একজন ব্যর্থ মানুষের গল্প by আসিফ নজরুল
ড. কামাল হোসেনকে আমার ঘনিষ্ঠভাবে জানার
সুযোগ ঘটে ২০১২ সালে একটি ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং মিশনে মালদ্বীপ সফরকালে। তিনি
বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূল রচয়িতা। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে কাছের
একজন মানুষ হিসেবে আইন, বিচার, জ্বালানি, পররাষ্ট্রসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ
মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর অন্যতম পরিচিতি বাংলাদেশের
সাংবিধানিক আইন, বিশেষ করে মানবাধিকারবিষয়ক সবচেয়ে আলোচিত মামলাগুলোর
প্রধান আইনজীবী হিসেবে। তিনি আন্তর্জাতিক বিশ্বে সাংবিধানিক, পরিবেশ এবং
জ্বালানিসম্পদ বিষয়ের অগ্রগণ্য একজন আইনবিশারদ হিসেবেও খ্যাতিমান।
এই বিশাল মানুষটিকে আমি সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতায় কয়েক বছর ধরে দেখি অন্য একটি কারণে। তাঁর কারণে একটি গুরুতর মামলায় শাস্তি ও হয়রানির হাত থেকে আমি রক্ষা পেয়েছিলাম মালদ্বীপযাত্রার কয়েক মাস আগে। তাঁর চেম্বার এই মামলার সব ব্যয়ভার বহন করেছিল, মামলার জন্য তিনি হরতালের দিন রিকশায় করে চেম্বারে চলে এসেছিলেন, মামলার একটি জবাব জমা দেওয়ার সময় প্যারিস থেকেই তা শুদ্ধ করে দিয়েছিলেন!
ড. কামাল হোসেন মানবাধিকার প্রশ্নে এমনভাবে এ দেশে বহু মামলা লড়েছেন বিনা পারিশ্রমিকে। এ দেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, আমলা, সুপ্রিম কোর্টের চাকরি হারানো বিচারপতি, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী থেকে শুরু করে বস্তিবাসী, বিনা বিচারে আটক অসহায় মানুষ, সুবিধাবঞ্চিত নারী-শিশুসহ বহু মানুষ নির্যাতন, হয়রানি এবং শোষণ থেকে মুক্তি পেয়েছে তাঁর নিজের বা তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠনগুলোর মাধ্যমে। আমার সঙ্গে তাঁর কোনোকালেই ঘনিষ্ঠতা ছিল না। বরং সাংবিধানিক আইনের সামান্য বিদ্যা নিয়ে পাকামো করতে গিয়ে আমি তাঁর বহু সমালোচনা করেছি টিভি আর পত্রপত্রিকায়। অথচ রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আশঙ্কায় জর্জরিত হয়ে তাঁর কাছে যাওয়ামাত্র তিনি আমাকে রক্ষা করতে দুহাত বাড়িয়ে দেন। এমনকি মামলার একদিনের শুনানিতে থাকতে পারবেন না বলে ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ আর শাহদীন মালিককে আমার পক্ষে থাকতে বলে দেন।
আমি এখন ভাবি, ভাগ্যিস এই মামলা হয়েছিল। না হলে কোনো দিন কামাল হোসেনের চেম্বারে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জানতে পারতাম না তাঁকে। দেখতাম না কী আশ্চর্য দক্ষতায় তিনি তৈরি করেন মামলার জবাব, কী অদ্ভুত স্নেহের বন্ধন তাঁর সঙ্গে তাঁর চেম্বারের জুনিয়র, অফিসার এবং কর্মচারীদের; কী প্রগাঢ় ভালোবাসায় তিনি দুঃখ করেন দেশ, সমাজ আর দেশের হতভাগা মানুষের জন্য। কত গভীরভাবে ভালোবাসেন দেশ, বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে।
মালদ্বীপে কয়েক দিন থাকাকালে তিনি আমাকে আইন, ইতিহাস. রাজনীতি ও আত্মজীবনীমূলক নানান গ্রন্থের কথা বলেন। বলেন, আন্তর্জাতিক আইন আর সম্পর্কের বিভিন্ন বিষয়। আমি তাঁকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করি। যেসব ক্ষুদ্র মানুষ তাঁকে অবমূল্যায়ন, অসম্মান এমনকি অপদস্থ করেছে, যেসব ঘটনায় তাঁর মনে কষ্ট পাওয়ার কথা, সেসব প্রসঙ্গও আসে। আমি অবাক হয়ে যাই, একবারও কারও সম্পর্কে সামান্য কটূক্তি করেন না তিনি। কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনায় নিজেকে জাহির করেন না তিনি। ‘আমি’ না তাঁর সব মহৎ বর্ণনা ‘আমরা’ বা ‘আমাদের’ এমন বহুবচনে।
বহুবার তাঁর সঙ্গে আলাপকালে অনুভব করেছি নিজের ক্ষুদ্রত্ব। আমি এবং আমার মতো আরও বহু লিলিপুটের এই দেশে জন্ম নিয়েছেন তিনি, ড. ইউনূস বা ফজলে হাসান আবেদের মতো মহিরুহ মানুষ। তাঁদের আকৃতি আমাদের ক্ষুদ্রত্বকে আরও উন্মোচিত করে বলে আমার তাঁদের বারবার আঘাত করি। আমরা একবারও ভাবি না কোনো আঘাতেই কাবু হওয়ার মতো মানুষ এঁরা না।
২.
কামাল হোসেনকে সর্বশেষ আঘাত করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তাঁকে একজন ব্যর্থ মানুষ হিসেবে বর্ণনা করে তাঁর কথার কোনো দাম নেই বলেছেন আমাদের অর্থমন্ত্রী। এর আগে ড. কামাল তাঁকে মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।
ড. কামাল ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনায় অর্থমন্ত্রীর নির্বিকার প্রতিক্রিয়ায়। ২০০৯ সালে ৬৪ কোটি টাকা লাভ করা এই প্রতিষ্ঠানটি বর্তমান সরকারের নিয়োগ দেওয়া পরিচালনা পর্ষদের দুর্নীতিবাজদের নির্বিচার ও বেপরোয়া লুটপাটের কারণে ২০১৩ সালে এসে ২৬২ কোটি টাকা লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে! রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের টাকা জনগণের টাকা। এই টাকা বর্তমান সরকারের আমলে ব্যাংকের পরিচালনা পর্যদের বা সরকারি প্রতিপত্তি খাটিয়ে লুটপাট হয়েছিল আরও কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে। সোনালী ব্যাংকের প্রায় চার হাজার কোটি টাকা এভাবে আত্মসাৎ করার ঘটনা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে উন্মোচিত হলে অর্থমন্ত্রী তখন বলেছিলেন: এই টাকা তেমন কিছুই না! এবারও বেসিক ব্যাংকের ঘটনায় তিনি হাসি হাসি মুখে তা-ই বললেন। আমরা কি কল্পনা করতে পারি জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত লোকজন লোপাট করে দিচ্ছে জানার পর কোনো সুস্থ মাথার মানুষ বলতে পারেন: এটি তেমন কিছুই না। সেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা অবস্থায়! এরও আগে সরকারি দলের লোকজনের কারসাজিতে শেয়ার মার্কেটের হাজার হাজার কোটি টাকা উধাও হওয়ার পর যখন রাস্তাঘাটে সাধারণ মানুষ আহাজারি করেছেন, এমনকি কোথাও কোথাও আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে, অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন: শেয়ার মার্কেট মোট অর্থবাজারের ১ শতাংশও নয়, তাই এ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই!
কামাল হোসেন বাংলাদেশে সবচেয়ে পরিমার্জিত ব্যক্তিদের একজন। তিনি সমালোচনা করতে হলেও কঠোর ভাষা ব্যবহার করেন না। কিন্তু মানুষের ধৈর্যেরও সীমা থাকে। জনগণের আমানত বা লগ্নি রাখা হাজার হাজার কোটি টাকা জনগণের করের টাকায় পালিত সরকারের লোকজন অনবরত লুট করবে আর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী হাসি হাসি মুখে তা ‘কিছুই না’ বলে উড়িয়ে দেবেন, এটি যে মানসিক অসুস্থতা, তা বলা ছাড়া উপায় থাকে কি? জনাব মুহিতের কথাবার্তায় এমন প্রতিক্রিয়া তাঁর কোনো কোনো সহকর্মীও ব্যক্ত করেছেন আগে। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল মাত্র কিছুদিন আগে বলেছিলেন, অর্থমন্ত্রী ‘একজন বৃদ্ধ মানুষ, যিনি রাবিশ কথাবার্তা বলেন।’ তাঁর আরও কয়েকজন সহকর্মী তাঁকে কথাবার্তায় সংযত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি তাঁদের যথাযথ প্রত্যুত্তর দিতে পারেননি। তাঁদের কাউকে তাঁর এ জন্য ব্যর্থ মানুষ মনে হয়নি, তাঁদের কথার কোনো দাম নেই বলার ইচ্ছে হয়নি।
৩.
কামাল হোসেন এক অর্থে অবশ্য ব্যর্থ! তবে তিনি ব্যর্থ মানুষ নন, ব্যর্থ রাজনীতিবিদ। সন্ত্রাস, মিথ্যাচার, দুর্নীতি, চাটুকারিতা, অশ্লীলতা আর একচ্ছত্রবাদের যে রাজনীতি চলছে দেশে, তাতে তাঁর সফল হওয়ার কোনো কারণ নেই। এসবের সঙ্গে তাল মেলাতে পারবেন না বলে তিনি বহু আগে স্বেচ্ছায় আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি আর জামায়াত যে অসুস্থ রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করেছে দেশে, তিনি সেই সম্মিলিত পঙ্কিলতার বিরুদ্ধে একা লড়ে জোরালো কোনো সুস্থ রাজনীতির ধারা তৈরি করতে পারেননি। অন্য বহু বাম-ডান-বিপ্লবী দল যা করেছে, তেমনভাবে পদ বা ক্ষমতার প্রলোভনে এদের কারও সঙ্গে কোনো আপসও করেননি। তাঁর প্রজ্ঞা, দেশপ্রেম আর শুদ্ধতার আদলে তিনি বৃহৎ একটি রাজনৈতিক ধারা গড়তে পারেননি। সেদিক দিয়ে তিনি ব্যর্থ হতে পারেন। কিন্তু অন্যদের মতো মন্ত্রিত্বের আকর্ষণে কখনো এরশাদ বা কখনো শেখ হাসিনার মন্ত্রী তিনি হননি, এসব আমলের অনাচার, শোষণ আর দুর্নীতিমূলক শাসনব্যবস্থার অংশীদার হননি।
কামাল হোসেন বাংলাদেশের অসুস্থ রাজনৈতিক ধারাকে অগ্রাহ্য করেছেন, কিন্তু এই ধারার বিরুদ্ধে যুদ্ধের কোনো কার্যকর কর্মকৌশল বাস্তবায়িত করতে পারেননি। তাঁর রাজনীতি হেরে গেছে আপাতত কিন্তু তিনি নিজে কখনো হারেননি। বাংলাদেশের যেকোনো সুস্থ ধারার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন আর উদ্যোগে তিনি তাই নির্দ্বিধায় অগ্রগণ্য একজন মানুষ হিসেবে স্বীকৃত ও সম্মানিত হয়েছেন। বাংলাদেশের সংবিধান ও বহু গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন এবং মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী মামলায় প্রধান ভূমিকা তিনি পালন করেছেন। তাঁর হাতে গড়ে উঠেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ব্লাস্ট, টিআইবি, বিলিয়া, সেইলসসহ বাংলাদেশের খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠানগুলো।
ড. কামালের ঈর্ষণীয় বহু অর্জন রয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। তিনি ইন্টারন্যাশনাল ল অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট, আইএলও ও ইন্টারন্যাশনল বার অ্যাসোসিয়েশনের বিভিন্ন কমিটির চেয়ারম্যান, বিশ্ববিখ্যাত কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের (অক্সফোর্ড, আমস্টারডাম, ডান্ডিসহ) ফেলো, জাতিসংঘের স্পেশাল রেপোর্টিয়ারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আরবিট্রেশনের কাউন্সেল ও গবেষণা জার্নালের অন্যতম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং করছেন। জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ এবং সারা বিশ্বে বিভিন্ন সংস্থার পরামর্শকের কাজ করেছেন, চীন, থাইল্যান্ড, ফিজি, আরব আমিরাত, কাতার, মোজাম্বিকসহ নানা দেশের জন্য খসড়া আইন প্রণয়ন করে দিয়েছেন। কামাল হোসেনের কথা শোনার জন্য পৃথিবীর নামী বিশ্ববিদ্যালয়, থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সরকার বহু টাকা খরচ করে তাঁকে অতিথি করে নিয়ে গেছেন।
এই ‘ব্যর্থ’ মানুষের মেধা আর বাকচাতুর্যে সিমিটার এবং শেভরনের মতো জায়েন্ট বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইসিএসআইডিতে (ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটেলমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট ডিসপুট) মামলায় জিতে বাংলাদেশ কয়েক হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পেরেছিল। আমার জানামতে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগসংক্রান্ত বিরোধে কখনোই বাংলাদেশ আর কোথাও জিততে পারেনি। বরং শেলের সঙ্গে বিএনপি এবং নাইকোর সঙ্গে আওয়ামী লীগ আমলে দলীর দৃষ্টিকোণ থেকে নিয়োজিত আইনজীবীদের কারণে হেরে যাওয়ার কারণে বিশাল আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের।
কামাল হোসেন দেশের শ্রেষ্ঠ সংবিধান প্রণয়ন করেছেন, বহু আইন আর মামলায় অবদান রেখেছেন, বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে আইনি যুদ্ধে বাংলাদেশকে জিতিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশের সব প্রগতিশীল আন্দোলন আর উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, সর্বোপরি বাংলাদেশকে নিজের কীর্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গৌরবান্বিত করেছেন।
তিনি যদি ব্যর্থ মানুষ হন তাহলে এমন আরও অনেক ব্যর্থ মানুষই প্রয়োজন আমাদের। তাঁর মতো মানুষের কথার দাম নেই যাঁদের কাছে, তাঁদের সম্পর্কে সতর্কও হতে হবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এই বিশাল মানুষটিকে আমি সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতায় কয়েক বছর ধরে দেখি অন্য একটি কারণে। তাঁর কারণে একটি গুরুতর মামলায় শাস্তি ও হয়রানির হাত থেকে আমি রক্ষা পেয়েছিলাম মালদ্বীপযাত্রার কয়েক মাস আগে। তাঁর চেম্বার এই মামলার সব ব্যয়ভার বহন করেছিল, মামলার জন্য তিনি হরতালের দিন রিকশায় করে চেম্বারে চলে এসেছিলেন, মামলার একটি জবাব জমা দেওয়ার সময় প্যারিস থেকেই তা শুদ্ধ করে দিয়েছিলেন!
ড. কামাল হোসেন মানবাধিকার প্রশ্নে এমনভাবে এ দেশে বহু মামলা লড়েছেন বিনা পারিশ্রমিকে। এ দেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, আমলা, সুপ্রিম কোর্টের চাকরি হারানো বিচারপতি, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী থেকে শুরু করে বস্তিবাসী, বিনা বিচারে আটক অসহায় মানুষ, সুবিধাবঞ্চিত নারী-শিশুসহ বহু মানুষ নির্যাতন, হয়রানি এবং শোষণ থেকে মুক্তি পেয়েছে তাঁর নিজের বা তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠনগুলোর মাধ্যমে। আমার সঙ্গে তাঁর কোনোকালেই ঘনিষ্ঠতা ছিল না। বরং সাংবিধানিক আইনের সামান্য বিদ্যা নিয়ে পাকামো করতে গিয়ে আমি তাঁর বহু সমালোচনা করেছি টিভি আর পত্রপত্রিকায়। অথচ রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আশঙ্কায় জর্জরিত হয়ে তাঁর কাছে যাওয়ামাত্র তিনি আমাকে রক্ষা করতে দুহাত বাড়িয়ে দেন। এমনকি মামলার একদিনের শুনানিতে থাকতে পারবেন না বলে ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ আর শাহদীন মালিককে আমার পক্ষে থাকতে বলে দেন।
আমি এখন ভাবি, ভাগ্যিস এই মামলা হয়েছিল। না হলে কোনো দিন কামাল হোসেনের চেম্বারে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জানতে পারতাম না তাঁকে। দেখতাম না কী আশ্চর্য দক্ষতায় তিনি তৈরি করেন মামলার জবাব, কী অদ্ভুত স্নেহের বন্ধন তাঁর সঙ্গে তাঁর চেম্বারের জুনিয়র, অফিসার এবং কর্মচারীদের; কী প্রগাঢ় ভালোবাসায় তিনি দুঃখ করেন দেশ, সমাজ আর দেশের হতভাগা মানুষের জন্য। কত গভীরভাবে ভালোবাসেন দেশ, বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে।
মালদ্বীপে কয়েক দিন থাকাকালে তিনি আমাকে আইন, ইতিহাস. রাজনীতি ও আত্মজীবনীমূলক নানান গ্রন্থের কথা বলেন। বলেন, আন্তর্জাতিক আইন আর সম্পর্কের বিভিন্ন বিষয়। আমি তাঁকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করি। যেসব ক্ষুদ্র মানুষ তাঁকে অবমূল্যায়ন, অসম্মান এমনকি অপদস্থ করেছে, যেসব ঘটনায় তাঁর মনে কষ্ট পাওয়ার কথা, সেসব প্রসঙ্গও আসে। আমি অবাক হয়ে যাই, একবারও কারও সম্পর্কে সামান্য কটূক্তি করেন না তিনি। কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনায় নিজেকে জাহির করেন না তিনি। ‘আমি’ না তাঁর সব মহৎ বর্ণনা ‘আমরা’ বা ‘আমাদের’ এমন বহুবচনে।
বহুবার তাঁর সঙ্গে আলাপকালে অনুভব করেছি নিজের ক্ষুদ্রত্ব। আমি এবং আমার মতো আরও বহু লিলিপুটের এই দেশে জন্ম নিয়েছেন তিনি, ড. ইউনূস বা ফজলে হাসান আবেদের মতো মহিরুহ মানুষ। তাঁদের আকৃতি আমাদের ক্ষুদ্রত্বকে আরও উন্মোচিত করে বলে আমার তাঁদের বারবার আঘাত করি। আমরা একবারও ভাবি না কোনো আঘাতেই কাবু হওয়ার মতো মানুষ এঁরা না।
২.
কামাল হোসেনকে সর্বশেষ আঘাত করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তাঁকে একজন ব্যর্থ মানুষ হিসেবে বর্ণনা করে তাঁর কথার কোনো দাম নেই বলেছেন আমাদের অর্থমন্ত্রী। এর আগে ড. কামাল তাঁকে মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।
ড. কামাল ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনায় অর্থমন্ত্রীর নির্বিকার প্রতিক্রিয়ায়। ২০০৯ সালে ৬৪ কোটি টাকা লাভ করা এই প্রতিষ্ঠানটি বর্তমান সরকারের নিয়োগ দেওয়া পরিচালনা পর্ষদের দুর্নীতিবাজদের নির্বিচার ও বেপরোয়া লুটপাটের কারণে ২০১৩ সালে এসে ২৬২ কোটি টাকা লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে! রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের টাকা জনগণের টাকা। এই টাকা বর্তমান সরকারের আমলে ব্যাংকের পরিচালনা পর্যদের বা সরকারি প্রতিপত্তি খাটিয়ে লুটপাট হয়েছিল আরও কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে। সোনালী ব্যাংকের প্রায় চার হাজার কোটি টাকা এভাবে আত্মসাৎ করার ঘটনা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে উন্মোচিত হলে অর্থমন্ত্রী তখন বলেছিলেন: এই টাকা তেমন কিছুই না! এবারও বেসিক ব্যাংকের ঘটনায় তিনি হাসি হাসি মুখে তা-ই বললেন। আমরা কি কল্পনা করতে পারি জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত লোকজন লোপাট করে দিচ্ছে জানার পর কোনো সুস্থ মাথার মানুষ বলতে পারেন: এটি তেমন কিছুই না। সেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা অবস্থায়! এরও আগে সরকারি দলের লোকজনের কারসাজিতে শেয়ার মার্কেটের হাজার হাজার কোটি টাকা উধাও হওয়ার পর যখন রাস্তাঘাটে সাধারণ মানুষ আহাজারি করেছেন, এমনকি কোথাও কোথাও আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে, অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন: শেয়ার মার্কেট মোট অর্থবাজারের ১ শতাংশও নয়, তাই এ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই!
কামাল হোসেন বাংলাদেশে সবচেয়ে পরিমার্জিত ব্যক্তিদের একজন। তিনি সমালোচনা করতে হলেও কঠোর ভাষা ব্যবহার করেন না। কিন্তু মানুষের ধৈর্যেরও সীমা থাকে। জনগণের আমানত বা লগ্নি রাখা হাজার হাজার কোটি টাকা জনগণের করের টাকায় পালিত সরকারের লোকজন অনবরত লুট করবে আর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী হাসি হাসি মুখে তা ‘কিছুই না’ বলে উড়িয়ে দেবেন, এটি যে মানসিক অসুস্থতা, তা বলা ছাড়া উপায় থাকে কি? জনাব মুহিতের কথাবার্তায় এমন প্রতিক্রিয়া তাঁর কোনো কোনো সহকর্মীও ব্যক্ত করেছেন আগে। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল মাত্র কিছুদিন আগে বলেছিলেন, অর্থমন্ত্রী ‘একজন বৃদ্ধ মানুষ, যিনি রাবিশ কথাবার্তা বলেন।’ তাঁর আরও কয়েকজন সহকর্মী তাঁকে কথাবার্তায় সংযত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি তাঁদের যথাযথ প্রত্যুত্তর দিতে পারেননি। তাঁদের কাউকে তাঁর এ জন্য ব্যর্থ মানুষ মনে হয়নি, তাঁদের কথার কোনো দাম নেই বলার ইচ্ছে হয়নি।
৩.
কামাল হোসেন এক অর্থে অবশ্য ব্যর্থ! তবে তিনি ব্যর্থ মানুষ নন, ব্যর্থ রাজনীতিবিদ। সন্ত্রাস, মিথ্যাচার, দুর্নীতি, চাটুকারিতা, অশ্লীলতা আর একচ্ছত্রবাদের যে রাজনীতি চলছে দেশে, তাতে তাঁর সফল হওয়ার কোনো কারণ নেই। এসবের সঙ্গে তাল মেলাতে পারবেন না বলে তিনি বহু আগে স্বেচ্ছায় আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি আর জামায়াত যে অসুস্থ রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করেছে দেশে, তিনি সেই সম্মিলিত পঙ্কিলতার বিরুদ্ধে একা লড়ে জোরালো কোনো সুস্থ রাজনীতির ধারা তৈরি করতে পারেননি। অন্য বহু বাম-ডান-বিপ্লবী দল যা করেছে, তেমনভাবে পদ বা ক্ষমতার প্রলোভনে এদের কারও সঙ্গে কোনো আপসও করেননি। তাঁর প্রজ্ঞা, দেশপ্রেম আর শুদ্ধতার আদলে তিনি বৃহৎ একটি রাজনৈতিক ধারা গড়তে পারেননি। সেদিক দিয়ে তিনি ব্যর্থ হতে পারেন। কিন্তু অন্যদের মতো মন্ত্রিত্বের আকর্ষণে কখনো এরশাদ বা কখনো শেখ হাসিনার মন্ত্রী তিনি হননি, এসব আমলের অনাচার, শোষণ আর দুর্নীতিমূলক শাসনব্যবস্থার অংশীদার হননি।
কামাল হোসেন বাংলাদেশের অসুস্থ রাজনৈতিক ধারাকে অগ্রাহ্য করেছেন, কিন্তু এই ধারার বিরুদ্ধে যুদ্ধের কোনো কার্যকর কর্মকৌশল বাস্তবায়িত করতে পারেননি। তাঁর রাজনীতি হেরে গেছে আপাতত কিন্তু তিনি নিজে কখনো হারেননি। বাংলাদেশের যেকোনো সুস্থ ধারার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন আর উদ্যোগে তিনি তাই নির্দ্বিধায় অগ্রগণ্য একজন মানুষ হিসেবে স্বীকৃত ও সম্মানিত হয়েছেন। বাংলাদেশের সংবিধান ও বহু গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন এবং মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী মামলায় প্রধান ভূমিকা তিনি পালন করেছেন। তাঁর হাতে গড়ে উঠেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ব্লাস্ট, টিআইবি, বিলিয়া, সেইলসসহ বাংলাদেশের খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠানগুলো।
ড. কামালের ঈর্ষণীয় বহু অর্জন রয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। তিনি ইন্টারন্যাশনাল ল অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট, আইএলও ও ইন্টারন্যাশনল বার অ্যাসোসিয়েশনের বিভিন্ন কমিটির চেয়ারম্যান, বিশ্ববিখ্যাত কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের (অক্সফোর্ড, আমস্টারডাম, ডান্ডিসহ) ফেলো, জাতিসংঘের স্পেশাল রেপোর্টিয়ারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আরবিট্রেশনের কাউন্সেল ও গবেষণা জার্নালের অন্যতম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং করছেন। জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ এবং সারা বিশ্বে বিভিন্ন সংস্থার পরামর্শকের কাজ করেছেন, চীন, থাইল্যান্ড, ফিজি, আরব আমিরাত, কাতার, মোজাম্বিকসহ নানা দেশের জন্য খসড়া আইন প্রণয়ন করে দিয়েছেন। কামাল হোসেনের কথা শোনার জন্য পৃথিবীর নামী বিশ্ববিদ্যালয়, থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সরকার বহু টাকা খরচ করে তাঁকে অতিথি করে নিয়ে গেছেন।
এই ‘ব্যর্থ’ মানুষের মেধা আর বাকচাতুর্যে সিমিটার এবং শেভরনের মতো জায়েন্ট বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইসিএসআইডিতে (ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটেলমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট ডিসপুট) মামলায় জিতে বাংলাদেশ কয়েক হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পেরেছিল। আমার জানামতে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগসংক্রান্ত বিরোধে কখনোই বাংলাদেশ আর কোথাও জিততে পারেনি। বরং শেলের সঙ্গে বিএনপি এবং নাইকোর সঙ্গে আওয়ামী লীগ আমলে দলীর দৃষ্টিকোণ থেকে নিয়োজিত আইনজীবীদের কারণে হেরে যাওয়ার কারণে বিশাল আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের।
কামাল হোসেন দেশের শ্রেষ্ঠ সংবিধান প্রণয়ন করেছেন, বহু আইন আর মামলায় অবদান রেখেছেন, বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে আইনি যুদ্ধে বাংলাদেশকে জিতিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশের সব প্রগতিশীল আন্দোলন আর উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, সর্বোপরি বাংলাদেশকে নিজের কীর্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গৌরবান্বিত করেছেন।
তিনি যদি ব্যর্থ মানুষ হন তাহলে এমন আরও অনেক ব্যর্থ মানুষই প্রয়োজন আমাদের। তাঁর মতো মানুষের কথার দাম নেই যাঁদের কাছে, তাঁদের সম্পর্কে সতর্কও হতে হবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments