অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ওপর বড় হুমকি by এম সাখাওয়াত হোসেন
মাস
খানেক আগে দুজন বিদেশি নাগরিক হত্যাসহ হোসেনি দালানে আশুরার দিনে গ্রেনেড
হামলার ধাক্কা সামলিয়ে ওঠার আগেই বড় আরেকটি ধাক্কায় সাধারণ মানুষ আতঙ্কে
পতিত হলো। একই দিনে প্রায় একই সমেয় দুটি আলাদা জায়গায় হামলা পরিচালিত
হলো। ওই হামলা ছিল সুপরিকল্পিত। টার্গেট ছিলেন দুটি প্রকাশনা সংস্থার
কর্ণধারেরা, একজন আহমেদুর রশীদ (টুটুল), তাঁর সঙ্গে আরও দুই সহযোগী ব্লগার
বলে পরিচিত সুদীপ কুমার বর্মণ, তারেক রহিম এবং আজিজ সুপার মার্কেটের
তিনতলায় জাগৃতি প্রকাশনার স্বত্বাধিকারী আরেফিন ফয়সল (দীপন)।
লক্ষণীয় বিষয় হলো শুদ্ধস্বরের স্বত্বাধিকারীর ওপর হামলায় চাপাতির সঙ্গে পিস্তল-জাতীয় অস্ত্রও ব্যবহার করা হয়েছিল বলে খবরে প্রকাশিত। তবে কী ধরনের অস্ত্র ছিল তা জানা যায়নি। শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে হামলায় কেউ মারা যাননি, তাঁদের দ্রুত উদ্ধার করে হাসপাতালে পৌঁছানো গিয়েছিল। তেমনটা ফয়সলের বেলায় হয়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, একাধিক ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত হামলায় ফয়সলের মৃত্যু নিশ্চিত করেই হামলাকারীরা স্থান ত্যাগ করে। এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। ফয়সলের হত্যা এবং টুটুলের হত্যাচেষ্টার পেছনে অভিজিৎ হত্যার যে কারণ প্রচার করা হয়েছে, তা একই সূত্রে গাঁথা। অর্থাৎ এই প্রকাশনা সংস্থা থেকে অভিজিতের বই প্রকাশ হওয়ার কারণ দেখিয়ে হত্যার দায় স্বীকার করে টুইট করেছে আনসার আল ইসলাম নামক কট্টরপন্থী সংগঠন। এর আগে অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম দায় স্বীকার করেছিল। সেই সূত্র ধরেই জামিনে থাকা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসিমউদ্দিন রহমানী নামক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
আনসার আল ইসলাম ছাড়া আর কোনো সংগঠন এখন পর্যন্ত হালের এই দুই প্রকাশকের ওপরে হামলার দায় স্বীকার করেছে বলে জানা যায়নি। অপর দিকে অভিজিৎ হত্যার দায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ছাড়া অন্য কোনো গোপন সংগঠন স্বীকার করেনি। কিন্তু আনসার আল ইসলামের এক টুইট বার্তায় ওই হত্যা এবং তার আগের হত্যাগুলোর দায় স্বীকার করা হয়েছে। তবে হোসেনি দালানে হামলা এবং দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে দায়েশ নামে পরিচিত ‘ইসলামি স্টেট’ জড়িত থাকার তথ্য কয়েকবার নিশ্চিত করেছে সাইট (SITE) নামক বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস নিয়ে গবেষণা করা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এর কারণ হয়তো এর আগে সরকার জঙ্গি দমন করে যে কৃতিত্ব প্রচার করেছে, তা যে হিতে বিপরীত হয়েছে তা অনুমান করার পর থেকেই মনে হয় হঠাৎ দুই বিদেশি হত্যার সঙ্গে এ দেশে আইএস অথবা অন্য কোনো জঙ্গি সংগঠন নেই বলে পূর্বতন অবস্থান পরিবর্তন করেছে। এর এই অবস্থান পরিবর্তনের মাঝেই এ দুটি হামলা সংঘটিত হয়েছে এবং তদন্তকারী সংস্থা এবং পুলিশের তরফ থেকে জঙ্গি সম্পৃক্ততার কথা বলা হচ্ছে। অবশ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ পর্যন্ত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকেই সন্দেহ করছে এবং আনসার আল ইসলামের দায় স্বীকারকে আমলে নিচ্ছে না।
আনসার আল ইসলাম নামক সংগঠন সংগঠিত হয়েছিল ইরাকের সুন্নি অঞ্চল আল-কায়েদার সম্পৃক্ততায়, সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে, ইরাকের বায়রা প্রদেশে। এদের দর্শন ছিল আল-কায়েদার ‘সালাফিইজম’। ওই সময় এদের নিয়ন্ত্রণে ছিল হালাবজার কাছাকাছি কিছু অঞ্চল। এর নেতৃত্বে প্রথমে ছিলেন আবু আবদুল্লাহ-আল সাফি। পরে ইসলাম মুভমেন্ট অব কুর্দিস্তান আনসার এর সঙ্গে যুক্ত হলে নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণের যেসব অজুহাত দাঁড় করেছিল, তার মধ্যে এই সংগঠনের সঙ্গে সাদ্দামের সম্পৃক্ততার অভিযোগও উঠেছিল, যা পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত হয়নি। ২০০৩ সালে মার্কিন বাহিনী ইরাক দখল করলে এই দখলদারির বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে পরিচিতি অর্জন করে। এই সংগঠন আরও পরে যেমনটা বলেছে, আনসার আল ইসলামের সঙ্গে মোল্লা ক্রেকারের নেতৃত্বে যখন ইসলামিক মুভমেন্ট অব কুর্দিস্তান যোগ দেয় তখন নেতৃত্ব চলে যায় তাঁর হাতে। এরপর থেকেই সরাসরি আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্ত হয় এই সংগঠন। অনেক পথ পার হয়ে সিরিয়ায় পা জমায় আনসার আল ইসলাম। বর্তমানে সিরিয়ায় আসাদবিরোধী কট্টরপন্থী দল আল-নুসরা ইসলামিক ফ্রন্টের সঙ্গে যোগ দিয়ে যুদ্ধরত রয়েছে। এর নেতৃত্বে রয়েছেন শেখ আবু হাশিমি আল ইব্রাহিম এবং এখন আল-কায়েদার ধ্বজাধারী।
হালে সংঘটিত এই দুই হামলায় আনসার আল ইসলামের দায় স্বীকার করা গৃহীত হলে এই দুই হত্যা ও হত্যাচেষ্টার পেছনে এই সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক আল-কায়েদার সম্পৃক্ততার কথা পরোক্ষভাবে স্বীকার করা হবে, যা হয়তো সরকারের জন্য শুভ হবে না মনে করেই এর অস্তিত্ব স্বীকার করছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। উল্লেখ্য, নিউইয়র্ক টাইমস-এর মে ৪, ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে অভিজিৎ, ওয়ািশকুর রহমান, আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যার দায় উপমহাদেশে সংগঠিত আল-কায়েদা (একিউআইএস) স্বীকার করে একটি ভিডিওবার্তা ‘সাইট’-এর কাছে পাঠিয়েছিল।
বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকেই জন্ম নেয় ক্ষোভের। বর্তমান বিশ্বে এই ক্ষোভকে কাজে লাগানো হয় এবং হয়েছে দেশীয় ও বিদেশি স্বার্থসিদ্ধ করতে। স্বাধীন দেশের নাগরিকেরা আতঙ্কের মধ্য বসবাস করতে চান না। একই সঙ্গে কেউ যেন স্বাধীনতার গণ্ডি পার না করেন, সেদিকেও সমাজ এবং রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য লক্ষ রাখা উচিত অপর দিকে বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন ২ নভেম্বর, ২০১৫ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে আনসার আল ইসলামের এক টুইট বার্তায় ওই সংগঠনের তরফ থেকে মুফতি আবদুল্লাহ আশরাফ এক লম্বা বিবৃতিতে একধরনের নীতিনির্ধারণের মতো বলেছেন যে তাঁদের টার্গেট শুধু ওই ব্যক্তিরা, যারা ইসলামের নবী (সা.) এবং ধর্ম নিয়ে নেতিবাচক লেখা এবং যেকোনোভাবে সম্পৃক্ত, শুধু তারাই। এই টুইটের তারিখ উল্লেখ রয়েছে অক্টোবর ১, ২০১৫ সাল। লক্ষণীয় যে এর এক মাসের মাথায় দুই প্রকাশনায় হামলা হয়েছে। কাজেই এই দায় স্বীকারকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উড়িয়ে দেবে, এমনটা ভাবা যায় না।
একদিকে আল-কায়েদার সম্পৃক্ততা, অপর দিকে শিয়া ইমামবাড়ায় হামলা এবং দুই বিদেশি নাগরিককে হত্যার পেছনে আইএসের সম্পৃক্ততার কথা সাইট নামক সংস্থাটি কয়েকবার উল্লেখ করেছে। ওই দাবিও নাকচ করা হয়েছে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফ থেকে। লক্ষণীয় বিষয় হলো যে আল-কায়েদায় এবং আইএসের সঙ্গে ভাবগত মতপার্থক্য তেমন না থাকলেও বর্তমানে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। এমনটাই সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অবস্থান বিশ্লেষণে প্রতীয়মান। যদি এই দুই সংগঠনের দায় স্বীকারকে তাত্ত্বিকভাবে গ্রহণ করা যায়, তাহলেও প্রতীয়মান হবে যে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত এই দুই কট্টরপন্থী সন্ত্রাসী সংগঠন বলে পরিচিত উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশে একধরনের প্রতিযোগিতায় রয়েছে, যা দেশের স্থিতিশীলতার জন্য মোটেও শুভকর নয়। এখানেই শঙ্কার জায়গা। বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তবে এসব তথ্য উন্মুক্ত তথ্যভান্ডার থেকে নেওয়া। আমাদের দেশের গোয়েন্দা এবং তদন্তকারী সংস্থার কাছে আনসার আল ইসলাম এবং আইএসের ওপর আরও বিস্তারিত তথ্য রয়েছে বলে বিশ্বাস রাখতে চাই, যা আমাদের জানার কথা নয়। তবে আমার কাছে অভিজিৎ হত্যার পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের স্বীকারোক্তি বিভ্রান্তিকর বলে মনে হয়। নির্মোহ তদন্তে অনেক বিষয়ই পরিষ্কার হতে পারে।
যে ঘটনাগুলো ঘটছে, সেগুলো অবশ্যই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বলে আমি মনে করি। এ ধরনের ঘটনা যেকোনো রাষ্ট্রকে দুর্বল করে। যেকোনো সন্ত্রাসী তা বামপন্থী হোক, ডানপন্থী হোক অথবা ধর্মীয় আঁধারেই হোক, রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার প্রয়াসেই এ ধরনের কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে থাকে। সমাজে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। তবে হাতেগোনা কয়েকটি দেশ ছাড়া বিশ্বের সব দেশেই রাজনীতির সঙ্গে পরোক্ষ হলেও ওই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মের প্রভাব থাকবেই। তবে সেই প্রভাব রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কতখানি থাকবে, তার সিদ্ধান্ত ওই দেশের জনগণকেই নিতে হয়।
বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও বর্তমানে যে সমস্যার মুখোমুখি আমরা রয়েছি, তা শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে সমাধান করা সম্ভব নয়। এমন নজির বিশ্বে নেই। এমনিতেই আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাজনৈতিক প্রভাবে পরিচালিত হয়, সেখানে এ ধরনের অত্যন্ত ‘হাই-টেক’ চিন্তা ‘লো-টেক’ কার্য সম্পাদনকে প্রতিহত করা এবং প্রতিরোধ করার মতো প্রশিক্ষণ ও তদন্তের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
ইংরেজিতে বলে, ভায়োলেন্স ইনক্রিজেস ভায়োলেন্স। কাজেই বন্দুকের শক্তিই একমাত্র সমাধান নয়। সমাধানের জন্য চাই ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক অধিকার এবং সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।
আমি ফয়সলের পিতা শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আবুল কাসেম ফজলুল হক, যাঁর সঙ্গে আমার যৎসামান্য পরিচয় রয়েছে, তাঁর একটি উক্তির প্রতিধ্বনি করতে চাই। তিনি বলেছিলেন যে একদিকে যেমন ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে যে রাজনীতি হচ্ছে, অপর দিকে ধর্ম নিয়ে যাঁরা রাজনীতি করছেন, উভয়েরই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। আমাদের বিজ্ঞজনেরা ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে এমনভাবে কথা বলেন, যা সাধারণ মানুষ বোঝেও না।
উপসংহারে বলতে চাই যে তদন্ত চলাকালে দোষারোপের রাজনীতি থেকে বিরত থাকা উচিত। অন্তত প্রকৃত দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত না করা পর্যন্ত। অপর দিকে সমাজপতি এবং রাজনীতিবিদদের ভাবতে হবে কেন একটি সমজাতিক (Homogeneous) রাষ্ট্রে কিছুসংখ্যক মানুষ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতাবোধ (Alienated) করবেন। তাঁদের ক্ষোভ কোথায়? এবং রাষ্ট্র কী ব্যবস্থা নিতে পারে? বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকেই জন্ম নেয় ক্ষোভের। বর্তমান বিশ্বে এই ক্ষোভকে কাজে লাগানো হয় এবং হয়েছে দেশীয় ও বিদেশি স্বার্থসিদ্ধ করতে। স্বাধীন দেশের নাগরিকেরা আতঙ্কের মধ্য বসবাস করতে চান না। একই সঙ্গে কেউ যেন স্বাধীনতার গণ্ডি পার না করেন, সেদিকেও সমাজ এবং রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য লক্ষ রাখা উচিত।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
লক্ষণীয় বিষয় হলো শুদ্ধস্বরের স্বত্বাধিকারীর ওপর হামলায় চাপাতির সঙ্গে পিস্তল-জাতীয় অস্ত্রও ব্যবহার করা হয়েছিল বলে খবরে প্রকাশিত। তবে কী ধরনের অস্ত্র ছিল তা জানা যায়নি। শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে হামলায় কেউ মারা যাননি, তাঁদের দ্রুত উদ্ধার করে হাসপাতালে পৌঁছানো গিয়েছিল। তেমনটা ফয়সলের বেলায় হয়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, একাধিক ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত হামলায় ফয়সলের মৃত্যু নিশ্চিত করেই হামলাকারীরা স্থান ত্যাগ করে। এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। ফয়সলের হত্যা এবং টুটুলের হত্যাচেষ্টার পেছনে অভিজিৎ হত্যার যে কারণ প্রচার করা হয়েছে, তা একই সূত্রে গাঁথা। অর্থাৎ এই প্রকাশনা সংস্থা থেকে অভিজিতের বই প্রকাশ হওয়ার কারণ দেখিয়ে হত্যার দায় স্বীকার করে টুইট করেছে আনসার আল ইসলাম নামক কট্টরপন্থী সংগঠন। এর আগে অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম দায় স্বীকার করেছিল। সেই সূত্র ধরেই জামিনে থাকা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসিমউদ্দিন রহমানী নামক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
আনসার আল ইসলাম ছাড়া আর কোনো সংগঠন এখন পর্যন্ত হালের এই দুই প্রকাশকের ওপরে হামলার দায় স্বীকার করেছে বলে জানা যায়নি। অপর দিকে অভিজিৎ হত্যার দায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ছাড়া অন্য কোনো গোপন সংগঠন স্বীকার করেনি। কিন্তু আনসার আল ইসলামের এক টুইট বার্তায় ওই হত্যা এবং তার আগের হত্যাগুলোর দায় স্বীকার করা হয়েছে। তবে হোসেনি দালানে হামলা এবং দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে দায়েশ নামে পরিচিত ‘ইসলামি স্টেট’ জড়িত থাকার তথ্য কয়েকবার নিশ্চিত করেছে সাইট (SITE) নামক বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস নিয়ে গবেষণা করা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এর কারণ হয়তো এর আগে সরকার জঙ্গি দমন করে যে কৃতিত্ব প্রচার করেছে, তা যে হিতে বিপরীত হয়েছে তা অনুমান করার পর থেকেই মনে হয় হঠাৎ দুই বিদেশি হত্যার সঙ্গে এ দেশে আইএস অথবা অন্য কোনো জঙ্গি সংগঠন নেই বলে পূর্বতন অবস্থান পরিবর্তন করেছে। এর এই অবস্থান পরিবর্তনের মাঝেই এ দুটি হামলা সংঘটিত হয়েছে এবং তদন্তকারী সংস্থা এবং পুলিশের তরফ থেকে জঙ্গি সম্পৃক্ততার কথা বলা হচ্ছে। অবশ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ পর্যন্ত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকেই সন্দেহ করছে এবং আনসার আল ইসলামের দায় স্বীকারকে আমলে নিচ্ছে না।
আনসার আল ইসলাম নামক সংগঠন সংগঠিত হয়েছিল ইরাকের সুন্নি অঞ্চল আল-কায়েদার সম্পৃক্ততায়, সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে, ইরাকের বায়রা প্রদেশে। এদের দর্শন ছিল আল-কায়েদার ‘সালাফিইজম’। ওই সময় এদের নিয়ন্ত্রণে ছিল হালাবজার কাছাকাছি কিছু অঞ্চল। এর নেতৃত্বে প্রথমে ছিলেন আবু আবদুল্লাহ-আল সাফি। পরে ইসলাম মুভমেন্ট অব কুর্দিস্তান আনসার এর সঙ্গে যুক্ত হলে নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণের যেসব অজুহাত দাঁড় করেছিল, তার মধ্যে এই সংগঠনের সঙ্গে সাদ্দামের সম্পৃক্ততার অভিযোগও উঠেছিল, যা পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত হয়নি। ২০০৩ সালে মার্কিন বাহিনী ইরাক দখল করলে এই দখলদারির বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে পরিচিতি অর্জন করে। এই সংগঠন আরও পরে যেমনটা বলেছে, আনসার আল ইসলামের সঙ্গে মোল্লা ক্রেকারের নেতৃত্বে যখন ইসলামিক মুভমেন্ট অব কুর্দিস্তান যোগ দেয় তখন নেতৃত্ব চলে যায় তাঁর হাতে। এরপর থেকেই সরাসরি আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্ত হয় এই সংগঠন। অনেক পথ পার হয়ে সিরিয়ায় পা জমায় আনসার আল ইসলাম। বর্তমানে সিরিয়ায় আসাদবিরোধী কট্টরপন্থী দল আল-নুসরা ইসলামিক ফ্রন্টের সঙ্গে যোগ দিয়ে যুদ্ধরত রয়েছে। এর নেতৃত্বে রয়েছেন শেখ আবু হাশিমি আল ইব্রাহিম এবং এখন আল-কায়েদার ধ্বজাধারী।
হালে সংঘটিত এই দুই হামলায় আনসার আল ইসলামের দায় স্বীকার করা গৃহীত হলে এই দুই হত্যা ও হত্যাচেষ্টার পেছনে এই সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক আল-কায়েদার সম্পৃক্ততার কথা পরোক্ষভাবে স্বীকার করা হবে, যা হয়তো সরকারের জন্য শুভ হবে না মনে করেই এর অস্তিত্ব স্বীকার করছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। উল্লেখ্য, নিউইয়র্ক টাইমস-এর মে ৪, ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে অভিজিৎ, ওয়ািশকুর রহমান, আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যার দায় উপমহাদেশে সংগঠিত আল-কায়েদা (একিউআইএস) স্বীকার করে একটি ভিডিওবার্তা ‘সাইট’-এর কাছে পাঠিয়েছিল।
বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকেই জন্ম নেয় ক্ষোভের। বর্তমান বিশ্বে এই ক্ষোভকে কাজে লাগানো হয় এবং হয়েছে দেশীয় ও বিদেশি স্বার্থসিদ্ধ করতে। স্বাধীন দেশের নাগরিকেরা আতঙ্কের মধ্য বসবাস করতে চান না। একই সঙ্গে কেউ যেন স্বাধীনতার গণ্ডি পার না করেন, সেদিকেও সমাজ এবং রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য লক্ষ রাখা উচিত অপর দিকে বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন ২ নভেম্বর, ২০১৫ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে আনসার আল ইসলামের এক টুইট বার্তায় ওই সংগঠনের তরফ থেকে মুফতি আবদুল্লাহ আশরাফ এক লম্বা বিবৃতিতে একধরনের নীতিনির্ধারণের মতো বলেছেন যে তাঁদের টার্গেট শুধু ওই ব্যক্তিরা, যারা ইসলামের নবী (সা.) এবং ধর্ম নিয়ে নেতিবাচক লেখা এবং যেকোনোভাবে সম্পৃক্ত, শুধু তারাই। এই টুইটের তারিখ উল্লেখ রয়েছে অক্টোবর ১, ২০১৫ সাল। লক্ষণীয় যে এর এক মাসের মাথায় দুই প্রকাশনায় হামলা হয়েছে। কাজেই এই দায় স্বীকারকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উড়িয়ে দেবে, এমনটা ভাবা যায় না।
একদিকে আল-কায়েদার সম্পৃক্ততা, অপর দিকে শিয়া ইমামবাড়ায় হামলা এবং দুই বিদেশি নাগরিককে হত্যার পেছনে আইএসের সম্পৃক্ততার কথা সাইট নামক সংস্থাটি কয়েকবার উল্লেখ করেছে। ওই দাবিও নাকচ করা হয়েছে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফ থেকে। লক্ষণীয় বিষয় হলো যে আল-কায়েদায় এবং আইএসের সঙ্গে ভাবগত মতপার্থক্য তেমন না থাকলেও বর্তমানে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। এমনটাই সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অবস্থান বিশ্লেষণে প্রতীয়মান। যদি এই দুই সংগঠনের দায় স্বীকারকে তাত্ত্বিকভাবে গ্রহণ করা যায়, তাহলেও প্রতীয়মান হবে যে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত এই দুই কট্টরপন্থী সন্ত্রাসী সংগঠন বলে পরিচিত উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশে একধরনের প্রতিযোগিতায় রয়েছে, যা দেশের স্থিতিশীলতার জন্য মোটেও শুভকর নয়। এখানেই শঙ্কার জায়গা। বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তবে এসব তথ্য উন্মুক্ত তথ্যভান্ডার থেকে নেওয়া। আমাদের দেশের গোয়েন্দা এবং তদন্তকারী সংস্থার কাছে আনসার আল ইসলাম এবং আইএসের ওপর আরও বিস্তারিত তথ্য রয়েছে বলে বিশ্বাস রাখতে চাই, যা আমাদের জানার কথা নয়। তবে আমার কাছে অভিজিৎ হত্যার পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের স্বীকারোক্তি বিভ্রান্তিকর বলে মনে হয়। নির্মোহ তদন্তে অনেক বিষয়ই পরিষ্কার হতে পারে।
যে ঘটনাগুলো ঘটছে, সেগুলো অবশ্যই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বলে আমি মনে করি। এ ধরনের ঘটনা যেকোনো রাষ্ট্রকে দুর্বল করে। যেকোনো সন্ত্রাসী তা বামপন্থী হোক, ডানপন্থী হোক অথবা ধর্মীয় আঁধারেই হোক, রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার প্রয়াসেই এ ধরনের কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে থাকে। সমাজে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। তবে হাতেগোনা কয়েকটি দেশ ছাড়া বিশ্বের সব দেশেই রাজনীতির সঙ্গে পরোক্ষ হলেও ওই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মের প্রভাব থাকবেই। তবে সেই প্রভাব রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কতখানি থাকবে, তার সিদ্ধান্ত ওই দেশের জনগণকেই নিতে হয়।
বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও বর্তমানে যে সমস্যার মুখোমুখি আমরা রয়েছি, তা শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে সমাধান করা সম্ভব নয়। এমন নজির বিশ্বে নেই। এমনিতেই আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাজনৈতিক প্রভাবে পরিচালিত হয়, সেখানে এ ধরনের অত্যন্ত ‘হাই-টেক’ চিন্তা ‘লো-টেক’ কার্য সম্পাদনকে প্রতিহত করা এবং প্রতিরোধ করার মতো প্রশিক্ষণ ও তদন্তের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
ইংরেজিতে বলে, ভায়োলেন্স ইনক্রিজেস ভায়োলেন্স। কাজেই বন্দুকের শক্তিই একমাত্র সমাধান নয়। সমাধানের জন্য চাই ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক অধিকার এবং সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।
আমি ফয়সলের পিতা শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আবুল কাসেম ফজলুল হক, যাঁর সঙ্গে আমার যৎসামান্য পরিচয় রয়েছে, তাঁর একটি উক্তির প্রতিধ্বনি করতে চাই। তিনি বলেছিলেন যে একদিকে যেমন ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে যে রাজনীতি হচ্ছে, অপর দিকে ধর্ম নিয়ে যাঁরা রাজনীতি করছেন, উভয়েরই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। আমাদের বিজ্ঞজনেরা ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে এমনভাবে কথা বলেন, যা সাধারণ মানুষ বোঝেও না।
উপসংহারে বলতে চাই যে তদন্ত চলাকালে দোষারোপের রাজনীতি থেকে বিরত থাকা উচিত। অন্তত প্রকৃত দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত না করা পর্যন্ত। অপর দিকে সমাজপতি এবং রাজনীতিবিদদের ভাবতে হবে কেন একটি সমজাতিক (Homogeneous) রাষ্ট্রে কিছুসংখ্যক মানুষ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতাবোধ (Alienated) করবেন। তাঁদের ক্ষোভ কোথায়? এবং রাষ্ট্র কী ব্যবস্থা নিতে পারে? বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকেই জন্ম নেয় ক্ষোভের। বর্তমান বিশ্বে এই ক্ষোভকে কাজে লাগানো হয় এবং হয়েছে দেশীয় ও বিদেশি স্বার্থসিদ্ধ করতে। স্বাধীন দেশের নাগরিকেরা আতঙ্কের মধ্য বসবাস করতে চান না। একই সঙ্গে কেউ যেন স্বাধীনতার গণ্ডি পার না করেন, সেদিকেও সমাজ এবং রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য লক্ষ রাখা উচিত।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
No comments