হার্ট অ্যাটাক, আইন, বিচার এবং অস্ট্রেলিয়া by শাহদীন মালিক
বিশ্ববিদ্যালয়
মঞ্জুরি কমিশনের কর্মকর্তা ওমর সিরাজ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন।
অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল আসছে না। এক ইতালীয় নাগরিক গুলিবিদ্ধ হয়ে খুন হওয়ার
চার দিনের মাথায় একই কায়দায় খুন হয়েছেন এক জাপানি নাগরিক। সারা দেশে
তোলপাড়, বিদেশি গণমাধ্যমও উচ্চকিত। অভিযোগ উঠেছে, গাইবান্ধার
সুন্দরগঞ্জে এক সাংসদ কাকডাকা সকালে এক কিশোরকে গুলি করেছেন। পিস্তলের
নিশ্চয়ই লাইসেন্স আছে তাঁর।
হার্ট অ্যাটাক হতেই পারে। ক্রিকেট দলের সফরও বাতিল হতে পারে। বিচ্ছিন্ন দুএকটি খুন–খারাবিও হতে পারে। পরিস্থিতি হয়তো এখনো এমন হয়ে যায়নি যে ‘গেল গেল’ করতে হবে। কিন্তু সব মিলিয়ে ভালো ঠেকছে না।
এক.
গত শতাব্দীর সত্তরের দশক কাটিয়েছি ব্রেজনেভ-কসিগিনের সোভিয়েত ইউনিয়নে। আশির দশক রোনাল্ড রিগ্যানের যুক্তরাষ্ট্রে। তারপর ম্যাগি (মার্গারেট) থ্যাচারের আর জন মেজরের যুক্তরাজ্যে। বারাক ভাইয়ের যুক্তরাষ্ট্রে থাকা হয়নি। এখন আর বিদেশ যাই না। যথেষ্ট হয়েছে।
রানি যখন ঢাকায় আসেন, তখন ছোটই ছিলাম। বেইলি রোডে থাকতাম। বেইলি রোডেই রানির জন্য তড়িঘড়ি করে প্রাসাদ করা হয়। সেই রানি এখনো আছেন। সপ্তাহ দুয়েক আগে ব্রিটেনের ইতিহাসের সবার থেকে বেশি সময় সিংহাসনে থাকার রেকর্ড হয়েছে—এখন প্রায় ৬৪ বছর ধরে রানি। রাষ্ট্রপ্রধান। তিনি অস্ট্রেলিয়ারও রাষ্ট্রপ্রধান। কানাডা ও আরও কিছু দেশেরও।
বিলেতে থাকাকালে ম্যাগি থ্যাচারের বা জন মেজরের জন্মদিনের খবর দেখিনি বা শুনিনি। অথবা ব্রেজনেভ-কসিগিন বা রোনাল্ড রিগ্যানের। আমেরিকায় বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে বেঁচে আছেন জিমি কার্টার আর বড় বা বাবা বুশ। তাঁদেরও জন্মদিনের মিটিং-মিছিলের খবর দেখিনি বা পড়িনি। নেতাদের জন্মদিন দলীয়ভাবে বা ঘটা করে উদ্যাপন কোনো কোনো দেশের সংস্কৃতি। স্পষ্টত পশ্চিমা দেশে এসব গত ৪০ বছরে হয়েছে বলে মনে হয় না। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে এক ব্যক্তির জন্মদিন এখন সরকারি ছুটির দিন। বছর বিশেক যাবৎ এটা চালু হয়েছে। মহাত্মা গান্ধীকে অনুসরণ করে ভদ্দরলোক বছর পঞ্চাশেক আগে বলেছিলেন, অন্যায় আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাটাই সবচেয়ে বড় ধর্ম। তিনি আমেরিকার রাজা-উজির কিছুই হননি। মারা যাওয়ার কয়েক দশক পর তাঁর জন্মদিনে সরকারি ছুটি। ভদ্দরলোকের নাম মার্টিন লুথার কিং।
দুই.
২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত যৌথ বাহিনীর অভিযানে অন্তত ৫৭ জন ব্যক্তি হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিলেন। তঁাদের প্রায় সবার হৃদ্রোগে আক্রান্তের ঘটনা ঘটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘হেফাজতে’ থাকার সময়।
যেমন ঘটল আবার ১ অক্টোবর। ২০০২-০৩ সালের হার্ট অ্যাটাকে যেসব মৃত্যু, হেফাজতে জখম, অঙ্গহানি, সম্পত্তি বিনষ্ট হয়েছিল, তার জন্য কোনো আইনি প্রতিকার, আদালতের শরণাপন্ন হওয়া যাবে না এবং অন্য সব ধরনের আইনি প্রক্রিয়া নিষিদ্ধ করে দায়মুক্তি আইন পাস করেছিল আমাদের মহান সংসদ, ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।
ওই আইনটা বাতিল চেয়ে মামলায় মহামান্য আদালতকে অন্যান্য দেশে কী কী হয়েছে, তা দেখাতে গিয়ে তুলে ধরেছিলাম বিভিন্ন দেশের আইন, যেখানে হেফাজতে মৃত্যুর জন্য রাষ্ট্র দায়িত্ব স্বীকার করে ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য আইন পাস করেছে। শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধে যারা মারা গেছে, সে রকম হাজার হাজার পরিবারকে সরকার ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। আমাদের বাংলাদেশের
মেয়ে হানুফা পশ্চিমবঙ্গের রেল কর্মচারী দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার জন্য কলকাতার হাইকোর্ট রেল কর্তৃপক্ষকে আদেশ দিয়েছেন ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে।
এমনকি ইরাক-আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের গুলিতে নিরপরাধ নাগরিক নিহত হলে মার্কিন সরকার ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। কে ক্ষতিপূরণ পাবে, কীভাবে চাইতে হবে, কে দেবে ইত্যাদি ব্যাপারে বিস্তারিত আইন আছে। হেফাজতে মৃত্যুর ব্যাপারে আইন আছে আর্জেন্টিনা থেকে ফিলিপাইন পর্যন্ত। আর আমাদের সংসদ আইন পাস করে দায়মুক্তি দিয়েছিল। পরবর্তী কোনো সংসদ সে আইন বাতিল করেনি। মহামান্য আদালত গত ১৩ সেপ্টেম্বর রায়ের মাধ্যমে যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন, ২০০৩-কে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছেন। আদালত এটাও বলেছেন যে রাষ্ট্রের কারণে কোনো নাগরিকের যদি প্রাণনাশ হয়, অঙ্গহানি বা অন্যান্য ক্ষতি হয়, তাহলে মহামান্য হাইকোর্ট ক্ষতিপূরণের জন্য আদেশ দিতে পারবেন।
তিন.
১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক লাঞ্ছনাকর ব্যবহার এবং দণ্ডবিরোধী সনদ গ্রহণ করে। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সনদটিতে অনুস্বাক্ষর করে। ২০১৩ সালে এরই ধারাবাহিকতায় নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন সংসদ পাস করে। আইনের মোদ্দা কথা হলো, আদালতে গিয়ে যেকোনো ব্যক্তি যদি অভিযোগ করে যে তাকে হেফাজতে নির্যাতন করেছে অথবা কারও মৃত্যু হয়েছে, তাহলে আদালত সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসককে নির্যাতনের ধরন (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন) পরীক্ষা করে আদালতে প্রতিবেদন দিতে আদেশ দেবেন এবং পুলিশ সুপারকে অভিযোগ তদন্ত করতে বলবেন। এই আইনটি অন্য সব আইনের ওপরে প্রাধান্য পাবে। তবে আদালতে গিয়ে মামলা করতে হবে। ওমর সিরাজের ঘটনার প্রতিকার পেতে হলে তাঁর আত্মীয়স্বজনকে আদালতে গিয়ে এই নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনেই মামলা করতে হবে।
ইদানীং বহুল প্রচলিত ‘হুকুমের আসামি’ এই আইনে স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক বক্তব্যই আজকাল লোকজন বিশ্বাস করে বলে মনে হয় না। বেআইনি ও অন্যায় কাজ করে যদি জনগণের আস্থাভাজন হওয়া যেত, তাহলে সারা দুনিয়ায় স্বৈরাচারেরাই থাকত; গণতন্ত্র, নির্বাচন, নৈতিকতা বা নৈতিক ভিত্তি ইত্যাদি কোনো শাসকের দরকার হতো না।
১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক লাঞ্ছনাকর ব্যবহার এবং দণ্ডবিরোধী সনদ গ্রহণ করে। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সনদটিতে অনুস্বাক্ষর করে। ২০১৩ সালে এরই ধারাবাহিকতায় নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন সংসদ পাস করে
এক দশক ধরে এ দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলছে। ঘুষ-দুর্নীতিও চলছে। মেডিকেল কলেজ ৩০টা না ৩০০টা, তাতে নেতাদের কিছু আসে যায় না। প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠছে হরদম। ফলে মেধা না প্রশ্নপত্র ফাঁসের ভিত্তিতে ভর্তি হচ্ছেন, পাস করছেন, চিকিৎসক হচ্ছেন; সেটা ঊর্ধ্বতনদের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে না। নেতারা, বড়রা চিকিৎসা নিতে বহুদিন ধরেই বিদেশ যান। দেশে কে চিকিৎসক হলেন, কে রোগী হলো, তাতে কার কী আসে যায়। অধমও পয়সা জমাচ্ছি, চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাব।
চার
দেশে বোমা ফোটেনি। তাও অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দল আপাতত আসছে না।
তারা দেখতে পায়। সারা বিশ্ব দেখছে। তারা দেখে ঘটা করে জন্মদিন উদ্যাপিত হয়। সৌদি রাজার জন্মদিন উদ্যাপিত হয় না। কারণ, সৌদিরা জন্মদিনে বিশ্বাস করে না। কিন্তু লিবিয়ায় গাদ্দাফির ও ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের জন্মদিন উদ্যাপিত হতো ঘটা করে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের জন্ম ১১ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে হামলার দিন। বিএনপির জন্য খালেদা জিয়ার জন্মদিন ১৫ আগস্ট। সারবত্তা—গণতান্ত্রিক দেশে সরকারপ্রধান বা বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের ঘটা করে জন্মদিন করা সম্পূর্ণ বেমানান, অনাকাঙ্ক্ষিত। বিশেষ উপলক্ষে বা নানা উপলক্ষ তৈরি করে এ ধরনের অনুষ্ঠান করার মধ্যে সম্পূর্ণ সামন্তবাদী–জমিদারি মানসিকতার পরিচয় মেলে।
গণতান্ত্রিক বিশ্ব এসব দেখে। দেখে আইনের শাসন নেই। লোকে আজকাল আর বিচার চায় না, ফাঁসি চায়। বিচারকেরা—সবাই সব ক্ষেত্রে নন—গুরুত্বপূর্ণ মামলায় পুলিশকে সাহায্য করার জন্য ‘রিমান্ড’ দেন। রিমান্ডই এ দেশে এখন তদন্ত, বিশেষ করে চাঞ্চল্যকর মামলায়। যে পুলিশ বা র্যা ব রিমান্ড আর বন্দুকযুদ্ধ করে, তাদের তদন্তের ক্ষমতা-দক্ষতা থাকে না। চাইলেও তারা পারবে না। যা শুরু হয়েছে, যেভাবে চলছে—তাতে বিপদের আশঙ্কা বাড়ছে।
ড. শাহদীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট।
হার্ট অ্যাটাক হতেই পারে। ক্রিকেট দলের সফরও বাতিল হতে পারে। বিচ্ছিন্ন দুএকটি খুন–খারাবিও হতে পারে। পরিস্থিতি হয়তো এখনো এমন হয়ে যায়নি যে ‘গেল গেল’ করতে হবে। কিন্তু সব মিলিয়ে ভালো ঠেকছে না।
এক.
গত শতাব্দীর সত্তরের দশক কাটিয়েছি ব্রেজনেভ-কসিগিনের সোভিয়েত ইউনিয়নে। আশির দশক রোনাল্ড রিগ্যানের যুক্তরাষ্ট্রে। তারপর ম্যাগি (মার্গারেট) থ্যাচারের আর জন মেজরের যুক্তরাজ্যে। বারাক ভাইয়ের যুক্তরাষ্ট্রে থাকা হয়নি। এখন আর বিদেশ যাই না। যথেষ্ট হয়েছে।
রানি যখন ঢাকায় আসেন, তখন ছোটই ছিলাম। বেইলি রোডে থাকতাম। বেইলি রোডেই রানির জন্য তড়িঘড়ি করে প্রাসাদ করা হয়। সেই রানি এখনো আছেন। সপ্তাহ দুয়েক আগে ব্রিটেনের ইতিহাসের সবার থেকে বেশি সময় সিংহাসনে থাকার রেকর্ড হয়েছে—এখন প্রায় ৬৪ বছর ধরে রানি। রাষ্ট্রপ্রধান। তিনি অস্ট্রেলিয়ারও রাষ্ট্রপ্রধান। কানাডা ও আরও কিছু দেশেরও।
বিলেতে থাকাকালে ম্যাগি থ্যাচারের বা জন মেজরের জন্মদিনের খবর দেখিনি বা শুনিনি। অথবা ব্রেজনেভ-কসিগিন বা রোনাল্ড রিগ্যানের। আমেরিকায় বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে বেঁচে আছেন জিমি কার্টার আর বড় বা বাবা বুশ। তাঁদেরও জন্মদিনের মিটিং-মিছিলের খবর দেখিনি বা পড়িনি। নেতাদের জন্মদিন দলীয়ভাবে বা ঘটা করে উদ্যাপন কোনো কোনো দেশের সংস্কৃতি। স্পষ্টত পশ্চিমা দেশে এসব গত ৪০ বছরে হয়েছে বলে মনে হয় না। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে এক ব্যক্তির জন্মদিন এখন সরকারি ছুটির দিন। বছর বিশেক যাবৎ এটা চালু হয়েছে। মহাত্মা গান্ধীকে অনুসরণ করে ভদ্দরলোক বছর পঞ্চাশেক আগে বলেছিলেন, অন্যায় আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাটাই সবচেয়ে বড় ধর্ম। তিনি আমেরিকার রাজা-উজির কিছুই হননি। মারা যাওয়ার কয়েক দশক পর তাঁর জন্মদিনে সরকারি ছুটি। ভদ্দরলোকের নাম মার্টিন লুথার কিং।
দুই.
২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত যৌথ বাহিনীর অভিযানে অন্তত ৫৭ জন ব্যক্তি হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিলেন। তঁাদের প্রায় সবার হৃদ্রোগে আক্রান্তের ঘটনা ঘটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘হেফাজতে’ থাকার সময়।
যেমন ঘটল আবার ১ অক্টোবর। ২০০২-০৩ সালের হার্ট অ্যাটাকে যেসব মৃত্যু, হেফাজতে জখম, অঙ্গহানি, সম্পত্তি বিনষ্ট হয়েছিল, তার জন্য কোনো আইনি প্রতিকার, আদালতের শরণাপন্ন হওয়া যাবে না এবং অন্য সব ধরনের আইনি প্রক্রিয়া নিষিদ্ধ করে দায়মুক্তি আইন পাস করেছিল আমাদের মহান সংসদ, ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।
ওই আইনটা বাতিল চেয়ে মামলায় মহামান্য আদালতকে অন্যান্য দেশে কী কী হয়েছে, তা দেখাতে গিয়ে তুলে ধরেছিলাম বিভিন্ন দেশের আইন, যেখানে হেফাজতে মৃত্যুর জন্য রাষ্ট্র দায়িত্ব স্বীকার করে ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য আইন পাস করেছে। শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধে যারা মারা গেছে, সে রকম হাজার হাজার পরিবারকে সরকার ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। আমাদের বাংলাদেশের
মেয়ে হানুফা পশ্চিমবঙ্গের রেল কর্মচারী দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার জন্য কলকাতার হাইকোর্ট রেল কর্তৃপক্ষকে আদেশ দিয়েছেন ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে।
এমনকি ইরাক-আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের গুলিতে নিরপরাধ নাগরিক নিহত হলে মার্কিন সরকার ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। কে ক্ষতিপূরণ পাবে, কীভাবে চাইতে হবে, কে দেবে ইত্যাদি ব্যাপারে বিস্তারিত আইন আছে। হেফাজতে মৃত্যুর ব্যাপারে আইন আছে আর্জেন্টিনা থেকে ফিলিপাইন পর্যন্ত। আর আমাদের সংসদ আইন পাস করে দায়মুক্তি দিয়েছিল। পরবর্তী কোনো সংসদ সে আইন বাতিল করেনি। মহামান্য আদালত গত ১৩ সেপ্টেম্বর রায়ের মাধ্যমে যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন, ২০০৩-কে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছেন। আদালত এটাও বলেছেন যে রাষ্ট্রের কারণে কোনো নাগরিকের যদি প্রাণনাশ হয়, অঙ্গহানি বা অন্যান্য ক্ষতি হয়, তাহলে মহামান্য হাইকোর্ট ক্ষতিপূরণের জন্য আদেশ দিতে পারবেন।
তিন.
১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক লাঞ্ছনাকর ব্যবহার এবং দণ্ডবিরোধী সনদ গ্রহণ করে। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সনদটিতে অনুস্বাক্ষর করে। ২০১৩ সালে এরই ধারাবাহিকতায় নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন সংসদ পাস করে। আইনের মোদ্দা কথা হলো, আদালতে গিয়ে যেকোনো ব্যক্তি যদি অভিযোগ করে যে তাকে হেফাজতে নির্যাতন করেছে অথবা কারও মৃত্যু হয়েছে, তাহলে আদালত সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসককে নির্যাতনের ধরন (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন) পরীক্ষা করে আদালতে প্রতিবেদন দিতে আদেশ দেবেন এবং পুলিশ সুপারকে অভিযোগ তদন্ত করতে বলবেন। এই আইনটি অন্য সব আইনের ওপরে প্রাধান্য পাবে। তবে আদালতে গিয়ে মামলা করতে হবে। ওমর সিরাজের ঘটনার প্রতিকার পেতে হলে তাঁর আত্মীয়স্বজনকে আদালতে গিয়ে এই নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনেই মামলা করতে হবে।
ইদানীং বহুল প্রচলিত ‘হুকুমের আসামি’ এই আইনে স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক বক্তব্যই আজকাল লোকজন বিশ্বাস করে বলে মনে হয় না। বেআইনি ও অন্যায় কাজ করে যদি জনগণের আস্থাভাজন হওয়া যেত, তাহলে সারা দুনিয়ায় স্বৈরাচারেরাই থাকত; গণতন্ত্র, নির্বাচন, নৈতিকতা বা নৈতিক ভিত্তি ইত্যাদি কোনো শাসকের দরকার হতো না।
১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক লাঞ্ছনাকর ব্যবহার এবং দণ্ডবিরোধী সনদ গ্রহণ করে। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সনদটিতে অনুস্বাক্ষর করে। ২০১৩ সালে এরই ধারাবাহিকতায় নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন সংসদ পাস করে
এক দশক ধরে এ দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলছে। ঘুষ-দুর্নীতিও চলছে। মেডিকেল কলেজ ৩০টা না ৩০০টা, তাতে নেতাদের কিছু আসে যায় না। প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠছে হরদম। ফলে মেধা না প্রশ্নপত্র ফাঁসের ভিত্তিতে ভর্তি হচ্ছেন, পাস করছেন, চিকিৎসক হচ্ছেন; সেটা ঊর্ধ্বতনদের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে না। নেতারা, বড়রা চিকিৎসা নিতে বহুদিন ধরেই বিদেশ যান। দেশে কে চিকিৎসক হলেন, কে রোগী হলো, তাতে কার কী আসে যায়। অধমও পয়সা জমাচ্ছি, চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাব।
চার
দেশে বোমা ফোটেনি। তাও অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দল আপাতত আসছে না।
তারা দেখতে পায়। সারা বিশ্ব দেখছে। তারা দেখে ঘটা করে জন্মদিন উদ্যাপিত হয়। সৌদি রাজার জন্মদিন উদ্যাপিত হয় না। কারণ, সৌদিরা জন্মদিনে বিশ্বাস করে না। কিন্তু লিবিয়ায় গাদ্দাফির ও ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের জন্মদিন উদ্যাপিত হতো ঘটা করে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের জন্ম ১১ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে হামলার দিন। বিএনপির জন্য খালেদা জিয়ার জন্মদিন ১৫ আগস্ট। সারবত্তা—গণতান্ত্রিক দেশে সরকারপ্রধান বা বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের ঘটা করে জন্মদিন করা সম্পূর্ণ বেমানান, অনাকাঙ্ক্ষিত। বিশেষ উপলক্ষে বা নানা উপলক্ষ তৈরি করে এ ধরনের অনুষ্ঠান করার মধ্যে সম্পূর্ণ সামন্তবাদী–জমিদারি মানসিকতার পরিচয় মেলে।
গণতান্ত্রিক বিশ্ব এসব দেখে। দেখে আইনের শাসন নেই। লোকে আজকাল আর বিচার চায় না, ফাঁসি চায়। বিচারকেরা—সবাই সব ক্ষেত্রে নন—গুরুত্বপূর্ণ মামলায় পুলিশকে সাহায্য করার জন্য ‘রিমান্ড’ দেন। রিমান্ডই এ দেশে এখন তদন্ত, বিশেষ করে চাঞ্চল্যকর মামলায়। যে পুলিশ বা র্যা ব রিমান্ড আর বন্দুকযুদ্ধ করে, তাদের তদন্তের ক্ষমতা-দক্ষতা থাকে না। চাইলেও তারা পারবে না। যা শুরু হয়েছে, যেভাবে চলছে—তাতে বিপদের আশঙ্কা বাড়ছে।
ড. শাহদীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট।
No comments