থমথমে পাহাড় হরতালের ডাক by আলমগীর মানিক
থমথমে
পাহাড়। দু’দিনের ছয় হত্যাকাণ্ডে পাহাড়জুড়ে নেমে এসেছে আতঙ্ক। নানিয়ারচরের
একমাত্র সড়কপথে যান চলাচল প্রায় বন্ধ। এ অবস্থায় ৭ ও ৮ই মে তিন পার্বত্য
জেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছে পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ।
শুক্রবার ব্রাশফায়ারে গাড়িচালক সজীব হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এ হরতালের ডাক
দেয়া হয়। ওদিকে উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা ও গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফের
৬ নেতাকর্মী হত্যাকাণ্ডের পর সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এ তথ্য জানিয়ে নানিয়ারচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা
আবদুল লতিফ বলেছেন, নানিয়ারচরের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বিভিন্ন
স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পাহাড়ে উত্তপ্ত এ পরিস্থিতি
পরিদর্শনে গতকাল নানিয়ারচর গেছেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি ড. এসএম
মনির-উজ-জামান। এ সময় তিনি জনগণকে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন,
পুলিশ জীবন দিয়ে হলেও জনগণের জানমাল রক্ষা করবে। তিনি বলেন, এখন থেকে
পাহাড়ে পুলিশ নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। ডিআইজি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের
শান্ত পরিবেশকে যারা অশান্ত করতে চায় তারাই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে।
পাহাড়ে অস্ত্রধারী, চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চলমান
থাকবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। বিকালে নানিয়ারচর উপজেলা সদরে আয়োজিত এক
মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
ওদিকে, নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেএসএস এমএন লারমা গ্রুপের সহ-সভাপতি শক্তিমান চাকমা, ইউপিডিএফ সংস্কার গ্রুপের প্রধান তপনজ্যোতি বর্মাসহ ছয় হত্যাকাণ্ডের মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানান ওসি। উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের ব্রাশ ফায়ারে শুক্রবার দুপুরে বেতছড়িতে বাঙ্গালী গাড়িচালক সজীব হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিন পার্বত্য জেলায় ৬ই মে কালো পতাকা উত্তোলন, ৭ ও ৮ই মে সকাল সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছে পার্র্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদ।
বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. শাহাদাৎ হোসেন সাকিব বলেন, গাড়িচালক সজীব হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও মহালছড়ি থেকে অপহৃত তিন বাঙ্গালীকে উদ্ধার করার দাবিতে তারা এই কর্মসূচি দিয়েছে। তিনি বলেন, সজীব হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও অপহৃত বাঙ্গালীদের মুক্তি না দিলে আরো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে।
এক বছরে ৪২ খুন
পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইকে কেন্দ্র করে ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পাহাড়। এলাকার দখল চাঁদাবাজির এলাকা নির্ধারণ এবং নিজেদের প্রতিপত্তি প্রকাশের হীন মানসিকতায় ক্রমেই প্রাণ হারাচ্ছে পাহাড়ের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। গত এক বছরে পার্বত্য তিন জেলায় আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে ৪২ খুন এবং ২৫ জন গুলিবিদ্ধ কিংবা আক্রমণের শিকার হয়েছেন। পাশাপাশি পাহাড়ে শতাধিক অপহরণের ঘটনাও ঘটিয়েছে আঞ্চলিক দলীয় সন্ত্রাসীরা। সংগঠনগুলোর ধার্যকৃত চাঁদা পরিশোধের বিড়ম্বনার সঙ্গে এই ধরনের হিংসা হানাহানি ও ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে পাহাড়ের মানুষ। সর্বশেষ চলতি মাসের ৩ ও ৪ঠা এপ্রিল মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুই শীর্ষ নেতাসহ ৬ জন আর গত এক মাসে রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়িতে অন্তত ১২ জন খুন হয়েছেন। এ সময় ১৫ জনেরও অধিক গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আহত হয়েছেন। যার মধ্যে ৪ঠা এপ্রিলই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ৮ জন। বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রতিপক্ষ পার্বত্য চুক্তি বিরোধী সংগঠন ইউপিডিএফ এর সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জেএসএস (এমএন লারমা) এর কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমা। এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে শক্তিমানের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান শেষে ফেরার পথে আবারো সেই একই পক্ষের অতর্কিত ব্রাশ ফায়ারে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক-এর প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মা ও জেএসএস এম এন লারমা সমর্থিত ৫ নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন।
নিহতদের মধ্যে পাহাড়ের সংগঠন ইউপিডিএফ’র (গণতান্ত্রিক) আহ্বাযক তপন জ্যোতি চাকমা বর্মা (৪৮), জেএসএস সংস্কার সমর্থিত সেতু লাল চাকমা (৪০) ভাড়ায় চালিত মাইক্রো চালক পানছড়ির বাসিন্দা মো. সজিব (৩৬), মহালছড়ি যুব সমিতির সুজন চাকমা (৩২) ও তুজিম চাকমা (২৯) বলে জানা গেছে।
ঘটনার সময় আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা তপন জ্যোতি চাকমাকে বহন করা মাক্রোবাস লক্ষ্য করে গুলি করলে ভাড়ায় চালিত মাইক্রোড্রাইভার গুলিবিদ্ধ হয়। এ সময় বিভক্ত আরো দু’অস্ত্র ধারী হামলাকারী গ্রুপ সে গাড়িতে গুলিবর্ষণ করলে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ সময় গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে পড়ে যায়। এ ঘটনার জন্য সংগঠনটি প্রতিপক্ষ গ্রুপ প্রসীত বিকাশ খীসা নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফকে দায়ী করছে।
এদিকে এর আগে, ১০ই এপ্রিল মহালছড়ি থেকে জেএসএস (এমএন লারমা) দলের দুই নেতাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা। এই ঘটনার একদিন পরেই ১১ই এপ্রিল নানিয়ারচরে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয় ইউপিডিএফ নেতা জনি চাকমাকে। এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে ১২ই এপ্রিল ইউপিডিএফ নামধারী সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র হামলায় জেএসএস(এমএন) লারমা দলের কালোময় চাকমা ও সাধন চাকমাকে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে সন্ত্রাসীরা কালোময় চাকমাকে মেরেই ক্ষান্ত হয়নি, তাকে পুড়িয়েও ফেলেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এদিকে ১৫ই এপ্রিল খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে উদ্ধার করা হয় এক বাঙালি যুবকের লাশ। তাকে অপহরণ করা হয়েছিল আরো দুইদিন আগেই। মোশারফ হোসেন নামে উদ্ধারকৃত যুবকের লাশের শরীরের বিভিন্ন অংশে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ।
১৫ই এপ্রিল রাত ৮টার সময় রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি ও খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় আঞ্চলিক দল ইউপিডিএফ ও জেএসএস (এমএন) এর মধ্যে চলা বন্দুকযুদ্ধে ইউপিডিএফর দুই নেতা বিজয় চাকমা ও তপন চাকমাকে গুলি করে হত্যা করে প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা। এই ঘটনার সময় দীঘিনালা থেকে এক চাকমা যুবকে অপহরণ করা হয়েছে বলেও জানা গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে হঠাৎ করেই আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে এই ধরনের হামলা-পাল্টা হামলাসহ খুন, গুম অপহরণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় ভাবিয়ে তুলেছে পাহাড়বাসীদের। অন্তর্কোন্দলে অগ্নিগর্ভ আকার ধারণ করছে পাহাড়ের বর্তমান পরিস্থিতি।
একের পর এক সশস্ত্র সংঘাতে ব্যাপকহারে হতাহতের ঘটনায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন পাহাড়ের জনপ্রতিনিধিরা। নিজেরা বড়ই অসহায়বোধ করছেন জানিয়ে রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অরুন চাকমা বলেন, আমাদের একজন জনপ্রতিনিধিকে প্রকাশ্যে মেরে ফেলল। বিষয়টি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আমি নিজেও এখন খুবই অসহায়বোধ করছি।
অপরদিকে নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান কোয়ালিটি চাকমা জানান, একজন নারী জনপ্রতিনিধি হয়ে বর্তমানে অত্যন্ত কঠিন সময় পার করছি। তিনি বলেন, আমাদের অবস্থা এখন অত্যন্ত শোচনীয়। চেয়ারম্যানকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা পরবর্তী সময়ে তিনিও খুব আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন জানিয়ে বলেন, আমরা আমাদের অবস্থান সম্পর্কে যদি বুঝেও না বোঝার ভান করি তাহলে পৃথিবীর কোনো শক্তিই আমাদের বোঝাতে বা সঠিক পথে ফেরাতে পারবে না।
রাঙ্গামাটি চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি বেলায়েত হোসেন ভূঁইয়া বলেন, আমরা ব্যবসায়িরাসহ রাঙ্গামাটিবাসী পাহাড়ের অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে পাহাড় থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি জানিয়ে আসছি। আমাদের দাবিগুলো যদি আমলে নিয়ে কাজ শুরু হতো তাহলে আজকের দিনের নৃশংস পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না।
এদিকে রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপার আলমগীর কবির বলেন, শুক্রবার একদিনেই পাঁচটি হত্যাসহ গুলিবিদ্ধের ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় আইনানুগ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা নেয়া যায় সে বিষয়ে সবার সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেবো। এক প্রশ্নের জবাবে এসপি বলেন, পাহাড়ে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, সমতলের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে পাহাড়ের পুলিশ বাহিনীকে তৈরি করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট দিলেই এই ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিপরীতে পুলিশ ত্বরিতভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবে।
ওদিকে, নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেএসএস এমএন লারমা গ্রুপের সহ-সভাপতি শক্তিমান চাকমা, ইউপিডিএফ সংস্কার গ্রুপের প্রধান তপনজ্যোতি বর্মাসহ ছয় হত্যাকাণ্ডের মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানান ওসি। উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের ব্রাশ ফায়ারে শুক্রবার দুপুরে বেতছড়িতে বাঙ্গালী গাড়িচালক সজীব হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিন পার্বত্য জেলায় ৬ই মে কালো পতাকা উত্তোলন, ৭ ও ৮ই মে সকাল সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছে পার্র্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদ।
বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. শাহাদাৎ হোসেন সাকিব বলেন, গাড়িচালক সজীব হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও মহালছড়ি থেকে অপহৃত তিন বাঙ্গালীকে উদ্ধার করার দাবিতে তারা এই কর্মসূচি দিয়েছে। তিনি বলেন, সজীব হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও অপহৃত বাঙ্গালীদের মুক্তি না দিলে আরো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে।
এক বছরে ৪২ খুন
পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইকে কেন্দ্র করে ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পাহাড়। এলাকার দখল চাঁদাবাজির এলাকা নির্ধারণ এবং নিজেদের প্রতিপত্তি প্রকাশের হীন মানসিকতায় ক্রমেই প্রাণ হারাচ্ছে পাহাড়ের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। গত এক বছরে পার্বত্য তিন জেলায় আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে ৪২ খুন এবং ২৫ জন গুলিবিদ্ধ কিংবা আক্রমণের শিকার হয়েছেন। পাশাপাশি পাহাড়ে শতাধিক অপহরণের ঘটনাও ঘটিয়েছে আঞ্চলিক দলীয় সন্ত্রাসীরা। সংগঠনগুলোর ধার্যকৃত চাঁদা পরিশোধের বিড়ম্বনার সঙ্গে এই ধরনের হিংসা হানাহানি ও ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে পাহাড়ের মানুষ। সর্বশেষ চলতি মাসের ৩ ও ৪ঠা এপ্রিল মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুই শীর্ষ নেতাসহ ৬ জন আর গত এক মাসে রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়িতে অন্তত ১২ জন খুন হয়েছেন। এ সময় ১৫ জনেরও অধিক গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আহত হয়েছেন। যার মধ্যে ৪ঠা এপ্রিলই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ৮ জন। বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রতিপক্ষ পার্বত্য চুক্তি বিরোধী সংগঠন ইউপিডিএফ এর সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জেএসএস (এমএন লারমা) এর কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমা। এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে শক্তিমানের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান শেষে ফেরার পথে আবারো সেই একই পক্ষের অতর্কিত ব্রাশ ফায়ারে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক-এর প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মা ও জেএসএস এম এন লারমা সমর্থিত ৫ নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন।
নিহতদের মধ্যে পাহাড়ের সংগঠন ইউপিডিএফ’র (গণতান্ত্রিক) আহ্বাযক তপন জ্যোতি চাকমা বর্মা (৪৮), জেএসএস সংস্কার সমর্থিত সেতু লাল চাকমা (৪০) ভাড়ায় চালিত মাইক্রো চালক পানছড়ির বাসিন্দা মো. সজিব (৩৬), মহালছড়ি যুব সমিতির সুজন চাকমা (৩২) ও তুজিম চাকমা (২৯) বলে জানা গেছে।
ঘটনার সময় আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা তপন জ্যোতি চাকমাকে বহন করা মাক্রোবাস লক্ষ্য করে গুলি করলে ভাড়ায় চালিত মাইক্রোড্রাইভার গুলিবিদ্ধ হয়। এ সময় বিভক্ত আরো দু’অস্ত্র ধারী হামলাকারী গ্রুপ সে গাড়িতে গুলিবর্ষণ করলে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ সময় গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে পড়ে যায়। এ ঘটনার জন্য সংগঠনটি প্রতিপক্ষ গ্রুপ প্রসীত বিকাশ খীসা নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফকে দায়ী করছে।
এদিকে এর আগে, ১০ই এপ্রিল মহালছড়ি থেকে জেএসএস (এমএন লারমা) দলের দুই নেতাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা। এই ঘটনার একদিন পরেই ১১ই এপ্রিল নানিয়ারচরে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয় ইউপিডিএফ নেতা জনি চাকমাকে। এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে ১২ই এপ্রিল ইউপিডিএফ নামধারী সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র হামলায় জেএসএস(এমএন) লারমা দলের কালোময় চাকমা ও সাধন চাকমাকে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে সন্ত্রাসীরা কালোময় চাকমাকে মেরেই ক্ষান্ত হয়নি, তাকে পুড়িয়েও ফেলেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এদিকে ১৫ই এপ্রিল খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে উদ্ধার করা হয় এক বাঙালি যুবকের লাশ। তাকে অপহরণ করা হয়েছিল আরো দুইদিন আগেই। মোশারফ হোসেন নামে উদ্ধারকৃত যুবকের লাশের শরীরের বিভিন্ন অংশে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ।
১৫ই এপ্রিল রাত ৮টার সময় রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি ও খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় আঞ্চলিক দল ইউপিডিএফ ও জেএসএস (এমএন) এর মধ্যে চলা বন্দুকযুদ্ধে ইউপিডিএফর দুই নেতা বিজয় চাকমা ও তপন চাকমাকে গুলি করে হত্যা করে প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা। এই ঘটনার সময় দীঘিনালা থেকে এক চাকমা যুবকে অপহরণ করা হয়েছে বলেও জানা গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে হঠাৎ করেই আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে এই ধরনের হামলা-পাল্টা হামলাসহ খুন, গুম অপহরণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় ভাবিয়ে তুলেছে পাহাড়বাসীদের। অন্তর্কোন্দলে অগ্নিগর্ভ আকার ধারণ করছে পাহাড়ের বর্তমান পরিস্থিতি।
একের পর এক সশস্ত্র সংঘাতে ব্যাপকহারে হতাহতের ঘটনায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন পাহাড়ের জনপ্রতিনিধিরা। নিজেরা বড়ই অসহায়বোধ করছেন জানিয়ে রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অরুন চাকমা বলেন, আমাদের একজন জনপ্রতিনিধিকে প্রকাশ্যে মেরে ফেলল। বিষয়টি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আমি নিজেও এখন খুবই অসহায়বোধ করছি।
অপরদিকে নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান কোয়ালিটি চাকমা জানান, একজন নারী জনপ্রতিনিধি হয়ে বর্তমানে অত্যন্ত কঠিন সময় পার করছি। তিনি বলেন, আমাদের অবস্থা এখন অত্যন্ত শোচনীয়। চেয়ারম্যানকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা পরবর্তী সময়ে তিনিও খুব আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন জানিয়ে বলেন, আমরা আমাদের অবস্থান সম্পর্কে যদি বুঝেও না বোঝার ভান করি তাহলে পৃথিবীর কোনো শক্তিই আমাদের বোঝাতে বা সঠিক পথে ফেরাতে পারবে না।
রাঙ্গামাটি চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি বেলায়েত হোসেন ভূঁইয়া বলেন, আমরা ব্যবসায়িরাসহ রাঙ্গামাটিবাসী পাহাড়ের অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে পাহাড় থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি জানিয়ে আসছি। আমাদের দাবিগুলো যদি আমলে নিয়ে কাজ শুরু হতো তাহলে আজকের দিনের নৃশংস পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না।
এদিকে রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপার আলমগীর কবির বলেন, শুক্রবার একদিনেই পাঁচটি হত্যাসহ গুলিবিদ্ধের ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় আইনানুগ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা নেয়া যায় সে বিষয়ে সবার সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেবো। এক প্রশ্নের জবাবে এসপি বলেন, পাহাড়ে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, সমতলের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে পাহাড়ের পুলিশ বাহিনীকে তৈরি করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট দিলেই এই ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিপরীতে পুলিশ ত্বরিতভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবে।
No comments