পাকিস্তান সংকটের ময়নাতদন্ত
পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে বিক্ষোভরত পিটিআই ও পিটিএর কর্মী-সমর্থকেরা গতকাল লাঠিসোঁটা নিয়ে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন পিটিভির কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর চালান। রয়টার্স |
পাকিস্তানে সরকারবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা আপাতত সুনির্দিষ্টভাবে বলা অসম্ভব। তবে এ পর্যন্ত যা যা ঘটে গেল তার একটি ময়নাতদন্ত এখনই করে ফেলা যায়। চলমান সংকটে চারটি পক্ষ স্পষ্ট। পক্ষগুলো হলো: প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও পাকিস্তান মুসলিম লিগ (পিএমএল-এন), পার্লামেন্টের তৃতীয় বৃহত্তম দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) ও ইমরান খান, পাকিস্তান আওয়ামী তেহরিক (পিএটি) ও তাহির-উল কাদরি এবং দেশটির সেনাবাহিনী। গত বছর অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনে স্বস্তিদায়ক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসেন নওয়াজ। এক বছরের মাথায় চলমান এই সংকটের জন্য নওয়াজ সরকারের অব্যবস্থাপনা ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলেরও দায় আছে। প্রথম বছরেই কিছু ভুল করেছে সরকার। যার অন্যতম হলো, ইমরানের ভোট জালিয়াতির অভিযোগকে সেভাবে পাত্তা না দেওয়া। ইমরানের অভিযোগ নিয়ে সরকারের এ অবস্থান যদিও আইনগতভাবে এখন পর্যন্ত ঠিকই আছে। কারণ, ভোট জালিয়াতির বিষয় নিয়ে কাজ করার কথা নির্বাচন কমিশনের তথা নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের। এ কারণেই হয়তো সরকার ইমরানের অভিযোগ আনুষ্ঠানিক ও আইনি-প্রক্রিয়ার ওপর ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু এটা না করে সরকার একটি কমিটি বা কমিশন গঠন করে অভিযোগ খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে পারত। এ ধরনের ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেই রাজপথে নামার সুযোগ পেয়েছেন ইমরান।
সরকারের আরেক ভুল হলো, পিএটির নেতা কাদরির বিরুদ্ধে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখানো। গত ১৭ জুন লাহোরে বিক্ষোভের সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে কাদরির ১১ নেতা-কর্মী নিহত হন। এতে নৈতিকভাবে এবং আইনগতভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে সরকার। ওই ঘটনার পর পুলিশ পিএটির এফআইআর নেয়নি। যদিও কয়েক দিন আগে আদালতের নির্দেশের পর সরকার জানায়, এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে এফআইআর করতে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। অথচ সরকার এটা আগেই করতে পারত। নওয়াজ সরকারের শেষ ভুল হলো, পার্লামেন্টে আলোচনা না করে সংকট মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর মধ্যস্থতা চাওয়া। গত কয়েক দিনে সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে চলেছেন নওয়াজ। রাজনীতিবিদ ইমরান বারবার তাঁর লক্ষ্য পাল্টান। কারও কারও আশঙ্কা, ইমরানের আন্দোলন দেশটিতে টানা ছয় বছরের গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতায় ছেদ টানতে পারে। ভোট জালিয়াতির অভিযোগ তুললেও প্রধানমন্ত্রী নওয়াজের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ আনতে পারেননি ইমরান। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এবং তা প্রমাণ হওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে অনড় অবস্থান নেওয়াটা কতটা ঠিক, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। ইমরান আন্দোলনে নামার আগে পার্লামেন্টের অন্য কোনো দলের সমর্থন জোগাড় করেননি। কোনো জোটও গড়েননি।
বারবার গণতন্ত্র শক্তিশালী করার কথা বললেও, একাই আন্দোলনে নামা এবং পার্লামেন্টে থেকে দাবি আদায়ের জোর চেষ্টা না করাটা ইমরানের ঠিক হয়নি বলে মনে করেন কেউ কেউ। কাদরি বিপ্লবের ডাক দিয়েছেন। কিন্তু লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট করেননি। তিনি ‘পদ্ধতিগত পরিবর্তনের’ দাবি তুলেছেন। কিন্তু কোথায়, কীভাবে তা করা হবে, তা প্রকাশ করেননি। তবে লাহোরে তাঁর ১১ নেতা-কর্মীর নিহত হওয়ার ঘটনা এবং পুলিশ এফআইআর না নেওয়াকে কেন্দ্র করে সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভ অনেকের চোখেই যৌক্তিক। চলমান সংকটের পেছনে সেনাবাহিনীর হাত রয়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ। সাবেক সেনাশাসক পারভেজ মোশাররফকে বিচারের মুখোমুখি করা, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টাসহ বিভিন্ন কারণে নওয়াজের প্রতি নাখোশ সেনাবাহিনী। এ কারণে নওয়াজকে বাগে আনতে তারা ইমরানকে ব্যবহার করছে বলেও মনে করা হয়। এখন সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক উন্নয়নে ব্যর্থতা বা টানা ছয় বছরের গণতান্ত্রিক অর্জন ধরে রাখতে ব্যর্থতার জন্য সরকারকে দোষারোপ করা হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কোনটা নৈতিকভাবে ঠিক এবং কোনটা আইনগতভাবে বৈধ, তা বিবেচনা করার মতো পরিস্থিতি যেন এই মুহূর্তে পাকিস্তানে নেই।
No comments