দৃশ্যপটের বাইরে তারা by সিরাজুস সালেকিন

নগরপিতা হওয়ার স্বপ্ন ছিল তাদের। নাগরিকদের সমস্যা নিয়ে সরব ছিলেন মিডিয়ায় ও মাঠে। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা চারজনই বাধ্য হলেন দৃশ্যপটের বাইরে চলে যেতে। তারা হলেন- বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, আওয়ামী লীগ নেতা হাজী মোহাম্মদ সেলিম ও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. তুহিন মালিক।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে আগে মাহমুদুর রহমান মান্নার ঠিকানা হয়েছে কারাগার। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামি করা হয়েছে। একই ধরনের মামলার আসামি হয়ে ড. তুহিন মালিক এখন দেশান্তরি। দৃশ্যত ক্ষমতাসীনদের চাপের মুখে সিটি নির্বাচন থেকে সরে গেছেন হাজী সেলিম। আর মনোনয়নপত্রে ত্রুটির জন্য ছিটকে পড়েছেন আবদুল আউয়াল মিন্টু। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। মনোনয়নপত্রে সমর্থক ওই সিটি করপোরেশনের ভোটার না হওয়ায় তার মনোনয়নপত্র বাতিল করেন রিটার্নিং অফিসার। আপিল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলে শুনানি শেষে আপিল খারিজ হয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হলেও প্রার্থী হতে পারেননি মিন্টু। মিন্টুর আইনজীবীরা দাবি করেছেন, নির্বাচন কমিশনের তাড়াহুড়ার কারণে মিন্টুর সমর্থক ভোটার হতে পারেননি। যদিও তিনি নির্বাচনী এলাকার বাসিন্দা এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে নিয়মিত কর পরিশোধ করেন। অথচ তিন সিটি করপোরেশনের মধ্যে ঢাকা উত্তরেই প্রার্থী নিয়ে কোন চিন্তা ছিল না বিএনপির। দীর্ঘ দিন থেকেই মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন তিনি। এমনকি এটাও বলাবলি আছে, ঢাকার মেয়র হওয়ার জন্যই বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন আবদুল আউয়াল মিন্টু।
ঢাকাকে দুই ভাগ করার পর ২০১২ সালে দুই সিটির নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। তখন আওয়ামী লীগ থেকে বিদায় নেয়া মাহমুুদুর রহমান মান্না নির্বাচনের প্রস্তুতি নেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ভোটারদের মধ্যে প্রচারণা শুরু করেছিলেন মান্না। বেশ কয়েকটি সভা-সমাবেশ করে জনগণের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছেন। ওই নির্বাচন স্থগিত হলে মান্না নাগরিক ঐক্য নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। সংগঠনের ব্যানারে নাগরিকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে কাজ শুরু করেন। চলতি বছরে সিটি নির্বাচনের আভাস পেয়ে মান্না ঢাকা উত্তর সিটিতে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দেন। সিটি নির্বাচনের প্রস্তুতি চলাকালে মান্নার দুটি ফোনালাপের রেকর্ড প্রকাশ হয়। সেখানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংসতায় উসকানি দেয়ার অভিযোগ উঠে মান্নার বিরুদ্ধে। ২৪শে ফেব্রুয়ারি মান্নাকে রাজধানীর বনানী থেকে আটক করে র‌্যাব। এরপর গুলশান থানায় তার বিরুদ্ধে সেনা বিদ্রোহে উসকানি ও রাষ্ট্রদ্রোহের দুটি মামলা দিয়ে ২০ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। মান্না কারাগারে থেকেই নির্বাচন করার ঘোষণা দেন। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কারাবন্দি মান্নার স্বাক্ষর সংগ্রহ ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করা সম্ভব না হওয়ায় মনোনয়নপত্র জমা দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ও অন্যান্য সহযোগিতার অভাব এবং তার শারীরিক সমস্যা প্রধান বাধা হিসাবে দায়ী করেন নাগরিক ঐক্যের নেতারা।
ঢাকা সিটি করপোরেশন দুই ভাগ হওয়ার আগ থেকেই মাঠে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তুহিন মালিক। ঢাকা দক্ষিণের সম্ভাব্য প্রার্থী ছিলেন তিনি। সেই ২০০৭ সাল থেকে নিজের নাম আর ছবিসহ নানা সচেতনতামূলক পোস্টারিং ও দেয়াল লিখন করে আসছিলেন। ২০১১ সালে সিটি করপোরেশন ভাগ হওয়ার পর তার প্রচারণায় পায় ভিন্ন মাত্রা। নিজেকে মেয়র প্রার্থী ঘোষণা করে নতুন করে প্রচারণা শুরু করেন। ‘ঢাকায় বাঁচতে ঢাকাকে বাঁচাতে’ শীর্ষক প্রচারণা তার সম্পর্কে নগরবাসীকে উৎসুক করে তোলে। কোন দলীয় রাজনৈতিক পরিচয় না থাকলেও রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার শুরু করেন তিনি। ঢাকাকে দক্ষিণ এশিয়ার মডেল করার স্বপ্ন ছিল তার। অনেকটা দ্রুত মিডিয়ায় জায়গা করে নিয়েছিলেন তুহিন মালিক। গত বছরের ৯ই ডিসেম্বর আদালতে সংবিধান নিয়ে কটূক্তি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও মানহানির অভিযোগ দায়ের করেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-সম্পাদক গোলাম রব্বানী। ২০১৪ সালের ৩০শে নভেম্বর পূর্ব লন্ডনের ওয়াটার লিলি গার্ডেন মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ নিয়ে কটূক্তি ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও মানহানিকর বক্তব্য দেয়ার অভিযোগে এ মামলা হয়। এরপর একই অভিযোগে তুহিন মালিকের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক মামলা করা হয়। একপর্যায়ে অনেক নীরবে দেশ ছাড়েন তিনি। নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিম ঢাকা দক্ষিণে মেয়র পদে লড়তে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে আসছিলেন। তফসিল ঘোষণার পর তিনি জোরেশোরে নির্বাচনী প্রচারণায় নামেন। কিন্তু এ সিটিতে সাঈদ খোকন দলীয় সমর্থন পাওয়ায় দলের নির্দেশে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। নির্বাচনে অংশ নিতে সংসদ সদস্য পদ ত্যাগ করার চেষ্টা করলেও তিনি সফল হননি। এ কারণে মনোনয়নপত্র তুললেও শেষ পর্যন্ত তিনি তা জমা দেননি।

No comments

Powered by Blogger.