পঞ্চাশ ভাগ জালভোট নাকি বাক্সে ভরে দেয়া হবে: ড. কামাল
ভোটারদের
সকাল সকাল ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল
হোসেন। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবে
ঐক্যফ্রন্ট। সরকার যদি দুই নম্বরি না করে তাহলে ঐক্যফ্রন্টই বিজয়ী হবে।
নির্বাচন পরিস্থিতি তুলে ধরতে গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে
সংবাদ সম্মেলন করেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা। সংবাদ সম্মেলনে তরুণ
ভোটারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, তোমরা যারা প্রথম ভোট দেয়ার সুযোগ পেয়েছো
তোমরাও সকাল সকাল ভোটকেন্দ্রে যাবে। ভয় পাবে না, ভোটকেন্দ্রে গেলে
দুর্বৃত্তরাই পালিয়ে যাবে। জনগণের শক্তির সঙ্গে তারা পারবে না। মনে রাখবে,
যদি তুমি ভয় পাও তবেই তুমি শেষ, যদি তুমি ঘুরে দাঁড়াও, তবে তুমিই বাংলাদেশ।
নির্বাচনে ভোটগ্রহণের দায়িত্বরত সব কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে ড. কামাল বলেন, আপনার ওপর যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা সততার সঙ্গে পালন করবেন। এটা করলে আপনাদের সম্মান বাড়বে। ভোটারের মুখের হাসির ওপরই নির্ভর করছে আপনার দায়িত্ব পালনে সফলতা ও তৃপ্তি। আপনি যদি কারও অধিকার হরণ করেন, তাহলে মনে রাখবেন অন্য কেউ আপনার মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তানের অধিকার হরণ করছে। এটা করলে জনগণ, ইতিহাস ও আইন আপনাদের ক্ষমা করবে না। তিনি বলেন, আপনারা কোনো দলের নয়, জনগণের সেবক।
জনগণ দেশের মালিক, দেশের মালিকদের তাদের ভোটের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করবেন না। কোনো অন্যায় নির্দেশ মানবেন না। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার, ভিডিপি, কোস্টগার্ডসহ সবার প্রতি অনুরোধ রেখে কামাল হোসেন বলেন, আপনারা অতীতের মতো গৌরবময় ভূমিকা পালন করুন। বিশ্বব্যাপী শান্তিরক্ষায় আপনাদের ভূমিকা প্রশংসিত হচ্ছে। সে প্রশংসার ফলে সারা বিশ্বে আপনাদের সুযোগ বেড়েছে। কোনো অবস্থাতেই তা যাতে ব্যাহত না হয়, সে ব্যাপারে আপনারা সতর্ক থাকবেন। প্রবাসীদের উদ্দেশ্য ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক বলেন, নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের জন্য যারা ভোট দিতে পারবেন না আপনারা আপনাদের স্বজনদের ফোন করে ভোট দিতে যেতে বলুন। তারা যদি ভোট দিতে পারেন সে আনন্দের অংশীদার আপনিও হবেন।
সারা দেশে ব্যাপক ধরপাকড় হামলা মামলার অভিযোগের পরও নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ড. কামাল হোসেন বলেন, আমাদের প্রত্যাশা, আমরা অবশ্যই আশা করি, আমরা জিতবো, সবাই এখন পরিবর্তন পরিবর্তন করে চিৎকার করছে। নির্বাচনে আমরাই জিতবো যদি কোনও দুই নম্বরি না হয়। বিএনপি’র অফিস রেখে ডিআরইউতে কেন সংবাদ সম্মেলন করলেন, আপনাদের (ঐক্যফ্রন্ট) মধ্যে ঐক্যের ঘাটতি আছে কি না- এমন প্রশ্নে ড. কামাল হোসেন বলেন, এ হল নেয়াটা কোনোভাবে প্রমাণ করে না যে, আমাদের মধ্যে ঐক্য নেই। আমাদের অফিসে গতকাল আগুন লাগার কারণে বড় হল না পেয়ে এখানে এসেছি। আমাদের মধ্যে ঐক্য আরও সুসংহত হয়েছে। এজেন্টদের বের করে দেয়া, হামলা গ্রেপ্তারের মতো ঘটনা আজও (নির্বাচনের দিন) হয়, তবে কি নির্বাচন থেকে সরে যাবেন? -এমন প্রশ্নে কামাল হোসেন বলেন, আমরা সরে যাওয়ার জন্য নির্বাচনে আসিনি। এর আগে বহুবার বলেছি, শেষ পর্যন্ত আমরা নির্বাচনে থাকবো। আমরা আশা করি জনগণ সকল অপশক্তিকে রুখে দিবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐক্যফন্টের ভোট বর্জন করতে পারে- বিষয়টি নিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কামাল হোসেন বলেন, কোনোভাবেই নির্বাচন থেকে সরে যাবো না। বহুবার বলেছি।
আমরা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবো। নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে কোনো দ্বিধা আছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো দ্বিধা নেই। নির্বাচন বর্জন প্রসঙ্গে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, উনি (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) তো আমাদের নেত্রী না। উনি কি বললেন না বললেন সেটা আমাদের বিষয় না। নজরুল ইসলাম খান বলেন, হামলা-মামলার প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, যদি হয় এর কোনো উত্তর দিতে চাই না। আমরা আশা করি জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটকেন্দ্র যাবে এবং ভোট ডাকাতদের প্রতিরোধ করবে।
এ সময় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, মানুষ যখন ভয় পায় তখন বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সরকার ভয় পেয়েছে। যে কারণে তারা বিরোধীদলের ওপর হামলা-নির্যাতন করছে, গুণ্ডামি করছে।
এ সময় বিএনপি’র নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, তফসিল ঘোষণার পর সারা দেশে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের ১১৫০৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, ৯৫৭টি নতুন মামলা হয়েছে। প্রার্থীসহ নেতাকর্মীদের ওপর ২৮৯৬টি হামলা হয়েছে এতে আহত হয়েছে ১৩ হাজার ২৫২ জন, নিহত হয়েছেন ৯ জন। ২৮শে ডিসেম্বর প্রচারণা বন্ধ হওয়ার পরও সারা দেশে গ্রেপ্তার হয়েছে ১০২৭ জন শুধু ২৮ তারিখ নতুন করে মামলা হয়েছে ৫৯টি, নিহত হয়েছে ১ জন। ঐক্যফ্রন্টের মোট ১৭ জন প্রার্থী কারাগার থেকে নির্বাচন করছেন। এরমধ্যে তফসিল ঘোষণা এবং নির্বাচন কমিশনের বৈধতা পাওয়ার পর ৭ জন প্রার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। তিনি আরও জানান, নির্বাচন কমিশনের বৈধতা পাওয়ার পর ১৬ জন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে। এরমধ্যে শেষ সময়ে এসে তিনজন প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছে।
আর ঐক্যফ্রন্ট চূড়ান্ত মনোনয়ন দেয়ার পর ৩ জন প্রার্থীকে বদল করে অন্য প্রার্থী দিয়েছেন হাইকোর্ট। নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমরা নানাভাবে খবর পাই সিটি করপোরেশন, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সরকার যা করেছে জাতীয় নির্বাচনেও সরকার সে রকম কিছু করার পরিকল্পনা করেছে। ভোটের আগে ভোটের বাক্স ভর্তি করা এবং জাল ভোট দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে সরকার। জনগণ ও নেতাকর্মীদের কাছে আহ্বান জানাই, আপনারা সজাগ ও সচেতন থাকবেন। যে কোনো ধরনের মন্দ পরিকল্পনা প্রতিহত করবেন। কেউ যেন আগেই বাক্স ভরতে না পারে। জাল ভোট দিতে না পারে। ফলাফল বদলে দিতে না পারে। মানুষ পরিবর্তন চায়, আমরাও পরিবর্তন চাই।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি স্থায়ী কমিটির গণফোরামের কার্যকরী সভাপতি ও ঢাকা-৬ আসনের প্রার্থী সুব্রত চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা-৭ আসনের প্রার্থী মোস্তফা মহসিন মন্টু, বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
৫০ ভাগ জাল ভোট নাকি বাক্সে ভরে দেয়া হবে
কূটনৈতিক রিপোর্টার জানান, ভোটের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে বিদেশি সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন। গতকাল বিকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে বিদেশি গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের ব্রিফিংয়ে তিনি এ আহ্বান জানান। ড. কামাল বলেন, নির্বাচনে সরকারি দলের তরফে যেভাবে ‘ভয়ের পরিবেশ’ তৈরি করা হয়েছে স্বাধীন দেশে এটি অতীতে কখনই হয়নি। তার পরও মানুষ ভোট দিতে চায়। তারা পরিবর্তন চায়। দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ পরিবর্তনের পক্ষে দাবি করে তিনি বলেন এক পারসেন্ট লোক পরিবর্তন চায় না। তারা কেন চায় না সেটা সবার জানান। তারা অন্যায়ভাবে সুবিধাভোগী। এরা সব সেক্টরেই রয়েছে। প্রশাসনেও এরা আছে। প্রশাসনের ওই সব সুবিধাভোগীদের দিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বিরোধী প্রার্থী, সমর্থক-ভোটারদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে অভিযোগ করে বিদেশি গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের উদ্দেশে তিনি বলেন- যারা বিদেশ থেকে সংবাদ সংগ্রহের জন্য এসেছেন আপনারা ঘুরেন, দেখেন মানুষ কতটা উন্মুখ হয়ে আছে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য।
ভোটের দিনে তারা কতটা মুক্তভাবে ভোট দিতে পারছে সেটাও নিশ্চয় আপনারা দেখবেন। সেই চিত্রটাই তুলে ধরুন। এত বাধার পরও মানুষ ভোট দিতে যাবে- এ নিয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই উল্লেখ করে ড. কামাল বলেন, সরকারি দল যেভাবে ভোটের পরিবেশ নষ্ট করেছে, মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে তা সত্যিই হতাশাজনক এবং পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত। ড. কামাল বলেন, প্রচারণাকালে অর্ধেকের বেশি আসনে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীর মিছিল-সভা সমাবেশ এমনকি বাড়ি ঘরে হামলা করেছে আওয়ামী লীগ ও সমর্থকরা। অনেক হামলায় পুলিশও জড়িত ছিল। প্রচারণা চালাতে গিয়ে ঐক্যফ্রন্টের ৪৯ জন প্রার্থী আহত হয়েছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন অনেকে। যার মধ্যে সিরাজগঞ্জে একজন নারী প্রার্থী রয়েছেন। ড. কামাল বলেন, বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর কেবল হামলাই হয়নি, পুলিশ দিয়ে হাজার হাজার সমর্থক-ভোটারদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেকে বাড়িঘর ছাড়া।
আক্রমণ, পুলিশ কেস এবং গ্রেপ্তারের ফিরিস্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, ৮ই নভেম্বর থেকে ২৫শে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশব্যাপী ১৫৭৪ পুলিশ কেস দেয়া হয়েছে ঐক্যফ্রন্ট নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে। ওই সব মামলায় ১ লাখ ২৫ হাজার ৬৮৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে আরও প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার ৬শ জনকে। কিন্তু এত কিছুর পরও তারা ভোটের মাঠে আছেন, ফল নিয়ে কতটা আশাবাদী এমন প্রশ্নের জবাবে বিরোধী ওই নেতা বলেন, আমি আশাবাদী। আমি এটাও আশা করবো, নির্বাচন কমিশন, সরকারি দল এবং প্রশাসনের কাছে তারা মানুষকে ভোট দেয়ার সুযোগ করে দেবেন। কিন্তু সেখানে যদি তা না নয়, তখন তারা কী করবেন? এমন প্রশ্নে ড. কামাল বলেন, ‘যদি এটি হয়, ‘যদি ওটি হয়’ এমন প্রশ্নে আসলে কোনো উত্তর দেয়া কঠিন।
কিন্তু তার পরও বলবো আমরা জানি এদেশের মানুষের শিকড়ে গণতন্ত্র। মানুষ ভোট দিতে পারলেই হয়। পাকিস্তানিরা তা কাড়তে পারেনি। এরশাদ জামানাও তা কেড়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। এরশাদ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন। এক বৃটিশ মন্ত্রীকে তিনি তা-ই বলেছিলেন ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরে। কিন্তু তিনি ১৫ সপ্তাহ থাকতে পারননি। ৬ই ডিসেম্বর তিনি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। ড. কামাল বলেন, আমাদের কাছে নানা রকম খবর আসছে। এমন নির্দেশনাও নাকি দেয়া হয়েছে ভোট যাই হোক ৫০ ভাগ ফেক ব্যালট বা জাল ভোট বক্সে ভরা দেয়া হবে। ফলও পরিবর্তন করা হতে পারে। আমরা জনরায়ের শেষ সময় পর্যন্ত দেখবো। এখানে অনেক কিছু করার আছে। সংবিধানেও এর নির্দেশনা আছে। আমরা ভোটের চিত্র দেখে বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেবো।
উল্লেখ্য, অর্ধশতাধিক বিদেশি সাংবাদিক এখন ঢাকায় নির্বাচন কাভার করছেন। তার মধ্যে অনেকে ঢাকার বাইরেও চলে গেছেন। বিদেশি গণমাধ্যমের স্থানীয় প্রতিনিধিরাও রয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য মতে, এবার বিবিসি, ক্যাবল নিউজ ইন্টারন্যাশনাল, ডয়েচে ভেলে, এনএইচকে, ইউমোরি সিমবান, এএফপি, এপি, নিউজ এজেন্সি, আল জাজিরা, জার্মান টিভি, টিভি টুডে নেটওয়ার্ক, নিউ ইয়র্ক টাইমস, লে মন্ডে, দি ইকোনোমিস্ট, জি-নিউজ, কিয়োডো নিউজ, টাইমস অব ইন্ডিয়া, দ্য হিন্দু, ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও (যুক্তরাষ্ট্র), স্ট্যাটেজিক নিউজ, ফ্রন্টলাইন, দি উইকসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর প্রতিনিধিরা নির্বাচন উপলক্ষে বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট কভার করতে ঢাকায় এসেছেন। অনেকে প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় প্রতিনিধিও রয়েছেন। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা ছিলেন।
নির্বাচনে ভোটগ্রহণের দায়িত্বরত সব কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে ড. কামাল বলেন, আপনার ওপর যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা সততার সঙ্গে পালন করবেন। এটা করলে আপনাদের সম্মান বাড়বে। ভোটারের মুখের হাসির ওপরই নির্ভর করছে আপনার দায়িত্ব পালনে সফলতা ও তৃপ্তি। আপনি যদি কারও অধিকার হরণ করেন, তাহলে মনে রাখবেন অন্য কেউ আপনার মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তানের অধিকার হরণ করছে। এটা করলে জনগণ, ইতিহাস ও আইন আপনাদের ক্ষমা করবে না। তিনি বলেন, আপনারা কোনো দলের নয়, জনগণের সেবক।
জনগণ দেশের মালিক, দেশের মালিকদের তাদের ভোটের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করবেন না। কোনো অন্যায় নির্দেশ মানবেন না। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার, ভিডিপি, কোস্টগার্ডসহ সবার প্রতি অনুরোধ রেখে কামাল হোসেন বলেন, আপনারা অতীতের মতো গৌরবময় ভূমিকা পালন করুন। বিশ্বব্যাপী শান্তিরক্ষায় আপনাদের ভূমিকা প্রশংসিত হচ্ছে। সে প্রশংসার ফলে সারা বিশ্বে আপনাদের সুযোগ বেড়েছে। কোনো অবস্থাতেই তা যাতে ব্যাহত না হয়, সে ব্যাপারে আপনারা সতর্ক থাকবেন। প্রবাসীদের উদ্দেশ্য ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক বলেন, নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের জন্য যারা ভোট দিতে পারবেন না আপনারা আপনাদের স্বজনদের ফোন করে ভোট দিতে যেতে বলুন। তারা যদি ভোট দিতে পারেন সে আনন্দের অংশীদার আপনিও হবেন।
সারা দেশে ব্যাপক ধরপাকড় হামলা মামলার অভিযোগের পরও নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ড. কামাল হোসেন বলেন, আমাদের প্রত্যাশা, আমরা অবশ্যই আশা করি, আমরা জিতবো, সবাই এখন পরিবর্তন পরিবর্তন করে চিৎকার করছে। নির্বাচনে আমরাই জিতবো যদি কোনও দুই নম্বরি না হয়। বিএনপি’র অফিস রেখে ডিআরইউতে কেন সংবাদ সম্মেলন করলেন, আপনাদের (ঐক্যফ্রন্ট) মধ্যে ঐক্যের ঘাটতি আছে কি না- এমন প্রশ্নে ড. কামাল হোসেন বলেন, এ হল নেয়াটা কোনোভাবে প্রমাণ করে না যে, আমাদের মধ্যে ঐক্য নেই। আমাদের অফিসে গতকাল আগুন লাগার কারণে বড় হল না পেয়ে এখানে এসেছি। আমাদের মধ্যে ঐক্য আরও সুসংহত হয়েছে। এজেন্টদের বের করে দেয়া, হামলা গ্রেপ্তারের মতো ঘটনা আজও (নির্বাচনের দিন) হয়, তবে কি নির্বাচন থেকে সরে যাবেন? -এমন প্রশ্নে কামাল হোসেন বলেন, আমরা সরে যাওয়ার জন্য নির্বাচনে আসিনি। এর আগে বহুবার বলেছি, শেষ পর্যন্ত আমরা নির্বাচনে থাকবো। আমরা আশা করি জনগণ সকল অপশক্তিকে রুখে দিবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐক্যফন্টের ভোট বর্জন করতে পারে- বিষয়টি নিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কামাল হোসেন বলেন, কোনোভাবেই নির্বাচন থেকে সরে যাবো না। বহুবার বলেছি।
আমরা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবো। নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে কোনো দ্বিধা আছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো দ্বিধা নেই। নির্বাচন বর্জন প্রসঙ্গে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, উনি (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) তো আমাদের নেত্রী না। উনি কি বললেন না বললেন সেটা আমাদের বিষয় না। নজরুল ইসলাম খান বলেন, হামলা-মামলার প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, যদি হয় এর কোনো উত্তর দিতে চাই না। আমরা আশা করি জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটকেন্দ্র যাবে এবং ভোট ডাকাতদের প্রতিরোধ করবে।
এ সময় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, মানুষ যখন ভয় পায় তখন বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সরকার ভয় পেয়েছে। যে কারণে তারা বিরোধীদলের ওপর হামলা-নির্যাতন করছে, গুণ্ডামি করছে।
এ সময় বিএনপি’র নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, তফসিল ঘোষণার পর সারা দেশে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের ১১৫০৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, ৯৫৭টি নতুন মামলা হয়েছে। প্রার্থীসহ নেতাকর্মীদের ওপর ২৮৯৬টি হামলা হয়েছে এতে আহত হয়েছে ১৩ হাজার ২৫২ জন, নিহত হয়েছেন ৯ জন। ২৮শে ডিসেম্বর প্রচারণা বন্ধ হওয়ার পরও সারা দেশে গ্রেপ্তার হয়েছে ১০২৭ জন শুধু ২৮ তারিখ নতুন করে মামলা হয়েছে ৫৯টি, নিহত হয়েছে ১ জন। ঐক্যফ্রন্টের মোট ১৭ জন প্রার্থী কারাগার থেকে নির্বাচন করছেন। এরমধ্যে তফসিল ঘোষণা এবং নির্বাচন কমিশনের বৈধতা পাওয়ার পর ৭ জন প্রার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। তিনি আরও জানান, নির্বাচন কমিশনের বৈধতা পাওয়ার পর ১৬ জন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে। এরমধ্যে শেষ সময়ে এসে তিনজন প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছে।
আর ঐক্যফ্রন্ট চূড়ান্ত মনোনয়ন দেয়ার পর ৩ জন প্রার্থীকে বদল করে অন্য প্রার্থী দিয়েছেন হাইকোর্ট। নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমরা নানাভাবে খবর পাই সিটি করপোরেশন, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সরকার যা করেছে জাতীয় নির্বাচনেও সরকার সে রকম কিছু করার পরিকল্পনা করেছে। ভোটের আগে ভোটের বাক্স ভর্তি করা এবং জাল ভোট দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে সরকার। জনগণ ও নেতাকর্মীদের কাছে আহ্বান জানাই, আপনারা সজাগ ও সচেতন থাকবেন। যে কোনো ধরনের মন্দ পরিকল্পনা প্রতিহত করবেন। কেউ যেন আগেই বাক্স ভরতে না পারে। জাল ভোট দিতে না পারে। ফলাফল বদলে দিতে না পারে। মানুষ পরিবর্তন চায়, আমরাও পরিবর্তন চাই।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি স্থায়ী কমিটির গণফোরামের কার্যকরী সভাপতি ও ঢাকা-৬ আসনের প্রার্থী সুব্রত চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা-৭ আসনের প্রার্থী মোস্তফা মহসিন মন্টু, বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
৫০ ভাগ জাল ভোট নাকি বাক্সে ভরে দেয়া হবে
কূটনৈতিক রিপোর্টার জানান, ভোটের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে বিদেশি সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন। গতকাল বিকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে বিদেশি গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের ব্রিফিংয়ে তিনি এ আহ্বান জানান। ড. কামাল বলেন, নির্বাচনে সরকারি দলের তরফে যেভাবে ‘ভয়ের পরিবেশ’ তৈরি করা হয়েছে স্বাধীন দেশে এটি অতীতে কখনই হয়নি। তার পরও মানুষ ভোট দিতে চায়। তারা পরিবর্তন চায়। দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ পরিবর্তনের পক্ষে দাবি করে তিনি বলেন এক পারসেন্ট লোক পরিবর্তন চায় না। তারা কেন চায় না সেটা সবার জানান। তারা অন্যায়ভাবে সুবিধাভোগী। এরা সব সেক্টরেই রয়েছে। প্রশাসনেও এরা আছে। প্রশাসনের ওই সব সুবিধাভোগীদের দিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বিরোধী প্রার্থী, সমর্থক-ভোটারদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে অভিযোগ করে বিদেশি গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের উদ্দেশে তিনি বলেন- যারা বিদেশ থেকে সংবাদ সংগ্রহের জন্য এসেছেন আপনারা ঘুরেন, দেখেন মানুষ কতটা উন্মুখ হয়ে আছে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য।
ভোটের দিনে তারা কতটা মুক্তভাবে ভোট দিতে পারছে সেটাও নিশ্চয় আপনারা দেখবেন। সেই চিত্রটাই তুলে ধরুন। এত বাধার পরও মানুষ ভোট দিতে যাবে- এ নিয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই উল্লেখ করে ড. কামাল বলেন, সরকারি দল যেভাবে ভোটের পরিবেশ নষ্ট করেছে, মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে তা সত্যিই হতাশাজনক এবং পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত। ড. কামাল বলেন, প্রচারণাকালে অর্ধেকের বেশি আসনে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীর মিছিল-সভা সমাবেশ এমনকি বাড়ি ঘরে হামলা করেছে আওয়ামী লীগ ও সমর্থকরা। অনেক হামলায় পুলিশও জড়িত ছিল। প্রচারণা চালাতে গিয়ে ঐক্যফ্রন্টের ৪৯ জন প্রার্থী আহত হয়েছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন অনেকে। যার মধ্যে সিরাজগঞ্জে একজন নারী প্রার্থী রয়েছেন। ড. কামাল বলেন, বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর কেবল হামলাই হয়নি, পুলিশ দিয়ে হাজার হাজার সমর্থক-ভোটারদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেকে বাড়িঘর ছাড়া।
আক্রমণ, পুলিশ কেস এবং গ্রেপ্তারের ফিরিস্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, ৮ই নভেম্বর থেকে ২৫শে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশব্যাপী ১৫৭৪ পুলিশ কেস দেয়া হয়েছে ঐক্যফ্রন্ট নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে। ওই সব মামলায় ১ লাখ ২৫ হাজার ৬৮৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে আরও প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার ৬শ জনকে। কিন্তু এত কিছুর পরও তারা ভোটের মাঠে আছেন, ফল নিয়ে কতটা আশাবাদী এমন প্রশ্নের জবাবে বিরোধী ওই নেতা বলেন, আমি আশাবাদী। আমি এটাও আশা করবো, নির্বাচন কমিশন, সরকারি দল এবং প্রশাসনের কাছে তারা মানুষকে ভোট দেয়ার সুযোগ করে দেবেন। কিন্তু সেখানে যদি তা না নয়, তখন তারা কী করবেন? এমন প্রশ্নে ড. কামাল বলেন, ‘যদি এটি হয়, ‘যদি ওটি হয়’ এমন প্রশ্নে আসলে কোনো উত্তর দেয়া কঠিন।
কিন্তু তার পরও বলবো আমরা জানি এদেশের মানুষের শিকড়ে গণতন্ত্র। মানুষ ভোট দিতে পারলেই হয়। পাকিস্তানিরা তা কাড়তে পারেনি। এরশাদ জামানাও তা কেড়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। এরশাদ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন। এক বৃটিশ মন্ত্রীকে তিনি তা-ই বলেছিলেন ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরে। কিন্তু তিনি ১৫ সপ্তাহ থাকতে পারননি। ৬ই ডিসেম্বর তিনি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। ড. কামাল বলেন, আমাদের কাছে নানা রকম খবর আসছে। এমন নির্দেশনাও নাকি দেয়া হয়েছে ভোট যাই হোক ৫০ ভাগ ফেক ব্যালট বা জাল ভোট বক্সে ভরা দেয়া হবে। ফলও পরিবর্তন করা হতে পারে। আমরা জনরায়ের শেষ সময় পর্যন্ত দেখবো। এখানে অনেক কিছু করার আছে। সংবিধানেও এর নির্দেশনা আছে। আমরা ভোটের চিত্র দেখে বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেবো।
উল্লেখ্য, অর্ধশতাধিক বিদেশি সাংবাদিক এখন ঢাকায় নির্বাচন কাভার করছেন। তার মধ্যে অনেকে ঢাকার বাইরেও চলে গেছেন। বিদেশি গণমাধ্যমের স্থানীয় প্রতিনিধিরাও রয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য মতে, এবার বিবিসি, ক্যাবল নিউজ ইন্টারন্যাশনাল, ডয়েচে ভেলে, এনএইচকে, ইউমোরি সিমবান, এএফপি, এপি, নিউজ এজেন্সি, আল জাজিরা, জার্মান টিভি, টিভি টুডে নেটওয়ার্ক, নিউ ইয়র্ক টাইমস, লে মন্ডে, দি ইকোনোমিস্ট, জি-নিউজ, কিয়োডো নিউজ, টাইমস অব ইন্ডিয়া, দ্য হিন্দু, ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও (যুক্তরাষ্ট্র), স্ট্যাটেজিক নিউজ, ফ্রন্টলাইন, দি উইকসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর প্রতিনিধিরা নির্বাচন উপলক্ষে বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট কভার করতে ঢাকায় এসেছেন। অনেকে প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় প্রতিনিধিও রয়েছেন। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা ছিলেন।
No comments