শ্রমিক বিক্ষোভ সংঘর্ষ, ভোগান্তি: পোশাক খাতের মজুরি পর্যালোচনায় কমিটি
নতুন
মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন ও বেতন বৈষম্য রোধের দাবিতে গতকালও বিক্ষোভ করেছেন
পোশাক শিল্প শ্রমিকরা। রাজধানীর কালশি, উত্তরা, সাভার এবং গাজীপুরে
শ্রমিকদের বিক্ষোভের সময় পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা
ঘটে। সাভারে গুলিতে সুমন মিয়া নামের এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি
করেছে আন্দোলনকারীরা। মৃত্যুর বিষয়টি হাসপাতাল ও থানা পুলিশ নিশ্চিত করলেও
কিভাবে তার মৃত্যু হয়েছে তা নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ।
গতকাল উত্তরার আজমপুর ও সাভার এলাকায় সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে টিয়ারশেল ও জলকামান নিক্ষেপ করে পুলিশ। এ সময় বিমানবন্দর সড়ক থেকে উত্তরার জসিমউদ্দিন মোড়, আজমপুর রেলক্রসিং এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে মিরপুরের পল্লবীর কালশিতে। এ সময় এসব এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
দুর্ভোগ পোহাতে হয় সাধারণ মানুষকে। পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে গতকাল বিকালে জরুরি বৈঠকে ডাকে সরকার। ওই বৈঠকের বিষয়টি শ্রমিকদের অবগত করার পর তারা রাস্তা থেকে সরে যায়। বৈঠক শেষে জানানো হয় মজুরি কাঠামো পর্যালোচনায় একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া আগামী এক মাসের মধ্যে সমস্যা সমাধান করারও আশ্বাস দেয়া হয়েছে সরকারের তরফ থেকে।
ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন দাবিতে পোশাক শ্রমিকরা সড়কে অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন গত চার দিন ধরে। গতকালও একই দাবিতে বিমানবন্দর সড়ক অবরোধের চেষ্টা করেন শ্রমিকরা। ওই এলাকার নীপা গার্মেন্ট, চৈতি গার্মেন্ট, ফ্লোরা ফ্যাশন, অ্যাপারেলস গার্মেন্টসহ বেশ কয়েকটি গার্মেন্টের শ্রমিকরা এতে অংশ নেন।
সকাল সাড়ে ৮টা থেকে গার্মেন্টের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। একপর্যায়ে শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তারা বিমানবন্দর সড়কের দিকে এগিয়ে যায়। আগে থেকেই সেখানে বিপুল পুলিশ মোতায়েন ছিলো। এমনকি আশেপাশে ছিলো সাঁজোয়া যান। বিমানবন্দর সড়ক অবরোধকালে তাদের বাধা দেয় পুলিশ। পরে জসিম উদ্দিন মোড়ে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করে শ্রমিকরা। শ্রমিকদের একাংশ জড়ো হয় আজমপুরে। পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে বিক্ষোভ করে শ্রমিকরা। এ সময় সড়কে যানজট সৃষ্টি হয়। পুলিশ তাদের সরে যেতে অনুরোধ করলেও শ্রমিকরা অবস্থানে অটুট থাকে। একপর্যায়ে শ্রমিকদের সড়ক থেকে সরিয়ে দিতে লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। দুপুরের পর আবারো তারা জড়ো হতে চাইলে পুলিশ তাদের সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে।
ওদিকে মিরপুরের পল্লবীতে জড়ো হয়ে দাবি আদায়ের জন্য নানা স্লোগান দেন পোশাক শ্রমিকরা। সকাল ৯টার পর থেকে তারা কালশি সড়কে অবস্থান নেন। এ সময় ওই এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শ্রমিকদের সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে পুলিশ। এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের বাকবিতণ্ডা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল থেকে ২২ তলা গার্মেন্ট এলাকায় পোশাক শ্রমিকরা রাস্তায় অবস্থান নেন। তাদের অবস্থানের কারণে সড়কটিতে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তায় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হলে পুলিশ তাদের সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে। একপর্যায়ের শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছে পুলিশ। পল্লবী থানার পরিদর্শক (অপারেশন্স) জানান, সকাল থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত শ্রমিকরা অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেছে। পুলিশ শান্তিপূর্ণভাবে শ্রমিকদের সরিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে। তবে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি।
সাভারে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, নিহত ১: সাভার-আশুলিয়ায় বেতন বৈষম্যের অভিযোগ এনে টানা তৃতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ করেছে বেশ কয়েকটি তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। এ সময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে অগ্নিসংযোগ করে। পুলিশ তাদেরকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে উভয়পক্ষের মধ্যে ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করা হয়। শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে সুমন মিয়া (২২) নামে এক শ্রমিকের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে।
এ ঘটনায় মো. মকুল নামে আরো এক শ্রমিককে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আমজাদুল হক বলেন, পুলিশ এক ব্যক্তিকে হাসপাতালে আনার আগেই সে মারা যায়। পরে সাভার মডেল থানার ওসি আবদুল আউয়াল স্বাক্ষর করে নিহতের মৃতদেহটি নিয়ে যায়। হাসপাতালটির জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, মো. সুমন মিয়া এক শ্রমিককে তার সহকর্মী রিপন মিয়া ও পুলিশ বিকাল সোয়া ৪টার দিকে নিয়ে আসে। তার বুকের বাম পাশে গোল চিহ্ন রয়েছে তা গুলি কিনা ময়নাতদন্তের পর জানা যাবে। এ ছাড়া মো. মকুল নামে আরো এক শ্রমিকের বাম উরুর পেছনে গুলি পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ গার্মেন্ট এন্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুজন বলেন, গুলিবিদ্ধ হয়ে এক শ্রমিক নিহতের খবর শুনেছি। তবে ওই কারখানায় আমাদের কোনো লোক না থাকায় বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারিনি। আশুলিয়া শিল্প পুলিশের পরিচালক সানা শামিনুর রহমান বলেন, গুলিবিদ্ধ হয়ে এক শ্রমিক মারা যাওয়ার খবর শুনেছি। তবে আমাদের সঙ্গে ওই কারখানার শ্রমিকদের কোনো সংঘর্ষ কিংবা গুলির ঘটনা ঘটেনি।
সকালে সাভারের হেমায়েতপুরে পদ্মার মোড় বাগবাড়ি এলাকায় এই শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে। শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের এই সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া সকাল ৮টা থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে। এ সময় ওই এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করায় যানচলাচলসহ সাধারণ মানুষের চলাচল বন্ধ থাকে। পুলিশ ও বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা জানায়, হেমায়েতপুরের পদ্মার মোড় বাগবাড়ি এলাকায় স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের শামস স্টাইল ওয়্যারস লিমিটেডের শ্রমিকরা সকালে কারখানায় কাজে যোগ না দিয়ে কারখানার পাশে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। একপর্যায়ে তাদের সঙ্গে পার্শবর্তী দীপ্ত অ্যাপারেলস কারখানাসহ আরো বেশ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরাও আন্দোলনে যোগ দেন। পরে তারা হেমায়েতপুর-শ্যামপুর সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে আগুন দিয়ে অবরোধ করলে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে ধাওয়া দেয়। এতে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
সংঘর্ষে এ সময় পুলিশসহ আহত হয় অর্ধশতাধিক। এ সময় পুলিশ শ্রমিকদের ওপর জলকামান ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। দুপুর ১টা পর্যন্ত চলে শ্রমিক পুলিশের মধ্যে ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়া। এ সময় পুরো এলাকায় সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা বিভিন্ন শাখা সড়ক ও গলিতে অবস্থান নিয়ে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, জলকামান ও সাঁজোয়া যান নিয়ে শ্রমিকদের প্রতিহত করে। শ্রমিকরা জানায়, আমাদের ন্যূনতম বেতন কাঠামোর প্রজ্ঞাপন গত ডিসেম্বরে জারি হয়েছে।
কিন্তু সেখানে আমাদের সব দাবি-দাওয়া উত্থাপন হয়নি। অপারেটর ও হেলপারের বেতনের মধ্যে অনেক বৈষম্য ও ব্যবধান রয়েছে। আমরা এগুলো দূর করার কথা বলছি। কিন্তু মালিকপক্ষ আমাদের দাবিতে কোনো সাড়া দিচ্ছে না। অন্যদিকে সাভার পৌর এলাকার দক্ষিণ দরিয়াপুর মহল্লার জেকে গ্রুপের তনিমা নিট কম্পোজিট, উলাইল, আশুলিয়ার কাঠগড়া ও চারাবাগ এলাকার কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা একই দাবিতে কর্মবিরতিসহ বিক্ষোভ করেছে। একপর্যায়ে শ্রমিকরা সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে চাইলে পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। শিল্প পুলিশ-১ এর পরিদর্শক মাহববুর রহমান জানান, বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। এ ছাড়া যেকোনো ঝামেলা এড়াতে সাভার ও আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। শ্রমিকদের ন্যূূনতম মজুরি বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ের জন্য গত তিনদিন ধরে বিক্ষোভ করছে শ্রমিকরা।
স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর থেকে জানান, বেতন ভাতার বৃদ্ধির দাবিতে গাজীপুরে কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে এবং মহাসড়ক অবরোধ করে। অবরোধ চলাকালে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া, পাল্টা-ধাওয়া ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় অন্তত ১০ জন আহত হয়েছে। পুলিশ ও শ্রমিকরা জানায়, বিকালে গাজীপুরের ভোগড়া এলাকার একটি গার্মেন্ট কারখানা শ্রমিকরা বেতন ভাতার বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দাবিতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এ সময় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। পুলিশকে লক্ষ্য করে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। জবাবে পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে কারখানায় ভাঙচুর চালিয়ে, কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর ও পুলিশের একটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। একই দাবিতে সকালে চক্রবর্তী এলাকায় দুটি গার্মেন্টের শ্রমিকরা চন্দ্রা নবীনগর মহাসড়ক প্রায় আধা ঘণ্টা অবরোধ করে। পুলিশ কাঁদানি গ্যাস ও লাঠিচার্জ করে তাদের সরিয়ে দেয়। অন্যদিকে বিকালে কোনাবাড়ি এলাকার কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে।
মজুরি কাঠামো পর্যালোচনায় কমিটি: তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের টানা বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে দেড় মাস আগে ঘোষিত নতুন মজুরি কাঠামো পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গতকাল মতিঝিলের শ্রমভবনে মালিক ও শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক জরুরি বৈঠকের পর এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। প্রায় দুই ঘণ্টা বৈঠক করেন বাণিজ্যমন্ত্রী ও শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, বিজিএমইএ নেতা আবদুুস সালাম মুর্শেদী, ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়াসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, মালিক পক্ষের ৫ জন, শ্রমিক পক্ষের ৫ জন এবং সরকারের বাণিজ্য সচিব ও শ্রম সচিবকে নিয়ে মোট ১২ সদস্যের কমিটি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ কমিটি আগামী এক মাসের মধ্যে মজুরির অসঙ্গতিগুলো খতিয়ে দেখবে এবং সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেবে।
তিনি বলেন, মজুরি নিয়ে কোনো সমস্যা থাকলে তা আলোচনা করে এক মাসের মধ্যেই সমাধান করা হবে। এ সময়ের মধ্যে শ্রমিকদের রাস্তায় বিশৃঙ্খলা না করে কাজে ফিরে যাওয়ার আহ্বানও জানান নতুন এ বাণিজ্যমন্ত্রী। ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন দাবিতে টানা তিন দিন ঢাকার রাস্তায় পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে এই বৈঠকে ডাকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
জানুয়ারি মাসে কোনো শ্রমিককে কম বেতন দেয়া হবে না। কোনো গ্রেডে কারও যদি বেতন কমে যায়, তবে সেটা হিসাব করে সমন্বয় করা হবে। বকেয়া আকারে শ্রমিকরা সেই বেতন পেয়ে যাবেন বলে জানান টিপু মুনশি।
বর্তমান শ্রমিক আন্দোলনের পেছনে শিল্পের বাইরের লোকের ইন্ধন আছে বলেও নিজের সন্দেহের কথা জানান মন্ত্রী।
তিনি বলেন, শ্রমিকদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। শ্রমিকরা যাতে কোনো রকম গুজব কিংবা উস্কানিতে পা না দেন আমরা সেই অনুরোধ করছি। এরপর থেকে ইন্ডাস্ট্রিবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ড করলে তা কঠোর হাতে দমন করা হবে।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, যারা ধ্বংসাত্মক কাজ করেছে তারা শ্রমিক না। তারা এ ট্রেডের বন্ধু না। তাদের কঠোর হাতে দমন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মালিক ও শ্রমিক একটা বাইসাইকেলের দুই চাকা। তাদের একসঙ্গেই এগোতে হবে। কোথায় কোনো ইরেগুলারিটি থাকলে সেটা দেখা হবে। কিন্তু কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সহ্য করা হবে না।
তিনি বলেন, সাইবার ক্রাইম শুরু হয়ে গেছে। বিভিন্ন রকম প্রচারপত্র লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে অনলাইনে। আমরা বরাবর দেখেছি, প্রত্যেক ঘটনার ক্ষেত্রে এ ধরনের অপকর্ম ঘটছে। এসব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান বলেন, প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত শ্রমিকবান্ধব। তিনি নিজেই সুপারিশ করে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন। এখন নতুন মজুরি কাঠামোর কোথাও কোনো অসুবিধা থাকলে আলোচনা করে তা ঠিক করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাই আর কোনো বিশৃঙ্খলা নয়। সবাইকে কাজে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করছি।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের কাছে একই কথা বলেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মাহবুবুর রহমান ইসমাইল ও জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন।
এদিকে পোশাক শ্রমিকদের সব গ্রেডে সমান হারে মজুরি বাড়ানোর পাশাপাশি বকেয়া বেতন পরিশোধ, ছাঁটাই ও নির্যাতন বন্ধের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি। গতকাল বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপতি তাসলিমা আখতার, সাধারণ সম্পাদক জুলহাসনাইন বাবুর যুক্ত বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়।
বিবৃতিতে তারা বলেন, পোশাক শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ ও সব গ্রেডে সমান হারে মজুরি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে উত্তরা, গাজীপুর নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিক ছাঁটাই, টার্গেট চাপ বাড়ানো এবং শ্রমিক নির্যাতন বন্ধের দাবি জানানো হয়। তারা বলেন, সমপ্রতি শ্রমিক আন্দোলন বিভিন্ন গ্রেডে মজুরি সমান হারে বৃদ্ধি না পাওয়ারই কারণ। এ ছাড়া বেতন বকেয়া, ছাঁটাই-নির্যাতন, টার্গেট চাপ ইত্যাদির ক্ষোভ রয়েছে।
বিবৃতিতে সরকার ও মালিক পক্ষকে পোশাক কারখানার ৩য়, ৪র্থ, ৫ম গ্রেডের শ্রমিকদের মূল মজুরি অন্যান্য গ্রেডের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বেতন বাড়িয়ে শিল্পের সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবি জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, অপারেটররাই গার্মেন্ট শিল্পের প্রাণ, প্রধান চালিকা শক্তি, সংখ্যার দিক থেকেও এরাই বেশি। শ্রমিকদের এ অংশকে বঞ্চিত করে, অংকের মার-প্যাঁচে ফেলে বেসিক কমিয়ে দিলে শেষ পর্যন্ত শিল্পের মঙ্গল আসবে না এ কথা মালিকদের পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে। পুলিশ ও মাস্তান দিয়ে নির্যাতন করে, মামলা ও গ্রেপ্তার করে এ আন্দোলন থামানো যাবে না। ষড়যন্ত্র ও ইন্ধনের গন্ধ খুঁজলে সমাধানের পথ পাওয়া যাবে না, বরং যে হারে ৭ম গ্রেডের মূল মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছে একই হারে অন্যান্য গ্রেডের মূল মজুরি বৃদ্ধির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান করার আহ্বান জানানো হয়।
গতকাল উত্তরার আজমপুর ও সাভার এলাকায় সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে টিয়ারশেল ও জলকামান নিক্ষেপ করে পুলিশ। এ সময় বিমানবন্দর সড়ক থেকে উত্তরার জসিমউদ্দিন মোড়, আজমপুর রেলক্রসিং এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে মিরপুরের পল্লবীর কালশিতে। এ সময় এসব এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
দুর্ভোগ পোহাতে হয় সাধারণ মানুষকে। পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে গতকাল বিকালে জরুরি বৈঠকে ডাকে সরকার। ওই বৈঠকের বিষয়টি শ্রমিকদের অবগত করার পর তারা রাস্তা থেকে সরে যায়। বৈঠক শেষে জানানো হয় মজুরি কাঠামো পর্যালোচনায় একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া আগামী এক মাসের মধ্যে সমস্যা সমাধান করারও আশ্বাস দেয়া হয়েছে সরকারের তরফ থেকে।
ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন দাবিতে পোশাক শ্রমিকরা সড়কে অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন গত চার দিন ধরে। গতকালও একই দাবিতে বিমানবন্দর সড়ক অবরোধের চেষ্টা করেন শ্রমিকরা। ওই এলাকার নীপা গার্মেন্ট, চৈতি গার্মেন্ট, ফ্লোরা ফ্যাশন, অ্যাপারেলস গার্মেন্টসহ বেশ কয়েকটি গার্মেন্টের শ্রমিকরা এতে অংশ নেন।
সকাল সাড়ে ৮টা থেকে গার্মেন্টের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। একপর্যায়ে শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তারা বিমানবন্দর সড়কের দিকে এগিয়ে যায়। আগে থেকেই সেখানে বিপুল পুলিশ মোতায়েন ছিলো। এমনকি আশেপাশে ছিলো সাঁজোয়া যান। বিমানবন্দর সড়ক অবরোধকালে তাদের বাধা দেয় পুলিশ। পরে জসিম উদ্দিন মোড়ে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করে শ্রমিকরা। শ্রমিকদের একাংশ জড়ো হয় আজমপুরে। পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে বিক্ষোভ করে শ্রমিকরা। এ সময় সড়কে যানজট সৃষ্টি হয়। পুলিশ তাদের সরে যেতে অনুরোধ করলেও শ্রমিকরা অবস্থানে অটুট থাকে। একপর্যায়ে শ্রমিকদের সড়ক থেকে সরিয়ে দিতে লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। দুপুরের পর আবারো তারা জড়ো হতে চাইলে পুলিশ তাদের সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে।
ওদিকে মিরপুরের পল্লবীতে জড়ো হয়ে দাবি আদায়ের জন্য নানা স্লোগান দেন পোশাক শ্রমিকরা। সকাল ৯টার পর থেকে তারা কালশি সড়কে অবস্থান নেন। এ সময় ওই এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শ্রমিকদের সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে পুলিশ। এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের বাকবিতণ্ডা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল থেকে ২২ তলা গার্মেন্ট এলাকায় পোশাক শ্রমিকরা রাস্তায় অবস্থান নেন। তাদের অবস্থানের কারণে সড়কটিতে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তায় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হলে পুলিশ তাদের সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে। একপর্যায়ের শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছে পুলিশ। পল্লবী থানার পরিদর্শক (অপারেশন্স) জানান, সকাল থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত শ্রমিকরা অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেছে। পুলিশ শান্তিপূর্ণভাবে শ্রমিকদের সরিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে। তবে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি।
সাভারে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, নিহত ১: সাভার-আশুলিয়ায় বেতন বৈষম্যের অভিযোগ এনে টানা তৃতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ করেছে বেশ কয়েকটি তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। এ সময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে অগ্নিসংযোগ করে। পুলিশ তাদেরকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে উভয়পক্ষের মধ্যে ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করা হয়। শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে সুমন মিয়া (২২) নামে এক শ্রমিকের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে।
এ ঘটনায় মো. মকুল নামে আরো এক শ্রমিককে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আমজাদুল হক বলেন, পুলিশ এক ব্যক্তিকে হাসপাতালে আনার আগেই সে মারা যায়। পরে সাভার মডেল থানার ওসি আবদুল আউয়াল স্বাক্ষর করে নিহতের মৃতদেহটি নিয়ে যায়। হাসপাতালটির জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, মো. সুমন মিয়া এক শ্রমিককে তার সহকর্মী রিপন মিয়া ও পুলিশ বিকাল সোয়া ৪টার দিকে নিয়ে আসে। তার বুকের বাম পাশে গোল চিহ্ন রয়েছে তা গুলি কিনা ময়নাতদন্তের পর জানা যাবে। এ ছাড়া মো. মকুল নামে আরো এক শ্রমিকের বাম উরুর পেছনে গুলি পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ গার্মেন্ট এন্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুজন বলেন, গুলিবিদ্ধ হয়ে এক শ্রমিক নিহতের খবর শুনেছি। তবে ওই কারখানায় আমাদের কোনো লোক না থাকায় বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারিনি। আশুলিয়া শিল্প পুলিশের পরিচালক সানা শামিনুর রহমান বলেন, গুলিবিদ্ধ হয়ে এক শ্রমিক মারা যাওয়ার খবর শুনেছি। তবে আমাদের সঙ্গে ওই কারখানার শ্রমিকদের কোনো সংঘর্ষ কিংবা গুলির ঘটনা ঘটেনি।
সকালে সাভারের হেমায়েতপুরে পদ্মার মোড় বাগবাড়ি এলাকায় এই শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে। শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের এই সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া সকাল ৮টা থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে। এ সময় ওই এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করায় যানচলাচলসহ সাধারণ মানুষের চলাচল বন্ধ থাকে। পুলিশ ও বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা জানায়, হেমায়েতপুরের পদ্মার মোড় বাগবাড়ি এলাকায় স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের শামস স্টাইল ওয়্যারস লিমিটেডের শ্রমিকরা সকালে কারখানায় কাজে যোগ না দিয়ে কারখানার পাশে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। একপর্যায়ে তাদের সঙ্গে পার্শবর্তী দীপ্ত অ্যাপারেলস কারখানাসহ আরো বেশ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরাও আন্দোলনে যোগ দেন। পরে তারা হেমায়েতপুর-শ্যামপুর সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে আগুন দিয়ে অবরোধ করলে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে ধাওয়া দেয়। এতে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
সংঘর্ষে এ সময় পুলিশসহ আহত হয় অর্ধশতাধিক। এ সময় পুলিশ শ্রমিকদের ওপর জলকামান ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। দুপুর ১টা পর্যন্ত চলে শ্রমিক পুলিশের মধ্যে ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়া। এ সময় পুরো এলাকায় সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা বিভিন্ন শাখা সড়ক ও গলিতে অবস্থান নিয়ে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, জলকামান ও সাঁজোয়া যান নিয়ে শ্রমিকদের প্রতিহত করে। শ্রমিকরা জানায়, আমাদের ন্যূনতম বেতন কাঠামোর প্রজ্ঞাপন গত ডিসেম্বরে জারি হয়েছে।
কিন্তু সেখানে আমাদের সব দাবি-দাওয়া উত্থাপন হয়নি। অপারেটর ও হেলপারের বেতনের মধ্যে অনেক বৈষম্য ও ব্যবধান রয়েছে। আমরা এগুলো দূর করার কথা বলছি। কিন্তু মালিকপক্ষ আমাদের দাবিতে কোনো সাড়া দিচ্ছে না। অন্যদিকে সাভার পৌর এলাকার দক্ষিণ দরিয়াপুর মহল্লার জেকে গ্রুপের তনিমা নিট কম্পোজিট, উলাইল, আশুলিয়ার কাঠগড়া ও চারাবাগ এলাকার কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা একই দাবিতে কর্মবিরতিসহ বিক্ষোভ করেছে। একপর্যায়ে শ্রমিকরা সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে চাইলে পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। শিল্প পুলিশ-১ এর পরিদর্শক মাহববুর রহমান জানান, বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। এ ছাড়া যেকোনো ঝামেলা এড়াতে সাভার ও আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। শ্রমিকদের ন্যূূনতম মজুরি বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ের জন্য গত তিনদিন ধরে বিক্ষোভ করছে শ্রমিকরা।
স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর থেকে জানান, বেতন ভাতার বৃদ্ধির দাবিতে গাজীপুরে কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে এবং মহাসড়ক অবরোধ করে। অবরোধ চলাকালে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া, পাল্টা-ধাওয়া ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় অন্তত ১০ জন আহত হয়েছে। পুলিশ ও শ্রমিকরা জানায়, বিকালে গাজীপুরের ভোগড়া এলাকার একটি গার্মেন্ট কারখানা শ্রমিকরা বেতন ভাতার বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দাবিতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এ সময় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। পুলিশকে লক্ষ্য করে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। জবাবে পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে কারখানায় ভাঙচুর চালিয়ে, কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর ও পুলিশের একটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। একই দাবিতে সকালে চক্রবর্তী এলাকায় দুটি গার্মেন্টের শ্রমিকরা চন্দ্রা নবীনগর মহাসড়ক প্রায় আধা ঘণ্টা অবরোধ করে। পুলিশ কাঁদানি গ্যাস ও লাঠিচার্জ করে তাদের সরিয়ে দেয়। অন্যদিকে বিকালে কোনাবাড়ি এলাকার কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে।
মজুরি কাঠামো পর্যালোচনায় কমিটি: তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের টানা বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে দেড় মাস আগে ঘোষিত নতুন মজুরি কাঠামো পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গতকাল মতিঝিলের শ্রমভবনে মালিক ও শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক জরুরি বৈঠকের পর এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। প্রায় দুই ঘণ্টা বৈঠক করেন বাণিজ্যমন্ত্রী ও শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, বিজিএমইএ নেতা আবদুুস সালাম মুর্শেদী, ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়াসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, মালিক পক্ষের ৫ জন, শ্রমিক পক্ষের ৫ জন এবং সরকারের বাণিজ্য সচিব ও শ্রম সচিবকে নিয়ে মোট ১২ সদস্যের কমিটি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ কমিটি আগামী এক মাসের মধ্যে মজুরির অসঙ্গতিগুলো খতিয়ে দেখবে এবং সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেবে।
তিনি বলেন, মজুরি নিয়ে কোনো সমস্যা থাকলে তা আলোচনা করে এক মাসের মধ্যেই সমাধান করা হবে। এ সময়ের মধ্যে শ্রমিকদের রাস্তায় বিশৃঙ্খলা না করে কাজে ফিরে যাওয়ার আহ্বানও জানান নতুন এ বাণিজ্যমন্ত্রী। ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন দাবিতে টানা তিন দিন ঢাকার রাস্তায় পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে এই বৈঠকে ডাকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
জানুয়ারি মাসে কোনো শ্রমিককে কম বেতন দেয়া হবে না। কোনো গ্রেডে কারও যদি বেতন কমে যায়, তবে সেটা হিসাব করে সমন্বয় করা হবে। বকেয়া আকারে শ্রমিকরা সেই বেতন পেয়ে যাবেন বলে জানান টিপু মুনশি।
বর্তমান শ্রমিক আন্দোলনের পেছনে শিল্পের বাইরের লোকের ইন্ধন আছে বলেও নিজের সন্দেহের কথা জানান মন্ত্রী।
তিনি বলেন, শ্রমিকদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। শ্রমিকরা যাতে কোনো রকম গুজব কিংবা উস্কানিতে পা না দেন আমরা সেই অনুরোধ করছি। এরপর থেকে ইন্ডাস্ট্রিবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ড করলে তা কঠোর হাতে দমন করা হবে।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, যারা ধ্বংসাত্মক কাজ করেছে তারা শ্রমিক না। তারা এ ট্রেডের বন্ধু না। তাদের কঠোর হাতে দমন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মালিক ও শ্রমিক একটা বাইসাইকেলের দুই চাকা। তাদের একসঙ্গেই এগোতে হবে। কোথায় কোনো ইরেগুলারিটি থাকলে সেটা দেখা হবে। কিন্তু কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সহ্য করা হবে না।
তিনি বলেন, সাইবার ক্রাইম শুরু হয়ে গেছে। বিভিন্ন রকম প্রচারপত্র লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে অনলাইনে। আমরা বরাবর দেখেছি, প্রত্যেক ঘটনার ক্ষেত্রে এ ধরনের অপকর্ম ঘটছে। এসব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান বলেন, প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত শ্রমিকবান্ধব। তিনি নিজেই সুপারিশ করে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন। এখন নতুন মজুরি কাঠামোর কোথাও কোনো অসুবিধা থাকলে আলোচনা করে তা ঠিক করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাই আর কোনো বিশৃঙ্খলা নয়। সবাইকে কাজে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করছি।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের কাছে একই কথা বলেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মাহবুবুর রহমান ইসমাইল ও জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন।
এদিকে পোশাক শ্রমিকদের সব গ্রেডে সমান হারে মজুরি বাড়ানোর পাশাপাশি বকেয়া বেতন পরিশোধ, ছাঁটাই ও নির্যাতন বন্ধের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি। গতকাল বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপতি তাসলিমা আখতার, সাধারণ সম্পাদক জুলহাসনাইন বাবুর যুক্ত বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়।
বিবৃতিতে তারা বলেন, পোশাক শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ ও সব গ্রেডে সমান হারে মজুরি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে উত্তরা, গাজীপুর নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিক ছাঁটাই, টার্গেট চাপ বাড়ানো এবং শ্রমিক নির্যাতন বন্ধের দাবি জানানো হয়। তারা বলেন, সমপ্রতি শ্রমিক আন্দোলন বিভিন্ন গ্রেডে মজুরি সমান হারে বৃদ্ধি না পাওয়ারই কারণ। এ ছাড়া বেতন বকেয়া, ছাঁটাই-নির্যাতন, টার্গেট চাপ ইত্যাদির ক্ষোভ রয়েছে।
বিবৃতিতে সরকার ও মালিক পক্ষকে পোশাক কারখানার ৩য়, ৪র্থ, ৫ম গ্রেডের শ্রমিকদের মূল মজুরি অন্যান্য গ্রেডের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বেতন বাড়িয়ে শিল্পের সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবি জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, অপারেটররাই গার্মেন্ট শিল্পের প্রাণ, প্রধান চালিকা শক্তি, সংখ্যার দিক থেকেও এরাই বেশি। শ্রমিকদের এ অংশকে বঞ্চিত করে, অংকের মার-প্যাঁচে ফেলে বেসিক কমিয়ে দিলে শেষ পর্যন্ত শিল্পের মঙ্গল আসবে না এ কথা মালিকদের পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে। পুলিশ ও মাস্তান দিয়ে নির্যাতন করে, মামলা ও গ্রেপ্তার করে এ আন্দোলন থামানো যাবে না। ষড়যন্ত্র ও ইন্ধনের গন্ধ খুঁজলে সমাধানের পথ পাওয়া যাবে না, বরং যে হারে ৭ম গ্রেডের মূল মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছে একই হারে অন্যান্য গ্রেডের মূল মজুরি বৃদ্ধির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান করার আহ্বান জানানো হয়।
No comments