ত্বকীর ২০ বছর! by রওনক রেহানা
তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী |
আজ
ত্বকীর ২০ বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু না, কালের চক্রপ্রবাহে বয়স বেড়ে চললেও
ত্বকীর বয়স বাড়েনি। ১৭ বছর ৫ মাসে আটকে আছে তার বয়স। পিটার প্যানের মতো
ত্বকীর বয়স আর বাড়বে না কোনো দিন। তবে পিটার প্যান চিরদিন কিশোর হয়ে থাকবে
বলে পণ করেছিল; কিন্তু ত্বকী তা করেনি, আর তা চায়ওনি। বরং ত্বকী সবকিছু
ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছিল। বড় হতে চেয়েছিল। মহাবিশ্বকে অতিক্রম করে মহাকাশকে
লক্ষ্য করেছিল।
৫ অক্টোবর ১৯৯৫ একরাশ স্বপ্ন আর ভালোবাসা জাগিয়ে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর জন্ম হয়েছিল। আমার দেহ আমার আত্মার সুর থেকে বেরিয়ে আসা আরেকটি জীবন্ত দেহ। অনাগত ভবিষ্যতে তাবৎ বিষয়ে সব সময়ে কল্যাণে ব্রতী হয়ে উঠতে পারবে আমার স্বপ্নের এমন এক কাঙ্ক্ষিত নতুন শিশু, যে আমাকে প্রথম মা হওয়ার সৌভাগ্য এনে দিয়েছিল। ‘কোন রূপলোকে ছিলি রূপকথা তুই,/ রূপ ধরে এলি এই মমতার ভুঁই/ ...কত যে তিমির নদী পারায়ে এলি/ দিঘল নভে তুই চাঁদ পহেলি।’ আমার প্রথম মা হওয়ার অনুভূতি ছিল এ রকমই। ‘ধন্য আজি সেই সে মেয়ে মা হলো যে তোমায় কোলে করে...।’ ত্বকীকে পেয়ে সারাক্ষণ কবিতায় হারিয়ে থাকতাম। একটু একটু করে বড় হতে থাকলে একসঙ্গে ছড়া কাটতাম, আবৃত্তি করতাম, কবিতা নিয়ে খেলা করতাম। হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটতে হাঁটতে ঘর ছেড়ে বাইরে পা রেখেছিল ত্বকী। কিন্তু ঘাতক আর শ্বাপদের কিলবিল পথে দাঁড়াতে পারল না। শৈশবে শিশুরা সবকিছুই হওয়ার স্বপ্ন দেখে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই স্বপ্নেও পরিবর্তন ঘটে যায়। ডাকঘর-এর কিশোর অমল একবার দইওয়ালা হতে চেয়েছিল; হতে পারেনি। ত্বকীর শৈশব স্বপ্নেও ভিড় করেছিল এমনই বিচিত্র সব চরিত্র। একবার আর্মি হতে চেয়েছিল। ওর বাবা জলপাই ছাপের জ্যাকেট ও ট্রাউজার এনে দিয়েছিল। পেয়ে আনন্দ আর ধরে না। সে আর্মির পোশাক এখনো যত্নে রেখেছি আমি, নেই আর্মি হতে চাওয়া ছেলেটি আমার।
ত্বকীকে আমি বস বলতাম। কী করলে ভালো হবে, কী করলে ভালো না-ও হতে পারে, ত্বকী সব সময় তা আমাকে বোঝাত। সারা দিন জমিয়ে রাখা সব কথা আমি আর সাকী-ত্বকীর সঙ্গে আলাপ করতাম। ত্বকী ছিল স্বল্পভাষী। হ্যাঁ, না বা দু-চারটে কথার মাধ্যমে সে তার মতামত জানাত। ছোট গণ্ডিতে ত্বকীর সঙ্গে মিশে থাকা এই আমার জীবনের ভিজে যাওয়া টুকরো চিত্র।
বই পড়ার একটা নেশা ছিল ত্বকীর। সাহিত্যের চেয়েও বিজ্ঞানের প্রতি ঝোঁকটা ছিল বেশি। খেরো খাতায় বাংলা ও ইংরেজিতে গল্প, কবিতা, বিজ্ঞান ও বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে লিখে রেখেছে। ভালো আবৃত্তি করত, গান গাইত, বাবার সঙ্গে দাবা খেলত, ছোট ভাই সাকীর সঙ্গে ক্রিকেট খেলত। এখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে-আয়োজনে আমি ত্বকীর মুখ খুঁজে ফিরি। যেদিকে তাকাই ত্বকীকে খুঁজে পেতে ইচ্ছা হয়। কেউ গান গাইলে ভেসে ওঠে ত্বকীর মুখ, যেন ত্বকী গাইছে। কেউ আবৃত্তি করলে শুনতে পাই ত্বকীর কণ্ঠ। ‘মহাভারত’ দেখতে দেখতে যুধিষ্ঠিরের চরিত্রটি যেন ত্বকী হয়ে সামনে দাঁড়ায়।
ত্বকী প্রকৌশলী হতে চেয়েছিল। স্বপ্ন ছিল বড় কিছু করার। এমন কিছু আবিষ্কার করা, যাতে মানবজাতির উপকারে আসে। ত্বকীর সেই স্বপ্নের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের স্বপ্নকেও জড়িয়ে ফেলেছিলাম। স্বপ্ন যে এত ঠুনকো হবে, তাসের ঘরের মতো এমনি ভেঙে যাবে, তা কখনো ভাবিনি।
এ-লেভেল প্রথম পর্বের পরীক্ষায় পদার্থবিজ্ঞানে বিশ্বের সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিল (২৯৭/৩০০), রসায়নে পেয়েছিল দেশের সর্বোচ্চ নম্বর (২৯৪/৩০০)। ফল প্রকাশের আগের দিন বিকেলে ৬ মার্চ ২০১৩ নিখোঁজ হলো ত্বকী। সুধীজন পাঠাগারে গিয়েছিল। পথ থেকে ওকে ধরে নিয়ে গেল দুর্বৃত্তরা। ওই রাতেই শহরের পরিচিত টর্চার সেলে হত্যা করে ত্বকীর লাশ ফেলে দিল ওরা শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে।
ত্বকীর ঘাতকেরা অজ্ঞাত নয়, চিহ্নিত। হত্যার কারণও অনুদ্ঘাটিত নয়। তারপরেও রাষ্ট্র ত্বকীর ঘাতকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। আর রাষ্ট্র যখন ঘাতকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়, সমাজের মানুষগুলো তখন অসহায় হয়ে পড়ে। তখন মানবতা, মূল্যবোধ, মুক্তিযুদ্ধ—এসবই মূল্যহীন হয়ে পড়ে, কথার কথা হয়ে ফুৎকারে উবে যায়, অসার হয়ে যায়।
ত্বকীকে ওরা বাঁচতে দিল না। অথচ স্বাধীন দেশে আজ চারদিকে ত্বকীর ঘাতকদের অশুভ আস্ফালন দেখি। শিশু হত্যা ও নির্যাতনের আজ যেন মহোৎসব শুরু হয়েছে। রাজন, রাকিব, রবিউলকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই গুলিবিদ্ধ হওয়া সুরাইয়া জানান দিচ্ছে এই ভূখণ্ড ভবিষ্যৎ শিশুদের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু রক্তস্নাত স্বাধীন বাংলাদেশে এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না।
ত্বকী অর্থ আলো। কিন্তু এ যেন এক অন্ধকার সময়ে আজ ত্বকীর জন্মদিন। আমরা সব সেই আঁধার পথের যাত্রী। ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’, কিন্তু আমাদের সবার হাতে তো আর আলো নেই। কিন্তু ত্বকীর ছিল, ত্বকীর হাতে আলো ছিল। ইতিহাস তো আলো ধরেই এগিয়ে চলে, আর ঘাতকেরা ইতিহাসের সেই আলোকে সব সময়ই ভয় পেয়েছে। বারবার নিভিয়ে দিতে চেয়েছে সেই আলো। তবে তারা তা কখনোই নেভাতে পারেনি, পারবেও না কখনো। ইতিহাসের সেই আলোতেই যে একসময় স্পষ্ট হয়ে ওঠে ঘাতকের কুৎসিত মুখ।
রওনক রেহানা: তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর মা।
৫ অক্টোবর ১৯৯৫ একরাশ স্বপ্ন আর ভালোবাসা জাগিয়ে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর জন্ম হয়েছিল। আমার দেহ আমার আত্মার সুর থেকে বেরিয়ে আসা আরেকটি জীবন্ত দেহ। অনাগত ভবিষ্যতে তাবৎ বিষয়ে সব সময়ে কল্যাণে ব্রতী হয়ে উঠতে পারবে আমার স্বপ্নের এমন এক কাঙ্ক্ষিত নতুন শিশু, যে আমাকে প্রথম মা হওয়ার সৌভাগ্য এনে দিয়েছিল। ‘কোন রূপলোকে ছিলি রূপকথা তুই,/ রূপ ধরে এলি এই মমতার ভুঁই/ ...কত যে তিমির নদী পারায়ে এলি/ দিঘল নভে তুই চাঁদ পহেলি।’ আমার প্রথম মা হওয়ার অনুভূতি ছিল এ রকমই। ‘ধন্য আজি সেই সে মেয়ে মা হলো যে তোমায় কোলে করে...।’ ত্বকীকে পেয়ে সারাক্ষণ কবিতায় হারিয়ে থাকতাম। একটু একটু করে বড় হতে থাকলে একসঙ্গে ছড়া কাটতাম, আবৃত্তি করতাম, কবিতা নিয়ে খেলা করতাম। হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটতে হাঁটতে ঘর ছেড়ে বাইরে পা রেখেছিল ত্বকী। কিন্তু ঘাতক আর শ্বাপদের কিলবিল পথে দাঁড়াতে পারল না। শৈশবে শিশুরা সবকিছুই হওয়ার স্বপ্ন দেখে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই স্বপ্নেও পরিবর্তন ঘটে যায়। ডাকঘর-এর কিশোর অমল একবার দইওয়ালা হতে চেয়েছিল; হতে পারেনি। ত্বকীর শৈশব স্বপ্নেও ভিড় করেছিল এমনই বিচিত্র সব চরিত্র। একবার আর্মি হতে চেয়েছিল। ওর বাবা জলপাই ছাপের জ্যাকেট ও ট্রাউজার এনে দিয়েছিল। পেয়ে আনন্দ আর ধরে না। সে আর্মির পোশাক এখনো যত্নে রেখেছি আমি, নেই আর্মি হতে চাওয়া ছেলেটি আমার।
ত্বকীকে আমি বস বলতাম। কী করলে ভালো হবে, কী করলে ভালো না-ও হতে পারে, ত্বকী সব সময় তা আমাকে বোঝাত। সারা দিন জমিয়ে রাখা সব কথা আমি আর সাকী-ত্বকীর সঙ্গে আলাপ করতাম। ত্বকী ছিল স্বল্পভাষী। হ্যাঁ, না বা দু-চারটে কথার মাধ্যমে সে তার মতামত জানাত। ছোট গণ্ডিতে ত্বকীর সঙ্গে মিশে থাকা এই আমার জীবনের ভিজে যাওয়া টুকরো চিত্র।
বই পড়ার একটা নেশা ছিল ত্বকীর। সাহিত্যের চেয়েও বিজ্ঞানের প্রতি ঝোঁকটা ছিল বেশি। খেরো খাতায় বাংলা ও ইংরেজিতে গল্প, কবিতা, বিজ্ঞান ও বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে লিখে রেখেছে। ভালো আবৃত্তি করত, গান গাইত, বাবার সঙ্গে দাবা খেলত, ছোট ভাই সাকীর সঙ্গে ক্রিকেট খেলত। এখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে-আয়োজনে আমি ত্বকীর মুখ খুঁজে ফিরি। যেদিকে তাকাই ত্বকীকে খুঁজে পেতে ইচ্ছা হয়। কেউ গান গাইলে ভেসে ওঠে ত্বকীর মুখ, যেন ত্বকী গাইছে। কেউ আবৃত্তি করলে শুনতে পাই ত্বকীর কণ্ঠ। ‘মহাভারত’ দেখতে দেখতে যুধিষ্ঠিরের চরিত্রটি যেন ত্বকী হয়ে সামনে দাঁড়ায়।
ত্বকী প্রকৌশলী হতে চেয়েছিল। স্বপ্ন ছিল বড় কিছু করার। এমন কিছু আবিষ্কার করা, যাতে মানবজাতির উপকারে আসে। ত্বকীর সেই স্বপ্নের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের স্বপ্নকেও জড়িয়ে ফেলেছিলাম। স্বপ্ন যে এত ঠুনকো হবে, তাসের ঘরের মতো এমনি ভেঙে যাবে, তা কখনো ভাবিনি।
এ-লেভেল প্রথম পর্বের পরীক্ষায় পদার্থবিজ্ঞানে বিশ্বের সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিল (২৯৭/৩০০), রসায়নে পেয়েছিল দেশের সর্বোচ্চ নম্বর (২৯৪/৩০০)। ফল প্রকাশের আগের দিন বিকেলে ৬ মার্চ ২০১৩ নিখোঁজ হলো ত্বকী। সুধীজন পাঠাগারে গিয়েছিল। পথ থেকে ওকে ধরে নিয়ে গেল দুর্বৃত্তরা। ওই রাতেই শহরের পরিচিত টর্চার সেলে হত্যা করে ত্বকীর লাশ ফেলে দিল ওরা শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে।
ত্বকীর ঘাতকেরা অজ্ঞাত নয়, চিহ্নিত। হত্যার কারণও অনুদ্ঘাটিত নয়। তারপরেও রাষ্ট্র ত্বকীর ঘাতকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। আর রাষ্ট্র যখন ঘাতকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়, সমাজের মানুষগুলো তখন অসহায় হয়ে পড়ে। তখন মানবতা, মূল্যবোধ, মুক্তিযুদ্ধ—এসবই মূল্যহীন হয়ে পড়ে, কথার কথা হয়ে ফুৎকারে উবে যায়, অসার হয়ে যায়।
ত্বকীকে ওরা বাঁচতে দিল না। অথচ স্বাধীন দেশে আজ চারদিকে ত্বকীর ঘাতকদের অশুভ আস্ফালন দেখি। শিশু হত্যা ও নির্যাতনের আজ যেন মহোৎসব শুরু হয়েছে। রাজন, রাকিব, রবিউলকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই গুলিবিদ্ধ হওয়া সুরাইয়া জানান দিচ্ছে এই ভূখণ্ড ভবিষ্যৎ শিশুদের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু রক্তস্নাত স্বাধীন বাংলাদেশে এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না।
ত্বকী অর্থ আলো। কিন্তু এ যেন এক অন্ধকার সময়ে আজ ত্বকীর জন্মদিন। আমরা সব সেই আঁধার পথের যাত্রী। ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’, কিন্তু আমাদের সবার হাতে তো আর আলো নেই। কিন্তু ত্বকীর ছিল, ত্বকীর হাতে আলো ছিল। ইতিহাস তো আলো ধরেই এগিয়ে চলে, আর ঘাতকেরা ইতিহাসের সেই আলোকে সব সময়ই ভয় পেয়েছে। বারবার নিভিয়ে দিতে চেয়েছে সেই আলো। তবে তারা তা কখনোই নেভাতে পারেনি, পারবেও না কখনো। ইতিহাসের সেই আলোতেই যে একসময় স্পষ্ট হয়ে ওঠে ঘাতকের কুৎসিত মুখ।
রওনক রেহানা: তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর মা।
No comments