্তঃআঞ্চলিক বিনিয়োগ প্রবাহও অনেক কম। ইন্ডিয়া ও সার্কের মধ্যে গত বছর বাণিজ্য হয়েছে মাত্র ১৯০০ কোটি ডলারের। অথচ, বাকিবিশ্বের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৬৩৭৪০ কোটি ডলার। এখনও সার্কের অভ্যন্তরীন আমদানির ৫৩ শতাংশই ট্যারিফ, প্যারা ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফ প্রতিবন্ধকতার আওতায় পড়ে।
আঞ্চলিক সংহতির এই লক্ষ্য পূরণে সার্ক ব্যর্থ হলেও, এটি একটি আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিণত হয়েছে। এই সংস্থায় সদস্য রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ১৪টি চুক্তি ও রুলস অব প্রসিডিউর গৃহীত হয়েছে। ৭টি আঞ্চলিক কনভেনশন ও ১২টি আঞ্চলিক চুক্তি এই সংস্থায় গৃহীত হয়েছে।
বৈশ্বিক ক্ষমতা চায় ভারত
ভূটান, চীন ও ভারতের ত্রিমুখী মিলনকেন্দ্র দোকলামে ২০১৭ সালের গ্রীষ্মে চীন ও ভারতের মধ্যকার সামরিক অচলাবস্থার সময়, ভারতীয় কৌশলবিদরা টের পেলেন, বৈশ্বিক খেলোয়াড় হিসেবে নিজেদের কৌশলগত স্বাতর্ন্ত্যে ঘাটতি আছে ভারতের। এ স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠিত হয় হার্ড ও সফট পাওয়ারের মাধ্যমে, যেমনটা হার্ভার্ড অধ্যাপক জোসেফ নাই দেখিয়েছেন। রাজনীতি, কূটনীতি, অর্থনীতি, সামরিক বাহিনী ও প্রযুক্তি হলো হার্ড পাওয়ার। কিন্তু কোনো জোরাজুরি ছাড়াই বন্ধু বা মিত্রদেশকে একটি নীতিগত লক্ষ্যে রাজি করানোই হলো সফট পাওয়ার।
ভারতের নীতিনির্ধারকরা উপলব্ধি করলেন, হার্ড ও সফট পাওয়ারের মিশ্রণ ঘটাতে হয় একটি পরাক্রমশালী রাষ্ট্রের। আর ভারত ব্যপকভাবে এই দিক দিয়ে পিছিয়ে। ভারতীয় কৌশলবিদরা চীন-যুক্তরাষ্ট্র সুপারপাওয়ার দ্বন্দ্বের পরিবর্তনশীল প্রকৃতি নিয়ে সচেষ্ট। শীতল যুদ্ধের সময়কার পরিস্থিতির তুলনায়, এখনকার সুপারপাওয়ার দ্বন্দ্ব হয় নানামুখী। সুতরাং, নানামুখী কৌশল প্রয়োজন ভারতের।
বর্তমান অর্থনীতির আকার বিবেচনা করে ভারতের কৌশলবিদরা এই উপসংহারে পৌছেছেন যে, ভারতের পক্ষে হার্ড ও সফট পাওয়ার, উভয়ই পাওয়া সম্ভব নয়। মোদির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল গোপনে ঠিক এই বিষয়টিরই ইঙ্গিত দিয়েছেন নিজের সর্দার প্যাটেল স্মরণসভার বক্তৃতায়। ভারতীয় কৌশলবিদরা বৈশ্বায়নের কারণে অভুতপূর্ব ক্ষমতার প্রকৃতি সম্পর্কেও সচেতন। এসব বিবেচনা করেই মোদি পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্করকে বেছে নিয়েছেন। দোভালকে মন্ত্রী পদমর্যাদায় উন্নীত করেছেন। প্রথমজন লিবারেল বৈশ্বিক ধারা ও অন্যান্য আঞ্চলিক প্রচেষ্টা থেকে মুনাফা ঘরে তোলার চেষ্টা করবেন। আরেকজন বৈশ্বিক সুপারপাওয়ার ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত নানা বিষয়ে কথা বলবেন, যেন আগামী ১০ বছরে সবচেয়ে কম খরচে সর্বোচ্চ জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়।
অতীতে অন্যান্য অগ্রসরমান অর্থনীতির চেয়ে বৈশ্বিক বিষয় আসয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক কম বিনিয়োগ করতে হয়েছে চীনকে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা একবার নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেন, চীন বিনামূল্যে সব পেয়ে যাচ্ছে। পরে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত গ্লোবাল টাইমস পত্রিকার সম্পাদকীয়তে ওই বক্তব্যের সমালোচনা করা হয়। কিন্তু চীন সরকারীভাবে ওই কথার প্রতিবাদ করেনি।
চীন বৈশ্বিক মঞ্চে শক্ত অবস্থান জানান দিতে শুরু করে কেবল যখন দেশের অর্থনীতির আকার ১০ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌছালো। উদারনৈতিক বৈশ্বিক ধারার কারণে সৃষ্ট ইতিবাচক সুবিধাসমূহ সফলভাবে সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছে চীন। চীনের এই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি করতে চায় ভারত। যদিও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট এখন অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন, ভারত চায় সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) কারণে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে পৌঁছানোর জন্য এসসিও-কে ব্যবহার করতে চায় ভারত। এ কারণে এসসিও ফোরামে পাকিস্তানের সঙ্গে আছে ভারতও। ভারত মহাসাগরে নিজের স্বার্থরক্ষা এবং অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগের বিষয়টি মাথায় রেখে, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রেটজির অংশ কোয়াড্রিলাটেরাল সিকিউরিটি ডায়লগ (কোয়াড)-কে ব্যবহার করে ভারত। একইভাবে রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে ও আরআইসি (রাশিয়া, ইন্ডিয়া ও চায়না) ফোরামের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতে চায় দেশটি। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে অংশ না নিয়েই চীনের কাছ থেকে সহযোগিতা ও আংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে বিশেষ নজর কামনা করে ভারত। ভারতের ভারানসি নগরিতে অক্টোবরে অনুষ্ঠেয় অনানুষ্ঠানিক সম্মেলনে এই সহযোগিতার রূপরেখা চূড়ান্ত হতে পারে।
বিমসটেককে প্রাধান্য
বিমসটেক গঠিত হয়েছে ৭টি দেশকে নিয়ে। সার্কের ৫টি (বাংলাদেশ, ভূটান, ভারত, নেপাল ও শ্রীলংকা) এবং আসিয়ানের দুইটি দেশ নিয়ে (মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড)। এই অঞ্চল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি এই ৭ দেশে বসবাস করে। ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্মিলিত অর্থনীতি এই দেশগুলোর। আর বিশ্বের ২৫ শতাংশ বাণিজ্য পণ্য বঙ্গোপসাগর দিয়ে অতিবাহিত হয়।
ভারত সার্ককে অকার্যকর করতে যেই মূল বিষয়কে উদ্ধৃত করছে, তা হলো ভারতে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে পাকিস্তানের উৎসাহ দেওয়ার অভিযোগ। কিন্তু আরও যৌক্তিক কারণ হলো, ভারত হার্ড বা সফট পাওয়ারের দিক থেকে একটি আঞ্চলিক সংগঠনকে নেতৃত্ব দেওয়ার অবস্থায় নেই। ভারতের নেতৃত্বে সার্ক যেসব প্রতিষ্ঠান ও নিয়ম প্রতিষ্ঠা করেছে, তার পূর্ণ বাস্তবায়ন ভারতের পক্ষে আর্থিকভাবে সম্ভব নয়। তাই ভারত বিমসটেককে সার্কের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। আর এর কারণগুলো বেশ সোজসাপ্টা।
প্রথমত, ভারতের সঙ্গে বিমসটেক-ভুক্ত দেশগুলোর রয়েছে তুলনামূলকভাবে ভালো সম্পর্ক, যেটা পাকিস্তানের সঙ্গে নেই। দ্বিতীয়ত, বিমসটেক দেশগুলোর ক্ষেত্রে বিনামূল্যে মূনাফা তুলতে পারে ভারত, কারণ এই দলের সঙ্গে ভিড়লে অন্য কোনো মূল্য চুকাতে হবে না। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষিণ এশিয়া উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা অর্থাৎ এসএএসইসি প্রকল্পগুলোতে ইতিমধ্যে বিনিয়োগ করেছে। এই প্রকল্পগুলোর উদ্দেশ্য বিমসটেক দেশগুলোতে পরিবহণ ব্যবস্থা, বাণিজ্য সহজীকরণ, জ্বালানী উন্নয়ন, অর্থনৈতিক-করিডোর উন্নয়ন করা। এই অঞ্চলে ২০১৮ সালে সামগ্রিক উন্নয়ন হয়েছে ১১০০ কোটি ডলার। ২০২৬ সালের মধ্যে এসএএসইসি ১৩০০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে চায়।
তৃতীয়ত, বিমসটেক কেবল ৪টি ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদার করতে চায়। ভারতকে কেবল শুধু ভারতীয় এসএএসইসি প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে হবে। ফলে বিমসটেক ভারতের জন্য হাতের কাছে থাকা ফল।
মোদির সহযোগিরা চান এক পাথরে দুই পাখি মারতে। বিমসটেককে পররাষ্ট্রনীতি পরিকল্পনায় একীভূত করতে, ভারত সার্কে পাকিস্তানকে অপ্রাসঙ্গিক করতে চায়। তবে ভারত সার্ক-কেন্দ্রীক প্রতিষ্ঠান ও নিয়মনীতির ক্ষেত্রে নিজের আর্থিক ও রাজনৈতিক দায় এড়াতে চায়।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, ভারত যদি ভবিষ্যতে সুপারপাওয়ার হয়ে যায়, তাহলে সার্ক ও বিমসটেকের মতো আঞ্চলিক সংগঠনগুলো গুরুত্ব হারাবে ভারতের কাছে। তেমনি, সার্ক হারিয়ে গেলে, এই অঞ্চলের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি পাকিস্তানেরও আর্থিক দায় থাকবে না। নিজেকে আঞ্চলিক খেলোয়াড় হিসেবে প্রমাণ করতে যেই প্রতিষ্ঠান ও নিয়ম ভারত নিজে সৃষ্টি করেছে, তা এখন ভারতের জন্যই মাত্রাতিরিক্ত হয়ে উঠেছে। এ কারণেই ভবিষ্যতে সার্ককে পুনর্জ্জীবিত করার কোনো যৌক্তিক প্রণোদনা ভারতের জন্য নেই।
>>>(ভিম ভুরতেল নেপালের কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনীতি বিভাগের ভিজিটিং ফেলো। তার এই নিবন্ধ এশিয়ান টাইমস থেকে নেওয়া হয়েছে।)
সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত দিক দিয়ে সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় অঞ্চল। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, সঙ্গীত ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিশ্বের সবচেয়ে অসংহত অঞ্চলগুলোর একটি দক্ষিণ এশিয়া।
২০০৬ সালে ভারতের নেতৃত্বে দক্ষিণ এশিয়া মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (সাফটা) স্বাক্ষরিত হয় এই অঞ্চলে বাণিজ্য উদারীকরণের উদ্দেশ্যে। কিন্তু ২০১৬ সাল নাগাদ এই অঞ্চলে শুল্ক হার শূন্যে নামিয়ে আনা ও সকল নন-ট্যারিফ প্রতিবন্ধকতা প্রত্যাহার করার যেই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছিল, তা অর্জিত হয়নি। সার্ক-কে দক্ষিণ এশিয়ার ইকোনমিক ইউনিয়ন হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য পূরণ হওয়া অনেক বাকি।
বিশ্বব্যাংকের মতে, এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের হার সম্মিলিত জিডিপির মাত্র ৫ শতাংশ। আন্তঃআঞ্চলিক বিনিয়োগ প্রবাহও অনেক কম। ইন্ডিয়া ও সার্কের মধ্যে গত বছর বাণিজ্য হয়েছে মাত্র ১৯০০ কোটি ডলারের। অথচ, বাকিবিশ্বের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৬৩৭৪০ কোটি ডলার। এখনও সার্কের অভ্যন্তরীন আমদানির ৫৩ শতাংশই ট্যারিফ, প্যারা ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফ প্রতিবন্ধকতার আওতায় পড়ে।
আঞ্চলিক সংহতির এই লক্ষ্য পূরণে সার্ক ব্যর্থ হলেও, এটি একটি আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিণত হয়েছে। এই সংস্থায় সদস্য রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ১৪টি চুক্তি ও রুলস অব প্রসিডিউর গৃহীত হয়েছে। ৭টি আঞ্চলিক কনভেনশন ও ১২টি আঞ্চলিক চুক্তি এই সংস্থায় গৃহীত হয়েছে।
বৈশ্বিক ক্ষমতা চায় ভারত
ভূটান, চীন ও ভারতের ত্রিমুখী মিলনকেন্দ্র দোকলামে ২০১৭ সালের গ্রীষ্মে চীন ও ভারতের মধ্যকার সামরিক অচলাবস্থার সময়, ভারতীয় কৌশলবিদরা টের পেলেন, বৈশ্বিক খেলোয়াড় হিসেবে নিজেদের কৌশলগত স্বাতর্ন্ত্যে ঘাটতি আছে ভারতের। এ স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠিত হয় হার্ড ও সফট পাওয়ারের মাধ্যমে, যেমনটা হার্ভার্ড অধ্যাপক জোসেফ নাই দেখিয়েছেন। রাজনীতি, কূটনীতি, অর্থনীতি, সামরিক বাহিনী ও প্রযুক্তি হলো হার্ড পাওয়ার। কিন্তু কোনো জোরাজুরি ছাড়াই বন্ধু বা মিত্রদেশকে একটি নীতিগত লক্ষ্যে রাজি করানোই হলো সফট পাওয়ার।
ভারতের নীতিনির্ধারকরা উপলব্ধি করলেন, হার্ড ও সফট পাওয়ারের মিশ্রণ ঘটাতে হয় একটি পরাক্রমশালী রাষ্ট্রের। আর ভারত ব্যপকভাবে এই দিক দিয়ে পিছিয়ে। ভারতীয় কৌশলবিদরা চীন-যুক্তরাষ্ট্র সুপারপাওয়ার দ্বন্দ্বের পরিবর্তনশীল প্রকৃতি নিয়ে সচেষ্ট। শীতল যুদ্ধের সময়কার পরিস্থিতির তুলনায়, এখনকার সুপারপাওয়ার দ্বন্দ্ব হয় নানামুখী। সুতরাং, নানামুখী কৌশল প্রয়োজন ভারতের।
বর্তমান অর্থনীতির আকার বিবেচনা করে ভারতের কৌশলবিদরা এই উপসংহারে পৌছেছেন যে, ভারতের পক্ষে হার্ড ও সফট পাওয়ার, উভয়ই পাওয়া সম্ভব নয়। মোদির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল গোপনে ঠিক এই বিষয়টিরই ইঙ্গিত দিয়েছেন নিজের সর্দার প্যাটেল স্মরণসভার বক্তৃতায়। ভারতীয় কৌশলবিদরা বৈশ্বায়নের কারণে অভুতপূর্ব ক্ষমতার প্রকৃতি সম্পর্কেও সচেতন। এসব বিবেচনা করেই মোদি পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্করকে বেছে নিয়েছেন। দোভালকে মন্ত্রী পদমর্যাদায় উন্নীত করেছেন। প্রথমজন লিবারেল বৈশ্বিক ধারা ও অন্যান্য আঞ্চলিক প্রচেষ্টা থেকে মুনাফা ঘরে তোলার চেষ্টা করবেন। আরেকজন বৈশ্বিক সুপারপাওয়ার ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত নানা বিষয়ে কথা বলবেন, যেন আগামী ১০ বছরে সবচেয়ে কম খরচে সর্বোচ্চ জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়।
অতীতে অন্যান্য অগ্রসরমান অর্থনীতির চেয়ে বৈশ্বিক বিষয় আসয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক কম বিনিয়োগ করতে হয়েছে চীনকে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা একবার নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেন, চীন বিনামূল্যে সব পেয়ে যাচ্ছে। পরে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত গ্লোবাল টাইমস পত্রিকার সম্পাদকীয়তে ওই বক্তব্যের সমালোচনা করা হয়। কিন্তু চীন সরকারীভাবে ওই কথার প্রতিবাদ করেনি।
চীন বৈশ্বিক মঞ্চে শক্ত অবস্থান জানান দিতে শুরু করে কেবল যখন দেশের অর্থনীতির আকার ১০ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌছালো। উদারনৈতিক বৈশ্বিক ধারার কারণে সৃষ্ট ইতিবাচক সুবিধাসমূহ সফলভাবে সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছে চীন। চীনের এই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি করতে চায় ভারত। যদিও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট এখন অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন, ভারত চায় সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) কারণে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে পৌঁছানোর জন্য এসসিও-কে ব্যবহার করতে চায় ভারত। এ কারণে এসসিও ফোরামে পাকিস্তানের সঙ্গে আছে ভারতও। ভারত মহাসাগরে নিজের স্বার্থরক্ষা এবং অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগের বিষয়টি মাথায় রেখে, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রেটজির অংশ কোয়াড্রিলাটেরাল সিকিউরিটি ডায়লগ (কোয়াড)-কে ব্যবহার করে ভারত। একইভাবে রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে ও আরআইসি (রাশিয়া, ইন্ডিয়া ও চায়না) ফোরামের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতে চায় দেশটি। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে অংশ না নিয়েই চীনের কাছ থেকে সহযোগিতা ও আংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে বিশেষ নজর কামনা করে ভারত। ভারতের ভারানসি নগরিতে অক্টোবরে অনুষ্ঠেয় অনানুষ্ঠানিক সম্মেলনে এই সহযোগিতার রূপরেখা চূড়ান্ত হতে পারে।
বিমসটেককে প্রাধান্য
বিমসটেক গঠিত হয়েছে ৭টি দেশকে নিয়ে। সার্কের ৫টি (বাংলাদেশ, ভূটান, ভারত, নেপাল ও শ্রীলংকা) এবং আসিয়ানের দুইটি দেশ নিয়ে (মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড)। এই অঞ্চল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি এই ৭ দেশে বসবাস করে। ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্মিলিত অর্থনীতি এই দেশগুলোর। আর বিশ্বের ২৫ শতাংশ বাণিজ্য পণ্য বঙ্গোপসাগর দিয়ে অতিবাহিত হয়।
ভারত সার্ককে অকার্যকর করতে যেই মূল বিষয়কে উদ্ধৃত করছে, তা হলো ভারতে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে পাকিস্তানের উৎসাহ দেওয়ার অভিযোগ। কিন্তু আরও যৌক্তিক কারণ হলো, ভারত হার্ড বা সফট পাওয়ারের দিক থেকে একটি আঞ্চলিক সংগঠনকে নেতৃত্ব দেওয়ার অবস্থায় নেই। ভারতের নেতৃত্বে সার্ক যেসব প্রতিষ্ঠান ও নিয়ম প্রতিষ্ঠা করেছে, তার পূর্ণ বাস্তবায়ন ভারতের পক্ষে আর্থিকভাবে সম্ভব নয়। তাই ভারত বিমসটেককে সার্কের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। আর এর কারণগুলো বেশ সোজসাপ্টা।
প্রথমত, ভারতের সঙ্গে বিমসটেক-ভুক্ত দেশগুলোর রয়েছে তুলনামূলকভাবে ভালো সম্পর্ক, যেটা পাকিস্তানের সঙ্গে নেই। দ্বিতীয়ত, বিমসটেক দেশগুলোর ক্ষেত্রে বিনামূল্যে মূনাফা তুলতে পারে ভারত, কারণ এই দলের সঙ্গে ভিড়লে অন্য কোনো মূল্য চুকাতে হবে না। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষিণ এশিয়া উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা অর্থাৎ এসএএসইসি প্রকল্পগুলোতে ইতিমধ্যে বিনিয়োগ করেছে। এই প্রকল্পগুলোর উদ্দেশ্য বিমসটেক দেশগুলোতে পরিবহণ ব্যবস্থা, বাণিজ্য সহজীকরণ, জ্বালানী উন্নয়ন, অর্থনৈতিক-করিডোর উন্নয়ন করা। এই অঞ্চলে ২০১৮ সালে সামগ্রিক উন্নয়ন হয়েছে ১১০০ কোটি ডলার। ২০২৬ সালের মধ্যে এসএএসইসি ১৩০০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে চায়।
তৃতীয়ত, বিমসটেক কেবল ৪টি ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদার করতে চায়। ভারতকে কেবল শুধু ভারতীয় এসএএসইসি প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে হবে। ফলে বিমসটেক ভারতের জন্য হাতের কাছে থাকা ফল।
মোদির সহযোগিরা চান এক পাথরে দুই পাখি মারতে। বিমসটেককে পররাষ্ট্রনীতি পরিকল্পনায় একীভূত করতে, ভারত সার্কে পাকিস্তানকে অপ্রাসঙ্গিক করতে চায়। তবে ভারত সার্ক-কেন্দ্রীক প্রতিষ্ঠান ও নিয়মনীতির ক্ষেত্রে নিজের আর্থিক ও রাজনৈতিক দায় এড়াতে চায়।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, ভারত যদি ভবিষ্যতে সুপারপাওয়ার হয়ে যায়, তাহলে সার্ক ও বিমসটেকের মতো আঞ্চলিক সংগঠনগুলো গুরুত্ব হারাবে ভারতের কাছে। তেমনি, সার্ক হারিয়ে গেলে, এই অঞ্চলের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি পাকিস্তানেরও আর্থিক দায় থাকবে না। নিজেকে আঞ্চলিক খেলোয়াড় হিসেবে প্রমাণ করতে যেই প্রতিষ্ঠান ও নিয়ম ভারত নিজে সৃষ্টি করেছে, তা এখন ভারতের জন্যই মাত্রাতিরিক্ত হয়ে উঠেছে। এ কারণেই ভবিষ্যতে সার্ককে পুনর্জ্জীবিত করার কোনো যৌক্তিক প্রণোদনা ভারতের জন্য নেই।
>>>(ভিম ভুরতেল নেপালের কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনীতি বিভাগের ভিজিটিং ফেলো। তার এই নিবন্ধ এশিয়ান টাইমস থেকে নেওয়া হয়েছে।)
No comments