এ কে খন্দকারের ভেতরে বাইরে
একাত্তরে
যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন এ কে খন্দকার ছিলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর
ঢাকা ঘাঁটির সেকেন্ড ইন কমান্ড। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে ১৫ই মে ত্রিপুরার
মতিননগরে পৌঁছার পর মুজিবনগর সরকার তাকে মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি
নিয়োগ করে। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও রণাঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
রাখেন তিনি। এক পর্যায়ে নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ বিমান
বাহিনী, তারপর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালনা করেন
উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সফল অভিযান। ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তিনিই ছিলেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি। মুক্তিযুদ্ধে
অবদান রাখায় ১৯৭২ সালে তাকে ভূষিত করা হয় বীর উত্তম খেতাবে। স্বাধীনতার পর এ
কে খন্দকার হন বিমান বাহিনীর চিফ অব এয়ার স্টাফ। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন
বাংলাদেশ বিমানের চেয়ারম্যান। ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তিনিই প্রথম
প্রতিবাদ স্বরূপ সরকারি পদ ত্যাগ করেন। ১৯৭৬-৮২ সালে অস্ট্রেলিয়ার এবং
১৯৮২-৮৬ সালে ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলেন তিনি। পরে ১৯৮৬-৯০ সালে হন
পরিকল্পনা মন্ত্রী। ১৯৯৮ ও ২০০১ সালে নির্বাচনে পাবনা-২ থেকে সংসদ সদস্য
নির্বাচিত হন এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার। ২০১১ সালে আবার
পরিকল্পনা মন্ত্রী হন তিনি। ২০১১ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয় তাকে।
২০০১-০৬ সালে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম গঠন এবং এতে নেতৃত্ব দিয়ে
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। এত সব
গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের ফাঁকে ফাঁকে লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের
স্মৃতিকথা। ‘১৯৭১ ভেতরে বাইরে’ শীর্ষক সেই স্মৃতিকথা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত
হয়েছে গতকাল। এতে মুক্তিযুদ্ধকালের জানা-অজানা কাহিনী ও তথ্য নিজস্ব
অভিজ্ঞতার আলোকে তুলে ধরেছেন তিনি। স্বভাবই এসেছে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে
স্বাধীনতা ঘোষণার প্রসঙ্গ। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বইটিতে ওই
প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, কোন মাধ্যমে বা চিরকুট পাঠিয়ে বঙ্গবন্ধু যে
স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে, ২৫শে মার্চ রাতে তার
ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মীরা প্রায় শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে ছিলেন। অথচ তারা কেউ কিছু
আঁচ করতে পারবেন না বা জানতে পারবেন না, এটা তো হয় না। তবে কি তিনি তাদের
বিশ্বাস করতে পারেন নি? এটা তো আরও অবিশ্বাস্য। বঙ্গবন্ধু যদি স্বাধীনতার
ঘোষণা দেবেনই, তবে তিনি ৩২ নম্বর সড়কের বাসায় থাকবেনই বা কেন?
এ
কে খন্দকার আরও লিখেছেন, স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে কাউকে
কিছু বলেননি বলেই আমি জানি। অনেকে বলেন, বঙ্গবন্ধু ২৫শে মার্চ রাতে এক
হাবিলদারের মারফত চিরকুট পাঠিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আবার বলা হয়,
বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীকে স্বাধীনতার
ঘোষণা দেয়ার জন্য পাঠিয়েছিলেন। কোথাও কোথাও এমনও উল্লিখিত হয়েছে যে
বঙ্গবন্ধু ইপিআরের বেতারযন্ত্রে বা ডাক ও তার বিভাগের টেলিগ্রামের মাধ্যমে
স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তাটি প্রচার করেন। এগুলোর কোন যুক্তিসংগত প্রমাণ আমি
কোথাও পাইনি। আর যা প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয় তার বিশ্বাসযোগ্যতা
খুঁজে পাইনি। কোন যুক্তিতে বঙ্গবন্ধু চিরকুট পাঠাবেন, যেখানে প্রকাশ্যে
স্বাধীনতা ঘোষণায় তাঁর কোন বাধাই ছিল না। বলতে গেলে মার্চ মাসের শুরু থেকে
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই দেশ চলেছে। ২৩শে মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবসেও সারা
দেশে দু’-চারটা সরকারি ভবন ছাড়া কোথাও পাকিস্তানি পতাকা ওড়েনি, বরং সবাই
স্বাধীন বাংলার পতাকা অথবা কালো পতাকা উড়িয়েছে। এ ধরনের অনুকূল পরিবেশ থাকা
সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু কেন গোপনে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে যাবেন? স্বাধীনতার
ঘোষণা করতে চাইলে তিনি তো জনগনের পাশে থেকেই তা করতে পারতেন। তাঁর মতো
সাহসী এবং ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় নেতার স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে রাতের
অন্ধকারের প্রয়োজন হয় না। আমরা যতদিন যুদ্ধ করেছি, ততদিন পর্যন্ত এ চিরকুট
পাঠানোর কথা শোনা যায়নি। বরং আমরা সবাই আলোচনা করতাম যে বঙ্গবন্ধু কেন
স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলেন না, দিলে কি ক্ষতি হতো ইত্যাদি। এ কে খন্দকার
লিখেছেন, ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যখন ঢাকা ছেড়ে চলে যান,
তখন একটা চরম সংকটপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়। সবাই ভাবতে থাকেন এখন আমাদের কি
করণীয়। এ সময় তাজউদ্দীন আহমদসহ আরও কিছু নেতা বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২
নম্বর বাড়িতে সমবেত ছিলেন। সেখানে এক ফাঁকে তাজউদ্দীন আহমদ একটি
টেপ-রেকর্ডার এবং স্বাধীনতার ঘোষণার একটি খসড়া বঙ্গবন্ধুকে দেন এবং তাঁকে
তা পড়তে বলেন। কিন্তু তিনি তা পড়েননি। এ ঘটনা স্বয়ং তাজউদ্দীন আহমদ
সাংবাদিক ও লেখক মঈদুল হাসানকে বলেছিলেন।
এ কে খন্দকারের বর্ণনায়, মুক্তিযুদ্ধকালে আমিও একদিন তাজউদ্দীন আহমদকে ২৫শে মার্চের রাতের ঘটনা নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তাজউদ্দীন আহমদ স্বীকার করেছিলেন, সেই খসড়া ঘোষণাটি তাঁর নিজের লেখা ছিল এবং তিনি বঙ্গবন্ধুকে খসড়া ঘোষণাটি পাঠ করার প্রস্তাব করেছিলেন। লেখাটা ছিল সম্ভবত এই রকম: ‘পাকিস্তানি সেনারা আমাদের আক্রমণ করেছে অতর্কিতভাবে। তারা সর্বত্র দমননীতি শুরু করেছে। এই অবস্থায় আমাদের দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এবং আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলাম।’ তাজউদ্দীন সাহেব আরও বলেন, এই খসড়া ঘোষণাটা শেখ মুজিবুর রহমানকে দেয়ার পর সেটা তিনি পড়ে কোন কিছুই বললেন না, নিরুত্তর রইলেন। অনেকটা এড়িয়ে গেলেন।
পরবর্তী সময়ে মঈদুল হাসানের কাছ থেকে জানতে পারি, বঙ্গবন্ধুকে তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘মুজিব ভাই, এটা আপনাকে বলে যেতেই হবে। কেননা কালকে কি হবে, যদি আমাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়? তাহলে কেউ জানবে না যে আমাদের কি করতে হবে? এই ঘোষণা কোন গোপন জায়গায় সংরক্ষিত থাকলে পরে আমরা ঘোষণাটি প্রচার করতে পারবো। যদি বেতার মারফত কিছু করা যায়, তাহলে সেটাও করা হবে।’ বঙ্গবন্ধু তখন প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, ‘এটা আমার বিরুদ্ধে একটা দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের বিচার করতে পারবে।’ এ কথায় তাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে সম্ভবত রাত নয়টার পরপরই ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ছেড়ে চলে যান। অবাক করার বিষয় হলো, পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা ঘোষণার সেই ছোট্ট খসড়াটি, যা তাজউদ্দীন আহমদ তৈরি করেছিলেন, তার প্রায় হুবহু একটি নকল বঙ্গবন্ধুর ২৬শে মার্চের ঘোষণা হিসেবে প্রচার হতে দেখি। ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত পত্রপত্রিকাতেও তাজউদ্দীনের সেই খসড়া ঘোষণার কথাগুলো ছাপা হয়েছিল। ২৫শে মার্চ রাতে যখন পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের আক্রমণ করে, সেই রাতেই শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাটি জনসম্মুখে কিভাবে এলো? ২৬শে মার্চ তারিখে তো সারা দেশেই সান্ধ্য আইন ছিল। আওয়ামী লীগের তরুণ কর্মী এবং ছাত্রলীগের নেতারা স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুকে মার্চ মাসে বেশ চাপ দিচ্ছিল। ধারণা করা যায়, সেই সময় তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর খসড়াটি তাঁদের দিয়েছিলেন এবং এদের মাধ্যমে যদি এটা স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে প্রচারিত হয়ে থাকে, তাহলে আমি বিস্মিত হবো না।
পরবর্তী সময়ে ঘটনার প্রায় এক বছর পর আরেকটা কথা প্রচার করা হয় যে, ধবংসযজ্ঞ শুরু হওয়ার ঠিক আগে শেখ সাহেব ইপিআরের বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন। এই তথ্যটি মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রথমত, সামরিক বাহিনীতে থাকার ফলে আমি জানি যে, সিগন্যাল সেন্টার বা বার্তাকেন্দ্র সব সময় অত্যন্ত বিশ্বাসী লোক দ্বারা পরিচালনা করা হয়। সিগন্যালই কোনও বাহিনীর প্রতিরক্ষা ও আক্রমণের মূল যোগাযোগমাধ্যম। সেখানে তো বিশ্বাসীদের বাদ দিয়ে সন্দেহের পাত্র বাঙালিদের হাতে সিগন্যাল ব্যবস্থা থাকতে পারে না। বাস্তবেও পাকিস্তানি বাহিনী আগে থেকেই পিলখানায় ইপিআরের বেতারকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রেখেছিল। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধু যার মারফত এই ঘোষণা ইপিআরের বার্তাকেন্দ্রে পাঠিয়েছিলেন, সেই ব্যক্তি স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও জনসমক্ষে এলেন না কেন? বঙ্গবন্ধুও তার জীবদ্দশায় কখনও সেই ব্যক্তির নাম প্রকাশ করেননি কেন? একই ভাবে চট্টগ্রামের ইপিআর বেতার কেন্দ্র থেকে কে, কিভাবে জহুর আহমেদকে বার্তাটি পাঠালেন, তা রহস্যাবৃতই থেকে গেছে। কাজেই ইপিআরের বার্তাকেন্দ্র ব্যবহার করে শেখ সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন- এটা সম্ভবত বাস্তব নয়। দ্বিতীয়ত, জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এমন কোন সংবাদ আমরা শুনিনি। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের জুন মাসে বাংলাদেশের নেতারা স্বীকৃতিদানের প্রশ্নে ভারত সরকারকে বেশ চাপ দেয়া শুরু করেন। ভারত সরকার বাংলাদেশ মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও অন্য প্রধান নেতাদের জিজ্ঞেস করে, শেখ মুজিবুর রহমান কি স্বাধীনতার প্রশ্নে কাউকে কিছু বলে গেছেন? তারা আরও জানতে চান যে স্বাধীনতার ঘোষণার কোন প্রমাণ, কোন দলিল, কোন জীবিত সাক্ষ্য আমাদের কাছে আছে কি না? এসময় জহুর আহমেদ চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। প্রত্যেকেই বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু কাউকে স্বাধীনতার ঘোষণার কথা বলে যাননি। জহুর আহমেদ চৌধুরী নিজে তাজউদ্দীনকে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু তাঁকে কিছু বলে যাননি। ইপিআরের বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠান- এ দাবিটি প্রচার শুরু হয় ১৯৭২ সালে। এর আগে এটি শোনা যায়নি। অথচ ২৫শে মার্চ রাত সাড়ে ১২টায় টেলিযোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে শেখ মুজিব চাইলে শুধু একটি ফোন করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (এখন রূপসী বাংলা) ভিড় করা যে কোন বিদেশী সাংবাদিককে স্বাধীনতার ঘোষণার কথা জানাতে পারতেন। তাহলে মূহর্তের মধ্যে সেটি সারা পৃথিবীতে প্রচার পেয়ে যেতো। বেশ পরে স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়ে আরেকটি তথ্য প্রকাশ পায়। এতে বলা হয় যে বঙ্গবন্ধু টেলিগ্রামের মাধ্যমে কাউকে কাউকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন। সেই ঘোষণার একটি কপি কিছুদিন আগে পত্রিকায় ছাপানো হয়। এই ঘোষণায় পাওয়া বিবৃতি আগের ঘোষণা থেকে পৃথক। ঘোষণা সংবলিত টেলিগ্রামটি হাতে লেখা এবং প্রাপকের স্ত্রী দাবি করেছেন যে এটি বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে লেখা। মিথ্যা প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় সাধারণ বিবেচনা ও জ্ঞানও রহিত হয়ে যায়। টেলিগ্রাম যে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে পাঠানো হয় এবং এখানে প্রেরকের হাতের লেখা প্রাপকের কাছে যায় না, তা তারা ভুলে যান।
২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তান বাহিনীর অভিযানের পর ইস্ট পাকিস্তান রেডিওর চট্টগ্রাম কেন্দ্রের বাঙালি কর্মকর্তারা বেতারের মাধ্যমে কিছু করার পদক্ষেপ নেন। চট্টগ্রামে সান্ধ্য আইনের মধ্যেই তাঁরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে সেখান থেকে কিছু প্রচার করতে উদ্যোগী হন। সেখানকার বেতার কেন্দ্রের বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে বেতারে কিছু-না-কিছু বলা অত্যন্ত প্রয়োজন। তাঁরা সবাই মিলে স্বাধীনতার ঘোষণার একটা খসড়া তৈরি করেন। ২৬শে মার্চ বেলা দুইটায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে গিয়ে তাঁরা সেই খসড়াটি নিজেদের কন্ঠে প্রচার করেন। পরবর্তী সময়ে সেই ঘোষণা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান পাঠ করেন। তাঁর ভাষণটি সেদিন সাড়ে চারটা-পাঁচটার দিকে পুনঃপ্রচার করা হয়। তাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে- এমন কথা বলা হয়েছিল। তবে প্রথম যে ঘোষণাটি পাঠ করা হয়েছিল, তার থেকে পরবর্তী সময়ে পাঠ করা ঘোষণাটি একটু আলাদা ছিল। এ সময় বেতারের কর্মীরা দু’টি বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। প্রথমত, যদি কোন সামরিক ব্যক্তিকে দিয়ে এই কথাগুলো বলানো যায়, তাহলে এর প্রভাব আরও ব্যাপক হবে। দ্বিতীয়ত, নতুন চালুকৃত বেতার কেন্দ্রটির নিরাপত্তা প্রদানের জন্য সামরিক বাহিনীর লোক প্রয়োজন। তাঁরা জানতে পারলেন, সেনাবাহিনীর বাঙালি সৈনিকেরা চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে বিদ্রোহ করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ করছেন। তাঁরা খোঁজ নিয়ে আরও জানতে পারেন যে মেজর জিয়াউর রহমান নামের একজন উধর্বতন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অন্যান্য কর্মকর্তা, সৈনিকসহ পটিয়ায় রয়েছেন। ২৭শে মার্চ সকাল ১০টার দিকে এসব বেতারকর্মী পটিয়ায় যান। তাঁরা মেজর জিয়াকে বেতার কেন্দ্রের প্রতিরক্ষার জন্য কিছু বাঙালি সেনাসদস্য দিয়ে সাহায্য করার অনুরোধ জানান। মেজর জিয়া সঙ্গে সঙ্গে এ ব্যাপারে সম্মতি দেন। এ সময় তাঁদের মধ্যে কেউ একজন মেজর জিয়াকে অনুরোধ করে বলেন, কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার একটি ঘোষণা তিনি পড়তে রাজি আছেন কিনা। মেজর জিয়া বেশ আগ্রহের সঙ্গে এই প্রস্তাবে রাজি হন। তিনি পটিয়া থেকে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে এসে প্রথম যে ঘোষণা দিলেন, সেটা ভুলভাবেই দিলেন। কারণ, তিনি প্রথম ঘোষণায় নিজেকে প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা করেছিলেন। পরে সংশোধন করে মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। সেটি টেপে ধারণ করা হয় এবং ২৭শে মার্চ সন্ধ্যার কিছু আগে তা পুনঃপ্রচার করা হয়। আর এভাবেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশ ঘটলো। রেডিওতে আমি মেজর জিয়ার ঘোষণা শুনেছি। ওই সময় আমি জিয়াকে চিনতাম না। তবে এই ঘোষণায় আমি স্বস্তিবোধ করলাম এবং আশ্বস্ত হলাম যে অন্তত মেজর পর্যায়ের একজন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা এই যুদ্ধে জড়িত হয়েছেন। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, ২৭শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতারের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজ উদ্যোগে মেজর জিয়ার কাছে গিয়েছেন এবং তাঁকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। মেজর জিয়া নিজস্ব উদ্যোগে তাঁদের কাছে আসেননি। এটা ঠিক জিয়া তাঁদের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু তিনি নিজে স্বপ্রণোদিত হয়ে ব্যক্তিগতভাবে এ উদ্যোগ নেননি। মেজর জিয়ার ঘোষণাটিকে কোনভাবেই স্বাধীনতার ঘোষণা বলা চলে না। মেজর জিয়া রাজনৈতিক নেতাও ছিলেন না বা স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার মতো উপযুক্ত ব্যক্তিও ছিলেন না। যে ঘোষণা চট্টগ্রাম বেতার থেকে তিনি দিয়েছিলেন, ঠিক একই ধরনের একাধিক ঘোষণা ২৬শে ও ২৭শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতার থেকে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতাও দিয়েছিলেন, এমনকি বেতারকর্মীরাও একই ধরনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে মেজর জিয়ার এই ঘোষণাটি প্রচারের ফলে সারা দেশের ভেতরে ও সীমান্তে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে এবং সাধারণ মানুষের মনে সাংঘাতিক একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। সেই সঙ্কটময় মূহর্তে জিয়ার ভাষণটি বিভ্রান্ত ও নেতৃত্বহীন জাতিকে কিছুটা হলেও শক্তি ও সাহস যোগায়। যুদ্ধের সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে শুনেছি এবং যুদ্ধের পরবর্তী সময়ও শুনেছি, মেজর জিয়ার ঘোষণাটি তাঁদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে কতটা উদ্দীপ্ত করেছিল। মেজর জিয়ার ঘোষণায় মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে, হ্যাঁ এইবার বাংলাদেশ সত্যিই একটা যুদ্ধে নেমেছে। হান্নান সাহেব বা অন্য ব্যক্তিদের ঘোষণা ও মেজর জিয়ার ঘোষণার মধ্যে তফাৎটা শুধু এখানেই ছিল। মেজর জিয়া যে কাজটি করতে পেরেছিলেন, তা করা উচিত ছিল জাতীয় পর্যায়ের প্রধান রাজনৈতিক নেতাদের এবং এর জন্য তাঁদের একটা পূর্বপরিকল্পনাও থাকা প্রয়োজন ছিল। স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে আরেকটি চরম সত্য ও বাস্তব কথা হলো, ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর স্বাধীনতার ঘোষণা হলো কিনা, তা শোনার জন্য সাধারণ মানুষ কিন্তু অপেক্ষা করেনি। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
No comments