পা বাঁধা ওড়নায় রুনীর ডিএনএ! by নেসারুল হক খোকন ও ওবায়েদ অংশুমান
সাগর
সরওয়ারের পা বাঁধা লাল ওড়নাতে শুধু রুনীর ডিএনএ পাওয়া গেছে। আর তার হাত
বাঁধা টিয়া রঙের ওড়না ও টি-শার্টে মিলেছে অজ্ঞাত দুই পুরুষের ডিএনএ। অর্থাৎ
সাগরকে খুন করার সময় কে বা কারা তার হাত-পা বেঁধেছে তা অনেকটা স্পষ্ট।
যদিও এখন পর্যন্ত অজ্ঞাত ওই দু’জনের পরিচয় মেলাতে পারেনি তদন্ত সংস্থা।
যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই (ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) পরিচালিত ল্যাব
থেকে এ রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর র্যাবের নীতিনির্ধারণী পর্যায়কে ভীষণ
ভাবিয়ে তোলে।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে র্যাবের সাবেক এক শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরের অনুসন্ধান টিমকে বলেন, তার ধারণা খুনের সঙ্গে অন্যতম সন্দেহভাজনদের ডিএনএ মেলাতে পারলে খুনিদের চিহ্নিত করাসহ পুরো রহস্যের জাল উন্মোচন হবে। এ জন্য এখন র্যাবের উচিত হবে একে একে সন্দেহভাজনদের গ্রেফতার করে তাদের ডিএনএ পরীক্ষা দ্রুত সম্পন্ন করা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাগরের পা বাঁধা ওড়নায় রুনীর ডিএনএ ছিল মানেই ধারণা করা যায়, সাগর খুন হওয়ার সময় রুনীর সক্রিয় উপস্থিতি ছিল। আর সাগর খুন হওয়ার পর রুনী খুন হন। এ কারণে রুনীর মৃত্যুর বিষয়টিও রহস্যে ঘেরা।
প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী র্যাবের সাবেক শীর্ষ এ কর্মকর্তা ঘটনার সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে আরও বলেন, তার মতে খুনের অনেক তথ্য জানে রুনীর মায়ের পরিবার। এবং আমি নিশ্চিত, চোর-ডাকাত সাগর-রুনীকে মারেনি। মনে রাখতে হবে, হাত বাঁধা ওড়না ও টি-শার্টে দুই পুরুষের ডিএনএ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ ক্রাইম সিন বিশ্লেষণ করলে এটাই প্রতীয়মান হবে যে, ওই দুই পুরুষকে হেল্প করেছে অন্য একজন। তিনি বলেন, তাই গ্রিল-ট্রিল ভাঙা এগুলোও ঠিক না। ওখান দিয়ে কোনো লোকজনের আসা-যাওয়াও সম্ভব না। এটা ইমপসিবল। আমি খুব ভালোভাবে ভেতরে ঢুকে পর্যবেক্ষণ করে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছি। আসলে সাগরকে খুন করার পর দরজা খুলে দেয়ায় খুনি বের হয়ে যায়। কারণ একজন তো ভেতরে ছিল। দরজা ভেতর থেকেই বন্ধ করা ছিল।
মোবাইলের শেষ কল : ঘটনার পর রুনীর পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ঘটনার দিন সকাল ৭টা ২১ মিনিটে রুনীর মোবাইল দিয়ে মেঘ তার নানীকে ফোন দেয়। কিন্তু বিষয়টি মানতে পারেননি ওই শীর্ষ র্যাব কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আমার ধারণা, তার (রুনী) পরিবার দাবি করলেও ঘটনার দিন সকাল বেলা মেঘ কাউকে কল দেয়নি। এর কারণ, মা-বাবার লাশ দেখার পর ওই বয়সের একটি ছেলে (মেঘ) সাত-আট মিনিট ধরে কথা বলতে পারে না। আর মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পরপরই পাগলের মতো রুনীর মায়ের ওই বাসায় ছুটে আসার কথা। অথচ রুনীর মা ওই সকালে বাসায় কীভাবে এসেছিলেন তা কেউ টের পায়নি?
ফ্যামিলি সব জানে : পুলিশের পাশাপাশি র্যাবও ঘটনার পর সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে রুনীর ঘনিষ্ঠজনদের সন্দেহের তালিকায় রাখে। এ বিষয়ে র্যাবের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তার দাবি, হত্যার পর ঘটনাস্থলে অরিজিনাল যে ক্রাইম সিন ছিল তা পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, আসলে ওই বাসার ড্রয়ার, আলমারি সব ঠিকঠাক ছিল। আর কাপড়-চোপড়ও ছড়ানো-ছিটানো ছিল না। এগুলো সব পরে করা। অন্যদিকে রুনীর মায়ের ‘আত্মহত্যা’ বলার বিষয়টি রহস্যজনক আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে গিয়ে তারা (রুনীর মা, রোমান, রিমন) কিন্তু পুলিশকে খবর দেয়নি। ঘটনার পরপরই রুনীর মা ওই বাসায় এসে অবস্থান করেন। এরপর তিনি যুক্তি-পরামর্শ করতে তার ছেলেদের ফোন দিয়ে ডেকে আনেন। ছেলেরা আসার পর তিনি চিৎকার দিয়ে বলেছিলেন, তার জামাই সাগর আর মেয়ে রুনী আত্মহত্যা করেছে। আমার প্রশ্ন, জামাই-মেয়ের এরকম লাশ দেখে কীভাবে তিনি বললেন, এটি আত্মহত্যা? র্যাবের এ শীর্ষ কর্মকর্তা আরও বলেন, আসলে এ ঘটনার সবই দেখেছে মেঘ। এ জন্য ঘটনার পর তাকে ভয় দেখানো হয়। এখনও সে ভয়ের মধ্যেই রয়েছে।
রহস্যে ঘেরা খুন : র্যাব কর্মকর্তার দাবি, ঘরের মধ্যে যে বা যারা ছিল (নাম উল্লেখ করলেও তা প্রকাশ করা হল না) তারা সাগরকে মেরেছে। সাগরকে আনাড়ি হাতে স্টেব করা হয়েছে। তিনি আরও দাবি করেন, রুনীর মৃত্যুটা রহস্যের। রুনীর পেটে একটা মাত্র স্টেব। তাও আবার ডান দিকে। ধারাল ছুরির স্টেবের কারণে তার মেইন আর্টারি কেটে যায়। তা না হলে
একটা স্টেপে মারা যাওয়ার কথা না। স্টেপ দেয়ার সময় তার পরনে ছিল টি-শার্ট। কিন্তু সেই টি-শার্ট কাটেনি। এখানেই বড় রহস্যের জন্ম দিয়েছে। পরিচিত লোকের বাইরে কেউ এ খুন করেনি। কারণ অপরিচিত কেউ খুন করলে কিচেনের ছুরি, চাকু ও বঁটি দিয়ে আঘাত করার কথা নয়। সেখানে বাইরের জিনিস থাকার কথা। তা কিন্তু সেখানে ছিল না, যা দিয়ে খুন করা হয়েছে তা সবই ওই ঘরেরই জিনিস।’ সাগরকে টর্চার করে খুন করা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘সাগরকে আনাড়িভাবে খুন করা হয়েছে। তার ঘাড়েও আঘাত আছে। আবার সামনেও আছে। যে ব্যক্তি বা যারা সাগরের শরীরে স্টেপ করেছে তারা কিন্তু আস্তে আস্তে স্টেপ করেনি। সে তার সর্বোচ্চ জোর দিয়ে আঘাত করেছে। ইচ্ছামতো করেছে। তার শক্তিতে এর বেশি করতে পারেনি। শেষ মুহূর্তে সাগরের শরীরে বড় যেসব স্টেপ করা হয়েছে সেখানে প্রথম ব্যক্তির সঙ্গে অন্যরা অংশ নিয়েছে বলে মনে হয়। কারণ সাগরের শরীরের শেষ স্টেপটা অনেক গভীরে ঢুকে যায়।’ সাগরের ওপরে অমানুষিক টর্চার হয়েছে এমন তথ্য জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘রুনীর শরীরের অন্য কোথাও কিন্তু কোনো প্রকারের টর্চার হয়নি। রুনীর পেটের ডানপাশে একটা মাত্র স্টেপ। তার শরীরে আর কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই।’
ডিএনএ পরীক্ষার আলামত : আলোচিত এ হত্যা রহস্য উদঘাটনের জন্য র্যাব ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া বিভিন্ন ধরনের আলামতের ডিএনএ পরীক্ষা করতে যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবে পাঠায়। আলামত হিসেবে সাগর-রুনীর পরনের কাপড়, সাগরের হাত-পা বাঁধার দুটি ওড়না (লাল ও টিয়া রঙের), গ্রিলের অংশবিশেষ, ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া চুল, গ্রিলের পাশে পাওয়া মোজা, দরজার লক, দরজার চেইন ও ছিটকানি পাঠানো হয়।
সাগরের প্রতি রুনীর ক্ষোভ : মৃত্যুর সাত দিন আগে রুনীর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী নাদিরা কিরণসহ এটিএন বাংলার কয়েকজনকে সাগরের প্রতি তার এক ধরনের ক্ষোভের কথা জানিয়েছিলেন রুনী। তাদের রুনী বলেন, ‘সাগর চেঞ্জ হয়ে গেছে।’ এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক নাদিরা কিরণ যুগান্তরকে বলেন, ‘ ঘটনার সাত দিন আগে সাগরের প্রতি ক্ষোভ থাকার কথা জানিয়েছিলেন রুনী । আমিসহ এটিএন বাংলার আরও দুই-চারজনকে রুনী বলেছিল, ‘সাগর আমাকে ইগনর করবে সেটা ভাবতে পারি না। সাগর আগের মতো নেই। অনেক বদলে গেছে...।’ নাদিরা কিরণ বলেন, ‘তিনি রুনীকে বুঝিয়েছিলেন, সাগরের বিষয়টা তেমন কিছুই না।’ নাদিরার বাসায় রুনী : জার্মানি থেকে সাগর-রুনী ফিরে আসে ২০১১ সালের শেষের দিকে। এরপর খুনের ঘটনার কয়েক মাস আগে সাগরের ওপর রাগ করে দু’বার নাদিরার বাসায় যান রুনী। এ প্রসঙ্গে নাদিরা কিরণ যুগান্তরকে বলেন, ‘রুনী কিন্তু আমার বাসায় রাগ করে চলেও এসেছিল। সেদিন আমি রুনী-সাগর দু’জনকেই বুঝিয়েছিলাম।’
সেই সাংবাদিক যা বললেন : সাংবাদিক সাগর জার্মানিতে থাকাবস্থায় (২০০৮-১১) ঢাকার অপর এক নারী সাংবাদিক সেখানে রেডিও ডয়েস এভেলে চাকরি নেন। তিনি সেখানে নয় মাস ছিলেন। বেশকিছু তথ্য যাচাইয়ের জন্য যুগান্তর অনুসন্ধানী টিম ওই নারী সাংবাদিকের মুখোমুখি হয়। ২০ মার্চ তার কর্মস্থলে গিয়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। ঘটনার বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাগর ও আরাফাত ভাই আগে থেকেই সেখানে কর্মরত ছিলেন। এর আগে সাগর ভাই ইত্তেফাকে আমার সহকর্মী ছিলেন। জার্মানি থেকে দেশে ফেরার পর রুনী আপার সঙ্গে আমার অনেকবার দেখা হয়েছে। তিনি আমার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করেছেন।’ তিনি বলেন, আসলে জার্মানিতে থাকাবস্থায় স্নিগ্ধা নামের বাঙালি এক মেয়ে রুনী আপার কান ভারি করত।’
তুমুল ঝগড়া : র্যাব মামলাটি প্রায় তিন বছর ধরে তদন্ত করছে। তাদের তদন্তে পারিবারিক কলহের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। এ বিষয়ে র্যাবের সদ্য বিদায়ী শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘সাগর রুনীকে সন্দেহের চোখে দেখত। তাদের মধ্যে প্রায় ঝগড়া হতো। ওই ফ্ল্যাটের আশপাশের লোকজন তা জানত। আর ঘটনার দিন রাতেও তাদের মধ্যে চিল্লা-পাল্লা হয়েছিল। আর তা পাশের ফ্ল্যাটের লোকজনও শুনতে পেয়েছিল। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেননি। কারণ এ ধরনের ঘটনা প্রায় তাদের মধ্যে ঘটত।’
পাদটীকা : সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনে দ্বিতীয় পর্যায়ের রিপোর্ট আজ শেষ হলেও যুগান্তর টিমের পরবর্তী অনুসন্ধান অব্যাহত থাকবে। অনুসন্ধান শেষে তৃতীয় পর্যায়ের রিপোর্ট নিয়ে যুগান্তর পুনরায় পাঠকের সামনে হাজির হবে।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে র্যাবের সাবেক এক শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরের অনুসন্ধান টিমকে বলেন, তার ধারণা খুনের সঙ্গে অন্যতম সন্দেহভাজনদের ডিএনএ মেলাতে পারলে খুনিদের চিহ্নিত করাসহ পুরো রহস্যের জাল উন্মোচন হবে। এ জন্য এখন র্যাবের উচিত হবে একে একে সন্দেহভাজনদের গ্রেফতার করে তাদের ডিএনএ পরীক্ষা দ্রুত সম্পন্ন করা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাগরের পা বাঁধা ওড়নায় রুনীর ডিএনএ ছিল মানেই ধারণা করা যায়, সাগর খুন হওয়ার সময় রুনীর সক্রিয় উপস্থিতি ছিল। আর সাগর খুন হওয়ার পর রুনী খুন হন। এ কারণে রুনীর মৃত্যুর বিষয়টিও রহস্যে ঘেরা।
প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী র্যাবের সাবেক শীর্ষ এ কর্মকর্তা ঘটনার সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে আরও বলেন, তার মতে খুনের অনেক তথ্য জানে রুনীর মায়ের পরিবার। এবং আমি নিশ্চিত, চোর-ডাকাত সাগর-রুনীকে মারেনি। মনে রাখতে হবে, হাত বাঁধা ওড়না ও টি-শার্টে দুই পুরুষের ডিএনএ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ ক্রাইম সিন বিশ্লেষণ করলে এটাই প্রতীয়মান হবে যে, ওই দুই পুরুষকে হেল্প করেছে অন্য একজন। তিনি বলেন, তাই গ্রিল-ট্রিল ভাঙা এগুলোও ঠিক না। ওখান দিয়ে কোনো লোকজনের আসা-যাওয়াও সম্ভব না। এটা ইমপসিবল। আমি খুব ভালোভাবে ভেতরে ঢুকে পর্যবেক্ষণ করে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছি। আসলে সাগরকে খুন করার পর দরজা খুলে দেয়ায় খুনি বের হয়ে যায়। কারণ একজন তো ভেতরে ছিল। দরজা ভেতর থেকেই বন্ধ করা ছিল।
মোবাইলের শেষ কল : ঘটনার পর রুনীর পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ঘটনার দিন সকাল ৭টা ২১ মিনিটে রুনীর মোবাইল দিয়ে মেঘ তার নানীকে ফোন দেয়। কিন্তু বিষয়টি মানতে পারেননি ওই শীর্ষ র্যাব কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আমার ধারণা, তার (রুনী) পরিবার দাবি করলেও ঘটনার দিন সকাল বেলা মেঘ কাউকে কল দেয়নি। এর কারণ, মা-বাবার লাশ দেখার পর ওই বয়সের একটি ছেলে (মেঘ) সাত-আট মিনিট ধরে কথা বলতে পারে না। আর মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পরপরই পাগলের মতো রুনীর মায়ের ওই বাসায় ছুটে আসার কথা। অথচ রুনীর মা ওই সকালে বাসায় কীভাবে এসেছিলেন তা কেউ টের পায়নি?
ফ্যামিলি সব জানে : পুলিশের পাশাপাশি র্যাবও ঘটনার পর সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে রুনীর ঘনিষ্ঠজনদের সন্দেহের তালিকায় রাখে। এ বিষয়ে র্যাবের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তার দাবি, হত্যার পর ঘটনাস্থলে অরিজিনাল যে ক্রাইম সিন ছিল তা পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, আসলে ওই বাসার ড্রয়ার, আলমারি সব ঠিকঠাক ছিল। আর কাপড়-চোপড়ও ছড়ানো-ছিটানো ছিল না। এগুলো সব পরে করা। অন্যদিকে রুনীর মায়ের ‘আত্মহত্যা’ বলার বিষয়টি রহস্যজনক আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে গিয়ে তারা (রুনীর মা, রোমান, রিমন) কিন্তু পুলিশকে খবর দেয়নি। ঘটনার পরপরই রুনীর মা ওই বাসায় এসে অবস্থান করেন। এরপর তিনি যুক্তি-পরামর্শ করতে তার ছেলেদের ফোন দিয়ে ডেকে আনেন। ছেলেরা আসার পর তিনি চিৎকার দিয়ে বলেছিলেন, তার জামাই সাগর আর মেয়ে রুনী আত্মহত্যা করেছে। আমার প্রশ্ন, জামাই-মেয়ের এরকম লাশ দেখে কীভাবে তিনি বললেন, এটি আত্মহত্যা? র্যাবের এ শীর্ষ কর্মকর্তা আরও বলেন, আসলে এ ঘটনার সবই দেখেছে মেঘ। এ জন্য ঘটনার পর তাকে ভয় দেখানো হয়। এখনও সে ভয়ের মধ্যেই রয়েছে।
রহস্যে ঘেরা খুন : র্যাব কর্মকর্তার দাবি, ঘরের মধ্যে যে বা যারা ছিল (নাম উল্লেখ করলেও তা প্রকাশ করা হল না) তারা সাগরকে মেরেছে। সাগরকে আনাড়ি হাতে স্টেব করা হয়েছে। তিনি আরও দাবি করেন, রুনীর মৃত্যুটা রহস্যের। রুনীর পেটে একটা মাত্র স্টেব। তাও আবার ডান দিকে। ধারাল ছুরির স্টেবের কারণে তার মেইন আর্টারি কেটে যায়। তা না হলে
একটা স্টেপে মারা যাওয়ার কথা না। স্টেপ দেয়ার সময় তার পরনে ছিল টি-শার্ট। কিন্তু সেই টি-শার্ট কাটেনি। এখানেই বড় রহস্যের জন্ম দিয়েছে। পরিচিত লোকের বাইরে কেউ এ খুন করেনি। কারণ অপরিচিত কেউ খুন করলে কিচেনের ছুরি, চাকু ও বঁটি দিয়ে আঘাত করার কথা নয়। সেখানে বাইরের জিনিস থাকার কথা। তা কিন্তু সেখানে ছিল না, যা দিয়ে খুন করা হয়েছে তা সবই ওই ঘরেরই জিনিস।’ সাগরকে টর্চার করে খুন করা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘সাগরকে আনাড়িভাবে খুন করা হয়েছে। তার ঘাড়েও আঘাত আছে। আবার সামনেও আছে। যে ব্যক্তি বা যারা সাগরের শরীরে স্টেপ করেছে তারা কিন্তু আস্তে আস্তে স্টেপ করেনি। সে তার সর্বোচ্চ জোর দিয়ে আঘাত করেছে। ইচ্ছামতো করেছে। তার শক্তিতে এর বেশি করতে পারেনি। শেষ মুহূর্তে সাগরের শরীরে বড় যেসব স্টেপ করা হয়েছে সেখানে প্রথম ব্যক্তির সঙ্গে অন্যরা অংশ নিয়েছে বলে মনে হয়। কারণ সাগরের শরীরের শেষ স্টেপটা অনেক গভীরে ঢুকে যায়।’ সাগরের ওপরে অমানুষিক টর্চার হয়েছে এমন তথ্য জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘রুনীর শরীরের অন্য কোথাও কিন্তু কোনো প্রকারের টর্চার হয়নি। রুনীর পেটের ডানপাশে একটা মাত্র স্টেপ। তার শরীরে আর কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই।’
ডিএনএ পরীক্ষার আলামত : আলোচিত এ হত্যা রহস্য উদঘাটনের জন্য র্যাব ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া বিভিন্ন ধরনের আলামতের ডিএনএ পরীক্ষা করতে যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবে পাঠায়। আলামত হিসেবে সাগর-রুনীর পরনের কাপড়, সাগরের হাত-পা বাঁধার দুটি ওড়না (লাল ও টিয়া রঙের), গ্রিলের অংশবিশেষ, ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া চুল, গ্রিলের পাশে পাওয়া মোজা, দরজার লক, দরজার চেইন ও ছিটকানি পাঠানো হয়।
সাগরের প্রতি রুনীর ক্ষোভ : মৃত্যুর সাত দিন আগে রুনীর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী নাদিরা কিরণসহ এটিএন বাংলার কয়েকজনকে সাগরের প্রতি তার এক ধরনের ক্ষোভের কথা জানিয়েছিলেন রুনী। তাদের রুনী বলেন, ‘সাগর চেঞ্জ হয়ে গেছে।’ এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক নাদিরা কিরণ যুগান্তরকে বলেন, ‘ ঘটনার সাত দিন আগে সাগরের প্রতি ক্ষোভ থাকার কথা জানিয়েছিলেন রুনী । আমিসহ এটিএন বাংলার আরও দুই-চারজনকে রুনী বলেছিল, ‘সাগর আমাকে ইগনর করবে সেটা ভাবতে পারি না। সাগর আগের মতো নেই। অনেক বদলে গেছে...।’ নাদিরা কিরণ বলেন, ‘তিনি রুনীকে বুঝিয়েছিলেন, সাগরের বিষয়টা তেমন কিছুই না।’ নাদিরার বাসায় রুনী : জার্মানি থেকে সাগর-রুনী ফিরে আসে ২০১১ সালের শেষের দিকে। এরপর খুনের ঘটনার কয়েক মাস আগে সাগরের ওপর রাগ করে দু’বার নাদিরার বাসায় যান রুনী। এ প্রসঙ্গে নাদিরা কিরণ যুগান্তরকে বলেন, ‘রুনী কিন্তু আমার বাসায় রাগ করে চলেও এসেছিল। সেদিন আমি রুনী-সাগর দু’জনকেই বুঝিয়েছিলাম।’
সেই সাংবাদিক যা বললেন : সাংবাদিক সাগর জার্মানিতে থাকাবস্থায় (২০০৮-১১) ঢাকার অপর এক নারী সাংবাদিক সেখানে রেডিও ডয়েস এভেলে চাকরি নেন। তিনি সেখানে নয় মাস ছিলেন। বেশকিছু তথ্য যাচাইয়ের জন্য যুগান্তর অনুসন্ধানী টিম ওই নারী সাংবাদিকের মুখোমুখি হয়। ২০ মার্চ তার কর্মস্থলে গিয়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। ঘটনার বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাগর ও আরাফাত ভাই আগে থেকেই সেখানে কর্মরত ছিলেন। এর আগে সাগর ভাই ইত্তেফাকে আমার সহকর্মী ছিলেন। জার্মানি থেকে দেশে ফেরার পর রুনী আপার সঙ্গে আমার অনেকবার দেখা হয়েছে। তিনি আমার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করেছেন।’ তিনি বলেন, আসলে জার্মানিতে থাকাবস্থায় স্নিগ্ধা নামের বাঙালি এক মেয়ে রুনী আপার কান ভারি করত।’
তুমুল ঝগড়া : র্যাব মামলাটি প্রায় তিন বছর ধরে তদন্ত করছে। তাদের তদন্তে পারিবারিক কলহের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। এ বিষয়ে র্যাবের সদ্য বিদায়ী শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘সাগর রুনীকে সন্দেহের চোখে দেখত। তাদের মধ্যে প্রায় ঝগড়া হতো। ওই ফ্ল্যাটের আশপাশের লোকজন তা জানত। আর ঘটনার দিন রাতেও তাদের মধ্যে চিল্লা-পাল্লা হয়েছিল। আর তা পাশের ফ্ল্যাটের লোকজনও শুনতে পেয়েছিল। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেননি। কারণ এ ধরনের ঘটনা প্রায় তাদের মধ্যে ঘটত।’
পাদটীকা : সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনে দ্বিতীয় পর্যায়ের রিপোর্ট আজ শেষ হলেও যুগান্তর টিমের পরবর্তী অনুসন্ধান অব্যাহত থাকবে। অনুসন্ধান শেষে তৃতীয় পর্যায়ের রিপোর্ট নিয়ে যুগান্তর পুনরায় পাঠকের সামনে হাজির হবে।
No comments