পোশাক কারখানায় হিজড়া কর্মী by এমএম মাসুদ
বাংলাদেশের
রপ্তানি আয়ের আশি ভাগের বেশি আসা পোশাক খাতে প্রথমবারের মতো নিয়োগ পেলো
হিজড়া সম্প্রদায়। প্রায় অর্ধশতাধিক হিজড়ার কর্মসংস্থানে ভালোবাসার হাত
বাড়িয়ে দিয়েছেন বেসরকারি খাতের তরুণ উদ্যোক্তা ও বাংলাদেশ ডেনিম এক্সপার্ট
লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোস্তাফিজ উদ্দিন। দেশের পোশাক
কারখানা হিসেবে এটাই প্রথম। ইউএসএআইডি ও হিজড়াদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন বন্ধু
সমাজ কল্যাণ সোসাইটির সহযোগিতায় পাইলট প্রকল্প হিসেবে প্রথমে ৫ জনকে নিয়োগ
দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই ২ জন কর্মস্থলে যোগদান করেছেন। এরা হলেন- শিমা
আক্তার ও দিলরুবা আক্তার। শিমা উৎপাদন কাঠামোর জুনিয়র সেফটি
অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করছে। আর দিলরুবা হাউজকিপিং দলের একজন জুনিয়র
সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করছে।
সামাজিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে চট্টগ্রামে অবস্থিত ডেনিম এক্সপার্ট লি. এই প্রকল্প হাতে নিয়েছে। পুরো কারখানায় ১৭০০ শ্রমিক কাজ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, প্রতিবন্ধীদের পাশাপাশি ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে কর্ম করে অর্থ উপার্জনের দিকে আগ্রহী হয়ে উঠছেন হিজড়া জনগোষ্ঠী। বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা, ফ্যাশন ডিজাইনার, ব্যবসায়ী, এমনকি পার্লারের বিউটিশিয়ান হিসেবে কাজ করছে হিজড়ারা। সরকারও তাদের সমাজের মূল স্রোতধারায় আনতে বাজেটে বরাদ্দ রেখে বিভিন্ন উন্নয়মূলক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বেসরকারি খাতে কোনো উদ্যোগ ছিল না। বাংলাদেশ ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড কারখানায় হিজড়াদের নিয়োগ দিয়ে একটি মহতী উদ্যোগ নিয়েছেন। ভবিষ্যতে অন্য কারখানার মালিকরাও এগিয়ে আসবেন বলে আশা তাদের।
এফবিসিসিআই সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, তৈরি পোশাকখাতে হিজড়াদের কাজে লাগানোর ধারণা আগে আমার ছিল না। এ ধরনের উদ্যোগ ব্যবসায়ীদের মধ্যে সচেতনতার সৃ?ষ্টি হবে।
জানা গেছে, ২০১৩ সালে সরকার হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় তাদের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বীকৃতি পেলেও অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হতে হয় তাদের। ওই সময় তাদের ট্রাফিক ?পুলিশে চাকরি দেয়ারও সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত পরে আর আলোর মুখ দেখেনি। তবে অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে সম্মানজনকভাবে অর্থ উপার্জন করতে পেরে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন তারা। সমাজসেবা অধিদপ্তরের মতে, বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। তবে সংশ্লিষ্টদের মতে, এর সংখ্যা আরো বেশি।
যেভাবে পোশাক কারখানায় হিজড়ারা: কয়েক মাস আগে মার্কিন দূতাবাস এবং ইউএসএআইডি সদস্যরা ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড কারখানা পরিদর্শন করেন। সঙ্গে ছিলেন হিজড়াদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন বন্ধু সমাজ কল্যাণ সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সালেহ আহমেদ। হিজড়া জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা চাহিদা ও মানবাধিকার বিষয়ক সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে ১৯৯৬ সালে বন্ধু সমাজ কল্যাণ সোসাইটি যাত্রা শুরু করে। পরিদর্শন শেষে প্রস্তাব করা হয়, একটি বিশেষ কর্মসূচির ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যেখানে হিজড়া কমিউনিটির সদস্যরা পোশাক কারখানায় কাজ করার সুযোগ পাবেন। প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন ডেনিম এক্সপার্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফিজ উদ্দিন। এর পর বন্ধু সমাজ কল্যাণ সোসাইটির সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ শুরু করে ডেনিম এক্সপার্ট। কারখানা পরিদর্শন করার জন্য বন্ধু’র সদস্য এবং হিজড়া প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানায় ডেনিম এক্সপার্ট কর্মকর্তারা। পেশাদার পরিবেশে হিজড়াদের একসঙ্গে কাজ করা যেতে পারে এমন উপায় অন্বেষণ করেন তারা। এজন্য একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এতে অংশগ্রহণের জন্য কারখানার প্রত্যেক বিভাগের একজন কর্মকর্তাকে নির্বাচন করা হয়। বন্ধু সংগঠনের সদস্যরা এবং হিজড়াদের প্রতিনিধি শিমা আক্তার, দিলরুবা আক্তার, আখি সুলতানা ও মনিসহ প্রায় ৫০ জন হিজড়া কর্মশালায় অংশ নেন। ডেনিম এক্সপার্টের কর্মকর্তারা হিজড়াদের স্বীকৃতি প্রদানের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোকপাত করেন। বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠী তাদের পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কিন্তু ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড বিশ্বাস করে, তাদের সমাজের মূলধারায় আনার এখনই সময়। এছাড়া জাতিসংঘের ঘোষিত টেকসই উন্নয়নের জন্য দরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন।
কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফিজ উদ্দিন বলেন, কর্মক্ষেত্র সবার জন্য সমান। হিজড়াদের মূল্যায়ন করা উচিত। হিজড়াদের নিয়ে লিঙ্গ, ধর্ম বা যৌন প্ররোচনা সত্ত্বেও সকলের সমান সুযোগ দেয়ার তাগিদ থেকেই তাদের কাজ দেয়ার চেষ্টা করছি। হিজড়াদের অন্যদের মতো সমান সুযোগ-সুবিধা দিতে ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড ও বন্ধু সোসাইটির মাঝে একটি অংশীদারিত্ব হয়েছে। মোস্তফিজ উদ্দিন বলেন, শিমা আক্তার ও দিলরুবা আক্তার হিজড়া কমিউনিটির সদস্য। তারা আমার কারখানায় কাজ শুরু করেছে। এজন্য আমি খুবই গর্বিত। শিমা ও দিলরুবাও গর্বিত ও আনন্দিত। কারণ তারা কখনো ভাবেননি যে সমাজের এতো বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে।
অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাস্তায়-বাসে-দোকানে সাহায্য নেয়ার নামে জোর করে টাকা আদায়ের মতো কাজ করে বলে হিজড়ারা সমাজের চোখে নেতিবাচক ইমেজের মানুষ হিসেবে চিহ্নিত। অন্যদিকে তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিরও অভিযোগ রয়েছে। হিজড়াদের অনেকেই স্বীকার করেছেন, পেটের দায়ে তারা এসব করেন।
তবে সব প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে হিজড়া শিমা আক্তার ও দিলরুবা নিজেকে পরিণত করেছেন দক্ষ শ্রমিক হিসেবে। নিজের মেধা আর অদম্য ইচ্ছা দিয়ে জয় করেছেন সকল বাধা। চট্টগ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশ ডেনিম এক্সপার্টা লিমিটেড নামের তৈরি পোশাক কারখানার নিরাপত্তা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে তারা এখন কারখানার সবার প্রিয় মুখ।
দিলরুবা আক্তার জানান, ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড শুধু একটি কারখানা নয়, এটি আমার কাছে এখন একটি পরিবার। সমস্ত কর্মচারী আমাকে শ্রদ্ধা করে এবং আমার কাজে আমাকে সাহায্য করে। এই কাখানায় চাকরি করায় সমাজে আমার গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। এছাড়া এই চাকরি ইতিমধ্যে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের দরজা খুলতে সাহায্য করছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ডেনিম কারখানায় যোগদান করার আগে আমার পরিবার আমাকে অসম্মানিত করেছিল এবং আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। কিন্তু এখন আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। দিলরুবার দায়িত্ব সুপারভাইজারের নির্দেশনায় অফিসের পরিচ্ছন্নতা ও রক্ষণাবেক্ষণ।
শিমা আক্তার বলেন, পোশাক খাতের একজন কর্মী হয়ে আমি গর্বিত। আমার আর অন্যদের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে না। এই করখানার সবাই খুব সহায়ক এবং আমাদের খুব ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। কারখানা মালিক মোস্তাফিজ উদ্দিন আমাকে সম্মান করেন এবং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পর্ষদ খুব সহায়ক। আমি আমার সর্বোচ্চ শ্রম দিয়ে সেরা হওয়ার চেষ্টা করছি। শিমা উৎপাদন কাঠামোর নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার কাছে নিয়োজিত। এতে অগ্নি এবং বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা সভার ব্যবস্থা করা, শ্রমিকদের পরিচয়পত্র এবং ইউনিফর্ম পর্যবেক্ষণ করা এবং নিরাপত্তা কমিটির সঙ্গে কাজ করা।
বন্ধু সমাজ কল্যাণ সোসাইটির প্রধান নির্বাহী সালেহ আহমেদ বলেন, হিজড়ারা প্রায়শই সমাজ ও তাদের পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তখন এটা নিয়ে আমি ভাবতে থাকি। তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ দিলে সমাজ ও দেশে অবদান রাখতে পারবে। এজন্য বন্ধু এবং ইউএসএআইডি-এর সঙ্গে একটি অংশীদারিত্বের মধ্যে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরে হিজড়ারা ডেনিম এক্সপার্ট পরিবারে সদস্য হয়ে যান। অর্থাৎ বাংলাদেশে হিজড়াদের অন্তর্ভুক্তির পদক্ষেপ হিসেবে প্রথম পোশাক কারখানা এটি। কারখানায় শিমা ও দিলরুবাকে কোম্পানির শ্রমিকরা তাদের ভালোভাবে গ্রহণ করেছে। তারা তাদের দায়িত্ব সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য শ্রমিকদের সঙ্গে ভালোভাবে কাজ করছে।
মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, একজন উদ্যোক্তা হিসাবে চাই সবাই উপকৃত হোক। কেবল ডেনিম শিল্পেই হিজড়ারা কাজ করবে তা নয়। বিশ্বাস করি প্রত্যেক কারখানা মালিক যেন তাদের কর্মসংস্থানে এগিয়ে আসে। তিনি বলেন, হিজড়াদের নিয়ে কারখানায় কয়েকটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রয়োজনীয় সচেতনতা-বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ প্রদান, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের কাজে সহায়তা প্রদান এবং এইচআর বিভাগের ব্যবস্থাপনায় কর্মীদের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করা। কারখানায় তাদের দীর্ঘমেয়াদি ক্যারিয়ারের জন্য তাদের সবার সাফল্য কামনা করছি।
তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সহসভাপতি মোহাম্মাদ নাছির জানান, হিজড়াদের কর্মসংস্থান ও উন্নয়নে আমাদের হাতে প্রকল্প রয়েছে। তবে প্রতিবন্ধীদের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিজিএমইএ সফলতা পেয়েছে। ইতিমধ্যেই সারা দেশের পোশাক কারখানায় প্রায় ২ থেকে আড়াই হাজার প্রতিবন্ধী শ্রমিক কাজ করছে। তারা যোগ্যতার সঙ্গে ভূমিকা রাখছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, যদি প্রতিটি কারখানায় অন্তত ৪ থেকে ৫ জন করে নিয়োগ দেয়া গেলে ৪ হাজার কারখানাতে বড় সংখ্যক হিজড়াদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হতে পারতো। কিন্তু এটি এখনও হয়ে উঠেনি। তবে যেহেতু শুরু হয়েছে আগামীতে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ আরো বাড়বে বলে জানান তিনি।
সামাজিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে চট্টগ্রামে অবস্থিত ডেনিম এক্সপার্ট লি. এই প্রকল্প হাতে নিয়েছে। পুরো কারখানায় ১৭০০ শ্রমিক কাজ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, প্রতিবন্ধীদের পাশাপাশি ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে কর্ম করে অর্থ উপার্জনের দিকে আগ্রহী হয়ে উঠছেন হিজড়া জনগোষ্ঠী। বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা, ফ্যাশন ডিজাইনার, ব্যবসায়ী, এমনকি পার্লারের বিউটিশিয়ান হিসেবে কাজ করছে হিজড়ারা। সরকারও তাদের সমাজের মূল স্রোতধারায় আনতে বাজেটে বরাদ্দ রেখে বিভিন্ন উন্নয়মূলক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বেসরকারি খাতে কোনো উদ্যোগ ছিল না। বাংলাদেশ ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড কারখানায় হিজড়াদের নিয়োগ দিয়ে একটি মহতী উদ্যোগ নিয়েছেন। ভবিষ্যতে অন্য কারখানার মালিকরাও এগিয়ে আসবেন বলে আশা তাদের।
এফবিসিসিআই সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, তৈরি পোশাকখাতে হিজড়াদের কাজে লাগানোর ধারণা আগে আমার ছিল না। এ ধরনের উদ্যোগ ব্যবসায়ীদের মধ্যে সচেতনতার সৃ?ষ্টি হবে।
জানা গেছে, ২০১৩ সালে সরকার হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় তাদের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বীকৃতি পেলেও অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হতে হয় তাদের। ওই সময় তাদের ট্রাফিক ?পুলিশে চাকরি দেয়ারও সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত পরে আর আলোর মুখ দেখেনি। তবে অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে সম্মানজনকভাবে অর্থ উপার্জন করতে পেরে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন তারা। সমাজসেবা অধিদপ্তরের মতে, বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। তবে সংশ্লিষ্টদের মতে, এর সংখ্যা আরো বেশি।
যেভাবে পোশাক কারখানায় হিজড়ারা: কয়েক মাস আগে মার্কিন দূতাবাস এবং ইউএসএআইডি সদস্যরা ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড কারখানা পরিদর্শন করেন। সঙ্গে ছিলেন হিজড়াদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন বন্ধু সমাজ কল্যাণ সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সালেহ আহমেদ। হিজড়া জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা চাহিদা ও মানবাধিকার বিষয়ক সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে ১৯৯৬ সালে বন্ধু সমাজ কল্যাণ সোসাইটি যাত্রা শুরু করে। পরিদর্শন শেষে প্রস্তাব করা হয়, একটি বিশেষ কর্মসূচির ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যেখানে হিজড়া কমিউনিটির সদস্যরা পোশাক কারখানায় কাজ করার সুযোগ পাবেন। প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন ডেনিম এক্সপার্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফিজ উদ্দিন। এর পর বন্ধু সমাজ কল্যাণ সোসাইটির সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ শুরু করে ডেনিম এক্সপার্ট। কারখানা পরিদর্শন করার জন্য বন্ধু’র সদস্য এবং হিজড়া প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানায় ডেনিম এক্সপার্ট কর্মকর্তারা। পেশাদার পরিবেশে হিজড়াদের একসঙ্গে কাজ করা যেতে পারে এমন উপায় অন্বেষণ করেন তারা। এজন্য একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এতে অংশগ্রহণের জন্য কারখানার প্রত্যেক বিভাগের একজন কর্মকর্তাকে নির্বাচন করা হয়। বন্ধু সংগঠনের সদস্যরা এবং হিজড়াদের প্রতিনিধি শিমা আক্তার, দিলরুবা আক্তার, আখি সুলতানা ও মনিসহ প্রায় ৫০ জন হিজড়া কর্মশালায় অংশ নেন। ডেনিম এক্সপার্টের কর্মকর্তারা হিজড়াদের স্বীকৃতি প্রদানের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোকপাত করেন। বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠী তাদের পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কিন্তু ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড বিশ্বাস করে, তাদের সমাজের মূলধারায় আনার এখনই সময়। এছাড়া জাতিসংঘের ঘোষিত টেকসই উন্নয়নের জন্য দরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন।
কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফিজ উদ্দিন বলেন, কর্মক্ষেত্র সবার জন্য সমান। হিজড়াদের মূল্যায়ন করা উচিত। হিজড়াদের নিয়ে লিঙ্গ, ধর্ম বা যৌন প্ররোচনা সত্ত্বেও সকলের সমান সুযোগ দেয়ার তাগিদ থেকেই তাদের কাজ দেয়ার চেষ্টা করছি। হিজড়াদের অন্যদের মতো সমান সুযোগ-সুবিধা দিতে ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড ও বন্ধু সোসাইটির মাঝে একটি অংশীদারিত্ব হয়েছে। মোস্তফিজ উদ্দিন বলেন, শিমা আক্তার ও দিলরুবা আক্তার হিজড়া কমিউনিটির সদস্য। তারা আমার কারখানায় কাজ শুরু করেছে। এজন্য আমি খুবই গর্বিত। শিমা ও দিলরুবাও গর্বিত ও আনন্দিত। কারণ তারা কখনো ভাবেননি যে সমাজের এতো বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে।
অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাস্তায়-বাসে-দোকানে সাহায্য নেয়ার নামে জোর করে টাকা আদায়ের মতো কাজ করে বলে হিজড়ারা সমাজের চোখে নেতিবাচক ইমেজের মানুষ হিসেবে চিহ্নিত। অন্যদিকে তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিরও অভিযোগ রয়েছে। হিজড়াদের অনেকেই স্বীকার করেছেন, পেটের দায়ে তারা এসব করেন।
তবে সব প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে হিজড়া শিমা আক্তার ও দিলরুবা নিজেকে পরিণত করেছেন দক্ষ শ্রমিক হিসেবে। নিজের মেধা আর অদম্য ইচ্ছা দিয়ে জয় করেছেন সকল বাধা। চট্টগ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশ ডেনিম এক্সপার্টা লিমিটেড নামের তৈরি পোশাক কারখানার নিরাপত্তা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে তারা এখন কারখানার সবার প্রিয় মুখ।
দিলরুবা আক্তার জানান, ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড শুধু একটি কারখানা নয়, এটি আমার কাছে এখন একটি পরিবার। সমস্ত কর্মচারী আমাকে শ্রদ্ধা করে এবং আমার কাজে আমাকে সাহায্য করে। এই কাখানায় চাকরি করায় সমাজে আমার গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। এছাড়া এই চাকরি ইতিমধ্যে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের দরজা খুলতে সাহায্য করছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ডেনিম কারখানায় যোগদান করার আগে আমার পরিবার আমাকে অসম্মানিত করেছিল এবং আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। কিন্তু এখন আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। দিলরুবার দায়িত্ব সুপারভাইজারের নির্দেশনায় অফিসের পরিচ্ছন্নতা ও রক্ষণাবেক্ষণ।
শিমা আক্তার বলেন, পোশাক খাতের একজন কর্মী হয়ে আমি গর্বিত। আমার আর অন্যদের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে না। এই করখানার সবাই খুব সহায়ক এবং আমাদের খুব ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। কারখানা মালিক মোস্তাফিজ উদ্দিন আমাকে সম্মান করেন এবং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পর্ষদ খুব সহায়ক। আমি আমার সর্বোচ্চ শ্রম দিয়ে সেরা হওয়ার চেষ্টা করছি। শিমা উৎপাদন কাঠামোর নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার কাছে নিয়োজিত। এতে অগ্নি এবং বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা সভার ব্যবস্থা করা, শ্রমিকদের পরিচয়পত্র এবং ইউনিফর্ম পর্যবেক্ষণ করা এবং নিরাপত্তা কমিটির সঙ্গে কাজ করা।
বন্ধু সমাজ কল্যাণ সোসাইটির প্রধান নির্বাহী সালেহ আহমেদ বলেন, হিজড়ারা প্রায়শই সমাজ ও তাদের পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তখন এটা নিয়ে আমি ভাবতে থাকি। তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ দিলে সমাজ ও দেশে অবদান রাখতে পারবে। এজন্য বন্ধু এবং ইউএসএআইডি-এর সঙ্গে একটি অংশীদারিত্বের মধ্যে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরে হিজড়ারা ডেনিম এক্সপার্ট পরিবারে সদস্য হয়ে যান। অর্থাৎ বাংলাদেশে হিজড়াদের অন্তর্ভুক্তির পদক্ষেপ হিসেবে প্রথম পোশাক কারখানা এটি। কারখানায় শিমা ও দিলরুবাকে কোম্পানির শ্রমিকরা তাদের ভালোভাবে গ্রহণ করেছে। তারা তাদের দায়িত্ব সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য শ্রমিকদের সঙ্গে ভালোভাবে কাজ করছে।
মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, একজন উদ্যোক্তা হিসাবে চাই সবাই উপকৃত হোক। কেবল ডেনিম শিল্পেই হিজড়ারা কাজ করবে তা নয়। বিশ্বাস করি প্রত্যেক কারখানা মালিক যেন তাদের কর্মসংস্থানে এগিয়ে আসে। তিনি বলেন, হিজড়াদের নিয়ে কারখানায় কয়েকটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রয়োজনীয় সচেতনতা-বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ প্রদান, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের কাজে সহায়তা প্রদান এবং এইচআর বিভাগের ব্যবস্থাপনায় কর্মীদের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করা। কারখানায় তাদের দীর্ঘমেয়াদি ক্যারিয়ারের জন্য তাদের সবার সাফল্য কামনা করছি।
তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সহসভাপতি মোহাম্মাদ নাছির জানান, হিজড়াদের কর্মসংস্থান ও উন্নয়নে আমাদের হাতে প্রকল্প রয়েছে। তবে প্রতিবন্ধীদের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিজিএমইএ সফলতা পেয়েছে। ইতিমধ্যেই সারা দেশের পোশাক কারখানায় প্রায় ২ থেকে আড়াই হাজার প্রতিবন্ধী শ্রমিক কাজ করছে। তারা যোগ্যতার সঙ্গে ভূমিকা রাখছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, যদি প্রতিটি কারখানায় অন্তত ৪ থেকে ৫ জন করে নিয়োগ দেয়া গেলে ৪ হাজার কারখানাতে বড় সংখ্যক হিজড়াদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হতে পারতো। কিন্তু এটি এখনও হয়ে উঠেনি। তবে যেহেতু শুরু হয়েছে আগামীতে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ আরো বাড়বে বলে জানান তিনি।
No comments