এইসব অসভ্যতা বন্ধ হবে কবে? by মরিয়ম চম্পা
চলন্ত
বাসে উঠার জন্য লড়াই চলছে। কেউ উঠতে পারছেন। কেউ পারছেন না। সবচেয়ে বেশি
বিপাকে নারীরা। ভিড় ঠেলে বাসের কাছে পৌঁছানোই দায়। ধাক্কাধাক্কির ভোগান্তি।
বাসের হেলপারের অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ। রোববার সকাল সাড়ে ১০ টায় প্রায়
একইরকম দৃশ্যের দেখা মেলে রাজধানীর ফার্মগেট, বাংলামোটর, ধানমন্ডি ও
শাহ্বাগে।
অবশ্য এ চিত্র রোজকার দেখা যায়। দিনের পর দিন। মাসের পর মাস। বছরের পর বছর। এই হয়রানি। খোদ রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন নানা প্রয়োজনে নারীদের রাস্তায় বের হতে হয়। কেউ কর্মজীবী, কেউ শিক্ষার্থী, কেউবা নিজের আদরের সন্তানটিকে স্কুল থেকে আনতে যাচ্ছেন। প্রতিনিয়ত এসব নারীর বড় অংশকেই কোনো না কোনো হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়। এসব অঘটনগুলো ভেঙেচুরে দেয় নারীর মনোজগৎ। তছনছ করে দেয় নারীর আত্মবিশ্বাসকে। নানা মানসিক যন্ত্রণায় ভোগেন অনেকে।
নারীদের রাস্তাঘাটে চলাচল যেন এক ধরনের যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের কথা অনেকটা আক্ষেপ করে শোনালেন একাধিক নারী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও পাশাপাশি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মিথিলা। মোহাম্মদপুর থেকে নিয়মিত ধানমন্ডি আসা-যাওয়া করেন তিনি। মিথিলা বলেন, বাসে উঠতে রীতিমতো লড়াই করতে হয়। ভিড় ঠেলে বাসে উঠা খুবই কষ্টকর। হেলপারদের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণতো আছেই। ওরা বাসে উঠতে সাহায্য করার নামে পিঠে হাত দেয়। নিষেধ করলেও শোনে না। বলে না ধরলে পইরা গেলেতো দোষ দিবেন হেলপার আর ড্রাইভারের।
বাসে উঠার পর বসার আসন পাওয়া যায় না বেশির ভাগ দিন। মিনিবাসে তিন চারটি এবং বড় বাসে নয়টি সংরক্ষিত আসন থাকলেও পুরুষ যাত্রীরা ওইসব আসনে বসে থাকেন। আর উঠতে বললে বলেন, সমান অধিকার চাইলে দাঁড়িয়ে চলাফেরা করতে শিখুন। তিনি বলেন, কখনোও কখনোও বাসে ভিড় থাকলে হেলপাররা সিট খালি নেই বলে তুলতে চায় না। তাদের ধারণা নারী যাত্রীরা বাসে উঠতে-নামতে সময় বেশি নেয়। দাঁড়িয়ে যেতে বেশি জায়গা লাগে। সন্ধ্যার পর বাসে উঠা আরও কঠিন হয়ে ওঠে।
ফার্মগেট তেজতুরী বাজারের একটি ছাত্রী হোস্টেলে বাস করা নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী বলেন, ভর্তি কোচিং উপলক্ষে প্রথম হোস্টেলে উঠি। প্রথমদিকে কোচিং ক্লাস করতে যাওয়ার সময় হোস্টেলের গেটে ৫-৬ জন কম বয়সী ছেলে পথ আটকে বসে থাকতো। অনেক কষ্টে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে কোচিং এর গেট পর্যন্ত পৌঁছতে আরেক দফা হয়রানির শিকার হতে হতো ফুটপাতের হকার ও পথচারীদের দ্বারা। প্রথম একবছর ফার্মগেটের ওভারব্রিজের নিচ দিয়ে যেতে কেটেছে অপরিচিত ব্যক্তিদের ধাক্কা ও কটূক্তি শুনে। কখন যে শরীরে ধাক্কা দিয়ে অবুঝের মতো চলে যেতেন বুঝতেই পারতাম না। প্রায়সই হোস্টেলে ফিরে অনেক কান্না করতাম। মনে হতো পুরো শরীরটাই যেন নোংরা হয়ে গেছে। যেখানে ধাক্কা খেতাম সেই স্থানটা পানি দিয়ে বারবার ধুয়েও যেন স্বস্তি পেতাম না। এরপরই স্থির করতাম এই শহরেই থাকবো না। রাগে দুঃখে বাবাকে ফোন দিয়ে বলতাম বাবা আমি এখানে থাকতে চাই না। আমাকে এসে নিয়ে যাও। আমি ঢাকাতে আর পড়বো না। বাবা বলতেন মামনি, পরিবেশ পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনাটাও একধরনের পরীক্ষা। একপর্যায়ে মোটা ও শক্ত মলাটের একধরনের ব্যাংকের ডায়রি ব্যবহার করা শুরু করি। ছোটবেলায় স্কুলে যাওয়ার সময় যেভাবে বুকের সামনে বই আগলে রাখতাম ঠিক একই ভাবে ডায়রি ব্যবহার শুরু করি। যেন কোনো অপরিচিত পথচারী ধাক্কা দিলে বরং সে নিজেই ব্যথা পায়। এভাবে আরও কতোদিন শক্ত মলাটের ডায়রি ব্যবহার করতে হবে জানি না।
নারী অধিকারকর্মী কাশফিয়া ফিরোজ বলেন, ২০১৪ সালে একটি ‘বেইজ লাইন সার্ভে’ করা হয়। ২০১৭ সালে ‘নারীর সংবেদনশীল নগর পরিকল্পনা’- শিরোনামে বেসরকারি সংস্থা একশন এইড-এর প্রকাশিত এই গবেষণায় দেখা যায় হয়রানির নানা চিত্র। নগর উন্নয়নে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রকল্প নকশা ও বাস্তবায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যাস্বল্পতার কারণে নারীবান্ধব নগর কাঠামো গড়ে ওঠেনি। এর ফলে রাস্তাঘাট, ফুটপাত, মার্কেট, পরিবহন ব্যবস্থা, পাবলিক টয়লেট, পার্ক ইত্যাদি গণপরিসরে নারীদের স্বাভাবিক উপস্থিতি ও বিচরণ যথেষ্ট সীমিত ও ঝুঁকিপূর্ণ। আরো হতাশার দিক হলো- একজন নারী কিন্তু একাধিকবার একাধিক ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। যেমন গড়ে একজন নারী তিন মাসে ৪ থেকে ৫ বার অশোভন আচরণের সম্মুখীন হয়েছেন, একইভাবে ৪ থেকে ৫ বার অপরিচিতের কাছ থেকে কুপ্রস্তাব পেয়েছেন। এবং ২ থেকে ৩ বার অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শের মতো হয়রানির সম্মুখীন হয়েছেন। যৌন হয়রানি বা নির্যাতন কোনো বিশেষ বয়সের নারীর ক্ষেত্রেই ঘটে না। কিশোরী বা প্রাপ্ত বয়স্ক সব বয়সের নারীর ক্ষেত্রেই এটা ঘটতে পারে।
সুমাইয়া খাতুন সুমী। পেশায় একজন ব্যাংকার। থাকেন পল্টনে। চাকরি করেন গাবতলীর একটি ব্যাংকে। পল্টন বাসস্ট্যান্ড থেকে ওয়েলকাম নইলে অন্য বাসে চড়ে গাবতলী যান। গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে নেমে নিরাপদ রাস্তা পারাপারের জন্য তিনি গাবতলীর আন্ডারপাস ব্যবহার করতেন। কিন্তু অপর্যাপ্ত আলো এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে তিনি তা ব্যবহার থেকে বিরত রয়েছেন।
সুমাইয়া খাতুন বলেন, পর্যাপ্ত আলো না থাকায় গাবতলী আন্ডারপাসের ভেতরে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের আনাগোনা বেশি। একদিন আন্ডারপাস দিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি সেখানে বসে নেশা করছিল। তারা তাকে উদ্দেশ্য করে খারাপ কথা বলে। আন্ডারপাসের ভেতরে পরিবেশ ভালো না হওয়ার কারণে মেয়েরা এই আন্ডারপাস ব্যবহারও কম করে। এরপর থেকে তিনিও আর নিরাপত্তাহীনতার কারণে গাবতলীর আন্ডারপাস ব্যবহার করেন না। ঝুঁকি নিয়েই রাস্তা পারাপার হন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স এর সাধারণ সম্পাদক ও পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়নে নারীর চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় আসে না। এর কারণ নগর উন্নয়নে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রকল্প নকশা ও বাস্তবায়নে নারীর অংশগ্রহণ কম। ফলে নারীবান্ধব নগর কাঠামো তৈরি হয়নি।
ঢাকা শহরে নারীবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে কোন বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেয়া দরকার এ প্রসঙ্গে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবীর বলেন, দেশে জেন্ডার সংবেদনশীল পরিবেশ এখনও গড়ে ওঠেনি। স্কুল-কলেজের মেয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়ার জন্য কোনো পাবলিক গাড়ি নেই। স্কুলে স্বাস্থ্যসম্মত বাথরুম নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের জন্য বাথরুমের সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। বাথরুম নোংরা হওয়ার কারণে মেয়েরা তা ব্যবহার করা এড়িয়ে যায়। গার্মেন্টস কর্মীদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ফুটপাতে যে সব নারী, মেয়ে, শিশু অবস্থান করেন তাদের পাবলিক টয়লেট নেই। এর ফলে ইউরিন ইনফেকশনে ভোগেন তারা।
সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ঘরে নারী যেমন সুরক্ষা পাবে, তেমনি নারী ঘরের বাইরে সুরক্ষা পাবে। তাদের কেন্দ্রে রেখে পরিকল্পনা করতে হবে। যেমন- কর্মস্থল, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে নারী যাবেন তার যাতায়াতের নিরাপত্তার জন্য রাস্তাঘাট, ফুটপাত, পরিবহন কতখানি নিরাপদ। এই বিষয়গুলো গুরুত্ব দিতে হবে। নারীর চলাচলে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট- রিকশা, বাস, টেম্পো, সিএনজি। সিএনজি, বেবিট্যাক্সি মেয়েদের চলাচলের জন্য কতটা নিরাপদ তা ট্রাফিক পুলিশকে দেখতে হবে। বাসে ড্রাইভার, হেলপার মেয়ে যাত্রীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করে কিনা তাও ট্রাফিক পুলিশেরই দেখার দায়িত্ব। এ ছাড়া মেয়েদের জন্য আলাদা বাসের পরিমাণ বাড়ানো দরকার। নইলে সাধারণ বাসে মেয়েদের আগে ওঠার ব্যবস্থা করা এবং তাদের সঙ্গে অসৌজন্য আচরণ কমানোর দায়িত্ব পরিবহন ম্যানেজমেন্টের।
ব্র্যাক-এর জেন্ডার প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর নিশাত সুলতানা বলেন, সম্প্রতি আমরা ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনা মুক্ত সড়ক’- শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি। যেখানে দেখা গেছে গণপরিবহনে শতকরা ৯৪ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন।
ব্র্যাক’র সড়ক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক আহমেদ নাজমুল হোসেইন বলেন, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সচেতনতার অংশ হিসেবে আমরা গাজীপুর, টাঙ্গাইল মহাসড়কের আশেপাশের ১০০ টি স্কুলে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছি। এসব স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সড়ক নিরাপত্তা ও যৌন হয়রানি সম্পর্কে তথ্য জানানো ও প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। ২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে জুন এই তিন মাস গবেষণাকর্মটি পরিচালিত হয়। ৪১৫ জন নারী এই জরিপে অংশগ্রহণ করেন। মূলত ঢাকা, গাজীপুর ও সাভারের বিরুলিয়া এলাকায় নগর, উপনগর এবং গ্রামাঞ্চল এই তিন অঞ্চলের নিম্ন ও নিম্ন মধ্য আয়ের পরিবারের নারীদের গণপরিবহন ব্যবহারের অভিজ্ঞতার ওপর জরিপটি পরিচালনা করা হয়।
গণপরিবহনে ৯৪ শতাংশ নারী কোনো না কোনো সময় মৌখিক, শারীরিক এবং অন্যান্য যৌন হয়রানির শিকার হন। এরমধ্যে ৬৬ শতাংশ নারী জানায়, ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষদের দ্বারাই নারীরা বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হন। ৩৫ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, তারা ১৯-২৫ বছর বয়সী পুরুষদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। গণপরিবহনে নারী নির্যাতনে কারণ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ না থাকা, বাসে অতিরিক্ত ভিড়, যানবাহনে পর্যাপ্ত আলো না থাকা, তদারকির (সিসিটিভি ফুটেজ মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকা) অভাবে নারীদের ওপর যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গণপরিবহন ব্যবহারকারী উত্তরদাতারা বলেন, শারীরিক যৌন হায়রানির মধ্যে রয়েছে ইচ্ছাকৃত স্পর্শ করা, চিমটি কাটা, কাছে ঘেঁষে দাঁড়ানো, আস্তে ধাক্কা দেয়া, নারীদের চুল স্পর্শ করা, কাঁধে হাত রাখা, হাত, বুক বা শরীরের অন্যান্য অংশ দিয়ে নারীর শরীর স্পর্শ করা ইত্যাদি। এসব ঘটনায় ৮১ শতাংশ নারী চুপ থাকেন। ৭৯ শতাংশ আক্রান্ত হওয়ার স্থান থেকে সরে আসেন।
অবশ্য এ চিত্র রোজকার দেখা যায়। দিনের পর দিন। মাসের পর মাস। বছরের পর বছর। এই হয়রানি। খোদ রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন নানা প্রয়োজনে নারীদের রাস্তায় বের হতে হয়। কেউ কর্মজীবী, কেউ শিক্ষার্থী, কেউবা নিজের আদরের সন্তানটিকে স্কুল থেকে আনতে যাচ্ছেন। প্রতিনিয়ত এসব নারীর বড় অংশকেই কোনো না কোনো হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়। এসব অঘটনগুলো ভেঙেচুরে দেয় নারীর মনোজগৎ। তছনছ করে দেয় নারীর আত্মবিশ্বাসকে। নানা মানসিক যন্ত্রণায় ভোগেন অনেকে।
নারীদের রাস্তাঘাটে চলাচল যেন এক ধরনের যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের কথা অনেকটা আক্ষেপ করে শোনালেন একাধিক নারী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও পাশাপাশি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মিথিলা। মোহাম্মদপুর থেকে নিয়মিত ধানমন্ডি আসা-যাওয়া করেন তিনি। মিথিলা বলেন, বাসে উঠতে রীতিমতো লড়াই করতে হয়। ভিড় ঠেলে বাসে উঠা খুবই কষ্টকর। হেলপারদের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণতো আছেই। ওরা বাসে উঠতে সাহায্য করার নামে পিঠে হাত দেয়। নিষেধ করলেও শোনে না। বলে না ধরলে পইরা গেলেতো দোষ দিবেন হেলপার আর ড্রাইভারের।
বাসে উঠার পর বসার আসন পাওয়া যায় না বেশির ভাগ দিন। মিনিবাসে তিন চারটি এবং বড় বাসে নয়টি সংরক্ষিত আসন থাকলেও পুরুষ যাত্রীরা ওইসব আসনে বসে থাকেন। আর উঠতে বললে বলেন, সমান অধিকার চাইলে দাঁড়িয়ে চলাফেরা করতে শিখুন। তিনি বলেন, কখনোও কখনোও বাসে ভিড় থাকলে হেলপাররা সিট খালি নেই বলে তুলতে চায় না। তাদের ধারণা নারী যাত্রীরা বাসে উঠতে-নামতে সময় বেশি নেয়। দাঁড়িয়ে যেতে বেশি জায়গা লাগে। সন্ধ্যার পর বাসে উঠা আরও কঠিন হয়ে ওঠে।
ফার্মগেট তেজতুরী বাজারের একটি ছাত্রী হোস্টেলে বাস করা নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী বলেন, ভর্তি কোচিং উপলক্ষে প্রথম হোস্টেলে উঠি। প্রথমদিকে কোচিং ক্লাস করতে যাওয়ার সময় হোস্টেলের গেটে ৫-৬ জন কম বয়সী ছেলে পথ আটকে বসে থাকতো। অনেক কষ্টে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে কোচিং এর গেট পর্যন্ত পৌঁছতে আরেক দফা হয়রানির শিকার হতে হতো ফুটপাতের হকার ও পথচারীদের দ্বারা। প্রথম একবছর ফার্মগেটের ওভারব্রিজের নিচ দিয়ে যেতে কেটেছে অপরিচিত ব্যক্তিদের ধাক্কা ও কটূক্তি শুনে। কখন যে শরীরে ধাক্কা দিয়ে অবুঝের মতো চলে যেতেন বুঝতেই পারতাম না। প্রায়সই হোস্টেলে ফিরে অনেক কান্না করতাম। মনে হতো পুরো শরীরটাই যেন নোংরা হয়ে গেছে। যেখানে ধাক্কা খেতাম সেই স্থানটা পানি দিয়ে বারবার ধুয়েও যেন স্বস্তি পেতাম না। এরপরই স্থির করতাম এই শহরেই থাকবো না। রাগে দুঃখে বাবাকে ফোন দিয়ে বলতাম বাবা আমি এখানে থাকতে চাই না। আমাকে এসে নিয়ে যাও। আমি ঢাকাতে আর পড়বো না। বাবা বলতেন মামনি, পরিবেশ পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনাটাও একধরনের পরীক্ষা। একপর্যায়ে মোটা ও শক্ত মলাটের একধরনের ব্যাংকের ডায়রি ব্যবহার করা শুরু করি। ছোটবেলায় স্কুলে যাওয়ার সময় যেভাবে বুকের সামনে বই আগলে রাখতাম ঠিক একই ভাবে ডায়রি ব্যবহার শুরু করি। যেন কোনো অপরিচিত পথচারী ধাক্কা দিলে বরং সে নিজেই ব্যথা পায়। এভাবে আরও কতোদিন শক্ত মলাটের ডায়রি ব্যবহার করতে হবে জানি না।
নারী অধিকারকর্মী কাশফিয়া ফিরোজ বলেন, ২০১৪ সালে একটি ‘বেইজ লাইন সার্ভে’ করা হয়। ২০১৭ সালে ‘নারীর সংবেদনশীল নগর পরিকল্পনা’- শিরোনামে বেসরকারি সংস্থা একশন এইড-এর প্রকাশিত এই গবেষণায় দেখা যায় হয়রানির নানা চিত্র। নগর উন্নয়নে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রকল্প নকশা ও বাস্তবায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যাস্বল্পতার কারণে নারীবান্ধব নগর কাঠামো গড়ে ওঠেনি। এর ফলে রাস্তাঘাট, ফুটপাত, মার্কেট, পরিবহন ব্যবস্থা, পাবলিক টয়লেট, পার্ক ইত্যাদি গণপরিসরে নারীদের স্বাভাবিক উপস্থিতি ও বিচরণ যথেষ্ট সীমিত ও ঝুঁকিপূর্ণ। আরো হতাশার দিক হলো- একজন নারী কিন্তু একাধিকবার একাধিক ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। যেমন গড়ে একজন নারী তিন মাসে ৪ থেকে ৫ বার অশোভন আচরণের সম্মুখীন হয়েছেন, একইভাবে ৪ থেকে ৫ বার অপরিচিতের কাছ থেকে কুপ্রস্তাব পেয়েছেন। এবং ২ থেকে ৩ বার অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শের মতো হয়রানির সম্মুখীন হয়েছেন। যৌন হয়রানি বা নির্যাতন কোনো বিশেষ বয়সের নারীর ক্ষেত্রেই ঘটে না। কিশোরী বা প্রাপ্ত বয়স্ক সব বয়সের নারীর ক্ষেত্রেই এটা ঘটতে পারে।
সুমাইয়া খাতুন সুমী। পেশায় একজন ব্যাংকার। থাকেন পল্টনে। চাকরি করেন গাবতলীর একটি ব্যাংকে। পল্টন বাসস্ট্যান্ড থেকে ওয়েলকাম নইলে অন্য বাসে চড়ে গাবতলী যান। গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে নেমে নিরাপদ রাস্তা পারাপারের জন্য তিনি গাবতলীর আন্ডারপাস ব্যবহার করতেন। কিন্তু অপর্যাপ্ত আলো এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে তিনি তা ব্যবহার থেকে বিরত রয়েছেন।
সুমাইয়া খাতুন বলেন, পর্যাপ্ত আলো না থাকায় গাবতলী আন্ডারপাসের ভেতরে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের আনাগোনা বেশি। একদিন আন্ডারপাস দিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি সেখানে বসে নেশা করছিল। তারা তাকে উদ্দেশ্য করে খারাপ কথা বলে। আন্ডারপাসের ভেতরে পরিবেশ ভালো না হওয়ার কারণে মেয়েরা এই আন্ডারপাস ব্যবহারও কম করে। এরপর থেকে তিনিও আর নিরাপত্তাহীনতার কারণে গাবতলীর আন্ডারপাস ব্যবহার করেন না। ঝুঁকি নিয়েই রাস্তা পারাপার হন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স এর সাধারণ সম্পাদক ও পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়নে নারীর চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় আসে না। এর কারণ নগর উন্নয়নে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রকল্প নকশা ও বাস্তবায়নে নারীর অংশগ্রহণ কম। ফলে নারীবান্ধব নগর কাঠামো তৈরি হয়নি।
ঢাকা শহরে নারীবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে কোন বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেয়া দরকার এ প্রসঙ্গে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবীর বলেন, দেশে জেন্ডার সংবেদনশীল পরিবেশ এখনও গড়ে ওঠেনি। স্কুল-কলেজের মেয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়ার জন্য কোনো পাবলিক গাড়ি নেই। স্কুলে স্বাস্থ্যসম্মত বাথরুম নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের জন্য বাথরুমের সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। বাথরুম নোংরা হওয়ার কারণে মেয়েরা তা ব্যবহার করা এড়িয়ে যায়। গার্মেন্টস কর্মীদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ফুটপাতে যে সব নারী, মেয়ে, শিশু অবস্থান করেন তাদের পাবলিক টয়লেট নেই। এর ফলে ইউরিন ইনফেকশনে ভোগেন তারা।
সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ঘরে নারী যেমন সুরক্ষা পাবে, তেমনি নারী ঘরের বাইরে সুরক্ষা পাবে। তাদের কেন্দ্রে রেখে পরিকল্পনা করতে হবে। যেমন- কর্মস্থল, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে নারী যাবেন তার যাতায়াতের নিরাপত্তার জন্য রাস্তাঘাট, ফুটপাত, পরিবহন কতখানি নিরাপদ। এই বিষয়গুলো গুরুত্ব দিতে হবে। নারীর চলাচলে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট- রিকশা, বাস, টেম্পো, সিএনজি। সিএনজি, বেবিট্যাক্সি মেয়েদের চলাচলের জন্য কতটা নিরাপদ তা ট্রাফিক পুলিশকে দেখতে হবে। বাসে ড্রাইভার, হেলপার মেয়ে যাত্রীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করে কিনা তাও ট্রাফিক পুলিশেরই দেখার দায়িত্ব। এ ছাড়া মেয়েদের জন্য আলাদা বাসের পরিমাণ বাড়ানো দরকার। নইলে সাধারণ বাসে মেয়েদের আগে ওঠার ব্যবস্থা করা এবং তাদের সঙ্গে অসৌজন্য আচরণ কমানোর দায়িত্ব পরিবহন ম্যানেজমেন্টের।
ব্র্যাক-এর জেন্ডার প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর নিশাত সুলতানা বলেন, সম্প্রতি আমরা ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনা মুক্ত সড়ক’- শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি। যেখানে দেখা গেছে গণপরিবহনে শতকরা ৯৪ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন।
ব্র্যাক’র সড়ক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক আহমেদ নাজমুল হোসেইন বলেন, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সচেতনতার অংশ হিসেবে আমরা গাজীপুর, টাঙ্গাইল মহাসড়কের আশেপাশের ১০০ টি স্কুলে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছি। এসব স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সড়ক নিরাপত্তা ও যৌন হয়রানি সম্পর্কে তথ্য জানানো ও প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। ২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে জুন এই তিন মাস গবেষণাকর্মটি পরিচালিত হয়। ৪১৫ জন নারী এই জরিপে অংশগ্রহণ করেন। মূলত ঢাকা, গাজীপুর ও সাভারের বিরুলিয়া এলাকায় নগর, উপনগর এবং গ্রামাঞ্চল এই তিন অঞ্চলের নিম্ন ও নিম্ন মধ্য আয়ের পরিবারের নারীদের গণপরিবহন ব্যবহারের অভিজ্ঞতার ওপর জরিপটি পরিচালনা করা হয়।
গণপরিবহনে ৯৪ শতাংশ নারী কোনো না কোনো সময় মৌখিক, শারীরিক এবং অন্যান্য যৌন হয়রানির শিকার হন। এরমধ্যে ৬৬ শতাংশ নারী জানায়, ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষদের দ্বারাই নারীরা বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হন। ৩৫ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, তারা ১৯-২৫ বছর বয়সী পুরুষদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। গণপরিবহনে নারী নির্যাতনে কারণ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ না থাকা, বাসে অতিরিক্ত ভিড়, যানবাহনে পর্যাপ্ত আলো না থাকা, তদারকির (সিসিটিভি ফুটেজ মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকা) অভাবে নারীদের ওপর যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গণপরিবহন ব্যবহারকারী উত্তরদাতারা বলেন, শারীরিক যৌন হায়রানির মধ্যে রয়েছে ইচ্ছাকৃত স্পর্শ করা, চিমটি কাটা, কাছে ঘেঁষে দাঁড়ানো, আস্তে ধাক্কা দেয়া, নারীদের চুল স্পর্শ করা, কাঁধে হাত রাখা, হাত, বুক বা শরীরের অন্যান্য অংশ দিয়ে নারীর শরীর স্পর্শ করা ইত্যাদি। এসব ঘটনায় ৮১ শতাংশ নারী চুপ থাকেন। ৭৯ শতাংশ আক্রান্ত হওয়ার স্থান থেকে সরে আসেন।
No comments