জাপানি নাগরিক হত্যা অশনিসংকেত by মনজুরুল হক
বাংলাদেশের
উত্তরাঞ্চলীয় জেলা রংপুরের শহরতলির এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে আততায়ীর গুলিতে
জাপানি নাগরিক হত্যার ঘটনাটি এখন বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে। যে
কারণে খবরটির দিকে অনেকের নজর আরও বেশি করে আকৃষ্ট হচ্ছে তা হলো, এটা
হচ্ছে মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে একই স্টাইলে বাংলাদেশে দ্বিতীয় বিদেশি
নাগরিক হত্যার ঘটনা। দুই হত্যাকাণ্ডের মধ্যে আরও যেসব মিল লক্ষ করা যায় তা
হলো, ঘটনার ঠিক পরপরই আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সক্রিয় জঙ্গিগোষ্ঠীর হত্যার
দায়িত্ব গ্রহণ করে বিবৃতি প্রচার করা এবং ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার হুমকি
দেওয়া।
ফলে আমাদের সরকার বা আমরা বাংলাদেশিরা যত জোরের সঙ্গেই বাংলাদেশের ইসলামি চরম পন্থার প্রভাব–বলয় থেকে বের হয়ে উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পথে এগিয়ে যাওয়ার দাবি করি না কেন, এক সপ্তাহের মধ্যে দুজন বিদেশি নাগরিকের হত্যাকাণ্ড কিন্তু বিশ্ববাসীর দুয়ারে ভিন্ন বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। বার্তাটি হচ্ছে, উগ্র মৌলবাদের থাবা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি, সেই কালো হাত আমাদের পেছনে বেশ জোরালোভাবেই ধাবমান। এ কারণেই আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এখন উচিত হবে হত্যার পেছনে যারা জড়িত, তাদের খুঁজে বের করা। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী তৎপরতার সঙ্গে আসলেই এদের কোনো যোগসাজশ রয়েছে কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে আরও অনেক বেশি তৎপর হওয়া। তা তারা করতে না পারলে একটি বিপজ্জনক রাষ্ট্রের যে তকমা আমাদের পরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশকে তা অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাবে।
জাপানি নাগরিক হত্যার ঘটনাটিকে আমাদের সরকারি মহল ও সংবাদমাধ্যম নানা দিক থেকে তুলে ধরে এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম নিহত জাপানিকে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী হিসেবে উল্লেখ করায় সরকারি ও বেসরকারি মহলের কেউ কেউ বলছেন, সঠিক অর্থে জাপানি হত্যার ঘটনা হিসেবে সেটাকে দেখা যায় না। তবে হত্যার পেছনে যারা জড়িত তারা মনে হয় না সে রকম কোনো হিসাব থেকে ঘটনাটি ঘটিয়েছে।
এটা এখনই বলা কঠিন যে আন্তর্জাতিক কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী নিশ্চিতভাবেই এসব হত্যার পেছনে জড়িত। তবে এ রকম হত্যাকাণ্ড চালিয়ে দেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করা বা পরিস্থিতি ঘোলাটে করে কোনো ধরনের ফায়দা লুটে নেওয়ার চেষ্টায় যে হত্যাকাণ্ড চালানো হতে পারে, সে রকম ধারণা নাকচ করে দেওয়া কঠিন। দুই হত্যার ধরন এবং এর থেকে লাভবান হওয়ার হিসাবনিকাশের দিকে আলোকপাত, মনে হয় সেই যুক্তিকেই আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে।
দুটি হত্যার বেলায়ই হত্যাকারীদের আর্থিক দিক থেকে লাভবান হতে পারার কোনো রকম প্রমাণ মেলে না। নিহত দুই বিদেশিও বিত্তবান ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কেউ নন, যাঁদের খুন করার মধ্য দিয়ে বিশাল কোনো সম্পদ হাতিয়ে নেওয়া সম্ভব। হত্যাকারীরা সম্ভবত যে বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকবে তা হলো প্রচার। বিশেষ করে এ ধরনের ঘটনার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশকে বিপজ্জনক এক রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা। বলার অপেক্ষা রাখে না, ঘটনা দুটি আংশিকভাবে হলেও সেই সাফল্য এনে দিয়েছে। সেদিক থেকে জাপানি নাগরিক হত্যার ঘটনার প্রভাব মনে হয় অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী হয়ে উঠবে, যদি না প্রমাণ করা যায় যে সেটা ছিল সত্যিকার অর্থেই বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা। নিহত ব্যক্তি আসল জাপানি, নাকি বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী জাপানি, সেই বিতর্ক এখানে অপ্রাসঙ্গিক। কেননা আমরা জানি, তিনি ছিলেন জাপানি পাসপোর্টধারী এবং অন্য যেকোনো জাপানি পাসপোর্টধারীর মতোই জাপান সরকার তাঁকে দেশের নাগরিক হিসেবেই দেখছে, বিদেশি হিসেবে নয়।
এখন দেখা যাক ঘটনার কী প্রতিক্রিয়া জাপানের দিক থেকে দেখা দিতে পারে। মার্কিন সরকার জাপানি নাগরিক হত্যার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখালেও জাপান কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ঝটপট কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি। তবে এর অর্থ এ রকম নয় যে বিষয়টি নিয়ে কোনো রকম উচ্চবাচ্য জাপান করছে না এবং আগামী দিনগুলোতেও করবে না। জাপান অবশ্যই চাইবে বাংলাদেশ সরকার যেন হত্যাকারীদের শনাক্ত করে বিচারের কাঠগড়ায় তাদের উপস্থিত করে। তবে তারও আগে জাপানি নাগরিকদের সামনে দেখা দেওয়া সম্ভাব্য হুমকি সামাল দিতে হলে কী করা দরকার তা নিয়ে জাপান ভাবছে এবং সে ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ তারা ইতিমধ্যে নিয়েছে। যেমন জাপানি নাগরিক নিহত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর জাপান সরকার বাংলাদেশ ভ্রমণের পরিকল্পনা করা জাপানি নাগরিক ও সেই সঙ্গে বাংলাদেশে অবস্থানরত জাপানিদের জন্য সতর্কতার মাত্রা আরও কিছুটা কঠোর করে নেয়। কী রকম সতর্কতা তাদের বজায় রাখতে হবে, সেই পরামর্শও জাপানি নাগরিকদের দেওয়া হচ্ছে।
তবে জাপান সরকার বিদেশভ্রমণের বেলায় চার মাত্রার যে সতর্কতামূলক সুপারিশ নাগরিকদের জন্য করে থাকে, সেই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থানের কোনো রকম হেরফের এখনো পর্যন্ত হয়নি। সতর্কতা বজায় রাখা দরকার, সে রকম রাষ্ট্রের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখনো হচ্ছে এক নম্বরে, হলুদ রং দিয়ে মানচিত্রে যেটাকে চিহ্নিত করা হয়। অর্থাৎ, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেশটির বেলায় নেই, তবে সেখানে অবস্থানকালে সতর্কভাবে চলাফেরা করার পরামর্শ নাগরিকদের দেওয়া হচ্ছে। গতকাল রোববার প্রচারিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশিকায় সেই সতর্কতার মাত্রাকেই আরও কিছুটা উন্নত করে নিয়ে কী করা দরকার এবং কোন বিষয়গুলোর দিকে তাদের আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে, সেসব পরামর্শ নতুন করে নাগরিকদের দেওয়া হয়েছে। তবে এর অর্থ নিশ্চয় এ রকম নয় যে বাংলাদেশের বেলায় সতর্কতার হলুদ রং আরও একটু গাঢ় হয়ে উঠবে না। এর অনেকটাই নির্ভর করবে ঘটনার পেছনে থেকে যাওয়া সব রকম রহস্য উন্মোচনে কতটা সফল আমরা হই তার ওপর।
সতর্কতার উচ্চ মাত্রা অবশ্য ব্যবসায়িক দিক থেকে নেতিবাচক কিছু প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশের ওপর ফেলবে। জাপানের যেসব ব্যবসায়ী ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনা যাচাই করে দেখার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল, তারা হয়তো এখন নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কার বিষয়টি নিয়ে আরও গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করবে। ফলে জাপানিদের বাংলাদেশে ভ্রমণের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব হয়তো এখন লক্ষ করা যাবে। জাপানের সেইশিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহায়তা গবেষক অধ্যাপক মাসাহাকি ওহাশি মনে করেন যে জাপানি নাগরিক হত্যার ঘটনা বাংলাদেশ সম্পর্কে কতটা নেতিবাচক প্রভাব জাপানিদের ওপর ফেলবে, তার অনেকটাই নির্ভর করবে আগামী দিনগুলোতে কোন বার্তা বাংলাদেশের কাছ থেকে পাওয়া যাবে তার ওপর। ‘আমি মনে করি না জাপানের ব্যবসায়ী, গবেষক ও বাংলাদেশ নিয়ে উৎসাহী অন্য জাপানিরা এখনই দেশটিকে খুবই বিপজ্জনক বলে ধরে নেবেন। যদি এমন প্রমাণিত হয় যে সেটা ছিল বিচ্ছিন্ন একটি হত্যার ঘটনা, সেই ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব দীর্ঘায়িত হবে না। তবে যদি এমন দেখা যায় যে ঘটনাটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার ধারাবাহিকতা, তাহলে কিন্তু জাপান সরকার সতর্কতার মাত্রা বাড়িয়ে দেবে এবং জাপানিরাও বাংলাদেশ ভ্রমণ এড়িয়ে যেতে চাইবেন’ বলেছেন অধ্যাপক ওহাশি।
ফলে সন্দেহ নেই যে জাপানি হত্যার ঘটনা অশনিসংকেত হিসেবে আমাদের সামনে এখন ঝুলে আছে। ভবিষ্যতে কোন পদক্ষেপ আমাদের সরকার গ্রহণ করে এবং বিদেশিদের আশ্বস্ত করার বস্তুনিষ্ঠ কোন উদ্যোগ সরকার ও নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে নেওয়া হয়, সেসব কিছুর ওপর অনেকটা নির্ভর করবে অশনি সেই সংকেত কাটিয়ে ওঠা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে কি না।
টোকিও, অক্টোবর ৪, ২০১৫
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
ফলে আমাদের সরকার বা আমরা বাংলাদেশিরা যত জোরের সঙ্গেই বাংলাদেশের ইসলামি চরম পন্থার প্রভাব–বলয় থেকে বের হয়ে উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পথে এগিয়ে যাওয়ার দাবি করি না কেন, এক সপ্তাহের মধ্যে দুজন বিদেশি নাগরিকের হত্যাকাণ্ড কিন্তু বিশ্ববাসীর দুয়ারে ভিন্ন বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। বার্তাটি হচ্ছে, উগ্র মৌলবাদের থাবা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি, সেই কালো হাত আমাদের পেছনে বেশ জোরালোভাবেই ধাবমান। এ কারণেই আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এখন উচিত হবে হত্যার পেছনে যারা জড়িত, তাদের খুঁজে বের করা। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী তৎপরতার সঙ্গে আসলেই এদের কোনো যোগসাজশ রয়েছে কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে আরও অনেক বেশি তৎপর হওয়া। তা তারা করতে না পারলে একটি বিপজ্জনক রাষ্ট্রের যে তকমা আমাদের পরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশকে তা অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাবে।
জাপানি নাগরিক হত্যার ঘটনাটিকে আমাদের সরকারি মহল ও সংবাদমাধ্যম নানা দিক থেকে তুলে ধরে এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম নিহত জাপানিকে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী হিসেবে উল্লেখ করায় সরকারি ও বেসরকারি মহলের কেউ কেউ বলছেন, সঠিক অর্থে জাপানি হত্যার ঘটনা হিসেবে সেটাকে দেখা যায় না। তবে হত্যার পেছনে যারা জড়িত তারা মনে হয় না সে রকম কোনো হিসাব থেকে ঘটনাটি ঘটিয়েছে।
এটা এখনই বলা কঠিন যে আন্তর্জাতিক কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী নিশ্চিতভাবেই এসব হত্যার পেছনে জড়িত। তবে এ রকম হত্যাকাণ্ড চালিয়ে দেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করা বা পরিস্থিতি ঘোলাটে করে কোনো ধরনের ফায়দা লুটে নেওয়ার চেষ্টায় যে হত্যাকাণ্ড চালানো হতে পারে, সে রকম ধারণা নাকচ করে দেওয়া কঠিন। দুই হত্যার ধরন এবং এর থেকে লাভবান হওয়ার হিসাবনিকাশের দিকে আলোকপাত, মনে হয় সেই যুক্তিকেই আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে।
দুটি হত্যার বেলায়ই হত্যাকারীদের আর্থিক দিক থেকে লাভবান হতে পারার কোনো রকম প্রমাণ মেলে না। নিহত দুই বিদেশিও বিত্তবান ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কেউ নন, যাঁদের খুন করার মধ্য দিয়ে বিশাল কোনো সম্পদ হাতিয়ে নেওয়া সম্ভব। হত্যাকারীরা সম্ভবত যে বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকবে তা হলো প্রচার। বিশেষ করে এ ধরনের ঘটনার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশকে বিপজ্জনক এক রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা। বলার অপেক্ষা রাখে না, ঘটনা দুটি আংশিকভাবে হলেও সেই সাফল্য এনে দিয়েছে। সেদিক থেকে জাপানি নাগরিক হত্যার ঘটনার প্রভাব মনে হয় অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী হয়ে উঠবে, যদি না প্রমাণ করা যায় যে সেটা ছিল সত্যিকার অর্থেই বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা। নিহত ব্যক্তি আসল জাপানি, নাকি বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী জাপানি, সেই বিতর্ক এখানে অপ্রাসঙ্গিক। কেননা আমরা জানি, তিনি ছিলেন জাপানি পাসপোর্টধারী এবং অন্য যেকোনো জাপানি পাসপোর্টধারীর মতোই জাপান সরকার তাঁকে দেশের নাগরিক হিসেবেই দেখছে, বিদেশি হিসেবে নয়।
এখন দেখা যাক ঘটনার কী প্রতিক্রিয়া জাপানের দিক থেকে দেখা দিতে পারে। মার্কিন সরকার জাপানি নাগরিক হত্যার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখালেও জাপান কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ঝটপট কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি। তবে এর অর্থ এ রকম নয় যে বিষয়টি নিয়ে কোনো রকম উচ্চবাচ্য জাপান করছে না এবং আগামী দিনগুলোতেও করবে না। জাপান অবশ্যই চাইবে বাংলাদেশ সরকার যেন হত্যাকারীদের শনাক্ত করে বিচারের কাঠগড়ায় তাদের উপস্থিত করে। তবে তারও আগে জাপানি নাগরিকদের সামনে দেখা দেওয়া সম্ভাব্য হুমকি সামাল দিতে হলে কী করা দরকার তা নিয়ে জাপান ভাবছে এবং সে ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ তারা ইতিমধ্যে নিয়েছে। যেমন জাপানি নাগরিক নিহত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর জাপান সরকার বাংলাদেশ ভ্রমণের পরিকল্পনা করা জাপানি নাগরিক ও সেই সঙ্গে বাংলাদেশে অবস্থানরত জাপানিদের জন্য সতর্কতার মাত্রা আরও কিছুটা কঠোর করে নেয়। কী রকম সতর্কতা তাদের বজায় রাখতে হবে, সেই পরামর্শও জাপানি নাগরিকদের দেওয়া হচ্ছে।
তবে জাপান সরকার বিদেশভ্রমণের বেলায় চার মাত্রার যে সতর্কতামূলক সুপারিশ নাগরিকদের জন্য করে থাকে, সেই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থানের কোনো রকম হেরফের এখনো পর্যন্ত হয়নি। সতর্কতা বজায় রাখা দরকার, সে রকম রাষ্ট্রের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখনো হচ্ছে এক নম্বরে, হলুদ রং দিয়ে মানচিত্রে যেটাকে চিহ্নিত করা হয়। অর্থাৎ, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেশটির বেলায় নেই, তবে সেখানে অবস্থানকালে সতর্কভাবে চলাফেরা করার পরামর্শ নাগরিকদের দেওয়া হচ্ছে। গতকাল রোববার প্রচারিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশিকায় সেই সতর্কতার মাত্রাকেই আরও কিছুটা উন্নত করে নিয়ে কী করা দরকার এবং কোন বিষয়গুলোর দিকে তাদের আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে, সেসব পরামর্শ নতুন করে নাগরিকদের দেওয়া হয়েছে। তবে এর অর্থ নিশ্চয় এ রকম নয় যে বাংলাদেশের বেলায় সতর্কতার হলুদ রং আরও একটু গাঢ় হয়ে উঠবে না। এর অনেকটাই নির্ভর করবে ঘটনার পেছনে থেকে যাওয়া সব রকম রহস্য উন্মোচনে কতটা সফল আমরা হই তার ওপর।
সতর্কতার উচ্চ মাত্রা অবশ্য ব্যবসায়িক দিক থেকে নেতিবাচক কিছু প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশের ওপর ফেলবে। জাপানের যেসব ব্যবসায়ী ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনা যাচাই করে দেখার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল, তারা হয়তো এখন নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কার বিষয়টি নিয়ে আরও গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করবে। ফলে জাপানিদের বাংলাদেশে ভ্রমণের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব হয়তো এখন লক্ষ করা যাবে। জাপানের সেইশিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহায়তা গবেষক অধ্যাপক মাসাহাকি ওহাশি মনে করেন যে জাপানি নাগরিক হত্যার ঘটনা বাংলাদেশ সম্পর্কে কতটা নেতিবাচক প্রভাব জাপানিদের ওপর ফেলবে, তার অনেকটাই নির্ভর করবে আগামী দিনগুলোতে কোন বার্তা বাংলাদেশের কাছ থেকে পাওয়া যাবে তার ওপর। ‘আমি মনে করি না জাপানের ব্যবসায়ী, গবেষক ও বাংলাদেশ নিয়ে উৎসাহী অন্য জাপানিরা এখনই দেশটিকে খুবই বিপজ্জনক বলে ধরে নেবেন। যদি এমন প্রমাণিত হয় যে সেটা ছিল বিচ্ছিন্ন একটি হত্যার ঘটনা, সেই ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব দীর্ঘায়িত হবে না। তবে যদি এমন দেখা যায় যে ঘটনাটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার ধারাবাহিকতা, তাহলে কিন্তু জাপান সরকার সতর্কতার মাত্রা বাড়িয়ে দেবে এবং জাপানিরাও বাংলাদেশ ভ্রমণ এড়িয়ে যেতে চাইবেন’ বলেছেন অধ্যাপক ওহাশি।
ফলে সন্দেহ নেই যে জাপানি হত্যার ঘটনা অশনিসংকেত হিসেবে আমাদের সামনে এখন ঝুলে আছে। ভবিষ্যতে কোন পদক্ষেপ আমাদের সরকার গ্রহণ করে এবং বিদেশিদের আশ্বস্ত করার বস্তুনিষ্ঠ কোন উদ্যোগ সরকার ও নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে নেওয়া হয়, সেসব কিছুর ওপর অনেকটা নির্ভর করবে অশনি সেই সংকেত কাটিয়ে ওঠা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে কি না।
টোকিও, অক্টোবর ৪, ২০১৫
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
No comments