প্রার্থীদের অঙ্গীকার ও ভোটারদের প্রত্যাশা by এস এম মাহফুজুর রহমান
২৮
এপ্রিল অনুষ্ঠেয় ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে
যথেষ্ট তোড়জোড় শুরু হয়েছে। নানা কার্যক্রমের মধ্যে নজরে পড়ার মতো
একটি হচ্ছে ভোটারদের প্রত্যাশা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে লেখালেখি ও মতামত
প্রকাশ। প্রার্থীরা নিজেদের নির্বাচনী প্রচারণা নিয়ে যত ব্যস্ত,
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এসব মতামত সম্পর্কে কি ততটা অবহিত? তাঁরা কি সময়
নিয়ে এগুলো পড়েন? তাঁরা কি নিজ নিজ নির্বাচনী প্রচারণায় এসব বিষয়
অন্তর্ভুক্ত করে গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব বাস্তবায়নে আগ্রহী?
এসব প্রশ্নের একটি উত্তর এমন হতে পারে যে ভোটাররা যা চান, তার সবকিছুতেই তো প্রার্থীদের সম্মত হতে হবে, নতুন করে আবার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কী আছে? আবার কোনো প্রার্থী বলতে পারেন, যা কিছু আলোচনায় আসছে, তার কোনোটিই কারও অজানা বিষয় নয়। তা ছাড়া আমরা শহরগুলোকে বিশ্বমানের নগরে রূপান্তরিত করব, এগুলো হবে তিলোত্তমা নগর, স্বপ্নের নগর, গ্রিন অ্যান্ড ক্লিন সিটি ইত্যাদি প্রতিশ্রুতিই আমরা দিচ্ছি। এসবের মধ্যেই তো আছে ভোটারদের সব দাবি।
কিন্তু এ রকম উত্তরের সঙ্গে একমত হওয়ার সুযোগ বাস্তবে আছে কি? স্পষ্টতই বলা যায়, না, একমত হওয়ার সুযোগ নেই। ভোটারদের দাবি যেমন হতে হবে সুচিন্তিত ও বাস্তবসম্মত, তেমনি ভোটপ্রার্থীদের অঙ্গীকারও হতে হবে সুনির্দিষ্ট, নৈতিকতা ও বিশ্বাসপ্রসূত। বলা বাহুল্য, নির্বাচনের আওতাভুক্ত তিন সিটি করপোরেশনের রয়েছে পাহাড়সম নানা সমস্যা। সেগুলোর সমাধানের চেষ্টা করা যেতে পারে, তবে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সব সমস্যা দূর করা প্রায় অসম্ভব কাজ। তাই নির্বাচিত প্রার্থীরা শেষ পর্যন্ত কতটা কী করতে পারবেন, ভোটাররা তার চাইতে বেশি দেখতে চান অঙ্গীকারগুলো কেমন, সেগুলো বাস্তবায়নে তাঁরা কতটা দক্ষ এবং বাস্তব বিবেচনায় কতটা আন্তরিক।
এই তিন সিটি করপোরেশনের আওতায় বসবাসরত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের একেক অংশের প্রত্যাশা একেক ধরনের। কেউ চান বাধাবিঘ্নহীন ব্যবসা-বাণিজ্যের নিশ্চয়তা, কেউ চান স্বাভাবিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত বন্ধুসুলভ ও সুন্দর কাজের পরিবেশ। একটি বড় অংশের মানুষের প্রয়োজন স্বচ্ছন্দ ও নিরাপদ আবাসস্থল আর সাধারণভাবে সবার দরকার মশা, যানজট, কালো ধোঁয়া, ফরমালিন, আবর্জনা, জলাবদ্ধতা ইত্যাদি থেকে মুক্তি আর নিরাপদ পানি, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, রান্নার গ্যাস সরবরাহ। যাঁরা মেয়র ও কাউন্সিলর হবেন, তাঁদের নিজেদের এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে নগর ভবনসমূহেরও নিজস্ব কিছু বিষয় আছে। যেমন, নির্বাচিত মেয়র বা কাউন্সিলরদের ক্ষমতা, অধিকার, দায়িত্ব–কর্তব্য, বেতন-ভাতাসহ সুযোগ-সুবিধা, স্থানীয় সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্রীয় সরকারের নানা অঙ্গ এবং ডেসা, ওয়াসা বা ইন্টারনেট সংযোগদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয়, চুক্তিভিত্তিক ঠিকাদারদের মাধ্যমে কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি, সরকারি অর্থ ব্যয়ে শৃঙ্খলা ইত্যাদি।
প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষের বসবাসের উপযোগিতা বিবেচনায় বিশ্বের খারাপ ও উত্তম শহরের যে তালিকা প্রতিবছর তৈরি হওয়ার একটি রীতি আছে, সেখানে শহরকে খারাপ বা উত্তম বিবেচনার মাপকাঠিগুলো কী কী কিংবা এসব মাপকাঠির কোনটি কী স্কেলে পরিমাপ করা হয়, মাপকাঠি অনুযায়ী প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রমিত মান কত—এসব বিষয়ে কি আমাদের মেয়র বা কাউন্সিলর পদে আগ্রহী প্রার্থীরা অবহিত? তাঁরা কি এসব বিষয়ে চিন্তাভাবনা করেন? করলে তাঁদের নির্বাচনী অঙ্গীকারে সেগুলো কীভাবে অন্তর্ভুক্ত? ভোটাররাই বা কীভাবে বুঝবেন যে মান অনুযায়ী এই তিন নগরের অবস্থান এসব মাপকাঠি অনুযায়ী উন্নীত করতে প্রার্থীদের মধ্যে কে কত বেশি উপযুক্ত বা আন্তরিক?
এবার তুলনামূলকভাবে ছোট ও সহজে সমাধানযোগ্য অথচ অনেকটাই স্থায়ীভাবে বিরাজমান একটি সমস্যার অবতারণা করছি। কিন্তু যখনই কেউ কোনো শহর ভালো লাগল কি না, তা নিয়ে মতামত দেয়, তখন বলে রাস্তাঘাট পরিষ্কার, শহরটি সবুজ ও প্রশস্ত, জঞ্জালমুক্ত, মানুষজন হাসিখুশি, কোনো অনিয়ম চোখে পড়ে না ইত্যাদি। আমাদের শহরগুলো সম্পর্কে কি এমনটি বলার সুযোগ আছে? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর, না। কারণ, যেকোনো রাস্তায় দাঁড়ান, ফুটপাত বলতে কিছু পাবেন না। যা আছে, তা হচ্ছে তিন প্রকারের দোকানের দখল: এক. স্থায়ী বা প্রায় স্থায়ী; দুই. বাঁশ বা সীমানাপ্রাচীরে ঝোলানো অথবা ফুটপাতে বিছানো মালামাল নিয়ে অস্থায়ী এবং তিন. ভ্যানমতো একটা কিছুতে বানানো হকারের ভিড়। আর এসব যদি না থাকে, তাহলে এখানে পাওয়া যাবে চাটাইঘেরা আড্ডাখানা অথবা ভাসমান মানুষের ঘেরাটোপ ঘর কিংবা মলমূত্র ত্যাগের উন্মুক্ত স্থান। এগুলো থেকে নিস্তার না পাওয়া নগরবাসীর অসহায়ত্ব, নাকি এসব আমাদের ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা? বিকল্প বের করার ঝামেলা এড়িয়ে আমাদের মেনে নেওয়ার মানসিকতা, আমাদের জাতিগত অভ্যাসের প্রতিফলন, নাকি এমন কিছু, যা থেকে গেলেই ভালো? এবং যা থেকে শহরকে পরিচ্ছন্ন করা মানে কিছু বিষয়ের সঙ্গে আপস না করলে যে ঝামেলা হতে পারে, সেগুলো এড়িয়ে চলা?
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কোনো প্রার্থী এসব বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিয়েছেন বলে জানা নেই। অথচ আন্তরিকতা নিয়ে এসব ক্ষেত্রে কাজ করলে নগরকে সুশৃঙ্খল ও সুন্দর করার কাজের ৫০ শতাংশেরও বেশি অর্জন করা সম্ভব। বিশৃঙ্খলার আরেক বিষয় রাস্তা দখল করে যেকোনো জায়গায় রিকশা, ঠেলাগাড়ি, ভ্যানগাড়ি, প্রাইভেট কার ইত্যাদি রাখা। এটি কি এমনই সমস্যা যে এর কোনো সমাধান নেই? আসলে এটা যে একটা সমস্যা, সে বিষয়টিই কর্তারা মাথায় নেন না। শোনা যায়, রিকশা বা অটোরিকশাজাতীয় পরিবহন থেকে নিয়মিত নগরভবনে চাঁদা যায়।
তিন নগরেই আছে বিপুলসংখ্যক মৌসুমি ও অভিবাসী রিকশাচালকের চাপ। এরা দু-তিন মাস বা কেউ কেউ তিন-চার সপ্তাহের জন্য ঢাকায় আসে, গ্রামে কাজ না থাকায় বেকার মৌসুমে সামান্য কিছু রোজগার করে আবার গ্রামে ফিরে যায়। এদের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, এরা নিয়মকানুন যেমন জানে না, তেমনি শহরও তেমন ভালো চেনে না। ট্রাফিক বিশৃঙ্খলায় তাদেরও অবদান আছে। এ ছাড়া সব বড় দোকান, স্কুল-কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় একেবারে রাস্তার ওপরেই স্থাপন করতে হবে কেন? কেনই বা যথেষ্টসংখ্যক পার্কিংয়ের ব্যবস্থা ছাড়া ভবন নির্মাণের সুযোগ দেওয়া হয়?
ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, ওভারপাস, আন্ডারপাস—এগুলো যতই হোক, নাগরিক হিসেবে আমাদের অভ্যাসের পরিবর্তন না হলে যানজট বাড়বেই, শহরও সুন্দর হবে না। ফুটপাত ও রাস্তা চলাচলের জন্য অবাধ ও উন্মুক্ত না থাকলে কিংবা খোলা জায়গাগুলো নোংরা আবর্জনায় বা অপরিকল্পিতভাবে ও অস্থায়ী আবাসে ঘিঞ্জি করে রাখলে শহরকে তিলোত্তমা করা সম্ভব হবে না।
অবাক করার বিষয় যে মেয়র বা কাউন্সিলর পদের প্রার্থীরা এসব বিষয়ে উদাসীন। তাঁরা সব বড় বিষয়ে অঙ্গীকার করে চলেছেন। সেগুলোর বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ, কোনো কোনোটি আদৌ বাস্তবসম্মত কি না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে। অথচ যা সহজে সমাধানযোগ্য, তার প্রতি মনোযোগ ও সদিচ্ছা থাকলে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করলে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হতো, নগরের মানুষ একটু স্বস্তি পেত।
এস এম মাহফুজুর রহমান: অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
email: ibmahfuz@gmail.com
এসব প্রশ্নের একটি উত্তর এমন হতে পারে যে ভোটাররা যা চান, তার সবকিছুতেই তো প্রার্থীদের সম্মত হতে হবে, নতুন করে আবার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কী আছে? আবার কোনো প্রার্থী বলতে পারেন, যা কিছু আলোচনায় আসছে, তার কোনোটিই কারও অজানা বিষয় নয়। তা ছাড়া আমরা শহরগুলোকে বিশ্বমানের নগরে রূপান্তরিত করব, এগুলো হবে তিলোত্তমা নগর, স্বপ্নের নগর, গ্রিন অ্যান্ড ক্লিন সিটি ইত্যাদি প্রতিশ্রুতিই আমরা দিচ্ছি। এসবের মধ্যেই তো আছে ভোটারদের সব দাবি।
কিন্তু এ রকম উত্তরের সঙ্গে একমত হওয়ার সুযোগ বাস্তবে আছে কি? স্পষ্টতই বলা যায়, না, একমত হওয়ার সুযোগ নেই। ভোটারদের দাবি যেমন হতে হবে সুচিন্তিত ও বাস্তবসম্মত, তেমনি ভোটপ্রার্থীদের অঙ্গীকারও হতে হবে সুনির্দিষ্ট, নৈতিকতা ও বিশ্বাসপ্রসূত। বলা বাহুল্য, নির্বাচনের আওতাভুক্ত তিন সিটি করপোরেশনের রয়েছে পাহাড়সম নানা সমস্যা। সেগুলোর সমাধানের চেষ্টা করা যেতে পারে, তবে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সব সমস্যা দূর করা প্রায় অসম্ভব কাজ। তাই নির্বাচিত প্রার্থীরা শেষ পর্যন্ত কতটা কী করতে পারবেন, ভোটাররা তার চাইতে বেশি দেখতে চান অঙ্গীকারগুলো কেমন, সেগুলো বাস্তবায়নে তাঁরা কতটা দক্ষ এবং বাস্তব বিবেচনায় কতটা আন্তরিক।
এই তিন সিটি করপোরেশনের আওতায় বসবাসরত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের একেক অংশের প্রত্যাশা একেক ধরনের। কেউ চান বাধাবিঘ্নহীন ব্যবসা-বাণিজ্যের নিশ্চয়তা, কেউ চান স্বাভাবিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত বন্ধুসুলভ ও সুন্দর কাজের পরিবেশ। একটি বড় অংশের মানুষের প্রয়োজন স্বচ্ছন্দ ও নিরাপদ আবাসস্থল আর সাধারণভাবে সবার দরকার মশা, যানজট, কালো ধোঁয়া, ফরমালিন, আবর্জনা, জলাবদ্ধতা ইত্যাদি থেকে মুক্তি আর নিরাপদ পানি, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, রান্নার গ্যাস সরবরাহ। যাঁরা মেয়র ও কাউন্সিলর হবেন, তাঁদের নিজেদের এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে নগর ভবনসমূহেরও নিজস্ব কিছু বিষয় আছে। যেমন, নির্বাচিত মেয়র বা কাউন্সিলরদের ক্ষমতা, অধিকার, দায়িত্ব–কর্তব্য, বেতন-ভাতাসহ সুযোগ-সুবিধা, স্থানীয় সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্রীয় সরকারের নানা অঙ্গ এবং ডেসা, ওয়াসা বা ইন্টারনেট সংযোগদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয়, চুক্তিভিত্তিক ঠিকাদারদের মাধ্যমে কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি, সরকারি অর্থ ব্যয়ে শৃঙ্খলা ইত্যাদি।
প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষের বসবাসের উপযোগিতা বিবেচনায় বিশ্বের খারাপ ও উত্তম শহরের যে তালিকা প্রতিবছর তৈরি হওয়ার একটি রীতি আছে, সেখানে শহরকে খারাপ বা উত্তম বিবেচনার মাপকাঠিগুলো কী কী কিংবা এসব মাপকাঠির কোনটি কী স্কেলে পরিমাপ করা হয়, মাপকাঠি অনুযায়ী প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রমিত মান কত—এসব বিষয়ে কি আমাদের মেয়র বা কাউন্সিলর পদে আগ্রহী প্রার্থীরা অবহিত? তাঁরা কি এসব বিষয়ে চিন্তাভাবনা করেন? করলে তাঁদের নির্বাচনী অঙ্গীকারে সেগুলো কীভাবে অন্তর্ভুক্ত? ভোটাররাই বা কীভাবে বুঝবেন যে মান অনুযায়ী এই তিন নগরের অবস্থান এসব মাপকাঠি অনুযায়ী উন্নীত করতে প্রার্থীদের মধ্যে কে কত বেশি উপযুক্ত বা আন্তরিক?
এবার তুলনামূলকভাবে ছোট ও সহজে সমাধানযোগ্য অথচ অনেকটাই স্থায়ীভাবে বিরাজমান একটি সমস্যার অবতারণা করছি। কিন্তু যখনই কেউ কোনো শহর ভালো লাগল কি না, তা নিয়ে মতামত দেয়, তখন বলে রাস্তাঘাট পরিষ্কার, শহরটি সবুজ ও প্রশস্ত, জঞ্জালমুক্ত, মানুষজন হাসিখুশি, কোনো অনিয়ম চোখে পড়ে না ইত্যাদি। আমাদের শহরগুলো সম্পর্কে কি এমনটি বলার সুযোগ আছে? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর, না। কারণ, যেকোনো রাস্তায় দাঁড়ান, ফুটপাত বলতে কিছু পাবেন না। যা আছে, তা হচ্ছে তিন প্রকারের দোকানের দখল: এক. স্থায়ী বা প্রায় স্থায়ী; দুই. বাঁশ বা সীমানাপ্রাচীরে ঝোলানো অথবা ফুটপাতে বিছানো মালামাল নিয়ে অস্থায়ী এবং তিন. ভ্যানমতো একটা কিছুতে বানানো হকারের ভিড়। আর এসব যদি না থাকে, তাহলে এখানে পাওয়া যাবে চাটাইঘেরা আড্ডাখানা অথবা ভাসমান মানুষের ঘেরাটোপ ঘর কিংবা মলমূত্র ত্যাগের উন্মুক্ত স্থান। এগুলো থেকে নিস্তার না পাওয়া নগরবাসীর অসহায়ত্ব, নাকি এসব আমাদের ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা? বিকল্প বের করার ঝামেলা এড়িয়ে আমাদের মেনে নেওয়ার মানসিকতা, আমাদের জাতিগত অভ্যাসের প্রতিফলন, নাকি এমন কিছু, যা থেকে গেলেই ভালো? এবং যা থেকে শহরকে পরিচ্ছন্ন করা মানে কিছু বিষয়ের সঙ্গে আপস না করলে যে ঝামেলা হতে পারে, সেগুলো এড়িয়ে চলা?
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কোনো প্রার্থী এসব বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিয়েছেন বলে জানা নেই। অথচ আন্তরিকতা নিয়ে এসব ক্ষেত্রে কাজ করলে নগরকে সুশৃঙ্খল ও সুন্দর করার কাজের ৫০ শতাংশেরও বেশি অর্জন করা সম্ভব। বিশৃঙ্খলার আরেক বিষয় রাস্তা দখল করে যেকোনো জায়গায় রিকশা, ঠেলাগাড়ি, ভ্যানগাড়ি, প্রাইভেট কার ইত্যাদি রাখা। এটি কি এমনই সমস্যা যে এর কোনো সমাধান নেই? আসলে এটা যে একটা সমস্যা, সে বিষয়টিই কর্তারা মাথায় নেন না। শোনা যায়, রিকশা বা অটোরিকশাজাতীয় পরিবহন থেকে নিয়মিত নগরভবনে চাঁদা যায়।
তিন নগরেই আছে বিপুলসংখ্যক মৌসুমি ও অভিবাসী রিকশাচালকের চাপ। এরা দু-তিন মাস বা কেউ কেউ তিন-চার সপ্তাহের জন্য ঢাকায় আসে, গ্রামে কাজ না থাকায় বেকার মৌসুমে সামান্য কিছু রোজগার করে আবার গ্রামে ফিরে যায়। এদের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, এরা নিয়মকানুন যেমন জানে না, তেমনি শহরও তেমন ভালো চেনে না। ট্রাফিক বিশৃঙ্খলায় তাদেরও অবদান আছে। এ ছাড়া সব বড় দোকান, স্কুল-কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় একেবারে রাস্তার ওপরেই স্থাপন করতে হবে কেন? কেনই বা যথেষ্টসংখ্যক পার্কিংয়ের ব্যবস্থা ছাড়া ভবন নির্মাণের সুযোগ দেওয়া হয়?
ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, ওভারপাস, আন্ডারপাস—এগুলো যতই হোক, নাগরিক হিসেবে আমাদের অভ্যাসের পরিবর্তন না হলে যানজট বাড়বেই, শহরও সুন্দর হবে না। ফুটপাত ও রাস্তা চলাচলের জন্য অবাধ ও উন্মুক্ত না থাকলে কিংবা খোলা জায়গাগুলো নোংরা আবর্জনায় বা অপরিকল্পিতভাবে ও অস্থায়ী আবাসে ঘিঞ্জি করে রাখলে শহরকে তিলোত্তমা করা সম্ভব হবে না।
অবাক করার বিষয় যে মেয়র বা কাউন্সিলর পদের প্রার্থীরা এসব বিষয়ে উদাসীন। তাঁরা সব বড় বিষয়ে অঙ্গীকার করে চলেছেন। সেগুলোর বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ, কোনো কোনোটি আদৌ বাস্তবসম্মত কি না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে। অথচ যা সহজে সমাধানযোগ্য, তার প্রতি মনোযোগ ও সদিচ্ছা থাকলে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করলে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হতো, নগরের মানুষ একটু স্বস্তি পেত।
এস এম মাহফুজুর রহমান: অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
email: ibmahfuz@gmail.com
No comments