ফাঁসি কার্যকর by নুরুজ্জামান লাবু ও আল আমিন

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। গতকাল রাত ১০টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেয়া দ্বিতীয় মৃত্যুদণ্ড হিসেবে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হলো। এর আগে ২০১৩ সালের ১২ই ডিসেম্বর আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের বিষয়ে গত দুই দিনে চলা নাটকীয়তার পর শুক্রবার রাতে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছিলেন শনিবারই কার্যকর হচ্ছে ফাঁসি। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আপত্তির মধ্যেই সরকার জামায়াতের এ নেতার ফাঁসি কার্যকর করলো।
এদিকে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের আগে বিকালে তার পরিবারের ২১ সদস্য তার সঙ্গে দেখা করেন। রাত ১০টা ১ মিনিটে ফাঁসি কার্যকরের পর ২০ মিনিট তাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ঢাকার সিভিল সার্জন তার মৃত্যু নিশ্চিত করার পর ময়নাতদন্ত শেষে লাশ কারাগার থেকে বের করা হয়। এর আগে বিকাল থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় নেয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাকধারী ও সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরকে সামনে রেখে গতকাল বিকাল থেকেই সারা দেশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হয় বিজিবি।
যেভাবে ফাঁসি কার্যকর: রাত ১০টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এই ফাঁসি কার্যকর করতে ৩ জন জল্লাদ অংশ নেন।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার ফরমান আলী ফাঁসি কার্যকর করতে লাল রুমালটি ব্যবহার করেন। তার হাত থেকে রুমালটি মাটিতে পড়তেই জল্লাদ ফাঁসির মঞ্চের হুইলটি টেনে দেন। এতে কামারুজ্জামানের পায়ের নিচ থেকে কাঠের পাটাতন সরে গেলে তিনি ফাঁসির দড়িতে ঝুলে পড়েন। মৃত্যু নিশ্চিত করতে তাকে অন্তত ২০ মিনিট ঝুলন্ত অবস্থায় রাখা হয়। পরে মাটিতে নামানোর পর সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা মৃতদেহ পরীক্ষা করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এ সময় তার হাত-পায়ের রগ কেটে শতভাগ মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। পরে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন চিকিৎসকরা। এরপর মুসলিম রীতি অনুযায়ী কামারুজ্জামানের মৃতদেহ গোসল করিয়ে কাফন পরানো হয়। এসবে নেতৃত্ব দেন কারা মসজিদের ইমাম। এরপর লাশটি কফিনে ঢুকিয়ে পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী শেরপুরে লাশ দাফন হবে কামারুজ্জামানের।
কারা সূত্র জানায়, রাতে জেল সুপার কেন্দ্রীয় কারাগার মসজিদের ইমাম মনির হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে আট নম্বর কনডেম সেলে যান। জেল সুপার কামারুজ্জামানকে জানিয়ে দেন যে, এটাই আপনার শেষ রাত। রাতেই আপনার ফাঁসি কার্যকর করা হবে। এখন আপনাকে তওবা পড়তে হবে। এ সময় কামারুজ্জামান গোসল ও ওজু করেন। পরে ইমাম সাহেব তাকে তওবা পড়ান। এর আগেই খাওয়া-দাওয়াসহ অন্যসব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করা হয়। কারা চিকিৎসকরা তার শরীরিক পরীক্ষার কাজও সম্পন্ন করেন। এরপর দুজন জল্লাদ প্রবেশ করেন কামারুজ্জামানের সেলে। তাকে পেছনমোড়া করে হাত বাঁধা হয়। তারপর তাকে ফাঁসির মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।
মঞ্চের ওপরে ত্রিপল টাঙানো ও একপাশে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জন্য বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। জল্লাদরা কামারুজ্জামানকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যান। তাকে কালো জমটুপি (মুখমণ্ডল আবৃত) পরানো হয়। এসময় জেল সুপার রুমাল হাতে নিয়ে ফাঁসির মঞ্চের একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। জল্লাদের দৃষ্টি ছিল লাল রুমালের দিকে। আর জেল সুপারের দৃষ্টি ছিল ঘড়ির কাঁটার দিকে। ঠিক ১০টা ১ মিনিটে জেল সুপারের হাত থেকে লাল রুমাল পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন জল্লাদ ফাঁসির মঞ্চের হুইল টেনে দেন।
এদিকে ফাঁসির আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে সন্ধ্যায় আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন, অতিরিক্ত আইজি প্রিজন কর্নেল মুহাম্মদ ফজলুল কবির, ডিআইজি প্রিজন গোলাম হায়দার, ঢাকার জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, ঢাকার জেলা সিভিল সার্জন আবদুল মালেক ভুঁইয়া, ডিএমপি কমিশনারের একজন প্রতিনিধি, পুলিশের লালবাগ জোনের ডিসি মফিজ আহমেদ কারা অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। এছাড়া ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী, জেলার নেছার আলম, কারা হাসপাতালের দুই চিকিৎসক ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস ও ডা. আহসান হাবীব আগে থেকেই কারা অভ্যন্তরে অবস্থান করছিলেন।
ভেতরে-বাইরে কঠোর নিরাপত্তা: কারাগারের যেখানে ফাঁসির মঞ্চ, তার পশ্চিম ও পূর্ব দিকের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ানো ছিল সশস্ত্র কারারক্ষীরা। চারদিক থেকে জ্বালানো ছিল উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বৈদ্যুতিক বাতি। নাজিমউদ্দিন রোডে কারাগারের আশপাশের উঁচু বাড়ির ছাদে ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক পাহারা। সন্ধ্যায় বাড়িওয়ালাদের মৌখিকভাবে কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়। আশপাশ ঘিরে গড়ে তোলা হয় তিন স্তরবিশিষ্ট কড়া নিরাপত্তা বলয়। দুপুরের পরপরই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে থেকে দর্শনার্থীদের সরিয়ে দেয় পুলিশ। আশপাশের সব সড়কে ব্যারিকেড দেয়া হয়। কারাগার এলাকায় বসবাসকারী লোকজন ছাড়া কাউকেই ওই এলাকায় প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। কারাগারের আশপাশে প্রচুরসংখ্যক র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি সদস্য মোতায়েন রাখা হয়। সন্ধ্যায় কারাগারের চারপাশের রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়। ডিএমপির লালবাগ জোনের উপকমিশনার (ডিসি) মফিজ আহমেদ জানান, জামায়াত-শিবিরের নাশকতার আশঙ্কায় রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রায় কার্যকর করা পর্যন্ত নিরাপত্তার স্বার্থে রাস্তা বন্ধ থাকবে।
ফাঁসির মহড়া: জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করতে প্রস্তুত রাখা হয় অন্তত ১০ জল্লাদকে। এরা হলো- রাজু, জনি, কক্সবাজারের বাবুল মিয়া ওরফে মুক্ত, সাভারের কালু মিয়া, ঢাকার ফারুক, মাসুম ও মনির হোসেন। শাহজাহানের একটু বয়স হওয়ায় তাকে এবার রাখা হয়নি। শাজাহানের নেতৃত্বেই ২০১৩ সালের ১২ই ডিসেম্বর কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল। রাজু ও জনি এখন সবচেয়ে সুঠামদেহী। এ কারণে তাদের দিয়েই ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি নেয় কারা কর্তৃপক্ষ। কামারুজ্জামানের আপিলের রায় দেয়ার পরপরই তাদের কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়। কারা সূত্র জানায়, ফাঁসি কার্যকরে তিনজন জল্লাদ মঞ্চে থাকেন। এই তিনজনকে ঠিক এক ঘণ্টা আগে ডেকে নেয়া হয়। আগে থেকে জল্লাদদেরও ফাঁসির কথা জানানো হয় না। জল্লাদ জনি তিনটি মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্ত আসামি। বাড়ি বৃহত্তর ময়মনসিংহে। কাশিমপুর কারাগারেই সেই দণ্ড খাটার সময় মিলেছে জল্লাদ প্রশিক্ষণ। রাজু নামের জল্লাদ কাদের মোল্লার ফাঁসির সময়ও প্যানেলে ছিলেন। কিন্তু সেবার অভিজ্ঞতা নেই বলে তার ডাক পড়েনি। এবার তার নেতৃত্বেই কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে বলে সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। এদিকে কারাসূত্র জানায়, গত কয়েক দিনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে একাধিকবার ফাঁসির মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। এতে জল্লাদদের প্রত্যেকেই অংশ নেন।
গ্রেপ্তার ও বিচার প্রক্রিয়া: ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগের মামলায় ২০১০ সালের ২৯শে জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরই ২রা আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার তদন্ত কর্মকর্তা মো. আবদুর রাজ্জাক খান কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে তদন্ত করেন। তদন্ত শেষে তিনি ২০১১ সালের ৩০শে অক্টোবর প্রসিকিউশনের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই বছর ৫ই ডিসেম্বর কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) ট্রাইব্যুনালে জমা দেন প্রসিকিউশন। তবে সেটি সঠিকভাবে বিন্যস্ত না হওয়ায় আমলে নেয়ার পরিবর্তে ফিরিয়ে দেন ট্রাইব্যুনাল। পরে ২০১২ সালের ১২ই জানুয়ারি প্রসিকিউশন কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে পুনরায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন। ৩১শে জানুয়ারি ৮৪ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগটি আমলে নেন ট্রাইব্যনাল-১। ওই বছরের ১৬ই এপ্রিল চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কামারুজ্জামানের মামলাটি প্রথম ট্রাইব্যুনাল থেকে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ১৬ই মে আসামিপক্ষ এবং ২০শে মে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ করেন। ২০১২ সালের ৪ঠা জুন কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। তার বিরুদ্ধে একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, দেশত্যাগে বাধ্য করাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি অভিযোগ আনা হয়। ২রা জুলাই কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ৮১ পৃষ্ঠার ওপেনিং স্টেটমেন্ট (সূচনা বক্তব্য) উত্থাপন করেন প্রসিকিউটর একেএম সাইফুল ইসলাম ও নূরজাহান বেগম মুক্তা। ২০১২ সালের ১৫ই জুলাই থেকে ২০১৩ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) আবদুুর রাজ্জাক খানসহ রাষ্ট্রপক্ষের মোট ১৮ জন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করেন। তাদের মধ্যে ১৫ জন ঘটনার সাক্ষী হচ্ছেন- ১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি হামিদুল হক, শেরপুরে কামারুজ্জামানের স্থাপন করা আলবদর ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্রের দারোয়ান মনোয়ার হোসেন খান মোহন, বীর মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সী বীরপ্রতীক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকির আবদুল মান্নান, মুক্তিযুদ্ধের শহীদ গোলাম মোস্তফা হোসেন তালুকদারের ছোট ভাই মোশাররফ হোসেন তালুকদার, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামানের বড় ভাই ডা. মো. হাসানুজ্জামান, লিয়াকত আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদের পুত্র জিয়াউল ইসলাম, অ্যাডভোকেট আবুল কাশেম, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সন্তান জালাল উদ্দিন, শেরপুর জেলার ‘বিধবাপল্লী’ নামে খ্যাত সোহাগপুর গ্রামের নির্যাতিত (ভিকটিম) তিন নারী সাক্ষী (ক্যামেরা ট্রায়াল), মুজিবুর রহমান খান পান্নু এবং দবির হোসেন ভূঁইয়া। আর জব্দ তালিকার প্রথম সাক্ষী হলেন- বাংলা একাডেমির সহকারী গ্রন্থাগারিক এজাব উদ্দিন মিয়া ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তথ্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা আমেনা খাতুন। আসামিপক্ষ তাদের জেরা সম্পন্ন করেন।
অন্যদিকে কামারুজ্জামানের পক্ষে ২০১৩ সালের ৬ই থেকে ২৪শে মার্চ পর্যন্ত মোট ৫ জন সাফাই সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। তারা হচ্ছেন- মো. আরশেদ আলী, আশকর আলী, কামারুজ্জামানের বড় ছেলে হাসান ইকবাল, বড় ভাই কফিল উদ্দিন এবং আবদুর রহিম। তাদের জেরা সম্পন্ন করেন রাষ্ট্রপক্ষ। এর আগে ২০১৩ সালের ২রা জানুয়ারি মামলাটির পুনর্বিচারের আবেদন জানান কামারুজ্জামানের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম। ওই বছরের ৩রা জানুয়ারি আবেদনের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন কামারুজ্জামানের আইনজীবী ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিকী। বিপক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর এ কে এম সাইফুল ইসলাম। ৭রা জানুয়ারি এ আবেদন খারিজ করে দেন দুটি ট্রাইব্যুনাল। ওই বছরের ১০ই জানুয়ারি এসব খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করেন। ১৫-১৬ই জানুয়ারি শুনানি শেষে ২১শে জানুয়ারি সেসব আবেদনও ট্রাইব্যুনাল খারিজ করে দেয়ায় মামলাগুলোর বিচারিক কার্যক্রমের সব প্রতিবন্ধকতা দূর হয়।
২০১৩ সালের ২৪শে মার্চ থেকে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত এবং ১৬ই এপ্রিল ৫ কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী, প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট এ কে এম সাইফুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট নুরজাহান বেগম মুক্তা। অন্যদিকে ৩ থেকে ১৬ই এপ্রিল ৪ কার্যদিবসে আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন কামারুজ্জামানের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ও আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিকী।
২০১৩ সালের ১৬ই এপ্রিল বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ায় রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ রাখেন ট্রাইব্যুনাল। ৯ই মে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কামারুজ্জামানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে এবং বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও শাহিনুর ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল ২১৫ পৃষ্ঠার রায়টি ঘোষণা করেন।
আপিল মামলার কার্যক্রম: ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির আদেশ থেকে খালাস চেয়ে ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ৬ই জুন আপিল বিভাগে আপিল করেন কামারুজ্জামান। তবে সর্বোচ্চ সাজা হওয়ায় কামারুজ্জামানের দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করেননি রাষ্ট্রপক্ষ। ১২৪টি যুক্তিতে আপিল করেন আসামিপক্ষ। তাদের মূল আবেদন ১০৫ পৃষ্ঠার। আর এর সঙ্গে ২ হাজার ৫শ’ ৬৪ পৃষ্ঠার আনুষঙ্গিক কাগজপত্র জমা দেয়া হয়। ২০১৩ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর আপিলের সার-সংক্ষেপ জমা দেন আসামিপক্ষ। সে সময়কার প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন নিজে এ আপিল মামলার শুনানিতে না থেকে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি (বর্তমান প্রধান বিচারপতি) এস কে সিনহার নেতৃত্বে ৪ সদস্যের পৃথক আপিল বেঞ্চ গঠন করে দেন। বেঞ্চের অন্য তিন সদস্য হচ্ছেন বিচারপতি আবদুল ওহাব মিয়া, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী। এ বেঞ্চে গত বছরের ৫ই জুন থেকে আপিল শুনানি শুরু হয়। ওই দিন থেকে মোট ১৭ কার্যদিবসে আপিল শুনানি শেষ হয়। এর মধ্যে গত বছরের ৯ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ও ১৭ই সেপ্টেম্বর ১৫ কার্যদিবসে আসামিপক্ষে শুনানি করেন কামারুজ্জামানের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহাবুব হোসেন, এসএম শাহজাহান ও অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম। অন্যদিকে গত বছরের ৯ই সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষে ৪ কার্যদিবস শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। আপিল শুনানি শেষ হওয়ায় গত বছরের ১৭ই সেপ্টেম্বর আপিল মামলাটির রায় অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন আপিল বিভাগ। ৩রা নভেম্বর কামারুজ্জামানকে ট্রাইব্যুনাল-২ এর দেয়া মৃতুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে চূড়ান্ত রায় সংক্ষিপ্ত আকারে দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ।
গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি কামারুজ্জামানের এ ফাঁসির রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। ওইদিন দুপুরে চার বিচারপতি রায়ে স্বাক্ষর দেয়া শেষ করলে ৫৭৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ করা হয়।
লাল কাপড়ে মোড়ানো মৃত্যু পরোয়ানা: পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি রাতেই আপিল বিভাগ থেকে ফাঁসির রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পৌঁছে দেয়া হয় বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মোস্তাফিজুর রহমান পূর্ণাঙ্গ রায় গ্রহণ করে মৃত্যু পরোয়ানা জারির প্রক্রিয়া শুরু করেন। পরদিন ১৯শে ফেব্রুয়ারি চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ ট্রাইব্যুনাল-২ এর ৩ বিচারপতি মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করেন। এরপর লাল কাপড়ে মোড়ানো মৃত্যু পরোয়ানা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। মৃত্যু পরোয়ানার সঙ্গে আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপিও পাঠান ট্রাইব্যুনাল। কারাগারে পৌঁছানোর পর কামারুজ্জামানকে মৃত্যুপরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়। তিনি আইনজীবীর সঙ্গে আলাপ করে রিভিউ আবেদন করার সিদ্ধান্ত নেন।
রিভিউ মামলার কার্যক্রম: আইন অনুসারে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের দিন থেকে রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করার জন্য ১৫ দিনের সময় পান আসামিপক্ষ। সে অনুসারে গত ৫ই মার্চ আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিভিউ আবেদন দাখিল করেন কামারুজ্জামানের আইনজীবীরা। পরে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার বিচারপতির আদালতে শুনানির দিন ধার্যের আবেদন জানান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৪ঠা মার্চ চেম্বার বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী রিভিউ আবেদনটি শুনানির জন্য পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। মোট ৭০৫ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে ৪৪টি যুক্তি দেখিয়ে কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বাতিল ও তার খালাস চান আসামিপক্ষ। আসামিপক্ষের সময়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুই দফায় পিছিয়েছে শুনানির দিন। গত ৯ই মার্চ শুনানির জন্য কার্যতালিকায় এলে প্রথমবার চার সপ্তাহের সময়ের আবেদন জানান আসামিপক্ষ। এর কারণ হিসেবে খন্দকার মাহবুব হোসেনের ব্যক্তিগত অসুবিধার কথা বলা হয়েছিল। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি পিছিয়ে গত ১লা এপ্রিল পুনর্নির্ধারণ করেন সর্বোচ্চ আদালত। ১লা এপ্রিল কামারুজ্জামানের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন অসুস্থ বলে উল্লেখ করে ফের চার সপ্তাহের সময়ের আবেদন জানানো হয়। ওই দিন চার দিন পিছিয়ে রোববার (৫ই এপ্রিল) দিন পুনর্নির্ধারণ করেন আপিল বিভাগ। অবশেষে ৫ই এপ্রিল সকালে শুনানি শেষ হলে ৬ই এপ্রিল রায়ের দিন ধার্য করেন সর্বোচ্চ আদালত। আসামিপক্ষে কামারুজ্জামানের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন এবং রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানি করেন। ৬ই এপ্রিলের রায়ে আপিল বিভাগ রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়ায় কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় চূড়ান্তভাবে বহাল থাকে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিয়া, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী। ৭ই এপ্রিল চূড়ান্ত এ রায়ের খসড়া লেখা শেষ করেন বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী। ৮ই এপ্রিল দুপুর নাগাদ চার বিচারপতি মিলে সেটি চূড়ান্ত করে ৩৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর করেন। এরপর সেটি যায় ট্রাইব্যুনাল হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।

No comments

Powered by Blogger.