ব্যবহৃত সিরিঞ্জ ফের ঢুকছে মানবদেহে by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
ব্যবহৃত
সিরিঞ্জ ফের ঢুকছে মানব দেহে। চীনসহ বিভিন্ন দেশের হাসপাতালে ব্যবহৃত এসব
সিরিঞ্জ ও ‘স্যালাইন সেট’ রিপ্যাকিং করে বাংলাদেশে বাজারজাত করছে একশ্রেণির
অসাধু ব্যবসায়ী। পাশাপাশি কাগজপত্রে অন্য পণ্যের নাম ঘোষণা দিয়ে আমদানি
করা হচ্ছে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ ও বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জাম। অবৈধভাবে আসা এসব
ওষুধ ও সরঞ্জামের মানদণ্ড নিশ্চিত না করে বাজারজাত করায় এগুলো সেবন ও
ব্যবহার মানবদেহের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। এমনকি হেপাটাইটিস-বি,
হেপাটাইটিস-সি,এইচআইভি এইডসসহ সংক্রমিত যে কোন প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত
হওয়ার ঝুঁকি থাকছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, ওষুধ প্রশাসন এবং
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য। সূত্রমতে, গত
২৭ মাসে ১০ কোটি ৮০ লাখ টাকার আমদানি নিষিদ্ধ ওষুধ আটক করেছে কাস্টম
গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।
এদিকে, বিভিন্ন হাসপাতালে ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, স্যালাইন প্যাক ও নিডোর প্রতিদিন বিক্রি হয় ঢাকার নিমতলীর ভাঙারি দোকানে। এগুলো রি-সাইক্লেনিং হয়ে পুনরায় বাজারে আসে বলে দোকানিরা জানিয়েছেন। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বহু দিন থেকেই মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অবৈধভাবে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আনা হচ্ছে। চীনসহ বিভিন্ন দেশের হাসপাতালে ব্যবহূত নিডেল, সিরিঞ্জ ও ইনফিউশন সেট (স্যালাইন সেট, নিডেল, সিরিঞ্জ) রিপ্যাকিং হয়ে বাংলাদেশে আসছে। এগুলো আনা হচ্ছে বিন্টস্টার প্যাক ও রিবন প্যাকে। এসব সুই-সিরিঞ্জে ‘জীবাণুমুক্ত’ লেখা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলো ‘জীবাণুযুক্ত’।
‘আমদানিকৃত মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট ইনফিউশন সেটস ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন ব্যতীত খালাস প্রদান’ শিরোনামে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০১২ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইনফিউশন সেট আমদানির কোন প্রকার অনুমতি বা ছাড়পত্র দেয়নি ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। কিন্তু সিআইসেল (কাস্টমস ইন্টেলিজেন্স) থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, উল্লিখিত সময়ের মধ্যে দেশের ১৫৮ জন আমদানিকারক ৫৯৮টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ৯৩ কোটি ৯৯ লাখ ১০ হাজার ২০৪ টাকার ইনফিউশন সেট আমদানি এবং খালাস করে নিয়েছেন। এতে রাজস্বের পরিমাণ ১৬ কোটি টাকা ৩৬ লাখ ১৩ হাজার ৬৫৪ টাকা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের মেডিক্যাল বা সার্জিক্যাল পণ্য কোনোভাবেই ব্যবহার করা যাবে না। এসব পণ্য ব্যবহারে হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, এইচআইভি এইডসসহ সুই দ্বারা সংক্রমিত হয় এমন যে কোন রোগ হতে পারে। এ ধরনের রোগের আক্রমণে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ ও স্যালাইন সেট শুধু একবার ব্যবহারের জন্যই তৈরি হয়ে থাকে।
প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, ‘ইনফিউশন সেট আমদানি নীতি আদেশ অনুসারে একটি নিয়ন্ত্রিত পণ্য। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর এসব পণ্যের উৎপাদনকারী দেশ, পণ্যের গুণাবলী, দাম, উৎপাদনকারীর রেকর্ড ইত্যাদি যাচাই-বাছাই করে তা আমদানির অনুমোদন দিয়ে থাকে। এসব পণ্য মানবদেহে সরাসরি ব্যবহৃত হয় বিধায় ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদনে উল্লিখিত উৎপাদক ব্র্যান্ডের বাইরে নিম্নমানের পণ্য আমদানি করা হলে তা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদনবিহীনভাবে বিভিন্ন শুল্ক ভবন দিয়ে আমদানি ও খালাস করা ইনফিউশন সেট ব্যবহার মানবদেহে ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি হলে দেশে মানব স্বাস্থ্যের প্রতি তা হুমকিস্বরূপ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
বিদেশ থেকে অবৈধভাবে আনা ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আটক সংক্রান্ত শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর একাধিক প্রতিবেদন রয়েছে। এর একটিতে বলা হয়েছে, দেশী কিছু প্রতিষ্ঠান আমদানির শর্ত পূরণ না করে কুরিয়ার সার্ভিস বা বিভিন্ন অবৈধপথে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানি করে থাকে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের হুমকির কারণ। ৫ই মার্চ ‘ফুড সাপ্লিমেন্ট’ ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা ৯৮ কেজি ওষুধ আটক করা হয়। এর মধ্যে ছিল ক্যানেসটেন ক্রিম, জেনিক্যাল অরলিস্টে, ইমিগ্রান, ফুসটাম জেলসহ বিভিন্ন ওষুধ। ভুয়া এলসির মাধ্যমে যার মূল্য দেখানো হয়েছিল মাত্র ৯৮ ডলার। প্রকৃতপক্ষে এসব ওষুধের দাম ছিল প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ টাকা। ২৬শে ফেব্রুয়ারি ডিএইচএল কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ‘হেলথ প্রোডাক্ট’ ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা দুই কার্টন ওষুধ জব্দ করা হয়। ওষুধের মধ্যে ছিল স্যাবলি ৫০০ এমজি, লেসকল ফ্লুভাসটিন, ডিমকর্ন এমআর, মাইকেলিক ইনজেকশন, গোনাল এফ ৭৫ আইইউ জাতীয় ওষুধ। এ ছাড়া ১৯শে মার্চ ‘ফ্রি মেডিসিন স্যাম্পল’ ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা ওষুধের চালান আটক করা হয়। যার মধ্যে ছিল ৬৫ লাখ টাকার পলিক্যাপ ও অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ। আর ৪ঠা মে জব্দ করা হয় ৪৭২ কেজি ব্যথানাশক ওষুধ, যা আমদানি করা হয়েছিল গার্মেন্ট পণ্য ঘোষণা দিয়ে।
শুল্ক গোয়েন্দার অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের গত ২রা অক্টোবর ঢাকার মেসার্স মাই কেয়ার করপোরেশন নামের একটি কোম্পানি মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তান থেকে ‘সান ব্লোকড ক্রীম’ নামের ১৭ হাজার ৩৯০ পিস ওষুধ আমদানি করেছে। যা কাস্টম আইন লঙ্ঘিত করেছে। এর মূল্য এক কোটি ১০ লাখ টাকা।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান এই প্রসঙ্গে মানবজমিনকে বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এধরনের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ওষুধ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে। ওষুধের সঙ্গে ফার্মেসি মালিক, ওষুধ ব্যবসায়ী, ওষুধ প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাসহ অনেকে জড়িত থাকতে পারে। ওষুধ খালাসের সঙ্গে কাস্টমস কর্মকর্তা জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অবৈধভাবে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আনা প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এক সহকারী পরিচালক নাম না প্রকাশ করার শর্তে মানবজমিনকে বলেন, বাংলাদেশ ডিসপোজেবল নিডেল ও সিরিঞ্জ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে এগুলো আমদানির অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। যে কোন ওষুধের সঙ্গে জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থ জড়িত। ওষুধ আমদানি করতে হলে ওষুধ প্রশাসনের লিখিত অনুমোদন ও ছাড়পত্র নিতে হবে। এর বাইরে ওষুধ আমদানি করার সুযোগ নেই। সুই-সিরিঞ্জসহ ইনফিউশন সেট আমদানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এগুলো গুরুত্বপূর্ণ মেডিক্যাল ডিভাইস। এর জন্য অবশ্যই পূর্বানুমতি নিতে হবে। ব্যবহৃত সুই-সিরিঞ্জ রিপ্যাক করে আমদানির কোন সুযোগ নেই। এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।
সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন হাসপাতালে ব্যবহৃত সিরিঞ্জ,স্যালাইন প্যাক ও নিডোর বিক্রি হয় ঢাকার নিমতলীর ভাঙারি দোকানে। সাম্প্রতি নিমতলীর কয়েকটি দোকানে দোকানীদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, আগে এই পুরানো সিরিঞ্জ পুনরায় ব্যবহার হলেও এখন আর হয় না। কয়েকটি দোকানে নিজে ক্রেতা সেজে জিজ্ঞাসা করলে তারা বললেন, আপনার কাছে বিক্রি করবো না। এগুলো ইসলামবাগে বিক্রি হবে। ওখানে সব সময়ে এগুলো বিক্রি করা হয় বলে তারা দাবি করেন। নবাব কাটারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটু দক্ষিণে মাজেদ সরদার রোডের মুনমুন দোকানের কাদের মিয়া জানান, আগে এগুলো পুনরায় ফার্মেসিতে বিক্রি হলেও এখন আর হয় না। এগুলো এখন ইসলামবাগের ক্লাবঘাটে রি-সাইক্লেনিং হয়। অর্থাৎ’ পুনরায় দানা তৈরির মাধ্যমে আবার বাজারে আসে। তখন বুঝা যাবে না, এটা পুরানো সিরিঞ্জ কি না। তার দোকানের অবস্থান ওই রোডের ৬৫/১, বাসার পাশেই।
এ প্রসঙ্গে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আবুল খায়ের চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, চোরাইপথে কেউ মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ওষুধ আমদানির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ পেলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। এরকম ভুয়া ওষুধ আনার অপরাধে ৪টি কুরিয়ার সার্ভিসকে বন্ধও করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। জরুরি প্রয়োজন হয়ে পড়লে ওষুধ প্রশাসনের কাছে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ মান রক্ষা করে শর্তসাপেক্ষে আমদানির অনুমোদন দেয়া যায়।
এ বিষয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সামিউল ইসলাম সাদী মানবজমিনকে বলেন, চোরাইপথে আমদানি করা ওষুধ ব্যবহারে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম চোরাচালান এবং মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। বিষয়টি ওষুধ প্রশাসন ভালো মতো দেখছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ এই বিষয়ে মানবজমিনকে বলেন, একই সুই-সিরিঞ্জ একাধিকবার ব্যবহারের ফলে হেপাটাইটিস, এইডস, কিডনি, ক্যানসারসহ যে কোন রোগের জীবাণু ছড়াতে পারে। এসব ব্যবহারকারীর শরীরে ইনফেকশন হবে। তার মৃত্যুঝুঁকিও অনেক বেশি। তাছাড়া অবৈধভাবে আমদানি করা কোন ওষুধ বা চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যবহারেও বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তো আছেই। তাই এগুলো সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। আইনের আওতায় আনতে হবে। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এগুলোর গুণগত মান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।
এদিকে, বিভিন্ন হাসপাতালে ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, স্যালাইন প্যাক ও নিডোর প্রতিদিন বিক্রি হয় ঢাকার নিমতলীর ভাঙারি দোকানে। এগুলো রি-সাইক্লেনিং হয়ে পুনরায় বাজারে আসে বলে দোকানিরা জানিয়েছেন। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বহু দিন থেকেই মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অবৈধভাবে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আনা হচ্ছে। চীনসহ বিভিন্ন দেশের হাসপাতালে ব্যবহূত নিডেল, সিরিঞ্জ ও ইনফিউশন সেট (স্যালাইন সেট, নিডেল, সিরিঞ্জ) রিপ্যাকিং হয়ে বাংলাদেশে আসছে। এগুলো আনা হচ্ছে বিন্টস্টার প্যাক ও রিবন প্যাকে। এসব সুই-সিরিঞ্জে ‘জীবাণুমুক্ত’ লেখা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলো ‘জীবাণুযুক্ত’।
‘আমদানিকৃত মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট ইনফিউশন সেটস ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন ব্যতীত খালাস প্রদান’ শিরোনামে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০১২ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইনফিউশন সেট আমদানির কোন প্রকার অনুমতি বা ছাড়পত্র দেয়নি ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। কিন্তু সিআইসেল (কাস্টমস ইন্টেলিজেন্স) থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, উল্লিখিত সময়ের মধ্যে দেশের ১৫৮ জন আমদানিকারক ৫৯৮টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ৯৩ কোটি ৯৯ লাখ ১০ হাজার ২০৪ টাকার ইনফিউশন সেট আমদানি এবং খালাস করে নিয়েছেন। এতে রাজস্বের পরিমাণ ১৬ কোটি টাকা ৩৬ লাখ ১৩ হাজার ৬৫৪ টাকা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের মেডিক্যাল বা সার্জিক্যাল পণ্য কোনোভাবেই ব্যবহার করা যাবে না। এসব পণ্য ব্যবহারে হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, এইচআইভি এইডসসহ সুই দ্বারা সংক্রমিত হয় এমন যে কোন রোগ হতে পারে। এ ধরনের রোগের আক্রমণে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ ও স্যালাইন সেট শুধু একবার ব্যবহারের জন্যই তৈরি হয়ে থাকে।
প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, ‘ইনফিউশন সেট আমদানি নীতি আদেশ অনুসারে একটি নিয়ন্ত্রিত পণ্য। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর এসব পণ্যের উৎপাদনকারী দেশ, পণ্যের গুণাবলী, দাম, উৎপাদনকারীর রেকর্ড ইত্যাদি যাচাই-বাছাই করে তা আমদানির অনুমোদন দিয়ে থাকে। এসব পণ্য মানবদেহে সরাসরি ব্যবহৃত হয় বিধায় ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদনে উল্লিখিত উৎপাদক ব্র্যান্ডের বাইরে নিম্নমানের পণ্য আমদানি করা হলে তা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদনবিহীনভাবে বিভিন্ন শুল্ক ভবন দিয়ে আমদানি ও খালাস করা ইনফিউশন সেট ব্যবহার মানবদেহে ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি হলে দেশে মানব স্বাস্থ্যের প্রতি তা হুমকিস্বরূপ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
বিদেশ থেকে অবৈধভাবে আনা ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আটক সংক্রান্ত শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর একাধিক প্রতিবেদন রয়েছে। এর একটিতে বলা হয়েছে, দেশী কিছু প্রতিষ্ঠান আমদানির শর্ত পূরণ না করে কুরিয়ার সার্ভিস বা বিভিন্ন অবৈধপথে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানি করে থাকে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের হুমকির কারণ। ৫ই মার্চ ‘ফুড সাপ্লিমেন্ট’ ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা ৯৮ কেজি ওষুধ আটক করা হয়। এর মধ্যে ছিল ক্যানেসটেন ক্রিম, জেনিক্যাল অরলিস্টে, ইমিগ্রান, ফুসটাম জেলসহ বিভিন্ন ওষুধ। ভুয়া এলসির মাধ্যমে যার মূল্য দেখানো হয়েছিল মাত্র ৯৮ ডলার। প্রকৃতপক্ষে এসব ওষুধের দাম ছিল প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ টাকা। ২৬শে ফেব্রুয়ারি ডিএইচএল কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ‘হেলথ প্রোডাক্ট’ ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা দুই কার্টন ওষুধ জব্দ করা হয়। ওষুধের মধ্যে ছিল স্যাবলি ৫০০ এমজি, লেসকল ফ্লুভাসটিন, ডিমকর্ন এমআর, মাইকেলিক ইনজেকশন, গোনাল এফ ৭৫ আইইউ জাতীয় ওষুধ। এ ছাড়া ১৯শে মার্চ ‘ফ্রি মেডিসিন স্যাম্পল’ ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা ওষুধের চালান আটক করা হয়। যার মধ্যে ছিল ৬৫ লাখ টাকার পলিক্যাপ ও অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ। আর ৪ঠা মে জব্দ করা হয় ৪৭২ কেজি ব্যথানাশক ওষুধ, যা আমদানি করা হয়েছিল গার্মেন্ট পণ্য ঘোষণা দিয়ে।
শুল্ক গোয়েন্দার অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের গত ২রা অক্টোবর ঢাকার মেসার্স মাই কেয়ার করপোরেশন নামের একটি কোম্পানি মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তান থেকে ‘সান ব্লোকড ক্রীম’ নামের ১৭ হাজার ৩৯০ পিস ওষুধ আমদানি করেছে। যা কাস্টম আইন লঙ্ঘিত করেছে। এর মূল্য এক কোটি ১০ লাখ টাকা।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান এই প্রসঙ্গে মানবজমিনকে বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এধরনের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ওষুধ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে। ওষুধের সঙ্গে ফার্মেসি মালিক, ওষুধ ব্যবসায়ী, ওষুধ প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাসহ অনেকে জড়িত থাকতে পারে। ওষুধ খালাসের সঙ্গে কাস্টমস কর্মকর্তা জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অবৈধভাবে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আনা প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এক সহকারী পরিচালক নাম না প্রকাশ করার শর্তে মানবজমিনকে বলেন, বাংলাদেশ ডিসপোজেবল নিডেল ও সিরিঞ্জ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে এগুলো আমদানির অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। যে কোন ওষুধের সঙ্গে জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থ জড়িত। ওষুধ আমদানি করতে হলে ওষুধ প্রশাসনের লিখিত অনুমোদন ও ছাড়পত্র নিতে হবে। এর বাইরে ওষুধ আমদানি করার সুযোগ নেই। সুই-সিরিঞ্জসহ ইনফিউশন সেট আমদানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এগুলো গুরুত্বপূর্ণ মেডিক্যাল ডিভাইস। এর জন্য অবশ্যই পূর্বানুমতি নিতে হবে। ব্যবহৃত সুই-সিরিঞ্জ রিপ্যাক করে আমদানির কোন সুযোগ নেই। এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।
সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন হাসপাতালে ব্যবহৃত সিরিঞ্জ,স্যালাইন প্যাক ও নিডোর বিক্রি হয় ঢাকার নিমতলীর ভাঙারি দোকানে। সাম্প্রতি নিমতলীর কয়েকটি দোকানে দোকানীদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, আগে এই পুরানো সিরিঞ্জ পুনরায় ব্যবহার হলেও এখন আর হয় না। কয়েকটি দোকানে নিজে ক্রেতা সেজে জিজ্ঞাসা করলে তারা বললেন, আপনার কাছে বিক্রি করবো না। এগুলো ইসলামবাগে বিক্রি হবে। ওখানে সব সময়ে এগুলো বিক্রি করা হয় বলে তারা দাবি করেন। নবাব কাটারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটু দক্ষিণে মাজেদ সরদার রোডের মুনমুন দোকানের কাদের মিয়া জানান, আগে এগুলো পুনরায় ফার্মেসিতে বিক্রি হলেও এখন আর হয় না। এগুলো এখন ইসলামবাগের ক্লাবঘাটে রি-সাইক্লেনিং হয়। অর্থাৎ’ পুনরায় দানা তৈরির মাধ্যমে আবার বাজারে আসে। তখন বুঝা যাবে না, এটা পুরানো সিরিঞ্জ কি না। তার দোকানের অবস্থান ওই রোডের ৬৫/১, বাসার পাশেই।
এ প্রসঙ্গে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আবুল খায়ের চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, চোরাইপথে কেউ মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ওষুধ আমদানির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ পেলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। এরকম ভুয়া ওষুধ আনার অপরাধে ৪টি কুরিয়ার সার্ভিসকে বন্ধও করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। জরুরি প্রয়োজন হয়ে পড়লে ওষুধ প্রশাসনের কাছে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ মান রক্ষা করে শর্তসাপেক্ষে আমদানির অনুমোদন দেয়া যায়।
এ বিষয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সামিউল ইসলাম সাদী মানবজমিনকে বলেন, চোরাইপথে আমদানি করা ওষুধ ব্যবহারে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম চোরাচালান এবং মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। বিষয়টি ওষুধ প্রশাসন ভালো মতো দেখছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ এই বিষয়ে মানবজমিনকে বলেন, একই সুই-সিরিঞ্জ একাধিকবার ব্যবহারের ফলে হেপাটাইটিস, এইডস, কিডনি, ক্যানসারসহ যে কোন রোগের জীবাণু ছড়াতে পারে। এসব ব্যবহারকারীর শরীরে ইনফেকশন হবে। তার মৃত্যুঝুঁকিও অনেক বেশি। তাছাড়া অবৈধভাবে আমদানি করা কোন ওষুধ বা চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যবহারেও বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তো আছেই। তাই এগুলো সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। আইনের আওতায় আনতে হবে। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এগুলোর গুণগত মান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।
No comments