দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ (প্রথম পর্ব) by পল স্ট্যানিল্যান্ড
১৪ই
নভেম্বর শ্রীলংকার পার্লামেন্টে সংঘাতময় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। স্পিকার
যখন ভোট আহ্বান করার চেষ্টা করেন তখন একদল এমপি তার দিকে ধাবিত হতে থাকেন
এবং দ্রুতগতিতে এগিয়ে যান। এ সময় প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপটি তাদের পিছনে
ফেরানোর জন্য ধাক্কা দিতে থাকেন। এর মধ্যে ঘুষাঘুষি শুরু হয়। একজন একটি
ছুরি নাচাতে থাকেন। একজন এমপি বিচ্ছিন্ন হয়ে স্পিকারের মাইক্রোফোন চুরি
করার চেষ্টা করেন। ফল হিসেবে তার স্থান হয় হাসপাতালে।
অক্টোবরে সৃষ্ট সাংবিধানিক সংকটের ফল হলো এই বিশৃঙ্খলা।
ওই অক্টোবরে দেশটির প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহকে বরখাস্ত করেন এবং তার স্থলাভিষিক করেন সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ রাজাপাকসে-কে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন এমপি ও নাগরিকরা। উল্টো সিরিসেনা পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করেন। তবে তার এ উদ্যোগকে সুপ্রিম কোর্ট থেকে অসাংবিধানিক হিসেবে আখ্যায়িত না করা পর্যন্ত পার্লামেন্ট বিলুপ্তির নির্দেশ বহাল থাকে।
অন্যদিকে রাজাপাকসে-কে পার্লামেন্ট প্রত্যাখ্যান করে। তবে তিনি পদ থেকে সরে যেতে অস্বীকৃতি জানান। এই অচলাবস্থার অবসান হয় গত ডিসেম্বরে। এ সময়ে সিরিসেনা তার হাতে বরখাস্ত হওয়া প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহকে পুনর্বহাল করতে বাধ্য হন। বিচার বিভাগ ও পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠদের সমন্বিত দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তা করতে বাধ্য হন।
দক্ষিণ এশিয়ার পুরনো গণতন্ত্রের একটি দেশ শ্রীলংকা। অতি সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত কখনো এমন অস্থিতিশীল অবস্থা সেখানে দেখা যায়নি। দেশটি ছিল নিরাপদ। দেশটিতে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের অবসান হয় ২০০৯ সালে। ২০১৫ সালে যে নির্বাচন হয় তাকে দেখা হয় উদারীকরণের এক নতুন বার্তা হিসেবে। কিন্তু গণতন্ত্রকে দেখে যতটা লাভবান বলে মনে হয়েছে তার চেয়ে কমই নিরাপদ থেকেছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীলংকা হলো দক্ষিণ এশিয়ার অন্যদের থেকে আলাদা। কিছু কিছু পরিমাপের দিক দিয়ে, কয়েক দশকে যেমনটা ছিল তার চেয়ে এ অঞ্চলটি অধিকতর স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক। সহিংসতা ও অসন্তোষ কমে এসেছে।
রাজপথ ত্যাগ করেছে সেনাবাহিনী। তারা ফিরে গেছে ব্যারাকে। বড় বড় বিদ্রোহকে নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। আঞ্চলিকতা হিসেবে, প্রতি বছরে গড়ে শতকরা প্রায় ৭ ভাগ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে দক্ষিণ এশিয়া। নিকট অতীতে কট্টরপন্থি সামরিক স্বৈরশাসকরা শাসন করেছে বর্তমানের বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও পাকিস্তানের মতো দেশকে। তারা এখন অন্তত আনুষ্ঠানিকভাবে গণতান্ত্রিক।
কিন্তু অশান্ত পরিস্থিতির বড় বড় সব উৎসের ওপর দৃশ্যত এই শান্ত পরিস্থিতি মুখোশ সৃষ্টি করেছে। জাতি ও ধর্মীয় উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোকে আক্রমণ করে ভোটে জয় পাওয়ার চেষ্টা করছেন রাজনীতিকরা।
অন্যদিকে পর্দার আড়ালে ওঁত পেতে আছে সেনাবাহিনী। দক্ষিণ এশিয়ার অভিজ্ঞতা বলে, এখানে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা মসৃণ নয় অথবা সমতার ভিত্তিতে অপসৃত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাউকে কাউকে ক্ষমতায়ন করা হয় অন্যদের দমন করার মাধ্যমে। সংস্কার থেকে সৃষ্টি হয় নতুন সংঘাত। মুক্ত রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা জনগণকে কথা বলার সুযোগ এনে দেয়। কিন্তু তাদের বক্তব্য হতে পারে গভীরভাবে অনুদার। ধারাবাহিকতার নির্বাচন রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করে না। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক গতিবিধি বলে দেয়, উদার গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে সুযোগকে কুক্ষিগত করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যখন তা নির্ধারণ করার আগে নিজেদের প্রকাশ করে এবং বড় ধরনের বিপদের মুখোমুখি পড়ে।
সংকটের উৎস
শ্রীলংকার সংকটের শিকড় নিহিত রয়েছে রাজাপাকসের প্রেসিডেন্সির ভিতরে। তার এই প্রেসিডেন্সি দ্বিতীয় মেয়াদে অংশত হয়ে উঠেছিল কর্তৃত্বপরায়ণ। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে স্বাধীনতাকামী লিবারেশন টাইগারস অব তামিল এলম-এর (যারা তামিল টাইগারস হিসেবে বেশি পরিচিত) সঙ্গে চলমান রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের ইতি ঘটান রাজাপাকসে ২০০৯ সালে। ২০১০ সালের নির্বাচনে তিনি ভূমিধস বিজয় নিয়ে নতুন করে বিজয়ী হন। পরিবার ও তার শ্রীলংকা ফ্রিডম পার্টি (এসএলএফপি) কে নিয়ে তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে যান। প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার বিস্তার ঘটান। ঘনিষ্ঠ হন চীনের। মিডিয়ার রিপোর্টে, রাজাপাকসে ও তার মিত্রদের দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে বিশ্বাসযোগ্যভাবে সম্পর্কযুক্ত করে।
সিরিসেনা ছিলেন এসএলএফপির সদস্য। কিন্তু ২০১৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অপ্রত্যাশিতভাবে তিনি পক্ষ ত্যাগ করেন রাজাপাকসে-কে চ্যালেঞ্জ জানাতে। ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি) ও অন্য বিরোধী দলগুলোর সমর্থনে সিরিসেনা বিস্ময়কর এক বিজয় অর্জন করেন। ওই বছরে পার্লামেন্ট নির্বাচনের পরে ইউএনপির নেতা রনিল বিক্রমাসিংহে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবির্ভূত হন। এর ফলে এমন একটি ক্ষেত্র সৃষ্টি হয় যেখানে সিরিসেনা ও বিক্রমাসিংহে মিলে উচ্চাকাক্সক্ষী সংস্কারমূলক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবেন। তাদের লক্ষ্য নির্বাহী ক্ষমতাকে কমিয়ে আনা এবং গৃহযুদ্ধের বিষয়গুলোতে দৃষ্টি দেয়া।
এসব এজেন্ডার কিছুটা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করেছে সরকার। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাজাপাকসে ক্ষমতার যে বিস্তার ঘটিয়েছিলেন তাকে সীমিত করা হয়। কিন্তু সিরিসেনা ও বিক্রমাসিংহে নিজেদের একত্রিত একটি টিম হিসেবে প্রমাণ দিতে পারেননি। এতে সংস্কার স্থবির হয়ে পড়ে। গত বছরের শুরুতে যখন স্থানীয় নির্বাচন হয় শ্রীলংকায় তখন রাজাপাকসের দল নতুন করে যাত্রা শুরু করে শ্রীলঙ্কা পোদুজানা পেরামুনা নামে এবং নির্বাচনে তারা বিজয়ী হয়। রাজাপাকসের এই উত্থানে সিরিসেনা ও বিক্রমাসিংহের মধ্যকার সম্পর্কে অবনতি ঘটে। তারই ধারাবাহিকতায় ২৬শে অক্টোবর বিক্রমাসিংহকে বরখাস্ত করেন সিরিসেনা এবং নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন মাহিন্দ রাজাপাকসে-কে।
সিরিসেনা একই সঙ্গে বিপুলপ্ত করেন পার্লামেন্ট। তিন সপ্তাহের মধ্যে তার সেই সিদ্ধান্তকে স্থগিত করেন সুপ্রিম কোর্ট। অপ্রতিরোধ্যভাবে সিরিসেনা ও রাজাপাকসে একত্রিত হয়ে জোট বাঁধেন। তাদের উদ্দেশ্য, পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাজাপাকসে-কে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অনুমোদন করা। কিন্তু লোভনীয় প্রস্তাব ও পার্লামেন্টে নিজ পক্ষের এমপিদের পক্ষত্যাগের ফলে বিক্রমাসিংহের পক্ষে চলে আসেন বেশির ভাগ। বরখাস্ত হওয়ার পর থেকেই প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছিলেন রণিল বিক্রমাসিংহে। ওদিকে ক্ষমতাকে সিরিসেনা ও রাজাপাকসে কুক্ষিগত করার বিরুদ্ধে রনিল বিক্রমাসিংহের প্রতি রাজপথে জনতার সমর্থন বাড়তে থাকে। তার বাসভবনের বাইরে অবস্থান নিতে থাকে বিপুলসংখ্যক মানুষ।
দেশটিতে এই অচলাবস্থা অব্যাহত থাকে কমপক্ষে ৬ সপ্তাহ।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখাতে সক্ষম হননি রাজাপাকসে। ফলে বাধ্য হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখানোর জন্য ২০১৯ সালে নতুন নির্বাচন ঘোষণা দিয়ে বসেন সিরিসেনা। চূড়ান্ত পেরেকটি ১৩ই ডিসেম্বর ঠুকে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয় সিরিসেনার বিরুদ্ধে। এর ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রনিল বিক্রমাসিংহেকে স্বীকৃতি দেন তিনি। যদিও সেখানে সংকটের তাৎক্ষণিক সমাধান হয়েছে, তবৃও শ্রীলংকার গণতন্ত্রের গভীর এক বিপন্নতা ফুটে উঠেছে, যা শিগগিরই দূরে যাবে বলে মনে হয় না।
জাতি ও জাতীয়তাবাদের বিপদ
শ্রীলংকা জাতিগত অস্থিরতার রাজনৈতিক সংকটের ভিতর নিমজ্জিত ছিল। এই অস্থিরতা দেশটিকে পঞ্চাশের দশক থেকে মহামারীর মতো জেঁকে ধরেছিল। রাজাপাকসে সিনহলিজ বৌদ্ধ জাতিদের জাতীয়তাবাদের পক্ষে শক্তিশালী অবস্থান নেন। এই গ্রুপটি জাতিগত সহিংসতার কেন্দ্রীয় চরিত্রে ভূমিকা রেখেছে। অতি সাম্প্রতিক সংকট নিয়ে যারা সমালোচনা করেন তাদের আক্রমণ করতে এই কার্ডটি ব্যবহার করেন রাজাপাকসে ও তার সমর্থকরা। তারা যুক্তি দেখান, বিক্রমাসিংহে বিদেশি (প্রধানত পশ্চিমাদের) প্রভাব ও বাইরের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করেন। এই রকম সমস্যা শ্রীলংকার বাইরে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। জাতি ও ধর্মীয় উত্তেজনা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য গণতন্ত্রেও এক আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে।
যদিও নির্বাচন হলো এখন এই উপমহাদেশজুড়ে এক নতুন রুটিন, প্রায়ই তা অবাধ ও সুষ্ঠু হয়। তবু রয়ে গেছে জাতিগত ও ধর্মীয় বিষয়গুলো প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতি কখনো কখনো পরিচালিত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ-সংখ্যালঘিষ্ঠ জটিলতা দিয়ে: তাদের দেশে বিপুল পরিমাণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রতিনিধিত্ব করা সত্ত্বেও রাজনীতিক ও নেতাকর্মীরা যুক্তি দেখান, পালাবদলের ভয়ানক সব প্রভাব, দীর্ঘমেয়াদি জনসংখ্যাতত্ত্বের পরিবর্তন, দুর্নীতি ও অভিজাত শ্রেণির অসাধুতা তাদের গ্রুপের ক্ষমতাকে খর্ব করছে। পশ্চিমা পপুলিস্ট বা জনপ্রিয়দের মতো, তারা দাবি করেন, এসব হুমকি বা বিপদ থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রুপগুলোকে তারা নিজেরাই সুরক্ষা দিতে পারেন, যখন এসব গ্রুপ এমনিতেই প্রাধান্য বিস্তার করে।
এই কৌশল একটি নির্বাচনী বিজয়ীর জন্য প্রমাণিত। ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি একটি রাজনৈতিক ‘মেশিন’ তৈরি করেছে, যেটা তাদের ২০১৪ সালের চূড়ান্ত বিজয় এনে দেয় নাটকীয়তার সঙ্গে। এতে তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা রাজ্যের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ রাজ্য নির্বাচনগুলোতে খুব দুর্বল পারফরমেন্স করলেও ২০১৯ সালে সেখানে জাতীয় নির্বাচনে এখনও বিজেপি জনপ্রিয় হিসেবে রয়েছে। ভারতের রাজনীতিতে শক্তিশালী বিষয় হয়ে আছে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা। এখনও অনেক ভারতীয় আছেন, যারা এ ধারণার সঙ্গে নেই তবু সাম্প্রতিক সময়ে নাটকীয়তার সঙ্গে হিন্দুদের পক্ষে গেছে অনেক কিছু। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কাঞ্চন চন্দ্র যেমনটা বলেছেন, হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের মধ্যেই ভারতের ধারণাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক সংকটের আগে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ ছিল তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে।
এর মূল নিহিত ছিল হলো সিনহলিজ বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের উত্থান, যা রাজনীতিতে একটি উত্তেজনা সৃষ্টি করে। তা এখনো এই দ্বীপরাষ্ট্রের গভীরে প্রভাব রাখে। দেশটিতে সিংহলিজ দুটি প্রধান দল বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে প্রশংসিত করার মাধ্যমে একে অন্যকে অতিক্রম করার চেষ্টা করেছে। চেষ্টা করা হয়েছে, শ্রীলংকার তামিল ও মুসলিম সংখ্যালঘুদের থেকে শ্রীলংকার রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সীমিত করতে। ২০১৫ সালে শ্রীলংকায় যে নির্বাচন হয় তাতে এমন জাতিগত উত্তেজনা মিটিয়ে ফেলার একটি সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু সিংহলিজ জাতীয়তাবাদীরা এমন সুযোগকে অবজ্ঞা করেছে, এতে সংস্কারমূলক এজেন্ডা ক্রমাগত ধ্বংস হয়েছে।
সম্ভবত দক্ষিণ এশিয়ায় জাতি-জাতীয়তাবাদ নিয়ে সবচেয়ে নাটকীয় ঘটেছে তা মিয়ানমারের উদারীকরণকে পশ্চাতে ঠেলে দেয়া। রাখাইনে মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর তার দেশের সেনাবাহিনী যে নৃশংসতা চালিয়েছে তার নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে বহু আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মিয়ানমারের মূল নেত্রী অং সান সুচির ওপর তিক্ত হতাশা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সূচি যে অবস্থান নিেেছন তাতে জনগণের সেন্টিমেন্ট প্রতিফলিত হয়েছে। মিয়ানমারের বহু মানুষ, এমনকি তারাও, যারা আগে সেনাবাহিনীর বিরোধিতা করতেন তারাও রোহিঙ্গা বিরোধী কঠোর নীতিকে সমর্থন করছেন। মিয়ানমারে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন ২০২০ সালে।
সম্ভবত ওই নির্বাচনটি হবে অং সান সূচির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি এবং এর প্রধান বিরোধী দল, সেনাবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির মধ্যে। তারা সবাই বার্মার জাতি-জাতীয়তাবাদের মর্মমূলে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করছে। মিয়ানমারে নির্বাচনী যে গণতন্ত্রের উত্থান ঘটেছে তাতে মেজরিটারিয়ানিজমের সমর্থকদের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এতে রয়েছে রাজনীতিবিদ থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষু, সামাজিক যোগাযোগ মিডিয়ার ব্যবহারকারী। তারা রোহিঙ্গাদের দেখে থাকে বহিরাগত হিসেবে, যাদের দেশ থেকে নির্মূল করে দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করে তারা।
(পাকিস্তানের অনলাইন ডেইলি টাইমসে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ)
অক্টোবরে সৃষ্ট সাংবিধানিক সংকটের ফল হলো এই বিশৃঙ্খলা।
ওই অক্টোবরে দেশটির প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহকে বরখাস্ত করেন এবং তার স্থলাভিষিক করেন সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ রাজাপাকসে-কে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন এমপি ও নাগরিকরা। উল্টো সিরিসেনা পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করেন। তবে তার এ উদ্যোগকে সুপ্রিম কোর্ট থেকে অসাংবিধানিক হিসেবে আখ্যায়িত না করা পর্যন্ত পার্লামেন্ট বিলুপ্তির নির্দেশ বহাল থাকে।
অন্যদিকে রাজাপাকসে-কে পার্লামেন্ট প্রত্যাখ্যান করে। তবে তিনি পদ থেকে সরে যেতে অস্বীকৃতি জানান। এই অচলাবস্থার অবসান হয় গত ডিসেম্বরে। এ সময়ে সিরিসেনা তার হাতে বরখাস্ত হওয়া প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহকে পুনর্বহাল করতে বাধ্য হন। বিচার বিভাগ ও পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠদের সমন্বিত দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তা করতে বাধ্য হন।
দক্ষিণ এশিয়ার পুরনো গণতন্ত্রের একটি দেশ শ্রীলংকা। অতি সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত কখনো এমন অস্থিতিশীল অবস্থা সেখানে দেখা যায়নি। দেশটি ছিল নিরাপদ। দেশটিতে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের অবসান হয় ২০০৯ সালে। ২০১৫ সালে যে নির্বাচন হয় তাকে দেখা হয় উদারীকরণের এক নতুন বার্তা হিসেবে। কিন্তু গণতন্ত্রকে দেখে যতটা লাভবান বলে মনে হয়েছে তার চেয়ে কমই নিরাপদ থেকেছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীলংকা হলো দক্ষিণ এশিয়ার অন্যদের থেকে আলাদা। কিছু কিছু পরিমাপের দিক দিয়ে, কয়েক দশকে যেমনটা ছিল তার চেয়ে এ অঞ্চলটি অধিকতর স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক। সহিংসতা ও অসন্তোষ কমে এসেছে।
রাজপথ ত্যাগ করেছে সেনাবাহিনী। তারা ফিরে গেছে ব্যারাকে। বড় বড় বিদ্রোহকে নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। আঞ্চলিকতা হিসেবে, প্রতি বছরে গড়ে শতকরা প্রায় ৭ ভাগ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে দক্ষিণ এশিয়া। নিকট অতীতে কট্টরপন্থি সামরিক স্বৈরশাসকরা শাসন করেছে বর্তমানের বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও পাকিস্তানের মতো দেশকে। তারা এখন অন্তত আনুষ্ঠানিকভাবে গণতান্ত্রিক।
কিন্তু অশান্ত পরিস্থিতির বড় বড় সব উৎসের ওপর দৃশ্যত এই শান্ত পরিস্থিতি মুখোশ সৃষ্টি করেছে। জাতি ও ধর্মীয় উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোকে আক্রমণ করে ভোটে জয় পাওয়ার চেষ্টা করছেন রাজনীতিকরা।
অন্যদিকে পর্দার আড়ালে ওঁত পেতে আছে সেনাবাহিনী। দক্ষিণ এশিয়ার অভিজ্ঞতা বলে, এখানে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা মসৃণ নয় অথবা সমতার ভিত্তিতে অপসৃত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাউকে কাউকে ক্ষমতায়ন করা হয় অন্যদের দমন করার মাধ্যমে। সংস্কার থেকে সৃষ্টি হয় নতুন সংঘাত। মুক্ত রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা জনগণকে কথা বলার সুযোগ এনে দেয়। কিন্তু তাদের বক্তব্য হতে পারে গভীরভাবে অনুদার। ধারাবাহিকতার নির্বাচন রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করে না। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক গতিবিধি বলে দেয়, উদার গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে সুযোগকে কুক্ষিগত করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যখন তা নির্ধারণ করার আগে নিজেদের প্রকাশ করে এবং বড় ধরনের বিপদের মুখোমুখি পড়ে।
সংকটের উৎস
শ্রীলংকার সংকটের শিকড় নিহিত রয়েছে রাজাপাকসের প্রেসিডেন্সির ভিতরে। তার এই প্রেসিডেন্সি দ্বিতীয় মেয়াদে অংশত হয়ে উঠেছিল কর্তৃত্বপরায়ণ। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে স্বাধীনতাকামী লিবারেশন টাইগারস অব তামিল এলম-এর (যারা তামিল টাইগারস হিসেবে বেশি পরিচিত) সঙ্গে চলমান রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের ইতি ঘটান রাজাপাকসে ২০০৯ সালে। ২০১০ সালের নির্বাচনে তিনি ভূমিধস বিজয় নিয়ে নতুন করে বিজয়ী হন। পরিবার ও তার শ্রীলংকা ফ্রিডম পার্টি (এসএলএফপি) কে নিয়ে তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে যান। প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার বিস্তার ঘটান। ঘনিষ্ঠ হন চীনের। মিডিয়ার রিপোর্টে, রাজাপাকসে ও তার মিত্রদের দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে বিশ্বাসযোগ্যভাবে সম্পর্কযুক্ত করে।
সিরিসেনা ছিলেন এসএলএফপির সদস্য। কিন্তু ২০১৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অপ্রত্যাশিতভাবে তিনি পক্ষ ত্যাগ করেন রাজাপাকসে-কে চ্যালেঞ্জ জানাতে। ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি) ও অন্য বিরোধী দলগুলোর সমর্থনে সিরিসেনা বিস্ময়কর এক বিজয় অর্জন করেন। ওই বছরে পার্লামেন্ট নির্বাচনের পরে ইউএনপির নেতা রনিল বিক্রমাসিংহে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবির্ভূত হন। এর ফলে এমন একটি ক্ষেত্র সৃষ্টি হয় যেখানে সিরিসেনা ও বিক্রমাসিংহে মিলে উচ্চাকাক্সক্ষী সংস্কারমূলক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবেন। তাদের লক্ষ্য নির্বাহী ক্ষমতাকে কমিয়ে আনা এবং গৃহযুদ্ধের বিষয়গুলোতে দৃষ্টি দেয়া।
এসব এজেন্ডার কিছুটা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করেছে সরকার। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাজাপাকসে ক্ষমতার যে বিস্তার ঘটিয়েছিলেন তাকে সীমিত করা হয়। কিন্তু সিরিসেনা ও বিক্রমাসিংহে নিজেদের একত্রিত একটি টিম হিসেবে প্রমাণ দিতে পারেননি। এতে সংস্কার স্থবির হয়ে পড়ে। গত বছরের শুরুতে যখন স্থানীয় নির্বাচন হয় শ্রীলংকায় তখন রাজাপাকসের দল নতুন করে যাত্রা শুরু করে শ্রীলঙ্কা পোদুজানা পেরামুনা নামে এবং নির্বাচনে তারা বিজয়ী হয়। রাজাপাকসের এই উত্থানে সিরিসেনা ও বিক্রমাসিংহের মধ্যকার সম্পর্কে অবনতি ঘটে। তারই ধারাবাহিকতায় ২৬শে অক্টোবর বিক্রমাসিংহকে বরখাস্ত করেন সিরিসেনা এবং নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন মাহিন্দ রাজাপাকসে-কে।
সিরিসেনা একই সঙ্গে বিপুলপ্ত করেন পার্লামেন্ট। তিন সপ্তাহের মধ্যে তার সেই সিদ্ধান্তকে স্থগিত করেন সুপ্রিম কোর্ট। অপ্রতিরোধ্যভাবে সিরিসেনা ও রাজাপাকসে একত্রিত হয়ে জোট বাঁধেন। তাদের উদ্দেশ্য, পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাজাপাকসে-কে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অনুমোদন করা। কিন্তু লোভনীয় প্রস্তাব ও পার্লামেন্টে নিজ পক্ষের এমপিদের পক্ষত্যাগের ফলে বিক্রমাসিংহের পক্ষে চলে আসেন বেশির ভাগ। বরখাস্ত হওয়ার পর থেকেই প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছিলেন রণিল বিক্রমাসিংহে। ওদিকে ক্ষমতাকে সিরিসেনা ও রাজাপাকসে কুক্ষিগত করার বিরুদ্ধে রনিল বিক্রমাসিংহের প্রতি রাজপথে জনতার সমর্থন বাড়তে থাকে। তার বাসভবনের বাইরে অবস্থান নিতে থাকে বিপুলসংখ্যক মানুষ।
দেশটিতে এই অচলাবস্থা অব্যাহত থাকে কমপক্ষে ৬ সপ্তাহ।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখাতে সক্ষম হননি রাজাপাকসে। ফলে বাধ্য হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখানোর জন্য ২০১৯ সালে নতুন নির্বাচন ঘোষণা দিয়ে বসেন সিরিসেনা। চূড়ান্ত পেরেকটি ১৩ই ডিসেম্বর ঠুকে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয় সিরিসেনার বিরুদ্ধে। এর ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রনিল বিক্রমাসিংহেকে স্বীকৃতি দেন তিনি। যদিও সেখানে সংকটের তাৎক্ষণিক সমাধান হয়েছে, তবৃও শ্রীলংকার গণতন্ত্রের গভীর এক বিপন্নতা ফুটে উঠেছে, যা শিগগিরই দূরে যাবে বলে মনে হয় না।
জাতি ও জাতীয়তাবাদের বিপদ
শ্রীলংকা জাতিগত অস্থিরতার রাজনৈতিক সংকটের ভিতর নিমজ্জিত ছিল। এই অস্থিরতা দেশটিকে পঞ্চাশের দশক থেকে মহামারীর মতো জেঁকে ধরেছিল। রাজাপাকসে সিনহলিজ বৌদ্ধ জাতিদের জাতীয়তাবাদের পক্ষে শক্তিশালী অবস্থান নেন। এই গ্রুপটি জাতিগত সহিংসতার কেন্দ্রীয় চরিত্রে ভূমিকা রেখেছে। অতি সাম্প্রতিক সংকট নিয়ে যারা সমালোচনা করেন তাদের আক্রমণ করতে এই কার্ডটি ব্যবহার করেন রাজাপাকসে ও তার সমর্থকরা। তারা যুক্তি দেখান, বিক্রমাসিংহে বিদেশি (প্রধানত পশ্চিমাদের) প্রভাব ও বাইরের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করেন। এই রকম সমস্যা শ্রীলংকার বাইরে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। জাতি ও ধর্মীয় উত্তেজনা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য গণতন্ত্রেও এক আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে।
যদিও নির্বাচন হলো এখন এই উপমহাদেশজুড়ে এক নতুন রুটিন, প্রায়ই তা অবাধ ও সুষ্ঠু হয়। তবু রয়ে গেছে জাতিগত ও ধর্মীয় বিষয়গুলো প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতি কখনো কখনো পরিচালিত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ-সংখ্যালঘিষ্ঠ জটিলতা দিয়ে: তাদের দেশে বিপুল পরিমাণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রতিনিধিত্ব করা সত্ত্বেও রাজনীতিক ও নেতাকর্মীরা যুক্তি দেখান, পালাবদলের ভয়ানক সব প্রভাব, দীর্ঘমেয়াদি জনসংখ্যাতত্ত্বের পরিবর্তন, দুর্নীতি ও অভিজাত শ্রেণির অসাধুতা তাদের গ্রুপের ক্ষমতাকে খর্ব করছে। পশ্চিমা পপুলিস্ট বা জনপ্রিয়দের মতো, তারা দাবি করেন, এসব হুমকি বা বিপদ থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রুপগুলোকে তারা নিজেরাই সুরক্ষা দিতে পারেন, যখন এসব গ্রুপ এমনিতেই প্রাধান্য বিস্তার করে।
এই কৌশল একটি নির্বাচনী বিজয়ীর জন্য প্রমাণিত। ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি একটি রাজনৈতিক ‘মেশিন’ তৈরি করেছে, যেটা তাদের ২০১৪ সালের চূড়ান্ত বিজয় এনে দেয় নাটকীয়তার সঙ্গে। এতে তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা রাজ্যের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ রাজ্য নির্বাচনগুলোতে খুব দুর্বল পারফরমেন্স করলেও ২০১৯ সালে সেখানে জাতীয় নির্বাচনে এখনও বিজেপি জনপ্রিয় হিসেবে রয়েছে। ভারতের রাজনীতিতে শক্তিশালী বিষয় হয়ে আছে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা। এখনও অনেক ভারতীয় আছেন, যারা এ ধারণার সঙ্গে নেই তবু সাম্প্রতিক সময়ে নাটকীয়তার সঙ্গে হিন্দুদের পক্ষে গেছে অনেক কিছু। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কাঞ্চন চন্দ্র যেমনটা বলেছেন, হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের মধ্যেই ভারতের ধারণাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক সংকটের আগে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ ছিল তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে।
এর মূল নিহিত ছিল হলো সিনহলিজ বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের উত্থান, যা রাজনীতিতে একটি উত্তেজনা সৃষ্টি করে। তা এখনো এই দ্বীপরাষ্ট্রের গভীরে প্রভাব রাখে। দেশটিতে সিংহলিজ দুটি প্রধান দল বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে প্রশংসিত করার মাধ্যমে একে অন্যকে অতিক্রম করার চেষ্টা করেছে। চেষ্টা করা হয়েছে, শ্রীলংকার তামিল ও মুসলিম সংখ্যালঘুদের থেকে শ্রীলংকার রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সীমিত করতে। ২০১৫ সালে শ্রীলংকায় যে নির্বাচন হয় তাতে এমন জাতিগত উত্তেজনা মিটিয়ে ফেলার একটি সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু সিংহলিজ জাতীয়তাবাদীরা এমন সুযোগকে অবজ্ঞা করেছে, এতে সংস্কারমূলক এজেন্ডা ক্রমাগত ধ্বংস হয়েছে।
সম্ভবত দক্ষিণ এশিয়ায় জাতি-জাতীয়তাবাদ নিয়ে সবচেয়ে নাটকীয় ঘটেছে তা মিয়ানমারের উদারীকরণকে পশ্চাতে ঠেলে দেয়া। রাখাইনে মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর তার দেশের সেনাবাহিনী যে নৃশংসতা চালিয়েছে তার নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে বহু আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মিয়ানমারের মূল নেত্রী অং সান সুচির ওপর তিক্ত হতাশা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সূচি যে অবস্থান নিেেছন তাতে জনগণের সেন্টিমেন্ট প্রতিফলিত হয়েছে। মিয়ানমারের বহু মানুষ, এমনকি তারাও, যারা আগে সেনাবাহিনীর বিরোধিতা করতেন তারাও রোহিঙ্গা বিরোধী কঠোর নীতিকে সমর্থন করছেন। মিয়ানমারে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন ২০২০ সালে।
সম্ভবত ওই নির্বাচনটি হবে অং সান সূচির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি এবং এর প্রধান বিরোধী দল, সেনাবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির মধ্যে। তারা সবাই বার্মার জাতি-জাতীয়তাবাদের মর্মমূলে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করছে। মিয়ানমারে নির্বাচনী যে গণতন্ত্রের উত্থান ঘটেছে তাতে মেজরিটারিয়ানিজমের সমর্থকদের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এতে রয়েছে রাজনীতিবিদ থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষু, সামাজিক যোগাযোগ মিডিয়ার ব্যবহারকারী। তারা রোহিঙ্গাদের দেখে থাকে বহিরাগত হিসেবে, যাদের দেশ থেকে নির্মূল করে দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করে তারা।
(পাকিস্তানের অনলাইন ডেইলি টাইমসে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ)
No comments