বুহারি নিজের পথ ঠিক করে ফেলেছেন by অ্যাডাম নসিটার

নাইজেরিয়ার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদু বুহারি গত বুধবার অভ্যর্থনা বক্তব্য দেন, সে সময় তাঁর মুখে হাসি দেখা যায়নি। বোধগম্যভাবেই সন্ত্রাসবাদ ও দুর্নীতির প্রসঙ্গই তাঁর বক্তৃতায় উঠে এসেছে। ভোটের লড়াইয়ে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে বুহারি নাইজেরিয়ার জন্য অসাধারণ নজির স্থাপন করলেন: ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর। যদিও এই বুহারি একসময় সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন।
সেই বক্তৃতায় বুহারি বলেছেন, কাগজে-কলমে ও বাস্তবে উভয় ক্ষেত্রেই নাইজেরিয়া এখন গণতান্ত্রিক দেশ। কারণ, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ঠিকঠাক কাজ করেছে বলেই তিনি এই বক্তৃতা দিতে পেরেছেন।
আবার দেশটির রাজধানী আবুজায় দেওয়া সেই বক্তৃতায় বুহারি নাইজেরিয়ার মতো বিশাল গণতান্ত্রিক দেশে দুটি বিষফোড়ার কথা উল্লেখ করেছেন: জঙ্গি সংগঠন বোকো হারামের নির্মম সহিংসতা ও তাঁর ভাষায় ‘দুর্নীতির দুষ্ট ক্ষত’। বুধবারের সেই বক্তৃতায় তিনি বোকো হারামের চেয়ে দুর্নীতিতেই বেশি জোর দিয়েছেন। এর মধ্যে সম্ভবত বোকো হারাম যে সামরিক হুমকি হয়ে উঠছে, সেই সত্যের প্রতি এক যুদ্ধপ্রবীণ ব্যক্তির তাচ্ছিল্যের ভাব রয়েছে।
যদিও বোকো হারাম হাজার হাজার মানুষ হত্যা করেছে এবং দেশের বিশাল ভূমি দখল করেছে, বুহারি গত জানুয়ারিতে নির্বাচনী প্রচারণাপর্বে এক সাক্ষাৎকারে খোলাখুলিভাবে ওই সংগঠনসংক্রান্ত সব শঙ্কা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। এমনকি তিনি এই সংগঠনের লড়াইয়ের সক্ষমতা নিয়েও তাচ্ছিল্য করেছেন। বক্তৃতায় বুহারি বলেছেন, ‘বোকো হারাম খুব শিগগির আমাদের সম্মিলিত ইচ্ছার শক্তি সম্পর্কে জানতে পারবে। তাদের না হারানো পর্যন্ত আমরা থামব না। যা করা দরকার, সবই করব।’ বাস্তবে বোকো হারাম ইসলামিক স্টেটের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করলেও এই জানুয়ারিতে তারা যতটা ভয়ংকর ছিল, এখন আর ততটা নয়।
অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি শক্তির সম্মিলিত অভিযানে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বোকো হারামের যে দখল ছিল, তা অনেকাংশে কমে গেছে। চাদের সেনাবাহিনী বোকো হারামের দখলে থাকা বেশ কয়েকটি সীমান্ত শহর পুনর্দখল করেছে, আর নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনী দক্ষিণ আফ্রিকার ভাড়াটে বাহিনীর সহায়তায় আরও কিছু শহর নিজেদের দখলে এনেছে।
নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনী দাবি করছে, বোকো হারাম অধিকৃত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সব অঞ্চলই—স্থানীয় সরকারের অঞ্চল—তারা নিজেদের দখলে এনেছে। তাদের এ দাবির সত্যতা নিরূপণ করা কঠিন। কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে গাওজাসহ আরও অনেক এলাকাই মাসের পর মাস বোকো হারামের দখলে ছিল।
কিন্তু বুহারির জন্য আরও চ্যালেঞ্জের কারণ হচ্ছে, সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রবাহিত ক্ষয়িষ্ণু ধারা: উচ্চপর্যায়ে দুর্নীতি, নৈতিকতার নিম্নমান, প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র না থাকা। কারণ, ছয় বিলিয়ন ডলারের সামরিক বাজেটের সিংহভাগই ভিন্ন খাতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, যে কারণে বোকো হারামের উত্থান হয়েছে।
আবুজায় এক কূটনীতিক বলেছেন, ‘তাঁদের সমস্যা প্রাতিষ্ঠানিক, এটা ঠিক করতে অনেক সময় লেগে যাবে।’ যদিও তাঁর কথা বলার এখতিয়ার ছিল না। বোকো হারামকে পরাজিত করতে ভাড়াটে সৈন্য নিয়োগ করা আসলে ‘স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি সমাধান, যতক্ষণ না তারা অন্য বিষয়গুলো আমলে নিতে পারছে’। সেই কূটনীতিক বলেছেন।
সাক্ষাৎকারে বুহারি বোকো হারামবিরোধী অভিযানে বিদেশি সেনা ব্যবহারে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁর হাতে আর বিকল্প নেই। তবে সেনাবাহিনীতে কমান্ড ঘাটতি দূর করাই তাঁর জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ হবে। এ কারণে মাঠে বোকো হারামের সঙ্গে লড়াইয়ে নাইজেরিয়া প্রভূত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বোকো হারামের সঙ্গে চলমান লড়াইয়ের বয়স প্রায় ছয় বছর।
আবার নাইজেরীয় সেনাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এজমালি অভিযোগ আছে। সেনারা ব্যাপক হারে নাগরিকদের হত্যা ও বন্দী করেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে লন্ডনের চিন্তক প্রতিষ্ঠান চ্যাটহ্যাম হাউসে বুহারি বলেছেন, ‘এ লড়াইয়ে আমাদের যে নেতৃত্ব প্রয়োজন, সেটাই আমাদের নেই।’ তবে সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্তাদের সরানোর ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করবেন বলেই তিনি জানিয়েছেন। এই বোকো হারামের কারণেই বুধবারের বক্তৃতায় বুহারি দুর্নীতির সমস্যায় নজর ফিরিয়েছেন, তাঁর ভাষায় ‘দুর্নীতি আমাদের জাতীয় চরিত্রকে ছিন্নভিন্ন’ এবং ‘আমাদের অর্থনীতি বিকৃত করেছে’।
বুহারি পরিষ্কার করে বলেছেন, তেলের পড়তি দামের পাশাপাশি দুর্নীতিও সে দেশের শীর্ষ অর্থনৈতিক সমস্যা: ‘দুর্নীতি এক অবৈধ কিন্তু বলশালী শক্তি, এটা শিগগিরই আমাদের গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করবে।’ তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘আমাদের দেশের অর্থনৈকি উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের জীবনের জন্য এই হুমকি নস্যাৎ করা হবে।’
চ্যাটহ্যাম হাউসে বুহারি প্রস্তাব দিয়েছেন, তিনি যেটাকে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন, সেটাই হবে দেশের তীব্র অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবিলার প্রথম পদক্ষেপ। সরকারের রাজস্বের ৭০ শতাংশই আসে তেল থেকে, সেই তেলের দাম পড়ে গেছে। ডলারের বিপরীতে গত ছয় মাসে নাইজেরিয়ার মুদ্রার মান পড়েছে ২০ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারে টান পড়েছে, আর আপৎকালীন সময়ের জন্য তেলের টাকা থেকে যে তহবিল তৈরি করা হয়েছিল, সেটাও নয়ছয় করা হয়েছে।
‘রাজস্ব কমতে থাকার পরিপ্রেক্ষিতে নাইজেরিয়ার অর্থনীতিকে নতুন জায়গায় দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে দুটি দুষ্ট ক্ষতের উপশম করতে হবে, যা বর্তমান প্রশাসনের জামানায় ফুলেফেঁপে উঠেছে: অপচয় ও দুর্নীতি।’ চ্যাটহ্যাম হাউসে বুহারি এ কথাই বলেছেন। অনেক অর্থনীতিবিদই বলেছেন, প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে এটা ঠিক আছে। লাগোসের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ প্যাট উতোমির কথা হচ্ছে, ‘দুর্নীতি কমাতে পারলে কাজ করা সম্ভব। আমাদের এবারের বাজেটে প্রেসিডেন্টের জন্য জেট বিমান কেনার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু নাইজেরিয়ার অনেক বিমান সংস্থার কাছেই প্রেসিডেন্টের বহরের সমান জেট বিমান নেই।’
আরেক অর্থনীতিবিদ বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের এক সাম্প্রতিক পত্রে নাইজেরিয়া সম্বন্ধে বলা হয়েছে, ‘দেশটি গভীরভাবে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত’। ফলে সেখানে বুহারির এই দুর্নীতিবিরোধী ডাকে সাড়া পাওয়া কঠিন হবে। নতুন প্রেসিডেন্ট যে ‘জবাবদিহি, অখণ্ডতা ও সততার’ ওপর জোর দিয়েছেন, এর ফলে নাইজেরিয়ার অর্থনীতিতে যে জিনিসটির অভাব ছিল, সেটাও পূরণ হয়ে যাবে।
হ্যাঁ, নাইজেরিয়ার রাজনীতিকেরা দুর্নীতি বন্ধের আহ্বান আগেও জানিয়েছেন। হয় তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন বা পরবর্তীকালে নিজেরাই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়েছেন। বুহারি তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন, এমনটা ভাবার কিছু কারণও হয়তো আছে। ১৯৮৪-৮৫ সালে সামরিক শাসক থাকার সময় তিনি ধনী হননি। আর যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল, তাঁদের তিনি দৌড়ের ওপর রেখেছেন।
‘এই প্রশাসন দুর্নীতি সহ্য করবে না, দুর্নীতি আমাদের দেশের জন্য সম্মানের ব্যাপার নয়, এটা থাকতে দেওয়া হবে না।’ বুধবার তিনি এ কথা বলেছেন।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; দ্য নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া
অ্যাডাম নসিটার: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস–এর পশ্চিম আফ্রিকা ব্যুরো–প্রধান।

No comments

Powered by Blogger.