আইএস না থাকলেও জঙ্গি আছে by আলী রীয়াজ
ইতালির
এক নাগরিককে হত্যার এক সপ্তাহের মধ্যে এক জাপানিকে হত্যার ঘটনা এবং এসবের
দায় স্বীকার করে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) দেওয়া কথিত বিবৃতির প্রেক্ষাপটে
কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা হচ্ছে। এক
বিরল ঐকমত্যের ঘটনা ঘটিয়ে বিএনপি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে
সরকার-সমর্থকেরা বলছেন যে দেশে জঙ্গি নেই, দেশ জঙ্গিবাদের কবলে পড়েনি। কেউ
কেউ আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেন যে দেশে কখনোই জঙ্গিবাদ ছিল না। কেননা,
বাংলাদেশের মানুষ জঙ্গিবাদের সমর্থক নয়। বাংলাদেশের মানুষ যে চরমপন্থী
মতামতকে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করে না, সেটা নিঃসন্দেহে সত্য। কিন্তু এই
কিছুদিন আগ পর্যন্ত আমরা সরকারিভাবেই দেশে আইএস এবং ভারতীয় উপমহাদেশে
আল-কায়েদার শাখার লোকজন রয়েছে বলে বলতে শুনেছি।
২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত এক বছরের সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরগুলো আমাদের এ বিষয়ে পরিস্থিতি বুঝতে সাহায্য করতে পারে। দৈনিক প্রথম আলো, জনকণ্ঠ ও নিউ এজ-এ এই সময়ে জঙ্গি আটক বিষয়ে যেসব খবর ছাপা হয়েছে, আমরা তার দিকে নজর দিলে দেখতে পাই যে এ বিষয়ে ৬৭টি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথম আলোয় ২৯টি, জনকণ্ঠ পত্রিকায় ২০টি ও নিউ এজ-এ ১৮টি। এসব খবর অনুযায়ী জঙ্গি সন্দেহে আটকের সংখ্যা ১০০ জন এবং সন্দেহভাজন ১২ জন, যাদের আটক করা যায়নি। এই আটক জঙ্গিদের সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে র্যাবের পক্ষে থেকে যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে যে এরা কোন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত বা যুক্ত হতে আগ্রহী। সাংগঠনিক সংশ্লিষ্টতার হিসাব পাওয়া গেছে ১০৪ জনের (এর মধ্যে ১২ জন আটক হয়নি, তবে তাদের সংশ্লিষ্টতার কথা বলা হয়েছে)। এই হিসাব অনুযায়ী জেএমবির সঙ্গে যুক্ত ২৫ জন, আইএসের সঙ্গে যুক্ত বা যুক্ত হতে আগ্রহী ২২, শহীদ হামজা ব্রিগেডের সঙ্গে যুক্ত ১৯ জন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে জড়িত ১৪ জন, হরকাতুল জিহাদ বা হুজির সঙ্গে জড়িত ১৩ জন এবং বাংলাদেশ জিহাদ গ্রুপের সঙ্গে জড়িত ১১ জন।
এই হিসাবের দিকে তাকালে দেখা যায় যে আটক জঙ্গিদের মধ্যে আইএসের সঙ্গে যুক্ত বা যুক্ত হতে আগ্রহীরা রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, আটক জঙ্গিদের মধ্যে একাধিক সদস্যকে বাংলাদেশে আইএসের সমন্বয়ক বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে আটক শাখাওয়াতুল কবিরকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেভাবেই পরিচয় করিয়ে দেয়। আবার মে মাসে যখন আবদুল্লাহ আল গালিব বলে এক সদস্যকে আটক করা হয়, তাঁকেও একইভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ২৬ মে কোমল পানীয় উৎপাদনকারী একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কর্মরত আমিনুল ইসলাম বেগকে আটক করার পর গণমাধ্যমে তাঁকে আইএসের ‘রিক্রুটার’ চিহ্নিত করা হয়।
এসব তথ্য এ ধারণাই তৈরি করে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকার আইএস ও আল-কায়েদার উপস্থিতি বিষয়ে যথেষ্ট পরিমাণে ওয়াকিবহাল আছে। শুধু তা-ই নয়, সরকারের পক্ষ থেকে বিরোধী দলের নেতাদের এই বলে সমালোচনা করা হয়েছে যে তাঁরা তালেবান এবং আইএসের ‘পুতুল’ মাত্র।
আমরা জানি যে যেকোনো দেশে এসব আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের উপস্থিতির পরিণতি ভয়াবহ অবস্থার তৈরি করে। এটাও আমরা জানি যে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো সেখানেই উপস্থিত হয়, যেখানে তাদের জন্য অভ্যন্তরীণভাবে অনুকূল পরিবেশ রয়েছে। অন্যপক্ষে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের উপস্থিতি বিদেশি শক্তিগুলোকে সংঘাতে টেনে আনে। আইএসের উত্থান ঘটেছে ইরাকে, যখন দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কাঠামো বিরাজমান সংকটের মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর প্রেক্ষাপট অবশ্যই ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। পশ্চিমা দেশগুলোর স্বার্থসিদ্ধির জন্য আইএসের উত্থান বলে যাঁরা বিশ্বাস করেন এবং যাঁরা করেন না, তাঁরা এ বিষয়ে একমত হবেন যে এ ধরনের পরিস্থিতি বিশ্বশক্তিকে এমনভাবে যুক্ত করে যে তা থেকে সহজে বেরিয়ে আসা যায় না। সিরিয়ায় পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি রাশিয়ার অংশগ্রহণ তার বড় প্রমাণ।
এক-দেড় বছর ধরে আইএসের উপস্থিতি বা সম্ভাব্য উপস্থিতির কথা বলার পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দল ও সরকার এর কারণ অনুসন্ধান, কারা এ ধরনের সংগঠনে যুক্ত হতে পারে, তা চিহ্নিত করা এবং তা মোকাবিলায় কী ব্যবস্থা বিবেচনা করেছে তা সাধারণের কাছে স্পষ্ট নয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের উপস্থিতি বিষয়ে বক্তব্য পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে করা হয়েছে বলে যে অভিযোগ আছে, তার সদুত্তর পাওয়া যায় না। ২০১৪ সালের একপক্ষীয় নির্বাচনের কারণে পশ্চিমা দেশগুলো বর্তমান সরকারের বিষয়ে যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করত, সেগুলো নিষ্পত্তিতে সরকার উৎসাহ দেখায়নি। অন্যদিকে, বাংলাদেশের সরকার আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান যে জোরদার, সেটা বারবার বলার চেষ্টা করেছে। এতে পশ্চিমাদের পাশাপাশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মনোযোগও আকর্ষিত হয়েছে কি না, সেটাও ভাবা দরকার।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে কেবল সন্দেহভাজনদের আটক, তাদের বিচার কিংবা সাধারণের মনে ভীতি তৈরি করে জঙ্গিবাদ—তা দেশীয় সংগঠনের বা আন্তর্জাতিক সংগঠনের—মোকাবিলা করা যায় না। এ বিষয়ে বাংলাদেশে যতটা আলোচনা হয়, ততটা সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব থাকে না। দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনা অনেক সময়ই এই দুর্বলতার কারণ। এই পটভূমিতেই আমরা প্রথমে ইতালির এক নাগরিক হত্যা এবং পরে এক জাপানিকে হত্যার ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম। ইতালির নাগরিকের হত্যার পরই যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত একটি বেসরকারি সংগঠন—যার বিষয়ে অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষকের মনে প্রশ্ন রয়েছে—এই মর্মে জানায় যে এ হত্যার দায় আইএস স্বীকার করেছে। আর জাপানের নাগরিক হত্যার পর বার্ত সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে যে আইএস নিজেদের টুইট একাউন্ট থেকে এ হত্যার দায় স্বীকার করেছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ব্লগার হত্যার ঘটনা এবং সেসব হত্যার দায়িত্ব স্বীকারসূচক বিবৃতির প্রেক্ষাপটে এই বিবৃতিকেও কেউ কেউ গ্রহণযোগ্য মনে করেছেন, কারও কারও মনে সংশয় তৈরি হয়েছে। তারপর সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবেই বলা হলো যে দেশে আইএসের অস্তিত্ব নেই।
এখন প্রশ্ন হতে পারে যে সরকার কি ‘অস্বীকারের’ সংস্কৃতির বশবর্তী হয়ে এ বক্তব্য দিচ্ছে? এ ধরনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য নতুন নয়, ২০০৫ সালে ক্ষমতাসীনেরা অভ্যন্তরীণ জঙ্গিদের উপস্থিতি বিষয়ে এ কৌশল নিয়েছিল। সরকারের মনে কি এ ধারণা তৈরি হয়েছে যে আইএসের উপস্থিতির স্বীকৃতি ২০০৯ সাল থেকে জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় তারা যে সাফল্য দাবি করে এসেছে, তাকে ম্লান করে দেয়? নাকি তারা অনুধাবন করছে যে এ ধরনের সংগঠনের উপস্থিতি প্রমাণিত হলে এযাবৎকালে আমরা অন্যত্র যে ধরনের পরিণতি দেখেছি, সে দিকেই দেশ এগোতে শুরু করবে? তাহলে জঙ্গিবাদের প্রশ্নকে প্রাধান্য দিয়ে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে ধারণা তৈরি করা হয়েছে, তা বাস্তব নয়?
বাংলাদেশে আইএসের উপস্থিতি এবং এই হত্যাকাণ্ড বিষয়ে দেওয়া কথিত বিবৃতি বিষয়ে যাঁরা সংশয়ী, আমি তাঁদের সঙ্গে একমত। কিন্তু বাংলাদেশে বিদেশি জঙ্গিদের উপস্থিতি বা তার আশঙ্কাকে যাঁরা এক কথায় নাকচ করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, আমি তাঁদের সঙ্গে একমত হতে অপারগ। কেননা, গত দুই দশকে বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রমের একটা ইতিহাস আছে এবং সেখানে বিভিন্নভাবেই বিদেশি যোগাযোগের প্রমাণ উপস্থিত।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত এক বছরের সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরগুলো আমাদের এ বিষয়ে পরিস্থিতি বুঝতে সাহায্য করতে পারে। দৈনিক প্রথম আলো, জনকণ্ঠ ও নিউ এজ-এ এই সময়ে জঙ্গি আটক বিষয়ে যেসব খবর ছাপা হয়েছে, আমরা তার দিকে নজর দিলে দেখতে পাই যে এ বিষয়ে ৬৭টি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথম আলোয় ২৯টি, জনকণ্ঠ পত্রিকায় ২০টি ও নিউ এজ-এ ১৮টি। এসব খবর অনুযায়ী জঙ্গি সন্দেহে আটকের সংখ্যা ১০০ জন এবং সন্দেহভাজন ১২ জন, যাদের আটক করা যায়নি। এই আটক জঙ্গিদের সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে র্যাবের পক্ষে থেকে যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে যে এরা কোন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত বা যুক্ত হতে আগ্রহী। সাংগঠনিক সংশ্লিষ্টতার হিসাব পাওয়া গেছে ১০৪ জনের (এর মধ্যে ১২ জন আটক হয়নি, তবে তাদের সংশ্লিষ্টতার কথা বলা হয়েছে)। এই হিসাব অনুযায়ী জেএমবির সঙ্গে যুক্ত ২৫ জন, আইএসের সঙ্গে যুক্ত বা যুক্ত হতে আগ্রহী ২২, শহীদ হামজা ব্রিগেডের সঙ্গে যুক্ত ১৯ জন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে জড়িত ১৪ জন, হরকাতুল জিহাদ বা হুজির সঙ্গে জড়িত ১৩ জন এবং বাংলাদেশ জিহাদ গ্রুপের সঙ্গে জড়িত ১১ জন।
এই হিসাবের দিকে তাকালে দেখা যায় যে আটক জঙ্গিদের মধ্যে আইএসের সঙ্গে যুক্ত বা যুক্ত হতে আগ্রহীরা রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, আটক জঙ্গিদের মধ্যে একাধিক সদস্যকে বাংলাদেশে আইএসের সমন্বয়ক বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে আটক শাখাওয়াতুল কবিরকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেভাবেই পরিচয় করিয়ে দেয়। আবার মে মাসে যখন আবদুল্লাহ আল গালিব বলে এক সদস্যকে আটক করা হয়, তাঁকেও একইভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ২৬ মে কোমল পানীয় উৎপাদনকারী একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কর্মরত আমিনুল ইসলাম বেগকে আটক করার পর গণমাধ্যমে তাঁকে আইএসের ‘রিক্রুটার’ চিহ্নিত করা হয়।
এসব তথ্য এ ধারণাই তৈরি করে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকার আইএস ও আল-কায়েদার উপস্থিতি বিষয়ে যথেষ্ট পরিমাণে ওয়াকিবহাল আছে। শুধু তা-ই নয়, সরকারের পক্ষ থেকে বিরোধী দলের নেতাদের এই বলে সমালোচনা করা হয়েছে যে তাঁরা তালেবান এবং আইএসের ‘পুতুল’ মাত্র।
আমরা জানি যে যেকোনো দেশে এসব আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের উপস্থিতির পরিণতি ভয়াবহ অবস্থার তৈরি করে। এটাও আমরা জানি যে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো সেখানেই উপস্থিত হয়, যেখানে তাদের জন্য অভ্যন্তরীণভাবে অনুকূল পরিবেশ রয়েছে। অন্যপক্ষে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের উপস্থিতি বিদেশি শক্তিগুলোকে সংঘাতে টেনে আনে। আইএসের উত্থান ঘটেছে ইরাকে, যখন দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কাঠামো বিরাজমান সংকটের মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর প্রেক্ষাপট অবশ্যই ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। পশ্চিমা দেশগুলোর স্বার্থসিদ্ধির জন্য আইএসের উত্থান বলে যাঁরা বিশ্বাস করেন এবং যাঁরা করেন না, তাঁরা এ বিষয়ে একমত হবেন যে এ ধরনের পরিস্থিতি বিশ্বশক্তিকে এমনভাবে যুক্ত করে যে তা থেকে সহজে বেরিয়ে আসা যায় না। সিরিয়ায় পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি রাশিয়ার অংশগ্রহণ তার বড় প্রমাণ।
এক-দেড় বছর ধরে আইএসের উপস্থিতি বা সম্ভাব্য উপস্থিতির কথা বলার পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দল ও সরকার এর কারণ অনুসন্ধান, কারা এ ধরনের সংগঠনে যুক্ত হতে পারে, তা চিহ্নিত করা এবং তা মোকাবিলায় কী ব্যবস্থা বিবেচনা করেছে তা সাধারণের কাছে স্পষ্ট নয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের উপস্থিতি বিষয়ে বক্তব্য পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে করা হয়েছে বলে যে অভিযোগ আছে, তার সদুত্তর পাওয়া যায় না। ২০১৪ সালের একপক্ষীয় নির্বাচনের কারণে পশ্চিমা দেশগুলো বর্তমান সরকারের বিষয়ে যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করত, সেগুলো নিষ্পত্তিতে সরকার উৎসাহ দেখায়নি। অন্যদিকে, বাংলাদেশের সরকার আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান যে জোরদার, সেটা বারবার বলার চেষ্টা করেছে। এতে পশ্চিমাদের পাশাপাশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মনোযোগও আকর্ষিত হয়েছে কি না, সেটাও ভাবা দরকার।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে কেবল সন্দেহভাজনদের আটক, তাদের বিচার কিংবা সাধারণের মনে ভীতি তৈরি করে জঙ্গিবাদ—তা দেশীয় সংগঠনের বা আন্তর্জাতিক সংগঠনের—মোকাবিলা করা যায় না। এ বিষয়ে বাংলাদেশে যতটা আলোচনা হয়, ততটা সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব থাকে না। দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনা অনেক সময়ই এই দুর্বলতার কারণ। এই পটভূমিতেই আমরা প্রথমে ইতালির এক নাগরিক হত্যা এবং পরে এক জাপানিকে হত্যার ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম। ইতালির নাগরিকের হত্যার পরই যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত একটি বেসরকারি সংগঠন—যার বিষয়ে অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষকের মনে প্রশ্ন রয়েছে—এই মর্মে জানায় যে এ হত্যার দায় আইএস স্বীকার করেছে। আর জাপানের নাগরিক হত্যার পর বার্ত সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে যে আইএস নিজেদের টুইট একাউন্ট থেকে এ হত্যার দায় স্বীকার করেছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ব্লগার হত্যার ঘটনা এবং সেসব হত্যার দায়িত্ব স্বীকারসূচক বিবৃতির প্রেক্ষাপটে এই বিবৃতিকেও কেউ কেউ গ্রহণযোগ্য মনে করেছেন, কারও কারও মনে সংশয় তৈরি হয়েছে। তারপর সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবেই বলা হলো যে দেশে আইএসের অস্তিত্ব নেই।
এখন প্রশ্ন হতে পারে যে সরকার কি ‘অস্বীকারের’ সংস্কৃতির বশবর্তী হয়ে এ বক্তব্য দিচ্ছে? এ ধরনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য নতুন নয়, ২০০৫ সালে ক্ষমতাসীনেরা অভ্যন্তরীণ জঙ্গিদের উপস্থিতি বিষয়ে এ কৌশল নিয়েছিল। সরকারের মনে কি এ ধারণা তৈরি হয়েছে যে আইএসের উপস্থিতির স্বীকৃতি ২০০৯ সাল থেকে জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় তারা যে সাফল্য দাবি করে এসেছে, তাকে ম্লান করে দেয়? নাকি তারা অনুধাবন করছে যে এ ধরনের সংগঠনের উপস্থিতি প্রমাণিত হলে এযাবৎকালে আমরা অন্যত্র যে ধরনের পরিণতি দেখেছি, সে দিকেই দেশ এগোতে শুরু করবে? তাহলে জঙ্গিবাদের প্রশ্নকে প্রাধান্য দিয়ে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে ধারণা তৈরি করা হয়েছে, তা বাস্তব নয়?
বাংলাদেশে আইএসের উপস্থিতি এবং এই হত্যাকাণ্ড বিষয়ে দেওয়া কথিত বিবৃতি বিষয়ে যাঁরা সংশয়ী, আমি তাঁদের সঙ্গে একমত। কিন্তু বাংলাদেশে বিদেশি জঙ্গিদের উপস্থিতি বা তার আশঙ্কাকে যাঁরা এক কথায় নাকচ করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, আমি তাঁদের সঙ্গে একমত হতে অপারগ। কেননা, গত দুই দশকে বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রমের একটা ইতিহাস আছে এবং সেখানে বিভিন্নভাবেই বিদেশি যোগাযোগের প্রমাণ উপস্থিত।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments