সফল উন্নয়নের জন্য দরকার স্বাধীন গণমাধ্যম -বিশেষ সাক্ষাৎকারে : ডেভিড কাপলান by কুন্তল রায়
ডেভিড ই কাপলান |
ডেভিড
ই কাপলানের জন্ম ১৯৫৫ সালের ৫ আগস্ট, যুক্তরাষ্ট্রে। প্রায় তিন দশক ধরে
বিশ্বজুড়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করেছেন এবং একে সম্প্রসারণে কাজ করছেন।
বর্তমানে সাংবাদিকদের বৈশ্বিক ও সবচেয়ে বড় সংগঠন গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ
জার্নালিজম নেটওয়ার্কের (জিআইজেএন) সহপ্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক।
১৯৯৭ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড
রিপোর্ট-এর প্রধান অনুসন্ধানী প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছেন। এ পত্রিকায়
কাজ করতে গিয়ে তিনি উদ্ঘাটন করেছেন জাপানের ভয়ংকর মাফিয়া চক্র,
জঙ্গিদের সৌদি সরকারের অর্থায়ন, টোকিওর সাবওয়ে স্টেশনে নার্ভ গ্যাস
প্রভৃতি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। সাংবাদিকতায় দেশি-বিদেশি ২০টিরও বেশি পদক
পেয়েছেন, এর মধ্যে চারবার ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার্স অ্যান্ড এডিটরসের
সেরা অনুসন্ধানী প্রতিবেদকের স্বীকৃতি পেয়েছেন। জিআইজেএন আয়োজিত
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের নবম বৈশ্বিক সম্মেলন চলাকালে গত ১০ অক্টোবর নরওয়ের
লিলহ্যামার শহরের র্যাডিসন ব্লু হোটেলে প্রথমআলোর মুখোমুখি হন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কুন্তল রায়
প্রথম আলো : সাংবাদিকদের নিয়ে বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক তৈরিতে কেন উদ্যোগী হলেন? তাঁদের নিয়ে নিয়মিত সম্মেলন আয়োজন করার কারণটাই-বা কী?
ডেভিড কাপলান : গ্লোবাল নেটওয়ার্ক ও সম্মেলন শুরু করার পেছনে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। বিশ্বায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবের পর সাংবাদিকতায় বিশাল পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বের নানা প্রান্তের সাংবাদিকদের মধ্যে যোগাযোগ এখন অনেক সহজ। শীতল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর রাষ্ট্রের সীমানা ভেঙে গেছে, পূর্ব ইউরোপে ও সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোতে স্বাধীন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থসাহায্য হয়েছে। ওই সময় থেকে বিশেষজ্ঞরা বলতে শুরু করলেন, উন্নয়নের জন্য যেমন কৃষি ও শিল্প খাতে উন্নয়ন দরকার, তেমনি স্বাধীন গণমাধ্যম দরকার। এটা সফল উন্নয়নের একটি তত্ত্ব। বৈজ্ঞানিক গবেষণার মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত যে স্বাধীন গণমাধ্যমের সঙ্গে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, উন্নত শিক্ষা ও সামাজিক সেবা, দুর্নীতি ও সংঘবদ্ধ অপরাধ হ্রাসের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। ফলে এখানেও বিনিয়োগ করতে হবে, যেমনটা অন্য সব ক্ষেত্রে করা হয়। ধীরে ধীরে হলেও পশ্চিমা সমাজ এটা শিখেছে। এমনকি চীনে যেখানে সাংবাদিকদের খারাপভাবে মূল্যায়ন করা হয়, সেখানেও এখন প্রচুর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হচ্ছে।
প্রথম আলো : এর কারণ কী বলে মনে করেন?
ডেভিড কাপলান : কারণ, সেখানে সরকারের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মনে করেন, দুর্নীতি রুখতে গেলে তাঁদের শক্তিশালী ও স্বাধীন গণমাধ্যম দরকার। ভারত, পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশেও গণমাধ্যম শক্তিশালী হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে স্বাধীন গণমাধ্যম বিকাশের এই শক্তি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ২০০১ সালে আমাদের সহপ্রতিষ্ঠাতা ব্র্যান্ট হিউস্টন ও নিলস মুলভাড ইউরোপিয়ান সাংবাদিকদের জন্য একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছিলেন। তখন হিউস্টন বললেন, পরেরবার আমরা পুরো বিশ্বকে আমন্ত্রণ জানাই না কেন? আমরা তখন নিশ্চিত ছিলাম না সেই সম্মেলনে আদৌ কেউ আসবেন কি না, কারণ সাংবাদিকেরা ‘একাকী নেকড়ে’ হিসেবে পরিচিত এবং একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী। অথচ ২০০৩ সালে দেখা গেল, ৩০টি দেশ থেকে ৩০০ জন সাংবাদিক এসেছেন। তখন আমরা আবিষ্কার করলাম, এই বিশাল পৃথিবীতে আমরা একা নই। এরপর থেকে আমরা তিন মহাদেশের সাতটি শহরে নয়টি সম্মেলন করেছি এবং প্রায় ছয় হাজারের মতো সাংবাদিককে একত্র করে বিশাল একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছি। এবার নরওয়ের লিলহ্যামারে আমাদের নবম সম্মেলনে ১২১টি দেশ থেকে প্রায় ৯৫০ জন সাংবাদিক এসেছেন। আমাদের লক্ষ্যই হলো, সারা বিশ্বে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বিস্তার করা, এ জন্য উৎসাহিত করা, অনুসন্ধানের সর্বাধুনিক কৌশল ও পদ্ধতিগুলো ছড়িয়ে দেওয়া এবং সাংবাদিকদের একটি নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্ম দেওয়া।
প্রথম আলো : সারা বিশ্বে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রসার কেন জরুরি মনে করছেন?
ডেভিড কাপলান : অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হলো জবাবদিহি, ক্ষমতার প্রহরী (ওয়াচডগ ইন পাওয়ার) ও গবেষণা দক্ষতার পদ্ধতিগত ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজে আসলেই কী হচ্ছে, তা তুলে আনা। সব সুস্থ সমাজে ওয়াচডগ সাংবাদিকতা এবং স্বাধীন ও প্রগতিশীল গণমাধ্যম থাকা দরকার, যারা ক্ষমতাসীনদের কঠিন প্রশ্ন করতে পারবে: কীভাবে টাকা খরচ হচ্ছে, কীভাবে ক্ষমতার ব্যবহার হচ্ছে, রাজনৈতিক পদ্ধতি কতখানি কার্যকর প্রভৃতি। সারা বিশ্ব ধীরে ধীরে, কখনো কষ্ট করে হলেও বুঝছে, একটি দেশের উন্নয়নের জন্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা দরকার। উন্নয়নের জন্য যেমন ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, কৃষি উন্নয়ন বা ভালো শিক্ষাব্যবস্থা দরকার, তেমনি স্বাধীন গণমাধ্যম দরকার। জাতিসংঘও এটা উপলব্ধি করতে পেরেছে তাদের সাম্প্রতিক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় তা উল্লেখ করেছে। বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রকে যদি বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে পাল্লা দিতে হয়, তাহলে তাদের এমন গণমাধ্যম থাকতে হবে, যারা অস্বস্তিকর প্রশ্ন তোলে। উন্নয়নের জন্য যে দাম দিতে হয়, এটা তারই অংশ। এ জন্যই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা জরুরি।
প্রথম আলো : বিশ্বজুড়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বিস্তারে বাধাগুলো কী কী?
ডেভিড কাপলান : যদি আমি বাংলাদেশের সঙ্গে নিজের দেশের (যুক্তরাষ্ট্র) তুলনা করি, আমাদের কাজ করা আপনাদের তুলনায় বেশ সহজ। উন্নত বিশ্বে আমরা মামলার মুখোমুখি হই, হুমকি পাই, রাজনৈতিক বা বাণিজ্যিক কারণে রিপোর্ট ছাপাতে সমস্যার মুখোমুখি হই। তবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য যে সময় দরকার, তা নিয়ে সব সময় যুদ্ধ চলে। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আর বাংলাদেশের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কেউ আপনাকে একটি রিপোর্টের জন্য তিন মাস সময় দিতে চাইবে না। তবে আমাদের একটি ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে। আমাদের বার্তাকক্ষগুলো এখন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা উৎসাহিত করে, আমাদের এমন পাঠক বা দর্শক আছেন, যাঁরা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পড়তে বা দেখতে পছন্দ করেন এবং আমাদের এমন সরকারি কর্মকর্তা আছেন, যাঁরা মনে করেন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সমাজে বৈধ ভূমিকা আছে। যদি তাঁরা এ জন্য বিব্রতও হন, তাঁরা এটাকে গণতন্ত্রের অংশ বলে মনে করেন।
প্রথম আলো : উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য তো পরিস্থিতি ভিন্ন?
ডেভিড কাপলান : আপনি যদি উন্নয়নশীল বিশ্বের দিকে তাকান, দেখবেন সেখানে নানা ধরনের সমস্যা। সেখানে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা অনেক নাজুক, সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর হাত অনেক লম্বা, সরকারি কর্মকর্তারা মনে করেন তাঁরা গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন-হয়রানি তো আছেই। সেখানে বিজ্ঞাপনের বাজার অনুন্নত আর বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সরকার গণমাধ্যমকে প্রভাবিত করতে পারে। অর্থনৈতিক সংকট তো আছেই, আছে সম্পদের অভাব, উন্নত প্রশিক্ষণের অভাব। অনেক দেশে সাংবাদিকতার কোর্সগুলো হয়তো গত শতাব্দীর। সবকিছু ঠেলেই আমাদের সামনে এগোতে হচ্ছে।
প্রথম আলো : বিশ্বজুড়ে যেভাবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এগোচ্ছে, তা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ডেভিড কাপলান : আমার দৃষ্টিতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হচ্ছে একটা ‘ভালো ভাইরাস’, যা বিশ্বজুড়ে ছড়ানোর মধ্য দিয়ে শক্তি অর্জন করছে। কারণ, মানুষ এটাই চায়। মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি আর সংঘবদ্ধ অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আধুনিক গবেষণা পদ্ধতি, সঠিক রিপোর্টিং ও পদ্ধতিগত অনুসন্ধানী কৌশল ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। সরকারগুলো আমাদের পছন্দ করে না, মামলা-হয়রানি-শারীরিক আঘাত—এত সব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও আমরা বড় হচ্ছি। কেন? বিশ্বের সাংবাদিক সম্প্রদায়ের দিকে তাকান। তাঁরা অর্থ বা খ্যাতির জন্য সাংবাদিকতা করেন না। তাঁরা শুধু যে সমাজ বা রাষ্ট্রে বাস করছেন, তাকে আরেকটু বেশি বাসযোগ্য করতে চান। বেশির ভাগ মানুষের সমাজে তেমন কোনো ক্ষমতা নেই, আর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা একটা ছোট্ট উপায়, যাতে একজন ব্যক্তি সমাজে পরিবর্তন আনতে পারেন। তাই শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বিশ্বজুড়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এগিয়ে চলেছে।
প্রথম আলো : বাংলাদেশের সাংবাদিকদের প্রতি আপনার কোনো পরামর্শ বা বক্তব্য...
ডেভিড কাপলান : আমাদের বাংলাদেশি সহকর্মীদের আমরা বৈশ্বিক এ নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানাই। সারা বিশ্বের সাংবাদিকদের নিয়ে আমাদের এই সংগঠন। এখানে যুক্ত হলে তাঁরা তথ্যপ্রযুক্তির সর্বাধুনিক ব্যবহারের মাধ্যমে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পদ্ধতি জানতে পারবেন, দেশি-বিদেশি সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি ও রক্ষা করতে পারবেন এবং একে-অন্যের সহযোগিতা নিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট তৈরি করতে পারবেন। আমরা মূলত এমন একটি নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্ম, যার মাধ্যমে বিশ্বের সাংবাদিক সম্প্রদায় একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। বর্তমান বিশ্বে সংবাদ খুব দ্রুত দেশের সীমানা ছাড়িয়ে যায়। সকালে আপনি যে খাবার খাচ্ছেন, বিকেলে আপনার শিশুটি যে খেলনা দিয়ে খেলছে, রাতে আপনি যে ওষুধটি খাচ্ছেন—সবই অন্য এক দেশ থেকে আসে। তাই গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধানী রিপোর্টিং করতে গেলে আপনাকে সীমানা পেরোতে হবে। বহু আগে থেকেই খারাপ লোকেরা আন্তর্জাতিক হয়ে গেছে। তারা চোখের নিমেষে এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ, মানুষ ও নিষিদ্ধ বস্তু পাচার করছে, পুলিশ তাদের ধরতে পারছে না, অথচ সাংবাদিকেরা তাদের ঠিকই খুঁজে বের করছেন। এ জন্য বাংলাদেশি সহকর্মীদের আমাদের আরও বেশি করে দরকার, বৈশ্বিক এই আন্দোলনে যেন তাঁরাও ভালোভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন।
প্রথম আলো : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ডেভিড কাপলান : আপনাকেও ধন্যবাদ।
প্রথম আলো : সাংবাদিকদের নিয়ে বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক তৈরিতে কেন উদ্যোগী হলেন? তাঁদের নিয়ে নিয়মিত সম্মেলন আয়োজন করার কারণটাই-বা কী?
ডেভিড কাপলান : গ্লোবাল নেটওয়ার্ক ও সম্মেলন শুরু করার পেছনে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। বিশ্বায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবের পর সাংবাদিকতায় বিশাল পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বের নানা প্রান্তের সাংবাদিকদের মধ্যে যোগাযোগ এখন অনেক সহজ। শীতল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর রাষ্ট্রের সীমানা ভেঙে গেছে, পূর্ব ইউরোপে ও সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোতে স্বাধীন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থসাহায্য হয়েছে। ওই সময় থেকে বিশেষজ্ঞরা বলতে শুরু করলেন, উন্নয়নের জন্য যেমন কৃষি ও শিল্প খাতে উন্নয়ন দরকার, তেমনি স্বাধীন গণমাধ্যম দরকার। এটা সফল উন্নয়নের একটি তত্ত্ব। বৈজ্ঞানিক গবেষণার মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত যে স্বাধীন গণমাধ্যমের সঙ্গে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, উন্নত শিক্ষা ও সামাজিক সেবা, দুর্নীতি ও সংঘবদ্ধ অপরাধ হ্রাসের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। ফলে এখানেও বিনিয়োগ করতে হবে, যেমনটা অন্য সব ক্ষেত্রে করা হয়। ধীরে ধীরে হলেও পশ্চিমা সমাজ এটা শিখেছে। এমনকি চীনে যেখানে সাংবাদিকদের খারাপভাবে মূল্যায়ন করা হয়, সেখানেও এখন প্রচুর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হচ্ছে।
প্রথম আলো : এর কারণ কী বলে মনে করেন?
ডেভিড কাপলান : কারণ, সেখানে সরকারের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মনে করেন, দুর্নীতি রুখতে গেলে তাঁদের শক্তিশালী ও স্বাধীন গণমাধ্যম দরকার। ভারত, পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশেও গণমাধ্যম শক্তিশালী হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে স্বাধীন গণমাধ্যম বিকাশের এই শক্তি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ২০০১ সালে আমাদের সহপ্রতিষ্ঠাতা ব্র্যান্ট হিউস্টন ও নিলস মুলভাড ইউরোপিয়ান সাংবাদিকদের জন্য একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছিলেন। তখন হিউস্টন বললেন, পরেরবার আমরা পুরো বিশ্বকে আমন্ত্রণ জানাই না কেন? আমরা তখন নিশ্চিত ছিলাম না সেই সম্মেলনে আদৌ কেউ আসবেন কি না, কারণ সাংবাদিকেরা ‘একাকী নেকড়ে’ হিসেবে পরিচিত এবং একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী। অথচ ২০০৩ সালে দেখা গেল, ৩০টি দেশ থেকে ৩০০ জন সাংবাদিক এসেছেন। তখন আমরা আবিষ্কার করলাম, এই বিশাল পৃথিবীতে আমরা একা নই। এরপর থেকে আমরা তিন মহাদেশের সাতটি শহরে নয়টি সম্মেলন করেছি এবং প্রায় ছয় হাজারের মতো সাংবাদিককে একত্র করে বিশাল একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছি। এবার নরওয়ের লিলহ্যামারে আমাদের নবম সম্মেলনে ১২১টি দেশ থেকে প্রায় ৯৫০ জন সাংবাদিক এসেছেন। আমাদের লক্ষ্যই হলো, সারা বিশ্বে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বিস্তার করা, এ জন্য উৎসাহিত করা, অনুসন্ধানের সর্বাধুনিক কৌশল ও পদ্ধতিগুলো ছড়িয়ে দেওয়া এবং সাংবাদিকদের একটি নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্ম দেওয়া।
প্রথম আলো : সারা বিশ্বে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রসার কেন জরুরি মনে করছেন?
ডেভিড কাপলান : অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হলো জবাবদিহি, ক্ষমতার প্রহরী (ওয়াচডগ ইন পাওয়ার) ও গবেষণা দক্ষতার পদ্ধতিগত ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজে আসলেই কী হচ্ছে, তা তুলে আনা। সব সুস্থ সমাজে ওয়াচডগ সাংবাদিকতা এবং স্বাধীন ও প্রগতিশীল গণমাধ্যম থাকা দরকার, যারা ক্ষমতাসীনদের কঠিন প্রশ্ন করতে পারবে: কীভাবে টাকা খরচ হচ্ছে, কীভাবে ক্ষমতার ব্যবহার হচ্ছে, রাজনৈতিক পদ্ধতি কতখানি কার্যকর প্রভৃতি। সারা বিশ্ব ধীরে ধীরে, কখনো কষ্ট করে হলেও বুঝছে, একটি দেশের উন্নয়নের জন্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা দরকার। উন্নয়নের জন্য যেমন ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, কৃষি উন্নয়ন বা ভালো শিক্ষাব্যবস্থা দরকার, তেমনি স্বাধীন গণমাধ্যম দরকার। জাতিসংঘও এটা উপলব্ধি করতে পেরেছে তাদের সাম্প্রতিক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় তা উল্লেখ করেছে। বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রকে যদি বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে পাল্লা দিতে হয়, তাহলে তাদের এমন গণমাধ্যম থাকতে হবে, যারা অস্বস্তিকর প্রশ্ন তোলে। উন্নয়নের জন্য যে দাম দিতে হয়, এটা তারই অংশ। এ জন্যই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা জরুরি।
প্রথম আলো : বিশ্বজুড়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বিস্তারে বাধাগুলো কী কী?
ডেভিড কাপলান : যদি আমি বাংলাদেশের সঙ্গে নিজের দেশের (যুক্তরাষ্ট্র) তুলনা করি, আমাদের কাজ করা আপনাদের তুলনায় বেশ সহজ। উন্নত বিশ্বে আমরা মামলার মুখোমুখি হই, হুমকি পাই, রাজনৈতিক বা বাণিজ্যিক কারণে রিপোর্ট ছাপাতে সমস্যার মুখোমুখি হই। তবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য যে সময় দরকার, তা নিয়ে সব সময় যুদ্ধ চলে। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আর বাংলাদেশের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কেউ আপনাকে একটি রিপোর্টের জন্য তিন মাস সময় দিতে চাইবে না। তবে আমাদের একটি ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে। আমাদের বার্তাকক্ষগুলো এখন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা উৎসাহিত করে, আমাদের এমন পাঠক বা দর্শক আছেন, যাঁরা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পড়তে বা দেখতে পছন্দ করেন এবং আমাদের এমন সরকারি কর্মকর্তা আছেন, যাঁরা মনে করেন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সমাজে বৈধ ভূমিকা আছে। যদি তাঁরা এ জন্য বিব্রতও হন, তাঁরা এটাকে গণতন্ত্রের অংশ বলে মনে করেন।
প্রথম আলো : উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য তো পরিস্থিতি ভিন্ন?
ডেভিড কাপলান : আপনি যদি উন্নয়নশীল বিশ্বের দিকে তাকান, দেখবেন সেখানে নানা ধরনের সমস্যা। সেখানে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা অনেক নাজুক, সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর হাত অনেক লম্বা, সরকারি কর্মকর্তারা মনে করেন তাঁরা গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন-হয়রানি তো আছেই। সেখানে বিজ্ঞাপনের বাজার অনুন্নত আর বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সরকার গণমাধ্যমকে প্রভাবিত করতে পারে। অর্থনৈতিক সংকট তো আছেই, আছে সম্পদের অভাব, উন্নত প্রশিক্ষণের অভাব। অনেক দেশে সাংবাদিকতার কোর্সগুলো হয়তো গত শতাব্দীর। সবকিছু ঠেলেই আমাদের সামনে এগোতে হচ্ছে।
প্রথম আলো : বিশ্বজুড়ে যেভাবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এগোচ্ছে, তা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ডেভিড কাপলান : আমার দৃষ্টিতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হচ্ছে একটা ‘ভালো ভাইরাস’, যা বিশ্বজুড়ে ছড়ানোর মধ্য দিয়ে শক্তি অর্জন করছে। কারণ, মানুষ এটাই চায়। মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি আর সংঘবদ্ধ অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আধুনিক গবেষণা পদ্ধতি, সঠিক রিপোর্টিং ও পদ্ধতিগত অনুসন্ধানী কৌশল ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। সরকারগুলো আমাদের পছন্দ করে না, মামলা-হয়রানি-শারীরিক আঘাত—এত সব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও আমরা বড় হচ্ছি। কেন? বিশ্বের সাংবাদিক সম্প্রদায়ের দিকে তাকান। তাঁরা অর্থ বা খ্যাতির জন্য সাংবাদিকতা করেন না। তাঁরা শুধু যে সমাজ বা রাষ্ট্রে বাস করছেন, তাকে আরেকটু বেশি বাসযোগ্য করতে চান। বেশির ভাগ মানুষের সমাজে তেমন কোনো ক্ষমতা নেই, আর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা একটা ছোট্ট উপায়, যাতে একজন ব্যক্তি সমাজে পরিবর্তন আনতে পারেন। তাই শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বিশ্বজুড়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এগিয়ে চলেছে।
প্রথম আলো : বাংলাদেশের সাংবাদিকদের প্রতি আপনার কোনো পরামর্শ বা বক্তব্য...
ডেভিড কাপলান : আমাদের বাংলাদেশি সহকর্মীদের আমরা বৈশ্বিক এ নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানাই। সারা বিশ্বের সাংবাদিকদের নিয়ে আমাদের এই সংগঠন। এখানে যুক্ত হলে তাঁরা তথ্যপ্রযুক্তির সর্বাধুনিক ব্যবহারের মাধ্যমে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পদ্ধতি জানতে পারবেন, দেশি-বিদেশি সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি ও রক্ষা করতে পারবেন এবং একে-অন্যের সহযোগিতা নিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট তৈরি করতে পারবেন। আমরা মূলত এমন একটি নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্ম, যার মাধ্যমে বিশ্বের সাংবাদিক সম্প্রদায় একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। বর্তমান বিশ্বে সংবাদ খুব দ্রুত দেশের সীমানা ছাড়িয়ে যায়। সকালে আপনি যে খাবার খাচ্ছেন, বিকেলে আপনার শিশুটি যে খেলনা দিয়ে খেলছে, রাতে আপনি যে ওষুধটি খাচ্ছেন—সবই অন্য এক দেশ থেকে আসে। তাই গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধানী রিপোর্টিং করতে গেলে আপনাকে সীমানা পেরোতে হবে। বহু আগে থেকেই খারাপ লোকেরা আন্তর্জাতিক হয়ে গেছে। তারা চোখের নিমেষে এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ, মানুষ ও নিষিদ্ধ বস্তু পাচার করছে, পুলিশ তাদের ধরতে পারছে না, অথচ সাংবাদিকেরা তাদের ঠিকই খুঁজে বের করছেন। এ জন্য বাংলাদেশি সহকর্মীদের আমাদের আরও বেশি করে দরকার, বৈশ্বিক এই আন্দোলনে যেন তাঁরাও ভালোভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন।
প্রথম আলো : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ডেভিড কাপলান : আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments