মানুষের হৃদয় জয় করতে হবে
ইরাকের সরকারি বাহিনী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) দখল থেকে ফালুজা শহরটিকে আবার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার উদ্দেশ্যে মরণপণ লড়াইয়ে নেমেছে। ফালুজা আইএসের দখলে থাকা দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এক দশক ধরে জঙ্গি ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এই ফালুজা। এর আগে রামাদিসহ কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শহর আইএসের হাতছাড়া হয়ে গেছে। ২০১৫ সালের মে মাস থেকে আইএস একটিও সফল অভিযান চালাতে পারেনি। এটা প্রায় নিশ্চিত যে এই লড়াইয়ে ইরাকি সরকার ফালুজা শহরের নিয়ন্ত্রণ আবার নিজের হাতে নিতে পারবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এর জন্য কত মূল্য চুকাতে হবে বা তার উদ্দেশ্যই বা কী? ইরাকি সমাজের অনেক গোষ্ঠীর কাছে ফালুজা শহরটি মার্কিন দখলদারির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে সুন্নি আরবদের কাছে। মহাশক্তিশালী মার্কিন সেনাবাহিনীও তার উন্নত অস্ত্রশস্ত্র ও গোয়েন্দাসক্ষমতা নিয়েও এই শহর নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহীদের একরকম সামাল দিতে পারলেও বিদ্রোহ ও বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর মূলোৎপাটন করতে পারেনি। আইএসের জন্ম এই ফালুজা শহরেই। অনেকেই এ কথা জানেন না যে আল-কায়েদা ইন ইরাক বা ইরাকি আল-কায়েদার নতুন রূপ আইএসের আজ বিশ্বব্যাপী যে পরিচিতি, তা সে অর্জন করার বহু আগেই, ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসেই ফালুজা শহরটি জিহাদি নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তার আগে সেখানে মাসের পর মাস রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে।
শহরটির প্রতীকী তাৎপর্যের পরিপ্রেক্ষিতে আইএস যদি ফালুজার ওপর থেকে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারায়, তাহলে সেটা তার জন্য মারাত্মক মনস্তাত্ত্বিক ধাক্কা হবে। সেটা হলে ইরাকি বাহিনী মসুল দখলের জন্য আরও বড় সামরিক অভিযানের আত্মবিশ্বাস পাবে। মসুল হচ্ছে ইরাকে আইএসের প্রধান ঘাঁটি, যেখানে তারা ২০১৪ সালের জুন মাসে ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু আইএস ও তার যোদ্ধারা, যারা স্থানীয় জনগণের সঙ্গে ব্যাপকভাবে মিশে আছে, যাদের প্রতি স্থানীয় জনগণের বেশ সমর্থনও আছে, তারা ফালুজার এই যুদ্ধে ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণে কতটা উদ্যোগী হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। ফালুজার যুদ্ধে আইএস হয়তো সেই পুরোনো স্টাইলের গেরিলা যুদ্ধের কৌশল নিতে পারে, নতুন কোনো বিস্ফোরক অস্ত্র বানাতে পারে এবং ফাঁদ পাততে পারে, যে কৌশলের দ্বারা তারা এই শহরের ওপর বাইরের যেকোনো শক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রতিহত করতে পারবে। ফলে ইরাকি সরকার বিজয়ের ঘোষণা দিলেও তা অর্থহীন হয়ে যেতে পারে। ইরাকি সরকার যদি ফালুজা পুনর্দখল করতে পারে, তাহলে বোঝা যাবে, যুদ্ধের পর নতুন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ফালুজা কখন ও কীভাবে আইএস থেকে মুক্ত হবে, সেটা তেমন কোনো বিষয় নয়, কে তাকে মুক্ত করবে, সেটাই আসল কথা। আইএসের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো ও তাকে পরাজিত করার দুটি দিক আছে; একটি সামরিক, অন্যটি রাজনৈতিক। ফালুজার মতো জনপদগুলোর স্থানীয় সুন্নি আরব অধিবাসীরা বাগদাদের শিয়ানিয়ন্ত্রিত সরকারকে বিশ্বাস করে না। কারণ, তাদের বিরুদ্ধে যে পক্ষপাত ও কর্তৃত্বমূলক আচরণের অভিযোগ রয়েছে, সেটা দূর করতে তারা তেমন কিছু করেনি (বিশেষ করে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী নুরি আল-মালিকির জমানায়)। তা ছাড়া শিয়া মিলিশিয়া গ্রুপগুলোর তৎপরতায় সেখানকার উত্তেজনা বেড়েছে। অভিযোগ আছে, তারা সুন্নি আরবদের ওপর গোষ্ঠীগত নিপীড়ন চালিয়েছে।
ইরাকে সুন্নি আরবদের সংখ্যা নেহাত কম নয়, তাদের অর্থবিত্ত ও প্রভাব-প্রতিপত্তিও উপেক্ষণীয় নয়, আবার তারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে একরকম স্বায়ত্তশাসনও ভোগ করে। জানা যায়, ফালুজায় তাদের কার্যক্রমের পরিসর খুবই সীমিত, যদিও মাঠের বাস্তবতা ও জঙ্গিদের ধারণা কিছুটা ভিন্ন। আইএসকে পরাজিত করতে হলে কিছু মৌলিক কাজ করতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, সুশাসন নিশ্চিতকরণ ও বিভক্ত সমাজকে এক সূত্রে গাঁথা। অর্থাৎ মাঠে আইএসের সঙ্গে লড়াই করার পাশাপাশি ইরাকি সরকারকে সুন্নি আরবদের হৃদয় ও মন জয় করতে হবে, তাদের দুঃখ-দুর্দশা ঘোচাতে হবে, যেগুলোর মূল অনেক গভীরে প্রোথিত (অনেকেই মনে করে, সরকারের তুলনায় আইএস মন্দের ভালো। সরকার তাদের অবজ্ঞা করে প্রান্তে ঠেলে দিয়েছে)। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ইরাকের ক্রমশ ভঙ্গুর হয়ে পড়া সরকার ও তার অকার্যকর, দুর্নীতিবাজ ও গোষ্ঠীকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় সেই কাজে সফল হবে, তার সম্ভাবনা খুবই কম। দৃশ্যপটে আইএসের আবির্ভাবের পর থেকে গোষ্ঠীগত উত্তেজনা যেমন বেড়েছে, তেমনি শাসনব্যবস্থা অকার্যকর হতে বসেছে ও আঞ্চলিক মেরুকরণ ঘটেছে। এসব কারণে আইএসের দ্রুত উত্থান ঘটেছে। এটা হলফ করে বলা যায়, এই বিশৃঙ্খল যুদ্ধে ‘খিলাফত’ ও আইএস-শাসিত অঞ্চলের পতন ঘটবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আইএস শেষ হয়ে যাবে। ইরাকের যেকোনো জায়গায় তাদের সন্ত্রাসী হামলা চালানোর সক্ষমতা আছে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া।
রাঞ্জ আলালদিন: লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া।
রাঞ্জ আলালদিন: লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ।
No comments