কোন পথে টেকসই সামাজিক সম্প্রীতি? by বদিউল আলম মজুমদার

গত ৫ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া মৃত্যুর মিছিল দিনে দিনে ভারী হচ্ছে। এ পর্যন্ত সারা দেশে ১৩১ জনের মৃত্যু ঘটেছে, যার মধ্যে ৭০ জন হয়েছে পেট্রলবোমা হামলার শিকার। পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে মানুষ হত্যা ঘৃণ্যতম অপরাধ, যার অবসান হওয়া দরকার। একই সঙ্গে অবসান হওয়া দরকার বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গ্রেপ্তার-বাণিজ্যের।
সরকারেরই দায়িত্ব শান্তি–শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আশা করি, সরকার বর্তমান সহিংসতার চক্র ভেঙে শিগগিরই সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। তবে টেকসইভাবে সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে এর উৎস ও কারণ সুস্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে হবে। অন্যথায় রোগের পরিবর্তে রোগের উপসর্গেরই চিকিৎসা করা হবে। সম্প্রীতিহীনতার ফলে সমাজে অস্থিরতা, অনৈক্য ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। আর দ্বন্দ্ব থেকেই সূত্রপাত হয় সহিংসতার এবং অব্যাহত সহিংসতা জাতিকে চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
পক্ষান্তরে সামাজিক সম্প্রীতির মাধ্যমে ‘সামাজিক পুঁজি’ সৃষ্টি হয়। সামাজিক পুঁজি আর্থিক পুঁজি থেকে ভিন্ন এবং এটি সৃষ্টি হয় যখন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে। সামাজিক পুঁজি আর্থিক পুঁজির অপ্রতুলতা দূর করতে পারে। সমাজের সকল স্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে ‘সামাজিক আন্দোলন’ ও ‘সামাজিক প্রতিরোধ’ গড়ে তোলা গেলে অনেক সামাজিক সমস্যারই অর্থকড়ি ছাড়াই সমাধান সম্ভব হয়। তাই অর্থনৈতিক দিক থেকে দরিদ্র দেশগুলোয় সামাজিক সম্প্রীতিই বড় পুঁজি হিসেবে দেখা দেয়।
সমাজে সম্প্রীতিহীনতা, দ্বন্দ্ব ও সহিংসতার উৎস সাধারণত দুটি: ‘আইডেনটিটি-বেইজড প্রিজুডিস’ বা পরিচয়ভিত্তিক বিদ্বেষাত্মক মনোভাব এবং রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ও দলাদলি। একটি সমাজে সাধারণত ভিন্ন ও স্বতন্ত্র ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতিসত্তা ও ভাষাভাষী মানুষ বসবাস করে। সমাজে এ ধরনের ভিন্নতাই ‘প্লুরালিজম’ বা বহুত্ববাদের ভিত্তি। বহুত্ববাদী সমাজে সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন সমাজে পরিচয়ভিত্তিক ভিন্নদের সম্পর্কে বিরাজমান ও সম্ভাব্য পূর্ব ধারণা বা বিদ্বেষাত্মক মনোভাবের অবসান ঘটিয়ে সবার জন্য শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা। আর ‘ইনক্লুসিভনেস’ বা সামাজিক আত্মীকরণের মাধ্যমেই এমন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব।
যেকোনো সমাজেই পরিচয়ভিত্তিক বৈচিত্র্য বা ‘ডাইভারসিটি’ একটি বাস্তবতা। এমনি বাস্তবতায় প্রয়োজন পূর্বধারণাগত বিদ্বেষ দূরীকরণের লক্ষ্যে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। আর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন সামাজিক সম্প্রীতি গড়ে তোলার ‘চ্যাম্পিয়ন’ বা প্রবক্তা সৃষ্টি করার মতো কার্যকর পদক্ষেপ। আরও প্রয়োজন পরিচয়ভিত্তিক ভিন্ন মতাদর্শীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্তকরণ। বঞ্চিতদের জন্য ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা প্রদান হতে হবে সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। মার্টিন লুথার কিংয়ের ভাষায়, ‘শান্তি সহিংসতার অনুপস্থিতি নয়, বরং ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা।’
ক্ষমতার রাজনীতি ও পরিচয়ভিত্তিক ভিন্ন মতাদর্শীদের প্রতি সহিংসতার মধ্যে যোগসূত্র প্রায়শই দৃশ্যমান। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদ ও শাসকশ্রেণিকে তাদের নিজস্ব হীন স্বার্থসিদ্ধির জন্য মানুষের মধ্যকার পরিচয়ভিত্তিক ভিন্নতাকে কাজে লাগাতে দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিরাজমান ধর্মীয় ভিন্নতাকে উসকে দিয়ে এবং পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে তাদের শাসনকালকে দীর্ঘায়িত করতে সক্ষম হয়। অনেক সময় রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাধরকে ধর্মীয় ও জাতিগত বিভেদ ও সহিংসতা সৃষ্টি করে দুর্বলদের জায়গা-জমি দখল করতে দেখা যায়। সামাজিক বিভিন্নতাকে পুঁজি করে সৃষ্ট সহিংসতার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ফায়দা লুটের বহু নজির বাংলাদেশে রয়েছে।
রাজনৈতিক সহিংসতা দূর করতে হলে নীতি ও মৌলিক বিষয়ের পার্থক্য অনুধাবন করা আবশ্যক। এটা স্বাভাবিক যে রাজনৈতিক দলের মধ্যে নীতির ক্ষেত্রে পার্থক্য বিরাজ করবে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন দলের মধ্যে ভিন্নতা থাকাই স্বাভাবিক। আর এই ভিন্নতা বহুত্ববাদেরই প্রতিফলন।
তবে কিছু মৌলিক বিষয়ে রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য থাকা জরুরি। আর এ ঐকমত্য হতে পারে ন্যূনতম বিষয়ে অথবা বৃহত্তর পরিসরে। বৃহত্তর পরিসরের ঐক্য বৈচিত্র্যের মধ্যে একতা সৃষ্টিতে সহায়তা করে। একটি রাষ্ট্রের সংবিধান হলো জাতির বৃহত্তর পরিসরের ঐকমত্যের প্রতীক।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহিষ্ণুতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা হওয়া প্রয়োজন। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সহিষ্ণুতা প্রতিপক্ষের মধ্যে মতবিনিময়ের দ্বার খোলা রাখে এবং আলাপ-আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে দুরূহ সংকট সমাধানের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। এর মাধ্যমে দলের মধ্যকার সমঝোতাকামীরা দ্বন্দ্ব ও সহিংসতা এড়াতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, যেখানে যৌক্তিক কণ্ঠ কোনো রূপ ভূমিকা রাখতে অপারগ, সেখানে উগ্র মতামতই সর্বাধিক সরব। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা এবং রাজনৈতিক রীতিনীতি চর্চার অভাব প্রকট। এর ফলে একের ওপর অন্যের মতামত চাপিয়ে দেওয়ার, এমনকি একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টায় তারা লিপ্ত, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
যে সমাজে ঐকমত্যের ক্ষেত্র যত বিস্তৃত, সে সমাজের খুঁটি তত শক্ত এবং সে সমাজে আত্মঘাতী দ্বন্দ্ব ও সহিংসতার মাধ্যমে গোটা জাতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়ার আশঙ্কাও তত কম। তাই রাজনৈতিক দলসমূহের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা হওয়া উচিত নিজেদের মধ্যে ঐকমত্যের ক্ষেত্র বিস্তৃত করা। এর জন্য প্রয়োজন মৌলিক বিষয়ে নতুন করে ঐকমত্য সৃষ্টি করা।
উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বারবার কাটাছেঁড়ার কারণে আমাদের ১৯৭২-এর মূল সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত ঐকমত্যের ক্ষেত্রগুলো আজ প্রায় নির্বাসিত। বিশেষ করে একতরফাভাবে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস, যে সংশোধনীর মাধ্যমে ‘মৌলিক কাঠামো’সহ সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বদলে ফেলা হয়েছে। বস্তুত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বিলুপ্তির মাধ্যমে পঞ্চদশ সংশোধনী আমাদের দেশে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের পথকেই রুদ্ধ করে ফেলেছে। আর শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের পথ রুদ্ধ হলে দেশে অদূর ভবিষ্যতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাই টেকসইভাবে সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য আজ আমাদের প্রয়োজন শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের পদ্ধতিসহ আরও অনেকগুলো বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা।
প্রসঙ্গত, ‘পার্টিয়ার্কি’ বা দলতন্ত্র—সর্বক্ষেত্রে দলের প্রাধান্যও—আমাদের বিরাজমান রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও হানাহানির আরেকটি কারণ। গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক দল অপরিহার্য, কিন্তু দলবাজি ও দলাদলি গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে। একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা অপরিহার্য। কিন্তু পক্ষপাতদুষ্টভাবে অদক্ষ ও অযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগের কারণে আমাদের অনেক প্রতিষ্ঠান ন্যায় প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে দলীয় বিবেচনায় অন্যায়কেই অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্রয় দিচ্ছে, যা সমাজে অস্থিরতা ও হানাহানির সৃষ্টি করছে। এ ছাড়া নগ্ন দলবাজির কারণে আমাদের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান এখন দ্বন্দ্বের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। তাই সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে সর্বক্ষেত্রে আজ দলবাজির অবসান করতে হবে।
মনে রাখা প্রয়োজন, দারিদ্র্য ও সহিংসতার মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে। দরিদ্র দেশগুলোতেই সহিংসতা ব্যাপক এবং দরিদ্ররাই প্রধানত এর শিকার হয়। বস্তুত, দারিদ্র্য ও সহিংসতা একে অপরের প্রভাবক। তাই গেরি হিউগটন ও ভিক্টর বুয়োট্রস তাঁদের সাম্প্রতিক বহু সমাদৃত লোকাস এফেক্ট নামক বইতে লিখেছেন, দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সহিংসতার অবসান।
আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেও দেখা যায়, আর্থসামাজিক উন্নয়ন সহিংসতা নিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পূর্ব বছর ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি অত্যন্ত সহিংস সময় এবং পাঁচ শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। কিন্তু আমরা সামাজিক সম্প্রীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে যে ১১০টি ইউনিয়নে কাজ করেছি, সেগুলোতে এ সময়ে কোনো ধরনের সহিংসতা ঘটেনি। অর্থাৎ সামাজিক আত্মীকরণ ও ব্যাপকভিত্তিক আর্থসামাজিক উন্নয়ন সমাজে পরিচয়ভিত্তিক ভিন্নতা ও বিদ্বেষের সমস্যাকে কাটিয়ে তুলতে সহায়ক হতে পারে।
পরিশেষে, আইডেনটিটি-বেইজড বা পরিচয়ভিত্তিক সামাজিক বিদ্বেষ বাংলাদেশে প্রকট সমস্যা নয়। তা সত্ত্বেও সময়ে সময়ে আমাদের দেশে পরিচয়ভিত্তিক ভিন্নরা সহিংসতার শিকার হয়েছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণেই মূলত এগুলো ঘটেছে। বস্তুত, রাজনৈতিক সহিংসতা আমাদের দেশে ব্যাপক, যা বর্তমানে আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। অব্যাহত সহিংসতার কারণে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও এখন চরম ঝুঁকির সম্মুখীন। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে এবং টেকসইভাবে সামাজিক সম্প্রীতি গড়ে তুলতে হলে আজ আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা সৃষ্টি ও সংলাপের আয়োজন করতে হবে, যাতে তারা অনেকগুলো মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক।

No comments

Powered by Blogger.