শারজায় শব্দের জন্য ভালোবাসা by আনিসুল হক
শারজা আন্তর্জাতিক বইমেলার সাবলীল আয়োজন |
শারজার
আন্তর্জাতিক বইমেলায় এসে আমি হাঁ হয়ে গেছি। ভাগ্যিস আরব আমিরাতে মাছি নেই,
থাকলে আমার হাঁ মুখে যেত ঢুকে। এই বইমেলা এত বড়, এত অর্থবহ, এত রংদার, এত
সুসংগঠিত যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার লাইনটা মনে পড়ছে—‘দারুণ সুন্দর
কিছু দেখলে আমার একটু একটু কান্না পায়’। আমার কান্না পাচ্ছে।
প্রথমে বলে নিই আয়োজনটা কত বড়! এটা ঘটছে একটা ছাদের নিচে, শারজার এক্সপো সেন্টারে। সেই ছাদ আবার কমপক্ষে ১০ তলা উঁচু। তারই নিচে গোটা চারেক সেমিনার রুম, একটা বিশাল বলরুম, কয়েকটা থিয়েটার হল আর নানা অঞ্চলে ভাগ করে বইয়ের সারি সারি স্টল আর প্যাভিলিয়ন। গোটা চত্বরই শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। ১ হাজার ৫০০ স্টল বসেছে, সারা পৃথিবী থেকে প্রকাশক, পুস্তক বিক্রেতারা এসেছেন। বড় বড় প্যাভিলিয়নও আছে, যেমন সবচেয়ে সুন্দর প্যাভিলিয়নটা দেখলাম সৌদি আরবের, আর অনেক টেলিভিশন চ্যানেলের। কত ভাষার বই যে আছে, ইংরেজি বই আছে সারি সারি, আরবি তো থাকবেই, অন্তত ৩০টা স্টল আছে ভারতের, আছে ভারতীয় নানা বই, ইংরেজি বই, দক্ষিণী নানা ভাষার বই, শুধু একটা ভাষার একটা বইও নেই—বাংলা। আমাকে ওরা দাওয়াত করেছে লেখক হিসেবে, আরব বিশ্বের বাইরের এই রকম ৫৫ জন লেখক এসেছেন অতিথি হয়ে, সারা পৃথিবী থেকে। ম্যানবুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক বেন ওক্রি থেকে শুরু করে কত দেশের কত লেখক। আর আছেন আরব দেশগুলোর লেখক-লেখিকারা। আমাকে ওরা বলেছিল, তুমি তোমার কোন বইটাকে তুলে ধরতে চাও, আমি দিল্লি থেকে প্রকাশিত ফ্রিডম’স মাদার-এর কথা বললাম, ফ্রিডম’স মাদার এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে, এখন বুঝছি, ভুল হয়ে গেছে, আমার উচিত ছিল সময় প্রকাশনীর মা বইটার কথা বলা, তাহলে অন্তত একটা বাংলা বই থাকতে পারত এখানে। একজন বাংলাদেশি সেলসম্যান একটা আরবি প্রকাশনায় কাজ করছেন, হবিগঞ্জে বাড়ি, বললেন, গত বছর একটা বাংলাদেশি বইয়ের দোকানের আসার কথা ছিল, ওরা বাংলাদেশের পতাকাও উড়িয়েছিল, পরে আর তারা আসেনি।
১১ দিনের বইমেলায় দর্শক আসেন ১৫ লাখ। মনে হয়, পুরো শারজা শহরই চলে আসে মেলায়। কত কী যে ঘটে! ইতালি থেকে এসেছে উড়ন্ত নাচিয়েদের দল, তারা প্রদর্শন করেছে ইতিহাস-ভিত্তিক নৃত্যনাট্য। একটা হলরুমে ঢুকে দেখি সার্কাস হচ্ছে, বাচ্চাদের জন্য, বাচ্চারা জোকারদের কাণ্ড দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ছে, অনেক কর্মশালা হয় শিশুদের নিয়েই। সভা হচ্ছে, সেমিনার হচ্ছে, আরব বিশ্বের প্রকাশকদের সম্মেলন হচ্ছে। নারী-পুরুষ পাশাপাশি কাজ করছেন, কোনো জড়তা নেই। কোথাও কোনো ত্রুটি নেই। বিমানবন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গে মারহাবা লাউঞ্জ থেকে একজন এসে আমাকে ইমিগ্রেশন পার করে আনলেন, তুলে দিলেন গাড়িতে। গাড়ি নিয়ে এল হোটেলে। সেখানে উদ্যোক্তারা অপেক্ষা করছে বইমেলার অতিথিদের জন্য। যখন চাইব, তখনই ওদের গাড়ি নিয়ে যাবে বইমেলায়। বইমেলায় লেখকদের জন্য আলাদা লাউঞ্জ, যেটা সব সাহিত্য উৎসবেই থাকে। ওদের মিডিয়া লাউঞ্জ গমগম করছে, এমনটা আমি দেখেছি বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে, কোপেনহেগেনে, কিন্তু সে তো বিশ্ব সম্মেলন, আর এটা তো শারজা বইমেলা। সবগুলো খবরের কাগজে বড় বড় ছবি, বড় বড় খবর, বইমেলাকে ঘিরে।
এর পেছনে আছে শারজার সুলতানের উৎসাহ—ড. শেখ সুলতান বিন মোহাম্মদ কাশমি। তিনি নিজেও লেখক। এই বইমেলার স্লোগান—ফর লাভ অব রিটেন ওয়ার্ড, লিখিত শব্দের ভালোবাসার জন্য। ইন্সপায়ারিং ক্রিয়েটিভিটি। সৃজনশীলতাকে উৎসাহ দেওয়া। তারা চায় নতুন প্রজন্ম বই পড়ুক। আজকের পাঠক, আগামীকালের নেতা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বইগুলোকে এনে দেওয়া পাঠকদের সামনে—যাতে তারা সস্তায় বই পায়—এই হচ্ছে এই বইমেলার উদ্দেশ্য। এত বড় একটা আয়োজন, কত মানুষ আসছে-যাচ্ছে, ছাদের নিচেই কত হাজার হাজার মানুষ, কিন্তু কোনো যানজট নেই, কোথাও ধাক্কাধাক্কি নেই, সুপরিচ্ছন্ন শৌচাগার, কোথাও এক টুকরা কাগজ পড়ে নেই। আবার অতিথিদের জাদুঘর দেখানো, কিংবা শহর ঘুরে দেখানোর কাজটাও চলছে আপন গতিতে। তাই তো সুযোগ ঘটে গেল কবি কহলিল জিব্রানের নিজের হাতে আঁকা ছবির প্রদর্শনী দেখার। এই প্রদর্শনীটা চলছে শারজা আর্ট মিউজিয়ামে। যেমন ঘুরে ঘুরে দেখলাম শারজা ইসলামিক সভ্যতা জাদুঘর। বিশেষভাবে মনোযোগ কাড়ল বিজ্ঞানচর্চায় মুসলিমদের অবদান। গণিতে, জ্যামিতিতে, রসায়নে, মহাকাশ গবেষণায় মুসলিমদের অবদানের নানা নমুনা প্রদর্শিত হচ্ছে। গ্রিকদের কাছ থেকে পাওয়া জ্ঞান আরবিতে অনুবাদ করেছিলেন মুসলিমরা, সেখান থেকে তা গেছে আবার ইউরোপে। এই জাদুঘরের দেয়ালে লেখা আছে, বিজ্ঞানচর্চায় মুসলিমদের এত ভালো করার কারণ ছিল মুসলিমরা অন্য বিশ্বাসে বিশ্বাসীদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অর্জনকেও সম্মানের চোখে দেখেছিলেন।
স্বাগতিকদের ব্যবহার আর আন্তরিকতা মুগ্ধ করার মতো। মি. আনিস, আপনার কী লাগবে। সব সময় সাদা লম্বা পোশাক পরা ছেলেরা কিংবা কালো পোশাক পরা মেয়েরা হাসিমুখে এগিয়ে আসছেন। না না, আমার কিছু লাগবে না বলেও সামলানো যায় না পরিস্থিতি। আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা হলো, আমাদের অধিবেশনে মঞ্চে বসে কানে আলাদা মাইক্রোফোন লাগানো, প্রশ্নকর্তা প্রশ্ন করছেন আরবিতে, হেডফোনে আমি সেটার অনুবাদ শুনছি ইংরেজিতে, আমি উত্তর দিচ্ছি ইংরেজিতে, যাঁরা তা আরবিতে শুনতে চান, কানে হেডফোন লাগিয়ে নিচ্ছেন।
সব ভালো। শুধু বাংলার অনুপস্থিতি ছাড়া। ভারতের এতগুলো স্টল, তাতেও কোনো বাংলা বই দেখলাম না। বাংলাদেশ সরকার তো একটা স্টল দিতে পারত! এ বিষয়ে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তবে প্রাথমিক উদ্যোগটা বুঝি আমাদের দূতাবাসকেই নিতে হবে।
বাংলাদেশিদের সঙ্গে দেখা তো হয়ই। তাঁদের একটাই কথা, স্যার, আমরা কিন্তু এখানে জিম্মির মতো আছি। কারণ, বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে আমাদের নিয়োগকারীরা আমাদের কম বেতনে প্রায় বন্দী করে রেখেছে। আরেক জায়গায় যে যাব, তার তো উপায় নেই, কারণ ভিসা নেই। আরব আমিরাতে বাংলাদেশিরা যাতে ভিসা পান, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে।
বাংলাদেশিরা আমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটেন, চট্টগ্রামের জহির, জাহাঙ্গীর, মাসুদ—তাঁরা উপহার এনে দেন আমার হাতে, আমার অনুষ্ঠানে বসে আলোচনা শোনেন। আমার মায়া লাগে। আমি তো ফিরে যাব কদিন পরেই। এঁরা থাকবেন এই মরুর দেশে। বছরে–দুই বছরে একবার সুযোগ পাবেন দেশে যাওয়ার। কিন্তু তাঁরা আটকে আছেন জিম্মির মতো। কারণ, ভিসা দেওয়া বন্ধ। এঁরা কী রকম পরম আত্মীয়ের মতো ব্যবহার করছেন আমার সঙ্গে। প্রবাসে বাঙালিমাত্রই সজ্জন। ওদের ভালোবাসাভরা চোখগুলো দেখলে আবেগ এসে যায়!
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
প্রথমে বলে নিই আয়োজনটা কত বড়! এটা ঘটছে একটা ছাদের নিচে, শারজার এক্সপো সেন্টারে। সেই ছাদ আবার কমপক্ষে ১০ তলা উঁচু। তারই নিচে গোটা চারেক সেমিনার রুম, একটা বিশাল বলরুম, কয়েকটা থিয়েটার হল আর নানা অঞ্চলে ভাগ করে বইয়ের সারি সারি স্টল আর প্যাভিলিয়ন। গোটা চত্বরই শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। ১ হাজার ৫০০ স্টল বসেছে, সারা পৃথিবী থেকে প্রকাশক, পুস্তক বিক্রেতারা এসেছেন। বড় বড় প্যাভিলিয়নও আছে, যেমন সবচেয়ে সুন্দর প্যাভিলিয়নটা দেখলাম সৌদি আরবের, আর অনেক টেলিভিশন চ্যানেলের। কত ভাষার বই যে আছে, ইংরেজি বই আছে সারি সারি, আরবি তো থাকবেই, অন্তত ৩০টা স্টল আছে ভারতের, আছে ভারতীয় নানা বই, ইংরেজি বই, দক্ষিণী নানা ভাষার বই, শুধু একটা ভাষার একটা বইও নেই—বাংলা। আমাকে ওরা দাওয়াত করেছে লেখক হিসেবে, আরব বিশ্বের বাইরের এই রকম ৫৫ জন লেখক এসেছেন অতিথি হয়ে, সারা পৃথিবী থেকে। ম্যানবুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক বেন ওক্রি থেকে শুরু করে কত দেশের কত লেখক। আর আছেন আরব দেশগুলোর লেখক-লেখিকারা। আমাকে ওরা বলেছিল, তুমি তোমার কোন বইটাকে তুলে ধরতে চাও, আমি দিল্লি থেকে প্রকাশিত ফ্রিডম’স মাদার-এর কথা বললাম, ফ্রিডম’স মাদার এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে, এখন বুঝছি, ভুল হয়ে গেছে, আমার উচিত ছিল সময় প্রকাশনীর মা বইটার কথা বলা, তাহলে অন্তত একটা বাংলা বই থাকতে পারত এখানে। একজন বাংলাদেশি সেলসম্যান একটা আরবি প্রকাশনায় কাজ করছেন, হবিগঞ্জে বাড়ি, বললেন, গত বছর একটা বাংলাদেশি বইয়ের দোকানের আসার কথা ছিল, ওরা বাংলাদেশের পতাকাও উড়িয়েছিল, পরে আর তারা আসেনি।
১১ দিনের বইমেলায় দর্শক আসেন ১৫ লাখ। মনে হয়, পুরো শারজা শহরই চলে আসে মেলায়। কত কী যে ঘটে! ইতালি থেকে এসেছে উড়ন্ত নাচিয়েদের দল, তারা প্রদর্শন করেছে ইতিহাস-ভিত্তিক নৃত্যনাট্য। একটা হলরুমে ঢুকে দেখি সার্কাস হচ্ছে, বাচ্চাদের জন্য, বাচ্চারা জোকারদের কাণ্ড দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ছে, অনেক কর্মশালা হয় শিশুদের নিয়েই। সভা হচ্ছে, সেমিনার হচ্ছে, আরব বিশ্বের প্রকাশকদের সম্মেলন হচ্ছে। নারী-পুরুষ পাশাপাশি কাজ করছেন, কোনো জড়তা নেই। কোথাও কোনো ত্রুটি নেই। বিমানবন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গে মারহাবা লাউঞ্জ থেকে একজন এসে আমাকে ইমিগ্রেশন পার করে আনলেন, তুলে দিলেন গাড়িতে। গাড়ি নিয়ে এল হোটেলে। সেখানে উদ্যোক্তারা অপেক্ষা করছে বইমেলার অতিথিদের জন্য। যখন চাইব, তখনই ওদের গাড়ি নিয়ে যাবে বইমেলায়। বইমেলায় লেখকদের জন্য আলাদা লাউঞ্জ, যেটা সব সাহিত্য উৎসবেই থাকে। ওদের মিডিয়া লাউঞ্জ গমগম করছে, এমনটা আমি দেখেছি বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে, কোপেনহেগেনে, কিন্তু সে তো বিশ্ব সম্মেলন, আর এটা তো শারজা বইমেলা। সবগুলো খবরের কাগজে বড় বড় ছবি, বড় বড় খবর, বইমেলাকে ঘিরে।
এর পেছনে আছে শারজার সুলতানের উৎসাহ—ড. শেখ সুলতান বিন মোহাম্মদ কাশমি। তিনি নিজেও লেখক। এই বইমেলার স্লোগান—ফর লাভ অব রিটেন ওয়ার্ড, লিখিত শব্দের ভালোবাসার জন্য। ইন্সপায়ারিং ক্রিয়েটিভিটি। সৃজনশীলতাকে উৎসাহ দেওয়া। তারা চায় নতুন প্রজন্ম বই পড়ুক। আজকের পাঠক, আগামীকালের নেতা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বইগুলোকে এনে দেওয়া পাঠকদের সামনে—যাতে তারা সস্তায় বই পায়—এই হচ্ছে এই বইমেলার উদ্দেশ্য। এত বড় একটা আয়োজন, কত মানুষ আসছে-যাচ্ছে, ছাদের নিচেই কত হাজার হাজার মানুষ, কিন্তু কোনো যানজট নেই, কোথাও ধাক্কাধাক্কি নেই, সুপরিচ্ছন্ন শৌচাগার, কোথাও এক টুকরা কাগজ পড়ে নেই। আবার অতিথিদের জাদুঘর দেখানো, কিংবা শহর ঘুরে দেখানোর কাজটাও চলছে আপন গতিতে। তাই তো সুযোগ ঘটে গেল কবি কহলিল জিব্রানের নিজের হাতে আঁকা ছবির প্রদর্শনী দেখার। এই প্রদর্শনীটা চলছে শারজা আর্ট মিউজিয়ামে। যেমন ঘুরে ঘুরে দেখলাম শারজা ইসলামিক সভ্যতা জাদুঘর। বিশেষভাবে মনোযোগ কাড়ল বিজ্ঞানচর্চায় মুসলিমদের অবদান। গণিতে, জ্যামিতিতে, রসায়নে, মহাকাশ গবেষণায় মুসলিমদের অবদানের নানা নমুনা প্রদর্শিত হচ্ছে। গ্রিকদের কাছ থেকে পাওয়া জ্ঞান আরবিতে অনুবাদ করেছিলেন মুসলিমরা, সেখান থেকে তা গেছে আবার ইউরোপে। এই জাদুঘরের দেয়ালে লেখা আছে, বিজ্ঞানচর্চায় মুসলিমদের এত ভালো করার কারণ ছিল মুসলিমরা অন্য বিশ্বাসে বিশ্বাসীদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অর্জনকেও সম্মানের চোখে দেখেছিলেন।
স্বাগতিকদের ব্যবহার আর আন্তরিকতা মুগ্ধ করার মতো। মি. আনিস, আপনার কী লাগবে। সব সময় সাদা লম্বা পোশাক পরা ছেলেরা কিংবা কালো পোশাক পরা মেয়েরা হাসিমুখে এগিয়ে আসছেন। না না, আমার কিছু লাগবে না বলেও সামলানো যায় না পরিস্থিতি। আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা হলো, আমাদের অধিবেশনে মঞ্চে বসে কানে আলাদা মাইক্রোফোন লাগানো, প্রশ্নকর্তা প্রশ্ন করছেন আরবিতে, হেডফোনে আমি সেটার অনুবাদ শুনছি ইংরেজিতে, আমি উত্তর দিচ্ছি ইংরেজিতে, যাঁরা তা আরবিতে শুনতে চান, কানে হেডফোন লাগিয়ে নিচ্ছেন।
সব ভালো। শুধু বাংলার অনুপস্থিতি ছাড়া। ভারতের এতগুলো স্টল, তাতেও কোনো বাংলা বই দেখলাম না। বাংলাদেশ সরকার তো একটা স্টল দিতে পারত! এ বিষয়ে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তবে প্রাথমিক উদ্যোগটা বুঝি আমাদের দূতাবাসকেই নিতে হবে।
বাংলাদেশিদের সঙ্গে দেখা তো হয়ই। তাঁদের একটাই কথা, স্যার, আমরা কিন্তু এখানে জিম্মির মতো আছি। কারণ, বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে আমাদের নিয়োগকারীরা আমাদের কম বেতনে প্রায় বন্দী করে রেখেছে। আরেক জায়গায় যে যাব, তার তো উপায় নেই, কারণ ভিসা নেই। আরব আমিরাতে বাংলাদেশিরা যাতে ভিসা পান, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে।
বাংলাদেশিরা আমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটেন, চট্টগ্রামের জহির, জাহাঙ্গীর, মাসুদ—তাঁরা উপহার এনে দেন আমার হাতে, আমার অনুষ্ঠানে বসে আলোচনা শোনেন। আমার মায়া লাগে। আমি তো ফিরে যাব কদিন পরেই। এঁরা থাকবেন এই মরুর দেশে। বছরে–দুই বছরে একবার সুযোগ পাবেন দেশে যাওয়ার। কিন্তু তাঁরা আটকে আছেন জিম্মির মতো। কারণ, ভিসা দেওয়া বন্ধ। এঁরা কী রকম পরম আত্মীয়ের মতো ব্যবহার করছেন আমার সঙ্গে। প্রবাসে বাঙালিমাত্রই সজ্জন। ওদের ভালোবাসাভরা চোখগুলো দেখলে আবেগ এসে যায়!
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments