বাংলার ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের বড় কারণ ব্রিটিশ সরকারের নীতি
বাংলার ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ (ফাইল ছবি) |
১৮৭৩ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত হওয়া ৬টি দুর্ভিক্ষের সময়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু সংক্রান্ত তথ্যের ভিত্তিতে ওই গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে। কোন দুর্ভিক্ষের সময় মাটির আর্দ্রতার পরিমাণ কেমন ছিল, গবেষকরা তার ভিত্তিতেই তাদের সিদ্ধান্ত টেনেছেন। দেখা গেছে, ওই ৬ দুর্ভিক্ষের ৫টির প্রধান কারণ মাটির আদ্রতার পরিমাণ ভয়াবহভাবে কমে যাওয়া। ১৮৯৬-৯৭ সালে উত্তর ভারতে আদ্রতার পরিমাণ ১১ শতাংশ কমে যে খাদ্য সংকট হয়েছিল, তাতে প্রাণ হারিয়েছিল ৫০ লাখ মানুষ।
তবে ওই গবেষণার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের প্রধান কারণ খরা নয়। দুর্ভিক্ষের তিন বছর আগেই ভারতের পূর্বাঞ্চল ১৯৪০ সালের বেশিরভাগ সময় ছিল খরার কবলে, ১৯৪১ সালে এসে অবস্থা ভয়াবহ রূপ নেয়। পত্রিকাগুলো তখন উপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের নিষেধাজ্ঞা ভেঙে পত্রিকার পাতায় ছাপতে শুরু করে কলকাতার রাস্তায় পড়ে থাকা না খেয়ে মরা মানুষের ছবি। তবে যে বছর ওই দুর্ভিক্ষ প্রবল আকার নেয় বলে প্রচলিত আছে, সেই ১৯৪৩ সালে গড়পড়তা বৃষ্টির পরিমাণ স্বাভাবিকই ছিল।
গান্ধীনগরের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনলজির অধ্যাপক ও এই গবেষণার প্রধান গবেষক বিমল মিশ্র ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে বলেছেন, জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটার নামের সাময়িকীতে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, এটা ছিল এক অভাবনীয় দুর্ভিক্ষ; এর জন্য বৃষ্টিপাত কম হওয়া যতোটা দায়ী, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী সরকারি নীতির ব্যর্থতা। ওই গবেষণা অনুযায়ী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ফসলে পোকার আক্রমণের বিস্তৃতির পাশাপাশি আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিয়ানমার ব্রিটিশদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার কারণে সরবরাহ ব্যবস্থায় তীব্র ধস নেমেছিল, দুর্ভিক্ষের বড় কারণ সেটাই।
অবশ্য ভারতের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতামত ভিন্ন। তিনি ১৯৮১ সালে বলেছিলেন, দুর্ভিক্ষের সময়ও বাংলা অঞ্চলে পর্যাপ্ত খাদ্যের যোগান ছিল। যুদ্ধকালিন মুদ্রাস্ফীতি আর ফটকা ক্রেতা ও মজুদদারদের দৌরত্বের কারণে খাদ্যের দাম গরীব মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে গিয়েছিল। ‘চার্চিলস এম্পায়ার’ নামে বইয়ের লেখক রিচার্ড টয়ীও মনে করেন, বাংলার এই দুর্ভিক্ষ চার্চিলের জীবনের সবচেয়ে খারাপ রেকর্ডগুলোর একটি। তার মতে, “ইউরোপে জার্মানির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তখন তিনি এতই ব্যস্ত যে বাংলার এই দুর্ভিক্ষ নিয়ে লোকজন তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেও তিনি এটাকে পাত্তা দেননি।”
এদিকে জার্মানিবাসী বাঙালি মধুশ্রী মুখার্জি সহযোগীদের নিয়ে ৭ বছর ধরে অজানা অনেক নথিপত্র ঘেঁটে ২০১০ সালে একটি বই লেখেন, যার নাম ‘চার্চিলস সিক্রেট ওয়ার' বা ‘চার্চিলের গোপন যুদ্ধ'৷ তাদের দাবি, চার্চিল নিজে সরাসরি বাংলার মন্বন্তরের জন্য দায়ী ছিলেন৷ বাংলায় যখন খাদ্য সংকট চলছে, সেটা মোকাবেলায় তিনি কোনও পদক্ষেপই নেন নি। বরং তার যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা ইউরোপের বেসামরিক মানুষদের জন্য খাদ্য মওজুদ গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছে। ভারতে যখন খাদ্যের অভাবে মানুষ মরছে, তখন তার পাশ দিয়েই অস্ট্রেলিয়া থেকে এক লাখ সত্তর হাজার গম বহনকারী জাহাজ গেছে ইউরোপে।বাংলায় ত্রাণ সাহায্য পাঠানোর হাজার আবেদন সত্ত্বেও তিনি সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সেই কাজ করতে দেন নি৷ এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া ত্রাণ পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া সত্ত্বেও চার্চিল ও তাঁর মন্ত্রীরা সেই অনুমতি দেন নি৷
বাংলার ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় কলকাতায় ত্রাণ বিতরণ |
No comments